#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩২
স্বপ্নীল কয়েকদিন শ্রাবণ্যকে ভীষণ বিরক্ত করলো। সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায় ফোন করে বলছে,
“এই শ্রাবণ্য আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। ”
শ্রাবণ্য স্বাভাবিক গলায় বলে,
“বলুন। ”
স্বপ্নীল দুটো অক্ষর বলে থেমে যায়। শ্রাবণ্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে। স্বপ্নীল বলে,
“না থাক। এখন না, পরে। ”
“এখন কী সমস্যা? ”
স্বপ্নীল মিথ্যে জবাব দেয়,
“আমার লজ্জা করে।”
আসলে স্বপ্নীলের লজ্জা করে না। লজ্জা খানিকটা ভেঙে গেছে ওইদিন চুমু খাবার পর। ওইভাবে লজ্জা করে না এখন আর।
কিন্তু কথাগুলো ও গুছিয়ে বলতে চাইছে। শ্রাবণ্য যতবারই বলে বলুন ততবারই সব গুলিয়ে যায়।
শ্রাবণ্য প্রথম দু’বার ফোনের ওপাশে নীরবে হেসেছে। এখন বিরক্ত হয়। বিরক্ত হয়ে বলে,
“আচ্ছা থাক আপনাকে কিছু বলতে হবে না।”
স্বপ্নীল অধৈর্য গলায় বলে,
“তুমি আপনি আপনি করো বলে আমি বলতে পারছি না। ”
শ্রাবণ্য হাসি আড়াল করে গম্ভীর গলায় বলে,
“তোমার যদি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা না থাকে তাহলে ফোন টা রাখো। আমার স্যার চলে আসবে এক্ষুনি। ”
স্বপ্নীল আচ্ছা বলে ফোন রেখে দেয় মন খারাপ করে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওর মুখ উজ্জ্বল হয়। শ্রাবণ্য ও’কে তুমি করে বলল না! কথাটাও একটু কেমন আদুরে গলায় বলল! সেই ভরদুপুরে স্বপ্নীল চোখ বন্ধ করে কল্পনায় খানিকক্ষণ আকাশে উড়ে বেড়ালো।
স্বপ্নীলের কথা গোছানো হয়ে ওঠার আগেই শ্রাবণ্যকে শহর ছাড়তে হয়। ইউনিভার্সিটি থেকে চব্বিশ দিনের জন্য সীতাকুণ্ড যেতে হয়। স্বপ্নীলের এতো মন খারাপ হলো। কাতর গলায় বলল,
“শ্রাবণ্য, না গেলে হয় না?”
শ্রাবণ্য হেসে বলে,
“না হয়না। ”
“আমি বৃহস্পতিবার যাব কেমন! ”
“নাহ! তার দরকার নেই, আমরা এতো ঝামেলার মধ্যে থাকব। কোথায় না কোথায় থাকব তার ঠিক নেই। আজ এক জায়গায়, কাল আরেক জায়গায় এভাবেই তো কেটে যাবে। ”
স্বপ্নীল আর কিছু বলল না। দ্রুত প্রস্থান করলো।
শ্রাবণ্যর যখন যাবার সময় হয় তখন বাড়ির সবার সামনেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বাড়ির লোকজন ছুটে এলো ও’কে সামলানোর জন্য। শ্রাবণ্যর এতো অসহায় লাগলো! এভাবে কাঁদলে ওর কী যেতে ভালো লাগবে। রঙ্গনা স্বপ্নীল কে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“গাধা তুই? জীবনে মানুষ হবি না। মেয়েটা যাচ্ছে কী আজীবনের জন্য! সীতাকুণ্ড গিয়ে কী ও আরেকটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলবে আজব!”
রঙ্গনা শ্রাবণ্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“চলো ওর যেতে হবে না। আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।”
শ্রাবণ্য নিচে নেমে বারান্দার দিকে তাকালো একবার। স্বপ্নীল বারান্দায় নেই। রঙ্গনা স্মিত হেসে বলল,
“ভ্যা ভ্যা শেষ হয় নি৷ কাঁদুক তো, চলো যাই।”
গাড়িতে বসে শ্রাবণ্যর চোখ টা ভিজে উঠলো। বিয়ের পর নরসিংদী গিয়ে ঠিকঠাক দুদিনও থাকে নি। বাবা, মায়ের অভিমানের কারণে যায় নি। এতটা সময় একসঙ্গে থেকে কখন যে স্বপ্নীল ওর অভ্যাস হয়ে গেল!
রঙ্গনা টিস্যু বক্স এগিয়ে দিলো। শ্রাবণ্য জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।
রঙ্গনা হেসে বলল,
“চোখ মুছে ফেলো। কাঁদছিলে তুমি! স্বপ্ন’র চেয়ে কম যাও না তুমিও। ”
শ্রাবণ্য ঠোঁট চেপে হাসার চেষ্টা করলো। রঙ্গনা বলল,
“দাদুর চয়েজ ঠিকঠাক হয় বুঝলে। এই সত্যিটা আমি স্বীকার করি না কারোর সামনে। কিন্তু মনে মনে ঠিকই স্বীকার করি। আমিও অন্যদের মতো ভাবতাম আমার এই বোকাসোকা ভাইকে কে বুঝবে। বিয়ে ওর আটকে থাকবে না ঠিকই, কিন্তু ওকে বোঝার, ভালোবাসার মানুষ টা আসবে তো।”
শ্রাবণ্য শুধু শুনছিল। মন টা ভীষণ খারাপ লাগছে। কিছু ভালো লাগছে না।
রঙ্গনা খেয়াল করলো শ্রাবণ্য অন্যমনস্ক। হঠাৎ কিছু না বলে ওর মাথায় হাত রাখলো। শ্রাবণ্য এক পলক দেখলো রঙ্গনাকে। পরের পলকেই জমে থাকা জল চোখ বেয়ে পড়লো।
ওরা স্টেশনে পৌছালো আগেই। বাকীদের কেউ কেউ এসেছে। রঙ্গনা পানি কিনে এনে শ্রাবণ্যকে বলল,
“মুখ টা মুছে নাও। কী বিশ্রী লাগছে তোমাকে ইশ!”
শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। রঙ্গনা বলল,
“কিছু খাবে? পেয়ারা, ঝালমুড়ি?”
“না। ”
“তোমার মন খারাপ কমেছে?”
শ্রাবণ্য হেসে বলল,
“না। ”
রঙ্গনা হেসে ফেলল শ্রাবণ্যর সরল জবাবে। ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত রঙ্গনা অপেক্ষা করলো।
****
রঙ্গনা মিশুকের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে যে দ্বিধায় ছিলো সেটা কেটে গেছে প্রায়। ওদের সম্পর্ক দিন দিন সহজও হয়েছে। তবে রঙ্গনা এবারও নিজেকে ছাড় দিয়েছে। মিশুকের পরিবারের তাতে আপত্তি নেই। মিশুকেরও কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি টাইপ ব্যাপার নেই। এটা ভালো, কিছুদিন আগে রঙ্গনা সলো ট্রিপে গেল। মিশুক আপত্তি করে নি, রঙ্গনা ভেবেছিল এটা নিয়ে হয়তো একটা ইস্যু ক্রিয়েট হবে। কিন্তু মিশুক ভীষণ কেয়ারফুল থাকে এসব ব্যাপারে। রঙ্গনাকে কোনো কিছু নিয়েই কিছু বলে না।
তবে এই ট্রিপে গিয়ে রঙ্গনা একটা বিষয় বেশ টের পেল। মিশুক ও’কে ভালোই মিস করেছে। পাহাড়, জঙ্গলে নেটওয়ার্ক কম থাকায় মিশুক একদিন ও’কে ফোনে পেল না। সারাদিনে কারোর সঙ্গে ও যোগাযোগ করতে পারলো না। সন্ধ্যেবেলা নেটওয়ার্ক পেয়ে ফোন করতেই মিশুকের অস্থির গলা। ও রওনাও হয়েছিল রঙ্গনা যেখানে আছে সেখানে যাবার জন্য। এই বিষয়টাও ওর ভালো লেগেছে। ভান মনে হয় নি, মনে হয়েছে সত্যিই ওর জন্য ছিলো ওই স্পেশাল ফিলিংস টুকু।
মিশুক দিল্লীতে গিয়েছিল হেড অফিসের একটা মিটিং এর জন্য। তিন দিনের জায়গায় ওদের সাতদিন থাকতে হলো। রঙ্গনা যতবারই ফোন করেছে মিশুক আফসোসের সুরে বলেছে, তোমাকে নিয়ে আসা উচিত ছিলো। এতোদিন থাকতে হবে বুঝলে নিয়ে আসতাম।
রঙ্গনা ফোনের এপাশে মিষ্টি করে হাসলো। কয়েক দিন আগেই ও স্বপ্নীল কে ভীষণ বকাবকি করছিল। কিন্তু মিশুকের এই অস্থিরতা ভালো লাগছে।
***
এক সপ্তাহ পর মিশুক ফিরলো। বেচারা ক্লান্ত বিধ্বস্ত। বাড়ি ফেরার পর রেস্ট নেবার আগে সবার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হলো। রঙ্গনা আশেপাশে নেই, একবার একটু দর্শন দিয়ে যে গেছে আর দেখতে পেল না।
মিশুক ঘরে এসে দেখলো রঙ্গনা ঘরে বসে আছে। ফোন দেখতে ব্যস্ত। মিশুক দরজাটা বন্ধ করে রঙ্গনাকে ভালো করে দেখলো। সাদা জর্জেটের শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ, চুলগুলো পেঁচিয়ে খোঁপা করে। কোনো জুয়েলারি নেই, তবুও কী সুন্দর লাগছিল। মিশুকের ধারণা এই সুন্দর লাগার ব্যাপার টা আসলে ওর চোখের সমস্যা। এমন মিষ্টি সমস্যা থাকুক, সারাজীবন থাকুক।
রঙ্গনা মিশুক কে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“দরজায় ওভাবে দাঁড়িয়ে আছ যে! আর তোমার এই অবস্থা কেন? ভীষণ বিশ্রী দেখাচ্ছে। অন্যসময় অবশ্য খুব সুশ্রী দেখায় ব্যপার টা তেমন না। ”
মিশুক তবুও তাকিয়ে রইলো। রঙ্গনাও খানিকক্ষণ তাকিয়ে হেসে ফেলল। মিশুক বলল,
“তোমার বিরহে আমার এই অবস্থা। ”
“সিরিয়াসলি! সস্তা ফিল্মি ডায়লগ। ”
“হোক সেটা। তবুও কথাটা সত্যি। ”
মিশুক এগিয়ে এসে আচমকাই রঙ্গনাকে জড়িয়ে ধরলো। রঙ্গনা আলিঙ্গন প্রত্যাখ্যান করলো না। মিশুক ঘাড়ের পাশে চুমু খেয়ে গাঢ় গলায় বলল,
“আই লাভ ইউ রঙ্গনা। ”
রঙ্গনা নিশ্চুপে হেসে বলল,
“ওহ! থ্যাংক ইউ।”
***
রেহানা ভালো করে সবকিছু দেখছে। খুটিয়ে খুটিয়ে জিনিসপত্র দেখছিল। আকাশীকে বলল,
“একাই থাকিস তোরা?”
“আমি আর আফরিন মা।”
“আর কেউ আসে না?”
“আসে, আফরিনের মা আসে। শ্রাবণ্য আসে, তুমিও এলে। এইতো….
রেহানার আর কেউ কথাটার মিনিং স্পষ্ট বুঝলো আকাশী। কোনো ছেলে বন্ধু আসে কিনা।
রেহানা আবারও বলল,
“তোর বাবা চাইছেন বাড়ি গিয়ে থাক।”
“এখানে আমার সব কাজ। সুযোগ পেলে বাড়িতে বেরিয়ে আসব।”
রেহানা খাটের উপর বসে বলল,
“যা বলতে আসছি বলি, তোর রিনা খালা একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছে। ছেলে ভালো, একবার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বউ থাকে নি। পার্সোনাল ইস্যু। কথা বলে দেখব?”
আকাশী কঠিন গলায় বলল,
“না।”
“কেন?”
“আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। ”
“এবার আমরা দেখেশুনে বিয়ে দেব। আমাদের সিদ্ধান্ত ভুল হবে না। শ্রাবণ্যকে দেখেছিস কতো ভালো আছে! তুই নিজের কপাল নিজে পুড়িয়েছিস।”
“আমি তো আগেই বলেছি মা, নিজের ক্ষত তে প্রলেপ লাগাতে আমি পারব।”
রেহানা আর কিছু বললেন না। আকাশীর সঙ্গে এবার আর মেজাজ দেখালেন না। তার মেজাজের কারণে মেয়েরা নাকি তার সঙ্গে সহজ হয় না। মুনসুরের এই অভিযোগ। মেয়েদের সঙ্গে তার ভালো করে কথা বলতে হবে। এজন্য এবার নরম গলায় কথা বললেন। তিনি নিজেও ব্যাপার টা উপলব্ধি করছেন। মেয়েরা আসলেই তার মাঝে দেয়াল তুলে দিয়েছে। এতটা নিষ্ঠুরও তো সে না।
রেহানা চলে যাবার পর আকাশীর রাফাতের কথা মনে পড়ে গেল। রাফাত সেই রাত ভোর হওয়া দিনটার পর আর ওর সঙ্গে দেখা করে নি। আকাশীর মন খারাপ হয়েছে। কোথাও গিয়ে মনে হয় একটা অনুভূতি ওর মনেও সৃষ্টি হয়েছিল। ভীষণ খারাপ লাগছিল। প্রায় ই ফোন টা হাতে নিয়ে রাফাত কে ফোন করতে গিয়ে থেমে যায়। ও কী আরেকবার তাড়াহুড়ো করে ফেলছে! বোধহয়। সেই ভাবনা থেকে আর যোগাযোগ করা হয় না।
****
রাফাত জয়েন করেছে মাস খানেক। তিন মাসের ছুটির প্ল্যান ক্যান্সেল করেছে। কাজে ডুবে থাকলে সব ভুলে যাবে। একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে। আকাশীকে ওর অনুভূতি জানানো হয়েছে। হ্যাঁ, মুখে কিছু বলে নি। কিন্তু ওর আচরণ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে। বাকী সিদ্ধান্ত আকাশীর। ও যদি রাফাত কে নিজের জীবনে রাখার যোগ্য মনে করে তো রাখবে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দিবে না।
রোজ রাতে রাফাত আকাশীর একাউন্ট, পেজ চেক করে। শাড়ি,জামাকাপড় এর ছবি দেখে। এতে মনে হয় যেন আকাশী ওর পাশেই আছে। আজ রাতে একটা আনন্দের ব্যাপার ঘটলো। আকাশী ও’কে মেসেঞ্জারে টেক্সট করেছে।
“আপনি কেমন আছেন? ”
রাফাতের এতো আনন্দ হলো! ভালোবাসার কথা বললেও বোধহয় এমন আনন্দের অনুভূতি হবে না। রাফাত লিখলো,
“তুমি কেমন আছ? ”
অনেক দূরে রাতের শহরে একা মেয়েটি মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ টির দিকে তাকিয়ে রইলো। উত্তরে কী লিখবে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।
চলবে….
(আর দুটো পর্ব সম্ভবত। পরের পর্ব শনিবার ইনশাআল্লাহ)