প্রেমদণ্ড (০৪)

0
407

#প্রেমদণ্ড (০৪)❤

সূয‍্যি মামা যখন পৃথিবীর অন‍্য প্রান্তে তাপ বিকীরণ করতে ব‍্যস্ত। এশিয়া মহাদেশের ছোট্ট বাংলাদেশে তখন গাঢ় অন্ধকার। গভীর অমানিশায় ব‍্যালকনির গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে ষোড়শী অনুজা। তার কিশোরী মনের মধ্যে কতশত প্রশ্নের আন্দোলন চলছে। মাঘের শীতল হাওয়ায় অনুজা কেঁপে কেঁপে উঠছে। গায়ে কোন শীতের কাপড় নেই। ইট পাথরের শহরে ব‍্যালকনিতে আসলেই প্রকৃত শীতের তীব্রতা ঠিক পাওয়া যায়। অনুজা শীতে কাঁপছে। হঠাৎ রেশমি সুতার কারুকার্যে তৈরি উষ্ণ চাদরে অনুজার শরীর ঢেকে গেল। অনুজি পারফিউমের চেনা ফ্রেগনেন্সে বুঝতে বাকি রইল না গায়ে চাদর জড়িয়ে দেওেয়া মানুষটা কে! বুঝেও চুপ রইল। আজকাল নিরবতা, নিস্তব্ধতা তাকে ঘিরে রেখেছে। মুখ ফুটে কিছু বলতেও কষ্ট হয় তার।

অনুজাকে চুপ দেখে ইজহান নিজেই বলল, “হিম শীতল রাতে উষ্ণ কাপড় ছাড়া ব‍্যালকনিতে এসেছিস কেন? শীত লাগে না? নাকি নায়িকা হওয়ার শখ জেগেছে?”

অনুজা অবাক স্বরে শুধালো, “নায়িকা হওয়ার শখ জাগবে কেন ইজহান ভাই?”

আঁতকে উঠল ইজহান। বলল, “ভাই ডাকছিস কাকে? কে তোর ভাই? কোনকালের ভাই? খবরদার ভাই ডাকবি না। ছাদে বেধেঁ রেখে আসব।”

“সেকি ভাই না তো কী? এতদিন তো ভাই ডেকে এসেছি।”

“এতদিন বউ ছিলি না। মায়ের বোনের বান্ধবীর মেয়ে ছিলি। সে সূত্রে ভাই ডাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এখন থেকে আর নয়। জামাইকে কেউ ভাই ডাকে না। মনে থাকবে?” গম্ভীর কন্ঠস্বর ইজহানের।

প্রতিত্তোরে অনুজা মাথা নাড়িয়ে বলল, “থাকবে। বললেন না তো নায়িকা হওয়ার শখ জাগবে কেন আমার?”

“দেখিস না প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ওয়েদারেও ওরা ফিনফিনে পাতলা শাড়ি পড়ে শুটিং করে। ভাবলাম তোর ও হয়তো নায়িকা হওয়ার শখ জেগেছে তাই এখনই ঠাণ্ডা সহ‍্য করার প্র‍্যাক্টিস করছিস।”

“মোটেও না। মাঝেমধ্যে উষ্ণতা এড়িয়ে শীতলতা উপভোগ করতে হয় বুঝলেন? এর মধ‍্যেও ভালোলাগা আছে।”

“রাখ তোর ভালোলাগা। দুদিন বাদে পরিক্ষা আর সে এসেছে ঠাণ্ডা উপভোগ করতে। জগতে কত অদ্ভূত জীব যে আছে। ঘুমাবি না? কাল থেকে কোচিংয়ে যাবি। অনেকটা সময় বেকার গেল বিয়ের চক্করে।”

অনুজা ইজহানের দিকে মুখ ঘুরিয়ে শীতল স্বরে শুধালো, “বিয়েটা কী মন থেকে মানতে পেরেছেন?”

প্রতিত্তোরে ইজহান পাল্টা প্রশ্ন করল, “তুই মানতে পেরেছিস?”

“আমি আগে জিজ্ঞাসা করেছি। উত্তরটা নিশ্চয় আমি আগে পাব!”

ইজহান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর সময় খুব ভালো দিতে পারে অনুজা। উত্তরটাও সময়ের ওপর ছেড়ে দে।”

তারপর খানিকক্ষণ নিরবতার নৈশব্দ ঘিরে রেখেছিল ইজহান-অনুজা দম্পতিকে। নিরবতার অবসান ঘটিয়ে ইজহান বলল, “তবে যাইহোক। বিয়ের পরে কিন্তু আমার বেশ উন্নয়ন হয়েছে। আমার হিসাবি আব্বা কি করেছে জানিস? তার কার্মকান্ডে তো আমি দারুণ অবাক!”

অনুজা কৌতূহল নিয়ে শুধালো, “কী?”

“আজ বিকালে আব্বা বাইকের শোরুমে নিয়ে গিয়ে বলছেন, তোমার যেটা পছন্দ হয় সেটাই নিয়ে নাও। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কতদিন চেয়েছি। কিন্তু আব্বা কিছুইতে রাজি হলেন না। অথচ আজ না চাইতেই! আব্বা আমার বিস্ময় বোধ হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। বললেন, বউমার কোথাও যেতে হলে তো তোমাকেই নিয়ে যেতে হবে। কাজেই এখন কেনাটা দরকারি মনে হল। আরও কি করেছে জানিস?”

অনুজার মধ্যে তেমন হেলদোল দেখা গেল না। তবুও জিজ্ঞাসা করল, “কী?”

“বুবুর বিয়ের পরে আব্বা গাড়ি দুটো তো ভাড়ায় দিয়ে দিল। আজ আবার প্রাইভেট কারটা নিয়ে এসেছেন। বললেন এখন বাড়ির জন্য প্রয়োজন পড়বে। লিফট নষ্ট ছিল। এতদিন যে মানুষ বলে এসেছে সিড়ি বেয়ে ওঠা সাস্থ‍্যের জন্য উপকারি। সেই মানুষ বললেন, একমাত্র ছেলের বউ সে কি সিড়ি ভেঙ্গে পাঁচতলায় উঠবে? কষ্ট হবে না!”

অনুজা অবাক হলো! শশুর বাবা থেকে এতটা আশা করেনি। যেভাবে ছেলেকে হুমকি ধামকি দিয়ে বিয়ে করালেন তাতে সেই ছেলের বউয়ের জন্য এতটা দরদ উতলে উঠবে ভাবা যায়? অনুজা মনের কথা মনেই রেখে দিল। কিছু বলল না।

ইজহান উৎফুল্লু কন্ঠে ফের বলল,
“বিয়ে করতেই এতকিছু! তাই তো ভাবি মানুষ বিয়ের জন্য এত পাগল কেন হয়! এদিকে আয়। আমার দু গালে দুটো চুমু দিয়ে যা। সবই পেলাম এটা আর বাদ থাকবে কেন?”

ইজহানের কথায় অনুজা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। লজ্জায় তার ফোলা গাল দুটো যেন আরেকটু ফুলে উঠল। ভাগ‍্যিস ব‍্যালকনির লাইট বন্ধ। নাহলে ইজহানের চোখ এড়াতো কি করে তার লজ্জারাঙা মুখশ্রী। অনুজাকে চুপ থাকতে দেখে দুষ্টু হাসল ইজহান। তা দেখে অনুজা মিনমিনিয়ে বলল, “এত লাগামছাড়া কেন আপনি? লজ্জা লাগে না বুঝি!”

ইজহান অনুজার আরেকটু নিকটে গিয়ে দাড়াল। অনুজার শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ আগের থেকে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। অন‍্যদিকে হৃদপিণ্ডে স্পন্দও দ্রুতগতিতে স্পন্দিত হচ্ছে। অনুজা নিজের এমন পরিবর্তনে অন্ধকারে মুখ ফিরিয়ে দাড়িয়ে রইল। পাছে দুষ্টু পুরুষটা তার বেসামাল অনুভূতির খোঁজ পেয়ে যায়।

কিন্তু লজ্জাবতী অনুজার শেষ রক্ষা বুঝি হল না। ইজহান অনুজার ফোলা গাল দুটো আলতো হাতে টিপে দিয়ে বলল, “ওরে আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা রে। এত লজ্জা কোনখানে রাখিস? তারপর তো ভাববি আমি পুরুষত্বহীন।”

অনুজা চোখমুখ খিচে বলল, “ইজহান ভাই আমি লজ্জা পাচ্ছি। বুঝতে পারছেন না কেন? আপনি সরুন তো। আমি ঘুমাতে যাব। ঘুম পেয়েছে।”

অনুজা নড়তে নিলেই ইজহান পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল অনুজাকে। আস্তে আস্তে পুরুষালি হাতের বন্ধনী শক্ত হতে লাগল। অনুজা প্রথমে নড়াচড়া করলেও কিছুক্ষণ পরেই স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল। ইজহান অনুজার ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে মোহগ্রস্ত কন্ঠে বলল, “কি হল সব শক্তি শেষ?”

ইজহানের অন‍্যরকম কন্ঠস্বরে অনুজার ষোড়শী সদ‍্য যৌবনা শরীর কেঁপে উঠল। শক্ত হাতের বন্ধনে আবদ্ধ পুরুষের ছোঁয়া নতুবা শীতের শীতলতা ঘোচাতে পিছন ঘুরে ইজহানের প্রসস্ত বুকে মুখ গুজে দিল অনুজা। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল তার। ইজহান আশকারা পেয়ে হাতের বন্ধন আরেকটু শক্ত করল। ফিসফিসিয়ে বলল, “নিঝুম রাত, নিরব নিস্তব্ধ প্রকৃতি, আকাশের তারাগুলো সাক্ষী রেখে পথচলা শুরু হোক। লাজুকলতা কি অনুমতি দিবে?”
লজ্জাবতী অনুজা প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। তার ছোট হাতদুটো দ্বারা ইজহানের বলিষ্ট পুরুষালি দেহটা আকড়ে ধরার চেষ্টা করল। ইজহান পূনরায় মুচকি হেসে বলল, “লাজুকলতা নিরবতা কে সম্মতির লক্ষণ হিসাবে ধরে নিব?”

প্রতিত্তোরে এবারও নিরব রইল অনুজা। ইজহান আর সময় ব‍্যায় না করে অনুজাকে কোলে তুলে নিল। লজ্জায় রাঙা হয়ে অনুজা একবার চোখ তুলে চাইল ইজহানের দিকে। ইজহান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মুখে প্রগাঢ় মুচকি হাসি। চোখদুটো যেন অতল সমুদ্র। কিশোরী অনুজার সেই অতল সমুদ্রে তলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগল না। নব দম্পতির সম্পর্কের আরেকটি ধাপ শুরু হল।
__________________________
মুয়াজ্জিনের সুমিষ্ট কন্ঠে ফজরের আজান ভেসে আসল অনুজার কানে। মনোযোগ দিয়ে আজান শুনে বিছানা সেরে উঠে পড়ল। হাটতে গিয়ে লক্ষ্য করল সে স্বাভাবিকভাবে হাটতে পারছে না। কোমর, পা লেগে আসছে। পা টেনে টেনে ওয়াশরুমে ঢুকল অনুজা। আজ সে ফজরের নামাজ আদায় করবে। বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কে সূচনা যখন হয়েই গেল নামাজটাও অভ‍্যাস হয়ে যাক। সমস্যা নেই তো কোন। অনুজার খুড়িয়ে হাটা ইজহানের চোক্ষু গোচর হল। মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে সে।কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে সেও উঠে পড়ল।

অনুজা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল ইজহান বিছানায় বসে আছে। ইজহানকে দেখে অনুজা একটু গুটিয়ে নিল নিজেকে।

ইজহান ইতস্তত করে বলল, “বেড টেবিলের ওপর গরম দুধ আর প‍্যারাসিটামল রাখা আছে। খেয়ে নিস। ঠিক হয়ে যাবে।”

অনুজা প্রতিত্তোরে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। তারপর নামাজে বসে পড়ল। ইজহান বসে না থেকে সেও ওয়াশরুমে ঢুকল।

বেলা একটু গড়াতেই অনুজা তৈরি হয়ে নিল। গতকালের আনা কুচকুচে কালো রঙের আবায়াটা পড়ে। মুশফিকা এক ফাকে বলে দিয়েছিল, “অনুজা যেন এখন থেকে পর্দা পালন করার ব‍্যপারে চেষ্টা করে।” অনুজা বিষয়টি সিরিয়াসভাবে নিয়ে প্রথমবারের মত গায়ে বোরকা জড়াল। মুশফিকার জোড়াজুড়িতে এক পিস স‍্যান্ডুয়িস তাড়াহুড়া করে খেয়ে ইজহানের সাথে বেড়িয়ে পড়ল।
______________
গন্তব্যে পৌঁছে ইজহান অনুজাকে জিজ্ঞাসা করল, “ছুটি কয়টাই?”

অনুজা প্রতিত্তোরে জানাল, “সাড়ে নয়টায়।”

“আমি এসে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?”

“আচ্ছা।”

“এখন যা। মন দিয়ে পড়িস।”

অনুজা সম্মতি জানিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে কোচিং সেন্টারে ঢুকে পড়ল। ইজহান অনুজার চলে যাওয়ার দিকে খানিকক্ষণ পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল। মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ অপরাধবোধ কাজ করছে তার। এতটা বাড়াবাড়ি হয়তো করা উচিত হয়নি তার। সে তো বুঝবান ছিল।

কোচিং পৌছাতেই ঘিরে ধরল মেয়েগুলো। ফিসফিসিয়ে শুধাল, “কি রে সাথে কে? বয়ফ্রেন্ড নাকি?”

অনুজা স্বাভাবিকভাবে বলল, “না। তবে, স্থায়ী বয়ফ্রেন্ড।”

মেয়েগুলোর চোখেমুখে বিস্ময়! তখনই অনুজার পাশে ব‍্যাগ রেখে বসতে বসতে ইসরাত বলল, “কেন? হতে পারে না নাকি? ওর বিয়ে হয়ে গেছে।”

সবাই একত্রে চিল্লিবে বলে উঠল, “কবে? কিভাবে?”

ইসরাত পূনরায় বলল, “কালকের আগের দিন। হঠাৎ করেই। যাইহোক, স‍্যার আসছেন। এ বিষয়ে পরে কথা হবে। তোরা চাইলে দুলুর কাছ থেকে ট্রিট নিতে পারিস। ওকে নিতে আসবে তো।”

“অবশ‍্যই নিব।” পূনরায় চিল্লিয়ে উঠল সকলে।

কোচিং ছুটি হতেই ইজহানকে সবাই ঘিরে ধরল। সবাই দুলাভাই, দুলাভাই বলে ইজহানকে পাগল করে ফেলে। জোরাজুড়িতে ইজহান মুখ থেকে হেলমেটটা খুলতেই পাশ থেকে একটা মেয়ে বলে উঠল, “একি! ইনি তো রুজমা আপুর বয়ফ্রেন্ড ছিলেন।”

পাশ থেকে আরেকটি মেয়ে বলে উঠল, “আরেহ! ইনি আমাদের পাড়ার সাবিহা আপুর বয়ফ্রেন্ড ছিলেন।”

সকলের দেওেয়া অপবাদে ইজহানের মুখখানা চুপসে গিয়েছে। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলে উঠল, “না না। ভুল বুঝছেন। ওরা তো আমার ফ্রেন্ড হত।”
তারপর অনুজার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তো শুধুমাত্র অনুজার বরফ্রেন্ড। আর কারো না।”

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here