#প্রেমদণ্ড (০৯)💚
বেশ সকাল সকাল ইজহানের ছোট ফুফু শায়েলা ও তার মেয়ে শর্মিলা এসেছে। অনুজা কোচিং থেকে ফিরেই নতুন মেহমানের মুখোমুখি হলো। ড্রয়িং রুমে ইজহানের ছোট ফুফু বসে আছেন। ইজহান অনুজাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজ প্রয়োজনে কোথাও একটা গিয়েছে। মেহমান আসবে অনুজা আগে থেকেই জানতো কিন্তু গ্রাম থেকে এত তাড়াতাড়ি এসে উপস্থিত হবে জানা ছিল না তার। বোরকা পরিহিত ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলানো অনুজা ছোট ফুফু শাশুড়ির সামনে পড়ে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়ে গিয়েছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কোথাও ফুফুর মেয়েটিকে দেখতে পেল না। ভদ্রমহিলা টেলিভিশনে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখছেন খুব মনোযোগ দিয়ে। কিচেন থেকে রান্নার সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। অর্থাৎ রান্নাবান্না চলছে। অনুজা কিছুটা ইতস্তত করে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম।”
অনুজার উপস্থিতি ও সালামে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলেন শায়েলা বেগম। চোখ ঘুরিয়ে অনুজাকে উপরনিচ পর্যবেক্ষণ করে জবাব দিলেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম। তা মাইয়া তুমিই বুঝি আমগোর ইজহানের বউ?”
অনুজা মাথা ঝাকালো। অর্থাৎ হ্যাঁ। তারপর বলল, “কেমন আছেন আন্টি?”
“আছি আল্লাহর রহমতে ভালাই। শোন মাইয়া, আমারে আন্টি ফান্টি কইবা না। ইজহানের ফুফু লাগি। তাই তুমিও আমারে ফুফু কইয়া ডাকবা। বুঝছো? তা তুমি বুঝি পেরাইবোট পইড়া আসলা? কোন ক্লাসে পড়?”
শায়েলা বেগমের একেরপর প্রশ্নে অনুজা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। একসাথে কেউ এত প্রশ্ন করে? অনুজা কোনরকম জবাব দিল, “জি আচ্ছা ফুফু।” তারপর দ্রুতগতিতে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরল।
অনুজা রুমে ঢুকেই প্রচণ্ড অবাক হলো। অচেনা অজানা একটা মেয়ে বিছানায় পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে শুয়ে ফোন স্ক্রল করছে। অনুজাকে দেখে মেয়েটি বলে উঠল, “ওহ তুমিই তাহলে। ভালোই তো আধিপত্য বিস্তার শুরু করে দিয়েছ। তা নাম কি মেয়ে?”
অনুজার নতুন মেহমানের মুখ থেকে এহেন কথা মোটেও ভালো লাগল না। ক্রোধে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। তার রুমে অনুমতি ব্যাতীত কেউ ঢুকবে এটা সে একদম ই সহ্য করতে পারে না। তারওপর এই মেয়ে তো বিছানা দখল করে বসে আছে। অনুজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আপনি রুম থেকে বেড়িয়ে গেলে ভালো হয়। আমি কাপড় বদলাব।”
অনুজা চেয়ারের ওপর দপ করে ব্যাগটা রাখল। মোটা বইয়ে বেশ শব্দ তৈরি হল তাতে। মেয়েটি চোখমুখ শক্ত করে বলল, “কি বললে তুমি? আমাকে বেড়িয়ে যেতে বল? এত সাহস তোমার। দুদিন এসে অধিকার দেখাতে এসেছ কোন সাহসে?”
অনুজা শান্ত কন্ঠে বলল, “আমি মোটেও অধিকার এবং সাহস দেখাচ্ছি না। আপনার সঙ্গে আমার আজ প্রথম সাক্ষাৎ। সেখানে অধিকার দেখানোর কি আছে? আমি এ বাড়ির বউ। আর আপনি ফুফু শাশুড়ির মেয়ে। কে কি সেটা আমার অজানা নয়। আপনি তখন থেকে আমার সাথে কঠিন স্বরে কথা বলছেন। বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে বসে আছেন। আপনাকে এত সাহস কে দিয়েছে? নিজের লিমিটে থাকুন। চোখে কি দেখতে পান না? আমি সবে কোচিং থেকে ফিরেছি। ফ্রেশ হব। আর আপনি কোথা থেকে এসে হুট করে রুম দখল করে মেজাজ দেখাতে চলে এসেছেন। আবার বলে তাকে কেন বেড়িয়ে যেতে বলেছি। হাউ ফানি!”
অনুজার কথার পিঠে আর কিছু বলার সাহস করল না মেয়েটি। গটগট শব্দ তুলে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। অনুজা যেন হাপ ছেড়ে বাঁচল। বসে লম্বা শ্বাস নিল কিছুক্ষণ। তারপর ফ্রেশ হয়ে মাথায় লম্বা করে ওড়না টেনে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। উদ্দেশ্যে কিচেনে।
অনুজা কোনদিকে না তাকিয়ে ড্রয়িং রুম পেড়িয়ে সোজা কিচেনে চলে গেল। আড় চোখে পুরোটা সময় তাকিয়ে ছিল শর্মিলা।
ফাতিমা বেগম রান্না করছেন। কপাল ঘামে ভিজে গিয়েছে। অনুজা এগিয়ে এসে শুধাল, “আম্মা আমার কিছু করা লাগবে? আপনার তো ঘেমে একাকার অবস্থা!”
ফাতিমা বেগম পিছন ফিরে বললেন, “আগুনের তাপে গরম লাগে। তার মধ্যে আমার আবার তাপ সহ্য হয় না। অল্পতেই ঘেমে উঠি। রান্না প্রায় হয়ে এসেছে। তুমি লেবু শশাগুলো কাঁটো তাহলেই হবে।”
অনুজা বিনাবাক্যে শশার খোসা ছিলতে লাগল।
রান্নাবান্না শেষ হতেই অনুজা ফাতিমা বেগমকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “আম্মা আপনি বরং একটু রেস্ট করুন গিয়ে। আমি খাবারগুলো টেবিলে নিয়ে রাখছি।”
ফাতিমা ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “পারবে? ভারি সব খাবারের ডিশ।”
অনুজা মৃদু হেসে বলল, “এটুকু আমি নিশ্চয় পারব। আপনি গিয়ে বসুন। আমি খাবার সাজিয়ে ডাক দিব।”
“আচ্ছা।” ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে ফাতিমা বেগম কিচেন ছাড়লেন। খাবারের ঘ্রাণে ম ম করে চারিপাশ। অনুজা পাতিল থেকে গরম পোলাও বড় একটা বোলে সাদা পোলাও গুলো বেড়ে নিল। এক এক করে খাবারের আইটেম গুলো টেবিলে এনে রাখল অনুজা। সবশেষে বেগুন ভাজি আর লেবু শশার সালাদ (স্যালাড)। বেশ ভারি খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। এ বাসায় সকালে নাস্তা হিসাবে রুটি, সবজি ভাজি, ডিমের অমলেট আর চা করা হয়। মেহমান উপলক্ষ্যেই আজ এত আয়োজন। অনুজা টেবিলে সব খাবার সুন্দর করে সাজিয়ে ফাতিমা বেগমকে ডাকতে গেল। ফাতিমা বেগম সবাইকে নিয়ে খেতে বসলেন। সবাই বসলেও অনুজা দাড়িয়ে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছিল। তা দেখে ফাতিমা বেগম বললেন, “তুমি দাড়িয়ে থেক না। বসে পড়। বেলা হয়েছে অনেক। খেয়ে সোজা বই নিয়ে বসবে। এসবে তোমার সময় নষ্ট করা লাগবে না।”
অনুজা বলল, “আব্বা খেতে আসবেন না? এখনো তো এলেন না।”
“চলে আসবে। তুমি বসো। খেয়ে নাও।”
অনুজা শর্মিলার চোখাচোখি হতেই একটা অদ্ভূত বিষয় খেয়াল করল। শায়লা বেগম নিঃশ্চুপে খেলেও শর্মিলা কেমন বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। যেন কত জনমের শত্রু সে। অনুজার কেমন খটকা লাগল। সদ্য চেনা আত্মীয় কেন তার সঙ্গে এমন আচরণ করবে? মনের মধ্যে বহু ভাবনা চিন্তার উদয় হল। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে অনুজার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল। দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে শশুর আব্বা ও স্বামী সাহেবের মুখশ্রী চোখ ভাসল। মুচকি হেসে অনুজা সালাম জানাল। দুজনের একত্রে সালামের জবাব দিয়ে ভিতরে ঢুকল। ফ্রেশ হয়ে ইজহান যখন খাবার খেতে বসল শর্মিলা আগ বাড়িয়ে বলে উঠল, “আমার পাশে বস না ইজহান ভাই। চেয়ারটাতো খালি পড়ে আছে।”
আট চেয়ারের বড় ডাইনিং টেবিল। ফাতিমা বেগম, রমিজ উদ্দিন, শায়লা বেগম, শর্মিলা ও অনুজা বসার পরেও তিনটা চেয়ার খালি পড়ে আছে। শর্মিলা বসেছে টেবিলের বাম পাশে।বাম পাশের একটা চেয়ার খালি। আর অনুজার ডান পাশে দুটো চেয়ার খালি পড়ে আছে। ইজহান কিছু না বলে অনুজার পাশের খালি চেয়ারটায় বসে পড়ল। চেয়ার খানিকটা টেনে একদম অনুজার গা ঘেঁষে বসল। শর্মিলার চুপসে যাওয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ইজহান হেসে দিয়ে বলল, “তোর পাশে বসব কেন? আমার বউ আছে না!”
রমিজ উদ্দিন ছেলের কথায় কে’শে উঠলেন। অনুজা লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলল। কিন্তু ইজহান নির্বিকারভাবে প্লেটে পোলাও নিয়ে রোস্টের পিস কামড়িয়ে খেতে ব্যাস্ত।
অনুজা কোচিং থেকে এসেই লক্ষ্য করেছে ফাতিমা বেগম কেমন নিরব হয়ে আছেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছেন না। এরমধ্যে শায়েলা বেগম বলে উঠলেন, “তা ইজহান আব্বা! আইজকা বিকালে গিয়া শর্মিলারে ভর্তি করাই দিয়ে আসবা। কোচিং সেন্টার থিকা নিয়া আসতে পারবা না? দিয়ে আসবা আর নিয়া আসবা। সমস্যা হইবো?”
ইজহান প্রতিত্তোরে বলল, “সরি ছোট ফুফু। আমি একবেলাও যেতে পারব না। আমার অনুজাকে কোচিং নিয়ে যেতে হয়। নিয়ে আসতেও হয়। ভার্সিটি খোলা। আমার দিনকাল খুব ব্যাস্ত। কাউকে আনা নেওয়ার দায়িত্বে আমি নেই।”
আঁতকে উঠলেন শায়লা বেগম। বললেন, “সেকি কথা। তোমাগো ভরসায় এইহানে আইলাম। এহন একি কথা কও। আমার মাইয়া চিনব কেমনে একলা একা? তোমার বউ তো ঢাকার মাইয়া। সব চিনে জানে। আমার ভোলাভালা মাইয়াডা একা চলবার পারব না তো। ও ভাইজান ইজহান কি কয়?”
“আপনার মেয়ে ভোলাভালা হলে ঢাকায় পড়তে আসার সাহস করে কি ভাবে? এরপর যখন ভার্সিটিতে চান্স পাবে তখন নিজেরটা নিজেরই তো করতে হবে। আপনার মেয়ে তো কচি খুকি নয়। আপনাদের আমি আসতে বলিনি। নিজের ইচ্ছায় এসেছেন। যা করবেন নিজের ইচ্ছাতেই করবেন আশাকরি।আমাকে এসবে জড়াবেন না। আমার নিজের পড়াশোনা আছে। হাজারটা ব্যাস্ততা আমার।”
ইজহানের কঠিন জবাবের পিঠে কিছু বলার সাহস করল না শায়লা বেগম। ভাইয়ের দিকে কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়ে রইল।
রমিজ উদ্দিন হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। তিনি ইজহানকে কখনও এতটা কঠোর হতে দেখননি। বোনের উদ্দেশ্যে বললেন, “কারো যাওয়া লাগবে না। গাড়ি থাকবে গ্যারেজে। ড্রাইভার নিয়ে আসবে, দিয়ে আসবে। এসব নিয়ে এত কথার কি আছে?”
মাঝখানে শর্মিলা বলে উঠল, “কিন্তু ইজহান ভাই তো শহরের সব অলিগলি চিনেন। তিনি সাথে থাকলে আমারও সুবিধা হত।”
“এখানে পড়তে এসেছিস। সব অলিগলি চিনতে নয়। যতটুকু চেনার জানার ড্রাইভারকে বললেই চিনিয়ে দিবেন।” ইজহানের কথায় পুনরায় দমে গেল শর্মিলা।
কথোপকথনের পুরোটা সময় জুড়ে ফাতিমা বেগম ছিলেন নিরব। তিনি একটি কথাও বলেননি। সবার আগে শর্মিলা উঠে চলে গেল। একে একে সবার খাওয়া শেষ হতেই অনুজা এটো থালা বাসন কিচেনে নিয়ে যেতে লাগল পরিষ্কার করার জন্য।
শায়লা বেগম পানদানি থেকে পান বানিয়ে মুখে পুড়ে নিলেন। বিপরীতে ফাতিমা বেগম বসা। অনুজা পিকদানি রেখে গেলেও শায়লা বেগম পানের পিক ফেললেন ঝকঝকে টাইলসের মেঝেতে। পানের লাল রঙা রসে মাখামাখি হয়ে আছে মেঝে। ফাতিমা বেগম তা দেখে বললেন, “এটা তুমি কি করলে? পিক দানি রেখে গিয়েছে দেখতে পাওনি?”
শায়লা বেগম দাঁত বেড় করে হেসে বললেন, “দেখবার পারি নাই। মাইয়াডা কইব না।”
”বলার কি আছে? চোখের সামনেই তো জ্বলজ্বল করছে। নিজের বাড়ির সিমেন্টের মেঝেটা ঝকঝকে তকতকে করে রাখ। এখানেই আসলেই শুরু হয় যত বাহনা। শোধরাবে না তাই না?”
শায়লা বেগম চোরের মত এদিক সেদিক তাকিয়ে ভাইকে খুজলেন। তারপর ইতস্তত করে বললেন, “কি যে বলেন না ভাবি। আপনাদের কথা কত বলি বাড়ি। শর্মিলা তো মামি-মামা বলতে পাগল।”
“শোন শায়লা। মেয়েকে পড়ানোর জন্য নিয়ে এসেছ আমি কিছু বলছি না। কি করেছ আর কি করনি সবটা আমার অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে। ভাইয়ের বাসায় এসেছ আশাকরি তার মান বজায় রাখবে। তোমার মেয়েটা যেন আমার ওইটুকু ছেলের বউয়ের সাথে কোনরকম বাজে ব্যাবহারের চেষ্টা না করে। নিজেদের মান নিজেদের বজায় রাখা শিখতে হয়।” গম্ভীর কন্ঠে নিজের কথার ইতি ঘটিয়ে ফাতিমা বেগম ড্রয়িং রুম ছাড়লেন। সেদিকে তাকিয়ে শায়লা বেগম নাকমুখ কুচকে বিড়বিড় করে বললেন, “একা খাইয়া তেল জমছে শরীরে। মাইয়াডারে একবার গছায় দিতে পারলে তোমার দেমাগ দেখব। তোমার একরত্তি পোলার বউরে তাড়াইতে আমার বেশিক্ষণ লাগবো না।”
_____________________
“ভালোই তো বশ করেছ ইজহান ভাইকে। বউয়ের কথা ছাড়া বাকি দুনিয়ার কথা তার কানে যায় না। তা কি দেখিয়ে বশ করলে? শহরের মেয়েদের তো আবার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। আছে শরীর। দেখাতে পারলেই বাঁচে।”
অনুজা সিংকে প্লেট ধুচ্ছিল। শর্মিলার কথায় রাগে অনুজার মাথা ফেঁটে যাওয়ার জোগাড়। পিছন ফিরে বলল, “আমার জামাইকে আমি বশ করব না তো পাশের বাড়ির আরেকজনকে করব? একমাত্র বউ হই নিশ্চয় সে আমার কথায় আগে শুনবে। আপনি বোধহয় চোখ থাকতেও অন্ধ সাজছেন। আপনার সম্পর্কে তার কাছে আমি একটি কথাও বলিনি। আর না বলার সময় পেয়েছি। ওড়না ছাড়া মামা, ভাইয়ের সামনে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আবার আমাকে বলছেন শরীর দেখাতে পারলেই বাঁচি। আপনার সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। আপনার সাথে আমার আজই দেখা হল। অথচ আপনার রিয়েকশন এমন যেন আমি কতকালের শত্রু। আমার তো মনে হয় আপনি নিজে শরীর দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজেকে ঠিক করুন। তারপর আমাকে উপদেশ দিতে আসবেন।”
শর্মিলা হিসহিসিয়ে বলল, “শত্রু নয় তো কি! তোমার জন্য এ বাড়ি, সংসার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। ইজহান আমার হয়নি। তোমাকে কি আমার ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা উচিত?”
শর্মিলার কথায় অবাক হল অনুজা। বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
“কি বলতে চাইছেন আপনি? আপনার কি ক্ষতি করেছি আমি?”
“শোন মেয়ে তোমাকে বলতে আমি বাধ্য নই। তবে শুনে রাখ তোমার পিরিতের স্বামীর সাথে আমার গভীর প্রেম ছিল। বিয়ে হওয়ার কথা ছিল আমার। কিন্তু হয়ে গেল তোমার সাথে। এই শরীরে নিশ্চয় বশ করেছ?”
শর্মিলার লাগামছাড়া কথায় অনুজার যেন পা থেকে মাটি সরে গেল। একটু একটু পাতালে ঢুকে যেতে লাগল সে। কি শুনল সে? পরক্ষণেই ফল কাঁটার ছুরিটা হাতিয়ে নিয়ে শর্মিলার উদ্দেশ্যে বলল, “ছুরি দেখেছিস বজ্জাত বেহায়া মেয়ে। এসব বলতে লজ্জা করে না? এক চিমটি সম্মানও তুই ডির্জাব করিস না। তোর কাছে শরীরের মূল্য নাই থাকতে পারে। কিন্তু আমার কাছে বহু মূল্যবান। আমার চোখের সামনে থেকে সরে যা। ছুরি দিয়ে কেঁটে টুকরো টুকরো করে ফেলব।”
শর্মিলা তাতে ভয় পেল বলে মনে হল না। রহস্যময়ী হাসি দিয়ে কিচেন থেকে বেড়িয়ে গেল।
অনুজা কাজ শেষ করে যখন রুমে এল চোখের সামনে ভেসে উঠল ইজহানের হাসিমাখা মুখ। বিরক্তি ও রাগ যেন তড়তড়িয়ে বেড়ে গেল। ইজহান হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু অনুজা থমথমে মুখ দেখে বলতে গিয়েও বলল না। অনুজা চেয়ার টেনে বসল পড়ার জন্য।
কিছুক্ষণ পর অনুজা বলে উঠল, “টেবিলের ওপর নীল রঙের ফাইলের মধ্যে প্রবেশপত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড রাখা ছিল। সেই ফাইলটা কি আপনি কোথাও রেখেছেন?”
ইজহান ফোন স্ক্রল করছিল। ফোন থেকে নজর সরিয়ে প্রতিত্তোরে বলল, “কই না তো। অন্য কোথাও রাখব কেন? ভালো করে খুজে দেখ। টেবিলের কোন ডয়ারে আছে নাকি।”
“আমি ভালো করে খুজে তবেই আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছি।”
“অন্য কোথাও রাখতে পার। আলমারি, ড্রেসিং টেবিলের ডয়ারে আছে কিনা দেখ। মেট্রেসের তলায়ও থাকতে পারে।”
“কি অদ্ভুত কথা বলছেন আপনি! এখানে সেখানে কেন রাখব। পড়াশোনার জিনিস কেন এদিক সেদিক রাখব। যাবে কোথায়?”
এবার নড়েচড়ে উঠল ইজহান। নিজেই রুমের সব কোণায় খুজল। কিন্তু কোথাও নীল রঙা ফাইল আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মিলল না। চিন্তায় অনুজার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে। এসব কাগজপত্র ছাড়া তো পরিক্ষার হলেই ঢুকতে দেবে না। ডুকরে কেঁদে উঠল অনুজা। সন্নিকটে পরিক্ষা। তারমধ্যে এ কিহেন কর্মকাণ্ড!
ইজহান জিজ্ঞাসা করল, “রুমে কেউ এসেছিল?”
“আমি কোচিং থেকে ফিরে দেখলাম আপনার কাজিন বিছানার ওপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। এ ছাড়া আর তো কাউকে দেখিনি। তাছাড়া সে যাবার সময় হাতও খালি ছিল।”
ইজহান চোখমুখ শক্ত করে বলল, “সে কেন এ রুমে আসবে? যার তার প্রবেশ আমি পছন্দ করি না।”
অনুজা ফোরন কেঁটে বলল, “এককালের গভীর প্রেমিকা যে সে হয় কি করে? সে তো পরম ভালোবাসার আত্মীয় তাই না?”
ইজহান ঘাড় কাত করে অনুজাকে পরখ করল। কি অদ্ভূত এইতো একটু আগে কেঁদেকেঁটে একাকার করে ফেলছিল। অথচ এখন কেমন আয়েশ করে খোঁচা দিচ্ছে! ইজহান প্রতিত্তোরে বলল, “কে প্রেমিকা?”
“ঢঙ করেন? আপনার ছোট ফুফুর মেয়ের সাথে যে একসময় গভীর প্রেম ছিল সেটা কি ভুলে গিয়েছেন? এত ভুলোমন কেন আপনার?”
“কোন কালে? ওর সাথে আমার সেভাবে দেখা হয়নি। দাদু থাকতে বছরে একবার গ্রামে যাওয়া হত। দাদু মা’রা যাওয়ার পর গ্রামে যাওয়া হয় না প্রায় তিনবছর হতে চলল। ওরাও আমাদের বাসায় খুব একটা আসে না। ফ্রেন্ড লিস্টে একসময় ছিল কিন্তু ওর বেহায়া নির্লজ্জ স্বভাবের জন্য এখনো ও আমার ব্লক লিস্টে। এসব কে বলে তোমাকে?”
“সে নিজেই বলেছে। এবং সে এটাও বলেছে আমি আপনাকে শরীর দেখিয়ে বশ করেছি। আমার জায়গায় তার থাকার কথা ছিল। আমি তার শত্রু।”
“আর কি বলেছে ও?”
এরপর অনুজা শর্মিলার সাথে এ পর্যন্ত হওয়া সব কথোপকথন ইজহানকে খুলে বলল। ইজহান জিজ্ঞাসা না করলেও বলতো। কেননা সে মোটেও অন্যায় সহ্য করতে রাজি নন। আর শর্মিলা তো সব সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। সব কথা শুনে ইজহান ক্রোধে ফুসতে লাগল। ইজহান হনহন করে বেড়িয়ে যেতে নিলে অনুজা গিয়ে আটকাল তাকে। শান্ত স্বরে বলল, “শুনুন মাথা গরম করবেন না। রেগে গিয়ে কিছু করা বা বলা উচিত নয়। আগে আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুলো খুজি। তারপর এসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে।”
ইজহান অনুজার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “তুমি জানো ও কতবড় বেয়াদব? ওর মা আম্মা যখন গ্রামে থাকতেন আব্বা তখন কলেজের শিক্ষক ছিলেন, ব্যবসা শুরু করেননি। তখন আম্মাকে কত জ্বালিয়েছে। কষ্ট দিয়েছে। তখন বুবু খুব ছোট ছিল। আমি এসব দেখিনি। আমার জন্ম এ শহরেই। তারপরও ওদের সাথে আমরা সবাই স্বাভাবিক ব্যবহার করি। ওই শর্মি আমাকে আকার ইঙ্গিতে বোঝাতে সে আমাকে পছন্দ করে। আম্মা এজন্য গ্রামে যাওয়ায় বাদ দিয়ে দিলেন। একদিন ছোট পোষাক পড়ে ইনবক্সে ছবি দিয়েছে। কতবড় বেশরম বুঝতে পারছো? ওর মা দাদুর মুখে চুনকালি মাখিয়ে ভেগে গিয়েছিল এক মুচির ছেলের সাথে। পরে দাদু বেঁচে থাকতেই দাদু বাড়ির পাশে ওদের একটি বাড়ি তৈরি করে দেওেয়া হয়। আর চাষাবাদের জন্য কিছু জমি। আব্বু প্রত্যেক মাসে খরচ পাঠায়। ছোট কাকু, বড় ফুফু ওদের নামও শুনতে পারে না। কিন্তু আমার আব্বা তো দয়ার সাগর। ফেলতে পারেন না বোনকে। অথচ দেখ কতটা জঘন্য মনোভাব ওদের। তোমার প্রবেশ পত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও নিয়েছে আমি নিশ্চিত। তুমি বইখাতা গুছিয়ে নাও। আমি আসছি এখনই।” ইজহান আর দাড়াল না। হনহন করে বেড়িয়ে গেল। অনুজাও ইজহানের পিছু নিল।
ইজহান সোজা মায়ের রুমে নক দিল। ভেতর থেকে ফাতিমা বেগম বললেন, “এসো।”
ইজহান মায়ের রুমে ঢুকেই বলল, “গেস্ট রুমে গিয়ে ছোট ফুফুর ব্যাগ সার্চ কর আম্মু।”
রমিজ উদ্দিন চেয়ারে গা এলিয়ে বসে ছিলেন। ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, “কি যা তা বলছো? ব্যাগ কেন সার্চ করবে?”
“কারণ আপনার ছোট বোনের আদরে বাদর হওয়া মেয়েটি অনুজার ফাইলে থাকা প্রবেশপত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড ফাইলসহ হাপিস করে ফেলেছে।”
“তুমি সিউর ও করেছে এসব?”
ইজহান এক এক করে সব খুলে বলল মা-বাবাকে। সব শুনে ফাতিমা বেগম শুধু স্বামীর দিকে শান্ত চোখে এক পলক তাকালেন। ইজহান আবার বলা শুরু করল, “আম্মা গিয়ে স্বাভাবিকভাবে বলবে। আমি অনুজাকে ওর মায়ের বাসায় রেখে আসব। সামনে পরিক্ষা আমি চাচ্ছিনা ওর পড়াশোনায় কোন ক্ষতি হোক।”
ফাতিমা বেগম স্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন, “আমার ঘরের বউ কেন যাবে? যদি কারো যাওয়ার হয় তবে যাবে আপনার বোন-ভাগ্নি। অনেক সহ্য করেছি বেয়াদবি। আপনিই বলুন এসব কার সহ্য হয়? অতটুকু মেয়ের সাথে এ কিরুপ ব্যবহার? আপনি যদি এর যোগ্য বিচার না করেন আমি এক কাপড়ে আপনার বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যাব।”
স্ত্রীকে বরাবরই শান্ত শিষ্ট দেখে এসেছেন রমিজ উদ্দিন। আজকের মত অশান্ত তাকে এত বছরের বিবাহিত জীবনে দেখেননি তিনি। চুপ থেকে বললেন, “আমি দেখছি।”
ইনশাআল্লাহ চলবে…..
লেখায়~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি।
চারদিন পরে গল্প দিলাম।😑
২৫০০+শব্দসংখ্যা আছে এ পর্বে। দুই পর্বের সমান। দুটো বেশি কথা বললে বলবেন। কিন্তু গঠনমূলক মন্তব্য করতে ভুলবেন না।
আমার গ্রুপ জান্নাতির গল্প রোমন্থন