হাতে_রেখো_হাত (৫)

0
145

#হাতে_রেখো_হাত (৫)

আরেকটি বিষণ্ন প্রহর। অরির কব*রের কাছে আসলেই আবরাজের হৃদয় থমকে যায়। চোখ ফেটে কান্না আসে। কখনো কাঁদে আবার কখনো গুমরে ম*রে। সত্যি বলতে মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা নেই। মাছের ঝোল ভীষণ ভালো বাসতো অরি। চাহিদা বলতে তো ঐ টুকুই ছিল। অন্যসব বাচ্চাদের মতো আড়ম্বর নেই ওর চাওয়ায়।খুব সাধারণ আর স্বচ্ছ। মাসের প্রথমেই বাজার থেকে বড় মাছ নিয়ে আসতেন বাবা। ভদ্রলোক জীবনে পরিশ্রম করেছেন। হয়তো আয়ের পরিমান অতিরিক্ত কিংবা বিলাশিতা করার মতো ছিল না তবে সন্তানদের সমস্ত সুখ এনে দেওয়ার প্রয়াস ছিল। অন্যদিকে মায়ের রান্নার হাত অসাধারণ। চুলোর শেষ আগুনে করা মরিচ পোড়া ভর্তাও অমৃত স্বাদ দিতো। যেদিন মাছের ঝোল কিংবা আবরাজের পছন্দের দেশী মুরগির ঝাল রান্না হতো, পরিবারের সবাই এক সাথে খেতো। মা অবশ্য খেতে চাইতেন না। তদারকি করতে চাইতেন সবার। কিন্তু ঐ স্বামী সন্তানের কারণে বসতে হতো তাকে। মাঝে সাঝে তিনি বলতেন ‘ আমি আছি বলেই একটু যত্ন করতে চাই। না থাকলে তো আর এমন যত্ন পাবি না। ‘ এমন কথাতে বেজায় রাগ দেখাতো আবরাজ। মা তখন ছেলের মাথায় হাত বুলাতেন। বলতেন এ জীবনের নিশ্চয়তা নেই। আজ নিশ্বাস আছে কাল না ও থাকতে পারে। অরিতা তখন জড়িয়ে ধরতো মায়ের উদরে। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ হাসি কান্নায় শেষ হতো ওদের ভোজন। ভদ্রমহিলা সর্বদা স্মরণ করাতেন মৃ*ত্যুর কথা। হয়তো সৃষ্টিকর্তা ওনাকে উপলব্দি করিয়েছিলেন সময় শেষ। অরিতার ক*বরে হাত বুলিয়ে ফিরে এলো আবরাজ। মেয়েটার জন্য কষ্ট হয় খুব। সামান্য আঁধার সহ্য হতো না যার সেই মেয়েটা এতোটা মাস শুয়ে আছে আঁধারে! সত্যিই পরিস্থিতি মানুষকে মানাতে শেখায়।

পার্ট টাইম জবটা আর করছে না আবরাজ। সরকার থেকে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল সেটা দিয়েই চলছে। তবে টাকা তো ফুরিয়ে আসে। এবার কিছু করা দরকার। খবরের কাগজ, নেট ঘেটে কিছু জব সার্কুলার বের করলো। সবাই চায় এডুকেটেড পার্সন। অনার্স পড়ুয়া হলেও একটা চান্স আছে। আবরাজ তো সবে এইচ এস সি পাস করলো। মন খারাপ হলো ছেলেটার। কিছু রেস্টুরেন্টে সার্ভিসিং জব রয়েছে। এগুলোই শেষ ভরসা।

তিনদিনের মাথায় চাকরিতে জয়েন করলো আবরাজ। লম্বাটে দেহ আর সুন্দর মুখাশ্রী হওয়াতে ফাইফ স্টার হোটলে জব পেল সে। বেতন ভালো। পড়াশোনার খরচ চালিয়েও কিছু টাকা বেঁচে যাবে। আগে হলে এই টাকা জমিয়ে রাখতো আবরাজ। বড় হবে অরি। বিয়ে দিতে হবে। ধুমধাম করে মস্ত আয়োজনে শশুর বাড়ি যাবে আদুরে বোনটা। কিন্তু এখন, এখন তো সেসব কিছু কল্পনাও করতে পারে না আবরাজ। রোজ বেলি ফুলের গুচ্ছ কিনে অরিতার ক*বরে দিবে। তারপর ও থেকে যাবে কিছু টাকা। আবরাজের অশান্ত লাগছে। টাকা কখনো সুখ হতে পারে না। তবে টাকা দিয়ে আমরা প্রায়শই সুখ কিনি। সেই সুখ ক্ষণকালের জন্য হলেও কিনি। আবরাজ ও কিনতো। তবে এখন কার জন্য সুখ কিনবে? ভালো লাগছে না কিছুই। শার্টের দুটো বোতাম খুলে গাছের নিচে বসলো। সামনেই অরিতার স্কুল দেখা যায়। মাঠের এক প্রান্ত বরাদ্দ ছিল অরির জন্য। সর্বদা সেখানটায় বসে থাকতো মেয়েটি। অন্য সব বাচ্চারা ছুটোছুটি করতো আর অরি তাকিয়ে থাকতো। একবার আবরাজ বলল ‘ খেলিস না কেন তুই? ‘ অরি বলতো
‘ যদি ব্যথা পাই। ‘ কিছুটা সময় চুপ ছিল আবরাজ। তারপর ই মনে পরে কিছু মাস আগের কথা। বান্ধবীদের সাথে কানামাছি খেলতে গিয়ে পায়ে আঘা*ত লাগে বাচ্চাটার। টানা আট দিন জ্বরে ভুগে। খরচ হয়ে অনেক গুলো টাকা। বাচ্চাটা সেদিন অবিজ্ঞদের মতো করে বলেছিল ‘ শুধু শুধু টাকা গুলো নষ্ট হলো। ইস আমি যদি না খেলতাম। ‘

শিউরে উঠে আবরাজ। মেঘ করেছে। ঠান্ডা হাওয়া বয়। দু চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জলকনা। সেসব পাত্তা দিলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। চোখে ভাসে ঐ তো অরি আসছে। ভাইয়া ভাইয়া করে ডাকে। এসেই জড়িয়ে ধরে বলবে’খেয়েছো ভাই?’
আবরাজ মিথ্যে বলবে। সে জানাবে ভরপেট খেয়েছে। অথচ সকাল থেকে এক দানা পেটে যায় নি। অরির টিফিন দিয়ে আবরাজ চলে যেতে নিলেই অরি ডাকবে। ভাইকে না খাইয়ে খাইবে না। ঐ টুকু টিফিনের আবার দুটো ভাগ! মেয়েটা কেমন যেন। আবরাজ ঠোঁট কামড়ে ধরে। আমরা আমাদের আপনজনকে খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলি।

বৃষ্টিতে ভিজে গেছে শরীর। হঠাৎ ই মনে হলো মাথার কাছটায় আর বৃষ্টি পরছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সীরাতের দেখা। অপ্রস্তুত বোধ করে ছেলেটা। ” এই ভরা বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? ”

” বসে ছিলাম। ”

” আলসেমি করে আর উঠা হয়নি,না? ”

” তেমনি কিছুটা। ”

” তুমি এই দিকে যে? ”

” বৃষ্টির সাথে বন্ধুত্ব করছি। ”

” মানে? ”

” এই যে বৃষ্টি ঝরছে,যারা ঘরকুনো কিংবা আদুরে এই বৃষ্টি তাদের ভীষণ অপছন্দ করে। ওরা ভিজলেই জ্বর সর্দি লেগে যা তা অবস্থা। আমি তাই বৃষ্টির সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করছি। দেশের সুরক্ষায় যাতে এই ঝড় বৃষ্টি আমাকে কাবু না করতে পারে। ”

সীরাতের কথাটা ভীষণ ভালো লাগলো আবরাজের। উঠে এসে বলল ” তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো। ”

” ভিজেই তো গেছো, চলো এক কিলোমিটার দৌড়ানো যাক। ”

“এই বৃষ্টিতে? ”

“তো? ” ছেলেটাকে ফের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে নিলো সীরাত। ছুটতে লাগলো বৃষ্টির জল মাথায় নিয়ে। কাঁদা পানির চপচপ শব্দ বিষণ্নতাকে হটিয়ে ফুটিয়ে তুললো এক চিলতে হাসি।
.
এক ভোরে উপস্থিত হলেন আনিসুল সাহেব। আবরাজ বিস্মিত! অরির মৃ*ত্যুর পর ও বাড়িটায় ফিরে যেতে চায় নি মন। তাই মসজিদে ছিল কিছু মাস। তারপর কাছাকাছি এক রুমের বাসা নিলো। আবরাজ কল্পনাও করেনি ভদ্রলোক চলে আসবেন এই অবধি। ছেলেটার মন গলে না। আরও একবার শূন্য হাতে ফিরতে হয় ওনাকে। সে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবরাজ। নাস্তা শেষ করে চলে আসে হোটেলে। ফাইফ স্টার হোটেল। পোশাক পরিবর্তন করতে হলো। ফর্মাল ড্রেসাপে ভালোই দেখায় ওকে। সুদর্শন মুখাশ্রী আর লম্বাটে হওয়াতে অনেকেই তাকিয়ে থাকে। মনে মনে তারা আপসোস করে ইস ছেলেটা গরিব কেন হলো? কেন হোটেলে জব করলো। কোনো এক আলিশান প্রাসাদে জন্ম নিলো না কেন? খুব কি ক্ষতি হতো কোটিপতি বাবার ঘরে জন্ম নিলে? আমাদের সমাজের একটি কমন বিষয় রয়েছে। নারীর রূপ আর ছেলের টাকা। দুটোই খুব বেশি জরুরী। সেসব মেনে নিয়েই বড় লোকের সুন্দরী মেয়ে গুলো চলে যায় তাদের কয়েক মুহুর্তের ভালো লাগাকে ফেলে। আবরাজ খাবারের অর্ডার নিচ্ছিলো। আচানাক রাইয়ের কণ্ঠটা কানে এলো। ও চাইছিল মেয়েটার মুখোমুখি না হতে। তবে লোক না থাকায় যেতে হলো। খুব স্বাভাবিক ওর আচারণ। ” ইয়েস ম্যাম। ”

পরিচিত কণ্ঠে ঘুরে তাকালো রাই। চোখের সামনে দাঁড়ানো ওর প্রাক্তন। যার বুকে মাথা রেখেছে বহুবার। ওভাবেই চলে যায় কিছু সময়। আবরাজ নিশ্চুপ। রাই বলে ” একটা লেমোনেইড দিয়ে যাবে। আর সাথে বেক পাস্তা। ”

নীরবে সম্মতি জানিয়ে চলে যায় আবরাজ। ফিরে আসে খাবার নিয়ে। খাবার রাখার সময় রাই ইচ্ছে করে ফেলে দেয় খাবার। আবরাজ যেন বিহ্বল হয়ে যায়। রাই এমনটা করবে আশা করে নি। মুহুর্তেই চিল্লিয়ে ভীড় করে ফেলে রাই। ম্যানেজার আসেন। প্রথমেই আবরাজকে ধমক দেয় আর তারপর স্যরি বলে রাই কে। রাই ইটস ওকে বলে বসে যায়। খাবারের বাটি উঠানোর সময় আবরাজ বলে ” একটা সময় ছিল যখন তুমি আমার বুকে মাথার রাখার জন্য কান্না অবধি করেছো। আমার ছোঁয়া পাওয়ার লোভে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে নোংরা নর্দমার পাশে। ”

অপমানে শরীর জ্বলে উঠে মেয়েটির। ছেলেটাকে চড় মারার জন্য উদ্যত হতেই আবরাজ ধমকে উঠে। ভরকে যায় রাই। একদম ই নেতিয়ে পরে। ” কিছু বলি নি বলে এই নয় তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা রয়েছে। আমি তোমাকে কেবল করুণা করছি। ”

দুঃখে কষ্টে রাই চুপ হয়ে যায়। খাবার রেখে উঠতে চাইলে ফের ধমকে উঠে আবরাজ। এত লোকের মাঝে প্রচণ্ড অপমানিত হয় মেয়েটি। মাথা নিচু করে বসে থাকে। তবে খাবার নামে না গলা দিয়ে।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

** সাধ্যমতো রেসপন্স করার অনুরোধ। আমার ইয়ার ফাইনাল চলছে তাই লেট হলো গল্প দিতে। **

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here