হাতে_রেখো_হাত (১৬)

0
112

#হাতে_রেখো_হাত (১৬)

অরির ক ব রের পাশে থাকা গাছটা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। আবরাজের হৃদয় ধক করে উঠে। আজকাল ব্যস্ততায় আসা হয় না। যত্ন নেওয়া হয় না গাছ গুলোর। নিয়ম করে অরিকে মনে ও করা হয় না। চোখের জল ও ফেলা হয় না। তবে মাঝে মাঝে বুকের একাংশ ছ্যাঁত করে উঠে। কিছু দিন পূর্বেই একটি অনন্য কাজ করেছে আবরাজ। পৈতৃক সম্পত্তির প্রায় সবটাই দান করে দিয়েছে এতিমখানায়। যেখানে ছোট ছোট শিশুদের অবস্থান। বাবা মা হীনা বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যত তৈরি হবে সেই টাকায়। পড়াশোনা করবে। আর ভালো পুষ্টিকর খাবার ও পাবে। প্রায় অর্ধ শতাধিক শিশুর জন্য বিপুল পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ। আঠারো বছর অবধি সকল দেখা শোনা করা হবে। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ হবে। আবরাজ কিংবা অরির মত কষ্টে দিন যাবে না মা বাবাহীন বাচ্চাগুলো। ছেলেটা একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। এই যে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি দান করল অথচ একটা প্রেস মিটিং তো বহুদূর কাউকেই জানতে দিল না। অনেকটা নীরবে রইল ঘটনাটা। কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল বিষয়টা। আবরাজের এই মহৎ দান সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে আবরাজের ধারণা এসব তো ওর বাবা দাদার অর্জন। তাদের সম্পদ। এসব অর্জনে তো ওর এক বিন্দু ঘাম ঝরে নি। তাহলে ক্রেডিট কেন যাবে ওর নামে?

সীরাত কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল। আবরাজ কে ব্যাতিব্যস্ত আর ভগ্ন দেখে ছুটে এলো। “কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমায়!”

“গাছটা মরে গেছে। দেখ কি হয়ে গেল। আমার বোনটা নিশ্চয়ই ভালো নেই। ভাইয়ের সাথে রাগ করেছে।”

সীরাত তাকায় তৎক্ষণাৎ। অর্ধমৃত প্রায়! মেয়েটির হৃদয়ে নাড়া দিল। আবরাজ ফের গাছের গোড়া খুঁড়ে। তারপর কিছু সার আর পানি দেয়। সীরাত অদ্ভুত ভাবে দেখল সবটা। হঠাৎ ই এখান থেকে একটা শিক্ষাগ্রহণ করে মেয়েটি। “গাছের মত প্রতিটা সম্পর্কের ও যত্নের প্রয়োজন। নতুবা সম্পর্কগুলো মরে যায় গাছের মতই।”

প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে অরির কবরের চারপাশ পরিষ্কার করল আবরাজ। গাছ গুলোকে তরতাজা দেখার জন্য দু চোখে আকাশসম ব্যকুলতা। বালুতে ভরে গেছে শরীর। সীরাত এগিয়ে এসে মুছে দিল কপালের ডানপাশ। “ঘেমে গেছ, পরিশ্রান্ত লাগছে। আসো একটু বিশ্রাম করবে।”

“বিশ্রাম আর পরিশ্রান্ত? এসব তো অনেক রেয়ার জিনিস সীরাত। আমার জীবনে পরিশ্রান্ত,বিশ্রাম এসব মূল্যবান শব্দ নেই।”

সঙ্গে সঙ্গে জবার করল সীরাত। “এটা ভুল। প্রতিটা মানুষই পরিশ্রান্ত হয়। তাকে বিশ্রাম নিতে হয়। নতুবা জীবনের শুরুতেই হেরে যেতে হয়।”

মৌন রইল আবরাজ। সীরাত খাবার এনেছে। ব্যাগ থেকে একে একে সব নামিয়ে রাখল। আবরাজের চোখ এখনো অরির কবরে। মেয়েটা শুয়ে আছে ঐ টুকু ঘরে। কত গুলো দিন হলো একাকি জীবনের। আচ্ছা অরির কি মনে আছে ভাইয়ের কথা? এই যে অরির জন্য আবরাজের এত কষ্ট হয় অরির ও কি কষ্ট হয় ভাইয়ের জন্য?

“কি হলো খাচ্ছ না কেন?”

“হুম এই তো খাব।”

বিরিয়ানির প্যাকেট খুলতেই আবরাজের চোখ ভিজে উঠে। সীরাত বুঝতে পারে। বিষয়টাকে মশ্রিন করতে বলে “জানো তো আমার মা বলত পৃথিবীর সমস্ত সুখ হার মেনে যাবে জান্নাতের একটি আলোতেই। তাহলে ভেবে দেখ অরি কতটা আনন্দে।”

আবরাজ তাকিয়ে রইল কেবল। সীরাত আরও কিছু বলল। ছেলেটার মাঝে তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। সীরাত হতাশ হলো। আবরাজের হাতে হাত রাখল। এক ভরসা আর স্বস্তির হাত।
.

সেনাবাহিনী তে জয়েন করার জন্য বেশ কিছু টাকা প্রয়োজন। আবরাজের কাছে তেমন কোনো টাকা পয়সা নেই। সবটাই দানস করেছে এতিমখানায়। এই মুহুর্তে কি করা উচিত ঠিক মাথায় আসছে না। এদিকে শপথ নিয়েছে নিজের দেশকে ভালোবেসে গ্রহন করবে।দেশের পথে উৎসর্গ করবে নিজের জীবন। নিজ শপথ থেকে সরে আসতে চাচ্ছে না ছেলেটা। এতে করে নিজের ব্যক্তিত্ব কে অপমান করা হবে। ছেলেটির মাথায় চট করেই বুদ্ধি এলো। বাড়িটা পুরে গেছে তবে জমি তো রয়েছে। শহরের বাসা ছিল। সামান্য জায়গা হলে ও বিক্রি করলে বেশ অনেক টাকা পাওয়া যাবে। ছেলেটি মনে মনে স্থির করলো জমিটা বিক্রি করবে। পর দিন ই লোক লাগিয়ে দেয়। প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে। হাতে অবশিষ্ট রয়েছে সামান্য কিছু অর্থ। যতদিন না জায়গাটা বিক্রি হয় ততদিন অবধি বেশ হিসেব করে চলতে হবে। রোজ ভাত খেলে ও আজ ভাত খেল না। বরং দোকান থেকে শুকনো রুটি কলা কিনে লাঞ্চ সেরে নিলো। এতে করে ত্রিশ টাকা বেঁচে গেল। যাহ দিয়ে আরেক বেলার খাবার হয়ে যাবে। হেঁটে হেঁটেই মাঠে আসে ছেলেটি। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল সীরাত। আবরাজ কে দেখে বেঞ্চ থেকে উঠে দাড়াঁয়। মেয়েটা দারুন লম্বা। ৫’৬ বা তাঁর কাছাকাছি। হাইট এ সেনাবাহিনীতে বিনা সংকোচে চান্স পেয়ে যাবে মেয়েটি। অবশ্য আবরাজ নিজে ও অত্যধিক লম্বা। তাই চান্স পেতে কোনো রকম অসুবিধা হবে না। তবে বডি স্ট্রাকচার নিয়ে হরেক রকমের ঝামেলা। নানা রকমের ফিটনেস রাখতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে সীরাত বলল
“কি ভাবছ তুমি?”

“ভাবলাম ফিটনেস এর দিকে নজর রাখতে হবে।”

“অবশ্যই রাখতে হবে। শোনো নিজেকে এমন ভাবে গড়তে হবে যাতে করে প্রথম ধাপেই টিকে যাও। যে জীবনে একবার হেরে যায় তার উঠে আসতে অনেক সময় লাগে।”

“হ্যাঁ।”

একটা কথা বলব?”

“নিশ্চয়ই।”

ছেলেটার হাত ধরে সীরাত। অবাক হলো না আবরাজ। মেয়েটা একটু গাঁয়ে পড়াই বটে তবে প্রচন্ড রকমের ভালো মানুষ। আবরাজ বলল “কি হলো বললে না কি বলবে?”

“তুমি টাকার টেনশন করছ তাই না? প্লিজ আমার থেকে এই সামান্য উপহার গ্রহন করো।”

“ধন্যবাদ সীরাত। তবে আমি এই টাকা গ্রহন করতে পারব না।”

“কিন্তু কেন?”

“আমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদটা এখনো রয়েছে। সেটা যতদিন অবধি আছে আমি সাহায্য নিতে পারব না। না হয় উপর থেকেই বাবা কষ্ট পাবেন।”

ফোঁস করে দম ফেলল মেয়েটি। কতবার এই কথাটা বোঝানো হয়েছে জানা নেই ওর। তবে আবরাজ এর আত্মসম্মান বোধ এতবেশি যে একটা কানা কড়ি ও নিবে না। এই নীতি বদলানোর সাধ্য কারো নেই।

দুজনে কিছু শরীর চর্চা করতে লাগল। শরীর ফিট রাখার জন্য এই সাধারন শরীর চর্চা গুলো জরুরী। জগিং শেষে একটা বেঞ্চে এসে বসল দুজনেই। একটা জুসের বোতল এগিয়ে দিল সীরাত। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আবরাজ। নাকি সুরে মেয়েটা বলল
“প্লিজ এটা কে অন্তত নাকোচ করো না। এটা জুস মাত্র। টাকার পাহাড় না।”

হেসে ফেলল ছেলেটা। মেয়ে টার হাত থেকে বোতল নিয়ে জুস পান করল। এই পৃথিবী তে একজন বন্ধু পেল বটে। যে সমস্ত কিছু জেনেও নির্দ্বিধায় ওর সঙ্গে হাতে হাত রেখে এগোচ্ছে। সত্যি বলতে কে আপন আর কেই বা পর তা বোঝা মুশকিল। না হলে সামান্য কারনে রাই চলে গেল ওর থেকে?

চলবে……
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here