হাতে_রেখো_হাত (১৭)

0
136

#হাতে_রেখো_হাত (১৭)

দুই মাস পেরোলে ও বাড়িটা বিক্রি করতে পারল না আবরাজ। আবারো পুরনো সেই জবটা নিয়েছে। মাঝে কয়েক মাস মন মানসিকতা ঠিক ছিল না, সেই কারনেই জবটা ছেড়ে দিয়েছিল। ভার্সিটিতে এডমিশন নিয়েছে। বি সি এস করলে সেনাবাহিনীর বড় পদে চাকরি হওয়ার সম্ভবনা থাকবে। সীরাত নিজে ও বি সি এস করবে বলে ঠিক করেছে। তবে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসে পড়াশোনা করবে বলে স্থির করে মেয়েটি। কষ্টের কথা মাথায় নেই। শুধু নিজ লক্ষ্য কে পূরণ করার চেষ্টা। মেয়েটা বড় ভালো আর উঁচু মনের এই নিয়ে দ্বিধা নেই। আবরাজের সাথে ছায়া হয়ে রয়েছে। এই ব্যস্ত দুনিয়ায় স্বস্তি ময় একটি নাম সীরাত। অন্তত আবরাজের কাছে তেমনি লাগে।

কিছু কাগজ পত্রের জন্য কলেজে এসেছে ছেলেটা। তখনি দেখা হয় রাই এর সাথে। মেয়েটা বেশ অনেক খানি শুকিয়ে গেছে। মুখের সেই মাধুর্যতা নেই। কেমন যেন লাগছে দেখতে। হতাশা গ্রস্ত হয়ে অন্য দিক ফিরে হাঁটা লাগায় আবরাজ। ঝড়ের বেগে এসে পথিমধ্যে বাঁধা দিল রাই। ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসির রেখা। আবরাজের দিকে তাকিয়ে বলল “কেমন আছ তুমি?”

“ভালো।”

“আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না?”

“জিজ্ঞাসা করার কি আছে,নিশ্চয়ই ভালোই আছ।

মেয়েটা সামান্য হাসল। চোখে মুখে দুঃখের ছাপ। তবে কেন যেন মেয়েটি কে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় না। আগাতে চাইলেই হাতটা ধরে ফেলল রাই। চোখ দুটোয় রাজ্যের ক্লান্তি। “আমাকে মাফ করে দিও আবরাজ। আমি আসলেই ভুল করেছি। খুব বড় ভুল।”

“মাফ চাওয়ার কিছু নেই রাই। তোমার মনে হয়েছিল আমি উপযুক্ত নই তাই চলে গেছো। ইটস ওকে।”

মেয়েটা ডুকরে কেঁদে উঠে। ক্রন্দনরত মুখে লাল লাল দাগের ছোঁপ। মায়া হয় খুব। তাই হালকা হাতে মেয়ে টির মাথায় হাত বুলায় আবরাজ। “কাঁদছ কেন?”

নাক টেনে তাকায় রাই। চোখে মুখে বিদ্রুপের হাসি। তবে সে বিদ্রুপ নিজের জন্য। “আমি ভুল করেছিলাম আবরাজ। রকি আমাকে ঠকিয়েছে। অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে এখন।”

“কেঁদো না। আরও ভালো কাউ কে পাবে তুমি।”

“ভালো কাউকে পাব? হাসালে আমায়। আমি তো এখন প্রেগনেন্ট।”

শেষোক্ত কথায় মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল ছেলেটার। এর মানে রাই ছেলেটার সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে গেছে। শুকনো ঢোক গিলল আবরাজ। রাই কিছু বলবে তাঁর আগেই চলে যায়। মাটিতে বসে পরে রাই। সবার মত আবরাজ ও বুঝি ঘৃনা করে ওকে।
.

ঘাসের উপর পা মেলে দিয়ে বসে আছে আবরাজ। পাশেই গুটি কয়েক পাথর রাখা। আনমনেই একটা একটা করে পাথর ছুঁড়ে ফেলছে নদীতে। পানিতে হালকা শব্দ করে পাথর গুলো ডুবে যাচ্ছে। অতলে হারিয়ে যাচ্ছে এরা। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ছেলেটার হেয়ালি পানা দেখে চলেছে সীরাত। এবার প্রশ্ন করা উচিত। তাই ধপ করে পাশে বসল। অথচ আবরাজের ধ্যান ভাঙল না! মেয়েটার ভ্রু সামান্য কুঁচকে গেল। কণ্ঠে রস এনে বলল “কী ভাবছ?”

কোনো উত্তর করল না আবরাজ। ওর ধ্যান জ্ঞান সমস্ত কিছু পৃথিবী থেকে বেরিয়ে কল্পনার জগতে মেতেছে। সব এখন বহু দূরে। হালকা হাতে ধাক্কা দিতেই সচকিত হয় ছেলেটা। সীরাতকে বসে থাকতে দেখে লম্বা হাসে।
“কখন এলে?”

“অনেকক্ষণ হলো। অথচ তুমি দেখলে না।”

“আচ্ছা।”

“কি হয়েছে তোমার?”

“আরে কি হবে। কিছুই হয় নি।”

দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে কথা গুলো বলল আবরাজ। তবে মেয়েটা অনেক চতুর প্রকৃতির। তাই সহজেই বুঝে গেল আবরাজ লুকাতে চাচ্ছে বিষয়টা। দুজনেই নীরবতা পালন করছে। গোধূলি বেলার শেষ প্রহর নেমেছে ধরায়। আবরাজ নীরবতা ভাঙে। “কি অদ্ভুত দুনিয়ার নিয়ম। প্রেমিকের কাছে নিজেকে ন্যস্ত করে দিতে একটু ও বুক কাঁপে না। ভাবে না ইন ফিউচার কী হবে। পরে যখন ধোঁকা খায় তখন কেঁদে বুক ভাসায়। এত সফট মনের কেন হয় মেয়েরা? একটা কথা বল তো নারীর শরীর এতটাই মূল্যহীন? কি করে মেয়েরা ভুলে যায় এসব। সামান্য মিষ্টি কথায় ভুলে যায়। নিজেকে অসম্মানিত করে বসে।”

কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে সীরাত উত্তর করল
“এই ভুলের জন্য দায়ী কারা বলো তো? এই ভুলের জন্য দায়ী সে নিজেই। কারন এমন অপকর্ম করেছে সে যাঁর ফল নিশ্চিত ভুগতে হবে।”

“হ্যাঁ সেটাই। তবে এর প্রতিকার সম্ভব নয়?”

“সম্ভব। তবে ধরে বেঁধে সংসার হয়?”

আবরাজ উত্তর করল না। সত্যিই বলতে প্রচন্ড বাজে অনুভূতি হচ্ছে রাই এর জন্য। হাজার হোক একটা সময় দুজনে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল। একটু হলে ও ফিলিং ছিল নিশ্চয়ই।

“হঠাৎ এসব কেন বললে বল তো?”

“এমনিই বললাম। এক্সারসাইজ করবে না?”

“উহু। আজ সন্ধ্যা দেখব। দেখবে না?”

মৃদু হাসল আবরাজ। দুজনের মাঝে রয়েছে সামান্য ব্যবধান। এই দূরুত্ব বজায় রেখেই সুন্দর এক সন্ধ্যা দেখল দুজনে।
.

ক্যাফেতে বসে রয়েছে আবরাজ। যাঁর জন্য অপেক্ষা করছে তাঁর আসার কথা ছিল আরো বিশ মিনিট আগে। তবে এখন অবধি পৌছায় নি। উপায় না পেয়ে কল করতে গেল ছেলেটা ঠিক তখনি একটি শব্দ কানে এসে বাজে। পেছন ঘুরতেই রকি বলল “সৈয়দ আবরাজ? আপনিই তো সে যার সাথে আমার দেখা হয়েছিল কয়েক মাস আগে।”

“হ্যাঁ। যাক চিনতে পেরেছেন।”

হাত মিলায় দুজনে। রকির আচারন নম্র। ছেলেটা যে এ কাজ করতে পারে বিশ্বাসই হচ্ছে না। যেন আকাশ কুসুম কল্পনা। কফির অর্ডার করে আবরাজ। কফি দিতেই চুমুক দিয়ে বলল “স্যরি একটু লেট হয়ে গেছে।তাহলে বলুন কোন কারনে জরুরী তলব?”

“আপনি রাই এর বয়ফ্রেন্ড তাই না?”

“উহুহ।”

“মানে! আমি তো নিজে দেখেছি।”

“আপনি ঠিক ই দেখেছেন। আর আমি রাই এর বয়ফ্রেন্ড ছিলাম, এখন নেই।”

ভ্রু কুঁচকে তাকায় আবরাজ। রকি সামান্য হাসল। কফি কাপ রেখে হাতের সামনে রাখল একটি পাজেল। সেটা নিয়ে খেলছে এখন। “আপনি তো রাই এর এক্স, এম আই রাইট?”

বিব্রত হয় আবরাজ। রকি ফের বলে “যে মেয়েটা আপনাকে ছেড়ে দিল সামান্য কারণে, সে আমাকে ছাড়বে না এর কোনো নিশ্চয়তা আছে?”

“দেখুন মিস্টার রকি আমার আর আপনার বিষয়টা আলাদা। আপনি ওর গর্ভে থাকা সন্তানের বাবা।”

ছেলেটার মুখটা কঠোর হয়ে গেল। কফির মগটা চেপে ধরল। সামান্য উত্তেজিত কন্ঠে বলল “আমার সাথে ফিজিক্যাল গেছে মানলাম, অন্য কারো সাথে যায় নি এর প্রমান কি? আমি বলাতে সুর সুর করে চলে এসেছে। নিশ্চয় আপনি ও”

কথার মাঝে থামিয়ে দিল আবরাজ। নিজেকে শান্ত রেখেই বলল “ওর সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। কখনো চুমু ও খাই নি আমি।”

ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এসব কথা বলতে ভালো লাগছে না।

“আমার পক্ষে এত মহান হওয়া সম্ভব নয় মিস্টার সৈয়দ আবরাজ। আপনি নেহাত ই ভালো মানুষ তাই ওর হয়ে সাফাই গাইছেন।”

“রকি আমার কথা শুনুন।”

“আমাকে মাফ করবেন। আর একটা সত্যিই কি জানেন রাই কে আমি নিজের থেকে ও বেশি ভালোবাসি। তবে ওর শাস্তি পাওয়া জরুরি।”

ছেলেটা চলে গেল। অদ্ভত ভাবে তাকিয়ে রইল আবরাজ। এ কেমন ভালোবাসা? তবে শেষোক্ত কথাটা যে মিথ্যে নয় তা বেশ ভালোই বুঝতে পারল আবরাজ। দীর্ঘশ্বাস টেনে উঠে দাঁড়ায়হ এর বেশি কি ই বা করতে পারে ওহ?

মনে এক রাশ বিষন্নতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। এই একটা দোষ। কারো দুঃখ সইতে পারে না। হঠাৎ করেই একটা গাড়ি এসে থামে ওর কাছে। অন্যমনস্ক থাকায় কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে এগুতে থাকে। গাড়ি থেকে নেমে আসেন অফিসার আবুল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারে লোকটা আজ অনেকদিন পর পুলিশের ফর্মাল ড্রেসে। এই পোষাক গায়ে রেখেই তো দেশ প্রেমের মর্মার্থ বুঝিয়ে ছিল ওকে।
“আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি দেশকে নিজের সাথে এগিয়ে নিতে অংশগ্রহণ করছ।”

“ধন্যবাদ স্যার।”

“আম প্রাউড অফ ইউ মাই বয়।”

ছেলেটা দুর্ভেদ্য হাসল। লোকটা সত্যিই খুব ভালো। তিনি আর বললেন “আসো রাস্তার ধারে বসে চা খাওয়া যাক।”

মাথাটা কাত করে সম্মতি জানায় আবরাজ। চায়ের দোকানে এসে আবরাজ বলে “দুটো চিনি ছাড়া লিকার চা দিবেন।”

আবুল অবাক হলেন না। কারণ এর লাস্টবার তিনি যখন আবরাজের সাথে দেখা করেছিলেন তখনও ছিল চায়ের আড্ডা। ছেলেটা সেবার দেশদ্রোহিদের ধরতে বেশ সাহায্য করেছে। স্কেচ করিয়ে ছিল একদম সঠিক নির্দেশনায়। আর সেই সুবাদেই শাস্তি প্রদান করতে পেরেছে দেশদ্রোহীদের। এর মধ্য থেকে একটা বিষয় খুব অবাক করেছে ওনাকে। আবরাজ নিজের করা প্রতিটা ভালো কাজ লুকিয়ে যাচ্ছে। বরারবর ই বলে বিষয়টা যেন পাঁচ কান না হয়। কারন ওহ চায় না এই মিশনগুলোতে কে সাহায্যে করেছে তা কেউ জানুক।

দু জনেই বেশ কিছুটা সময় নিয়ে চা পান করল। আবুল বললেন “তোমাকে একটা কথা জানাতে এসেছি।”

“কি কথা?”

“সীরাত আমার মেয়ে।”

কথাটা যেন ধনুকের মতো বুকে এসে বিঁধে। ছেলেটার চাহনি দেখে হেসে ফেললেন আবুল। আশ্বস্ত করে বললেন “রিলাক্স আমি ই পাঠিয়েছিলাম ওকে। তোমার মনটা কে দেশ প্রেমের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি জানি তুমি পারবে।”

কি বলবে বুঝতে পারল না আবরাজ। ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন আবুল। যাওয়ার পূর্বে একটি কার্ড প্রদান করলেন যেটা তে লিখা আছে ভালো কাজ গুলোর জন্য সরকারি ভাবে আবরাজ আর সীরাতকে সেনাবাহিনী তে নিয়োগ করা হবে। এক টাকা ও দিতে হবে না।

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here