#হাতে_রেখো_হাত (১৯)
সেনাবাহিনীর ট্রেনিংটা হচ্ছে সব থেকে যন্ত্রনাময় এক ট্রেনিং। তাঁর উপর ওরা দুজন স্পেশাল ফোর্সে নিয়োগ হতে চলেছে। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেই জগিং এর জন্য বের হতে হলো। জানুয়ারি মাস হওয়ার কারণে শীতের প্রকোপটা একটু বেশিই বলা চলে। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে খবর এসেছে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল কিছু দিন পূর্বে। সেটা কমে যেতেই তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে হু হু করে। মাইনাস এর ঘরে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে! যদি ও এখন আট দশে এ উঠা নামা করছে। দেশের আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তনে ও থেমে নেই ওদের স্পেশাল ফোর্স। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ছুটে চলেছে আবরাজ ও সীরাত। মাথায় থাকা হ্যাট এর সাথে লাগানো রয়েছে ছোট্ট টচ লাইট। যেটার সাহায্যে রাস্তা দেখবে ওরা। এখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার সাথে তীব্র কুয়াশা। গাঁয়ে জগিং কস্টিউম। তবে সেটা শীত মানাতে অক্ষম। বার বার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। প্রায় দুই কিলোমিটার জগিং করার পর হাঁপিয়ে উঠল সীরাত। অথচ অন্য সময় নিমিষেই পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে নিত! হাঁটুতে হাত রেখে শ্বাস নিল বার কয়েক। মেয়েটার বাহু ধরে উঁচু করল আবরাজ। “খুব বেশি ক্লান্ত লাগছে?”
“হ্যাঁ।”
“কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিবে?”
“আচ্ছা চলো।”
পাহাড়ের ঢাল থেকে একটু সমতল স্থানে এসে গাছের শিখরে বসল দুজনায়। মনে মনে দোয়া পাঠ করল। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করল জার্নির সফলতার। সীরাতের দিকে তাকিয়ে আবরাজ লক্ষ্য করল মেয়েটার মুখ মন্ডল কেমন শুকিয়ে কাঠ। কয়েক দিনেই যেন বয়স বেড়ে গেছে। সীরাতের মাথাটা হাতের সাহায্যে আলগোছে বুকে চেপে নিল আবরাজ। সীরাত বলল “তোমার বুকের মধ্যভাগে যেন হয় শুধু আমার বাস।”
স্মিত হাসল ছেলেটি। সীরাতের এলোমেলো চুলের গুচ্ছে হাত গলিয়ে দিল। মাথায় বিলি কেঁটে দিতে দিতে বলল “শুধু তোমার ই বাস হবে সীরাত। শুধু তোমার ই বাস। এই যে ধরলাম তোমার হাত।”
“আমরা বিয়ে করছি কবে?”
বিয়ে শব্দটা টনক নাড়িয়ে দিল আবরাজের। ছেলেটি একটু সময় নিয়ে বলল “তুমি তো জানোই সেনাবাহিনী তে নিয়োগ দেওয়া হয় অবিবাহিতদের।”
“সেটা তো বুঝলাম। তবে নিয়োগ দেওয়া হবে সামনে মাসেই। আমরা কি পরের মাসেই বিয়ে করতে পারি না?”
ছেলেটা সম্মতি জানায়। আবরাজের গালে চুমু খেল মেয়েটি। ছেলেটার গলায় নাক ডুবিয়ে কয়েকটা শ্বাস ফেলল। যেন বুকের ভেতর পাহাড় সমান চিন্তাটা নিমেষেই নেমে গেছে।
প্রায় ঘন্টা খানেক জগিং করার পর পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসল দুজনেই। সীরাতের সাথে সাথে আবরাজ ও হাঁপিয়ে উঠেছে। ছেলেটার ঘর্মাক্ত মুখে ছোপ ছোপ লাল দাগ। আঁতকে উঠল মেয়েটি। আবরাজের মুখে হালকা হাতে হাত বুলাচ্ছে। “একি মুখে লাল লাল দাগ কেন?”
“দেখি, ফোনটা দাও তো।”
ফোন এগিয়ে দেয় সীরাত। নিজের মুখটা ক্যামেরায় দেখে ফোঁস করে দম ফেলে ছেলেটি। সীরাতের চিন্তিত মুখের যা তা অবস্থা। ফলে হেসে উঠে আবরাজ। “আরে পাগলী এটা এলার্জির জন্য হয়েছে। আমার খুব ই সামান্য এলার্জি রয়েছে। অনেক দিন ধরে মেডিসিনের প্রয়োজন হয় না। ”
“ইসস কেমন হয়ে গেল। চিন্তার কারণ নেই তো?”
“উঁহু। আসো আগে ক্যাম্প এ যাই।”
“হুম।”
তাঁবু টানিয়ে ক্যাম্প করা হয়েছে। মোট আটাশ জন কে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে ছয় জন কে নেওয়া হবে। তাই একটু বেশি কসরত করতে হচ্ছে। প্রতিটা মানুষ ই চরম খাটুনি দিচ্ছে।
তাঁবুর ভেতরে এসে শুয়ে পরে সীরাত। আবরাজ যায় ক্যাম্পিং প্রধান এর কাছে। লোকটি কারো সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছেন। কথা শেষ হতেই আবরাজ বলল
“হ্যালো স্যার।”
“হ্যালো মাই বয়। হঠাৎ কি মনে করে?”
“স্যার ট্রেনিং চলবে কতদিন?”
“দেখা যাক। তবে শোনো আজ সন্ধ্যাতে একটা বিশেষ পরীক্ষা আছে সকলের। এটা কিন্তু খুব ই হার্ড।”
“কেমন পরীক্ষা?”
“উহু সন্ধ্যাতেই জানাব সকলকে।”
লোকটা দূর্ভেদ্য হাসল। আবরাজের পিঠ চাপরে চলে গেলেন তারপর। ছেলেটি বিধ্বস্ত পায়ে তাঁবুর কাছে আসল। মনে মনে প্রার্থনা করছে সেই পরীক্ষাটি যেন না হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। পুরো আকাশ জুড়ে ঘন কালো অন্ধকার। সবাই কাঁপতে কাঁপতে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আগুনের উত্তাপে সকলে গা গরম করছে। ঠিক তখনি ক্যাপ্টেন মনসুর আহমদ বললেন “তোমাদের সকলকে আজ সন্ধ্যার আয়োজনে স্বাগতম। আজ খুব দারুন খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।”
সকলে কড়তালি দিল। হাত উঁচিয়ে থামতে বললেন তিনি। একটা পেপার বের করে বললেন “এই পেপারে রয়েছে একটি বিশেষ ঘোষনা। যা শোনার পর হয়ত সবাই শকড হতে পারো। তবে ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ে যেভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয় আমরা ও সেভাবে ট্রেনিং দিতে চাচ্ছি। কারন একজন সেনাবাহিনীর মূল কথা হলো দেশের প্রতি ভালোবাসা। এই দেশপ্রেমের জন্য তাঁকে টিকে থাকতে হবে। মূলত শক্ত পোক্তদের ই সেনাবাহিনী তে নিয়োগ করা হয় বা হবে। কারণ দূর্বল রা নিজেকেই রক্ষা করতে পারে না। আর তাঁরা অন্যদের রক্ষা করবে কি করে?”
সকলের মাঝে টান টান উত্তেজনা কাজ করছে। আবরাজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। যা ভয় পেয়েছিল তাই হতে যাচ্ছে। সীরাত এখনো কিছু বুঝে উঠে নি। ওর হৃদয়ে দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা থাকলেও সেনাবাহিনী নিয়ে তেমন গবেষণা করার সুযোগ হয় নি। তাই আবরাজের জ্যাকেট খামচে ধরে বলল “স্যার কি বললেন বলো তো?”
“আজকের আয়োজন দেখেছ?”
“হুহম। দারুণ সব খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। উফ ভাবতেই আমার কেমন লাগছে।”
“পেটুক হইয়ো না একটু পরে সব আনন্দ বের হবে।”
“কি সব বলছ?”
“যা বলছি তাই। দেখ শুধু কি হয়।”
“ধ্যাত!”
থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল সকলে। সবার জন্য সুস্বাদু ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকলেই পেট পুরে খেল।
ক্যাপ্টেন মনসুর সকলকে জড়ো হতে বললেন। সকলে জড়ো হতেই কাগজটা মেলে ধরলেন তিনি। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বললেন “এখানে লিখা আছে আজ থেকে আগামী সাত দিন আপনারা কোনো রকম খাবার পাবেন না। সমস্ত খাবার এই বন জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে খেতে হবে। আর তাঁর পরের উইক এ চার দিন আপনাদের খাবার দেওয়া হবে তবে সে খাবারটা, আচ্ছা থাক এটা না হয় পরে জানলেন। আপাতত এই সাত দিনের জন্য প্রস্তুত তো?”
সকলে এক যোগে বলল “ইয়েস স্যার।”
সীরাতের ভ্রু কুচকে আছে। আবরাজের হাত চেপে বলল “স্যার পুরো কথা বললেন না কেন?”
“বললে আগামী সাত দিন পেটে ভাত যাবে না।”
“আবরাজ তুমি একটা যা তা। ধ্যাত আমি গেলাম, ঘুম পাচ্ছে।”
মেয়েটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল ছেলেটা। কি যে হবে কে জানে! অফিসার আবুল তাকে বলেছিল সীরাত অনেক খুঁতখুঁতে। ওর মনে দেশ প্রেম জাগাতে কসরত করতে হয়েছে। তিনি তাই চেয়েছিলেন পাশে এমন কেউ থাকুক যে ওকে ভরসা দিবে। দেশকে ভালোবাসবে।
সকাল সকাল খিদে না পেলে ও জগিং করার পর পর ই পেটে ইঁদুর খেলা শুরু হয়ে গেল। সকলে বেরিয়ে পরল খাবারের সন্ধানে। বন জঙ্গলে সর্বোচ্চ ফল পাওয়া যাবে। অথবা কিছু শাক। সীরাতের সাথে জুটি বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছে আবরাজ। মেয়েটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। “কি জঙ্গল এটা? যার কোনো আগা মাথা নেই। শুধু পাহাড়ি গাছের জঙ্গল।”
“কথা বলো না। এখন খোঁজ কর।”
চোখ বুলাতে থাকে সীরাত। কিছুই চোখে পড়ল না। পাশেই তীব্র স্রোতের নদী। ঝর্ণার পানি এসে মিলিত হচ্ছে। মেয়েটার লোভ জাগে। খাবারে সন্ধান ছেড়ে সেখানে এসে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে আবরাজের উদ্দেশ্যে করে ডাকে “এদিকে আসো।”
কথাটা যেন কয়েক বার বেজে উঠল। পাহাড়ের বুকে কথা আটকে প্রতিধ্বনি শুরু হয়েছে। মেয়েটার মনে প্রফুল্লতা ছড়িয়ে পড়েছে। চিৎকার করে যাচ্ছে। “ভালোবাসি।”
আরও কয়েক বার কথাটা শোনা গেল। পাশে এসে দাঁড়ায় আবরাজ। হাতে কিছু ফল। পাশেই ছিল গাছ টা। তবে খুব সাবধানের সাথে ফল গুলো নিতে হয়েছে। কারন গাছটা ভর্তি ছিল কাঁটা। যদি ও বেশ কিছু স্থানে কাঁটার আঘা*ত হয়েছে। “চলো পেয়ে গেছি ফল।”
“উহু। আমি যাব না।”
“কি করবে?”
“একযোগে ভালোবাসি বলব।”
“সীরাত লেইট হচ্ছে তো।”
বায়না ধরে মেয়েটি। আবরাজের মন প্রশমিত হয়। সে ও মেতে উঠে প্রতিধ্বনির খেলায়। সীরাতের বাহুতে স্পর্শ করে। কাঁধে থুতনি রেখে পেছন থেকে দু হাতের মাঝে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করে বলে উঠে আচানাক
‘ভালোবাসি সীরাত। খুব বেশি ভালোবাসি। শুধু হাতে রেখো হাত, প্রমিস করছি আমি তোমার জন্য সব সুখ এনে দিব দু হাতের মুঠোয়।’
**রুস্মি একটি অপূর্ণ অধ্যায়। ওর গল্প ঐ অবধিই। পর্ব ১৭ তে আমি বি এস সির জায়গাতে বি সি এস লিখে ফেলেছি। 🤦♀️ মূলত সেটা বি এস সি হব্বে। এডিট এর সময় এই অপকর্মটি ঘটে।**
চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ