প্রেমাসুখ #পর্ব_৮ (ধুরন্ধর হৃৎপিণ্ড) #লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

0
651

#প্রেমাসুখ
#পর্ব_৮ (ধুরন্ধর হৃৎপিণ্ড)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“এই যে মহারাণী! এখানে আপনি চন্দ্রবিলাসে মত্ত! আর ওদিকে আমি হবু শ্বশুর শাশুড়ির সাথে আড্ডা দিয়ে এলাম। উফফ! ফিলিং সো গর্বিত!”

উপমা শান্ত চাহনিতে তাকাল অর্ণবের দিকে। গভীর রাত। জার্নি করে আসার দরুন সাঁঝ অনেকটা আগেই ঘুম রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। ঘড়িতে বারোটা পেরিয়েছে। তবুও সমগ্র শহরের রাস্তা এমনকি অধিকাংশ বাসাগুলো আলোকিত। যানবাহনের কর্কশ শব্দ ভালোই শোনা যাচ্ছে। একটু পরপর কোত্থেকে যেন একরাশ হিম-শীতল বাতাস সমগ্র গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে। বাতাসে প্রেম প্রেম টাইপের গন্ধ মিশে আছে। এই শান্ত, ঠান্ডা, স্তব্ধ সময়টাতে অনুভবশক্তি প্রখর হয়। অব্যক্ত প্রেমিকের প্রেমকথন নির্ঝঞ্জাট শোনা যায়; বক্তার কথোপকথন ছাড়াই। এমন সময়টাকেই হয়ত কবিরা প্রেমলগ্ন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এই সময়টাতে চাঁদ দেখছিল উপমা। তখনই অর্ণব এসে উপর্যুক্ত কথাটি বলল। উপমার রুম ও গেস্ট রুম; যেটাতে অর্ণবকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, দুটোই পাশাপাশি। এটাচ বারান্দা হওয়ায় দু’রুমের যাতায়াত সহজতর হয়েছে।

অর্ণব এপাশে চলে এলো। উপমাকে চুপ থাকতে দেখে অর্ণব বলল,“মন খারাপ? দুঃখ বিলাস করছিলে?”

উপমা বারান্দার বাইরেই দৃষ্টি রেখে বলল,“উঁহু! সুখ বিলাস করছিলাম।”

এরপর অর্ণবের ঘোলা চোখে নিজের চোখজোড়া স্থির রেখে বলল,“এই যে! তোমাকে দেখতে পেলাম! চোখ দুটো জুড়িয়ে গেল। ভীষণ সুখসুখ লাগছে! নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি লাগছে। এখন এই সুখটা উপভোগ করছি, চুপিসারে!”

অর্ণব মিহি হেসে উপমার পাশাপাশি দাঁড়াল। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলল,“বেশ তো! বড়ো হয়ে যাচ্ছো!”

উপমা ভ্রু কুঁচকাল। এরপর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। অর্ণব তা দেখে সামান্য হেসে বলল,“এবার তবে বাড়ি নিয়ে যেতে হয়।”

উপমা হালকা একটা শ্বাস ফেলে বলল,“ক’দিন আগেই মামাবাড়ি গিয়েছিলাম। এখন আর যাব না।”

অর্ণব উপমার দুবাহুতে হাত রেখে, ওকে মুখোমুখি দাঁড় করাল। বাতাসে উপমার খোলা চুলগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। সামনের ক’গাছি চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিল। প্রেম প্রেম টাইপের এই আবহাওয়া আরও জোরদার হলো। দুপাশেই থমথমে নিরবতা; শোনা যাচ্ছে শুধুই হৃৎপিণ্ডের ব্যাকুলতা। স্তব্ধ মুহূর্তে অর্ণব, উপমার চিবুকে হাত রেখে তার নিচু করে রাখা মুখটা উপরে তুলে বলল,“মামাবাড়ি না। শ্বশুরবাড়ি! যাবে?”

__________
ড্রয়িং রুমে সোফার উপর বসে দাঁত নিয়ে নখ কাটছিল সাঁঝ। দৃষ্টি তার সামনে বিষণ্ণ মনে বসে থাকা উপমার দিকে। প্রচণ্ড মন খারাপ তার। একদম শান্ত ভঙ্গিতে মেঝের দিকে চাহনি স্থির রেখে বসে আছে। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে না।

সকাল থেকে এই নিয়ে একাদশ বারের মতো সাঁঝ বলে উঠল, “কী হয়েছে তোর? বলবি না আমাকে?”

বরাবরের মতোই উপমা চুপ। শীতল চোখে সাঁঝকে একবার দেখে পুনরায় পূর্ব কার্যে মত্ত হলো। সাঁঝ একটা শ্বাস টেনে মনে মনে আওড়াল,“এই মেয়েটা এতটা অন্তর্মুখী না হলেও পারত!”

তখনই মনোয়ারা বেগম সেখানে এসে উপমাকে বলল,“একটু তিন তলার সালমা ভাবির বাসায় গিয়ে এটা দিয়ে আয় তো!”

হাতে তার এক বাটি আচার। তিন তলার সালমা ভাবি! চারমাস আগেই এই বাসায় উঠেছে। তার মেয়ে, শর্মী এখানে থাকে না; মাঝে মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ করে যায়। এইতো! এসেছে কিছুদিন আগে। ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। আচার খুব পছন্দ করে; বিশেষ করে তা যদি হয় মনোয়ারা বেগমের হাতে বানানো! এজন্যই মনোয়ারা বেগম খুব জলদি আচার বানিয়ে ফেলল।

উপমাকে চুপ থাকতে দেখে মনোয়ারা বেগম পুনরায় বলে উঠল, “কীরে! শুনতে পাচ্ছিস না? দিয়ে আয় না মা। আমার কোমরে ব্যাথা; সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারব না।”

উপমার মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন দেখা গেল না। মনোয়ারা বেগম পুনরায় কিছু বলার জন্য উদ্যত হওয়ার আগেই সাঁঝ বলে উঠল,“আমি যাচ্ছি ফুপ্পি।”

‘সে-কী! তুমি যাবে কেন? কষ্ট করতে হবে না, আমিই যাচ্ছি।’

‘এই না! আমি যাচ্ছি তো। এই ফাঁকে ছাদেও ঘুরে আসব।’

‘যাবে বলছো?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ! যাচ্ছি।’

মনোয়ারা বেগম হাতের বাটিটা সাঁঝকে দিয়ে বলল,“আচ্ছা, যাও তবে। তিন তলার ডান পাশের বাসাটায়।”

সাঁঝ “আচ্ছা” বলতেই মনোয়ারা বেগম রান্না ঘরে চলে গেল, দুপুরের খাবার তৈরির উদ্দেশ্যে। সাঁঝও ওপরে চলে গেল।

উপমা এখনও সেভাবেই বসে আছে। মূল কারণ হচ্ছে, অর্ণবের একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় আজই টাঙ্গাইল ফিরে গিয়েছে। তাও আবার সেই ভোর সকালে। শুক্রবার হওয়ার জন্য এখনই যাওয়ার কথা কেউ ভাবেনি। উপমাতো ভেবেছিল বেশ কয়েকদিন অর্ণবকে চোখে চোখ রাখতে পারবে, দু’চোখ ভরে প্রিয় মানুষটাকে দেখতে পারবে, সারাদিন দেখে যাবে; কিন্তু তা আর হলো কোথায়?

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে সাঁঝ ভাবছে,কাল উপমার ফোনটা নিয়েও লাভ হলো না। তার ভার্চুয়াল জামাই অনলাইনে আসেনি আর। ব্যাপারটা তার কাছে বড়োই অদ্ভুত ঠেকল। বলা বাহুল্য, তারা এখনও একে অপরের ব্যক্তিগত সকল বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞাত। এখনও একে অপরের ফ্রেন্ড লিস্টে এড হয়নি। চ্যাটিং-এর সময় ফান করতে করতে এতটাই বিমোহিত হয়ে যায় যে বাকি সব দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল থাকে না। এভাবেই চলছে বেশ কতগুলো দিন।

তিন তলায় আসতেই সাঁঝ হঠাৎ ভুলে গেল, ডান পাশের ফ্ল্যাট না-কি বা পাশের ফ্ল্যাট! এদিক সেদিক কয়েকবার তাকাল। এক হাত কোমরে রেখে কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল, মনোয়ারা বেগম তাকে কী বলেছিল! অনেকক্ষণ ভেবেও ঠিক মনে করতে পারল না।

পুনরায় দুই দরজার দিকে তাকাল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ভাবতে লাগল, “ডানে? নাহ্! বামে বলেছিল মনে হয়। হ্যাঁ, বামেই হবে হয়ত।”

আর কিছু না ভেবে বা পাশের ফ্ল্যাটের কলিং বেলে চাপ দিল। মিনিট খানেক অপেক্ষা করতেই দরজা খুলে গেল। ছাই রং-এর টি শার্ট ও কালো ট্রাউজার! সাঁঝ যতদূর জানে, এই বাড়িতে কোনো ছেলে মানুষ নেই। তবে? মনে মনে নিজের মনকে বিশাল একটা প্রশ্ন করে ফেলল,“এই খাটাশ হৃৎপিণ্ড কোত্থেকে উদয় হলো!”

কিন্তু মুখে বলতে পারল না। হৃদ নিজের দরজার সামনে সাঁঝকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখের চশমাটা হাত দিয়ে ঠিক করে নিল। নিশ্চিত হলো, এটা সাঁঝ! তার হাতে একটা বাটি দেখতে পেল। ঢাকা আছে বিধায় ঠিক বুঝে উঠতে পারল না এটা কী!

খানিকক্ষণের নীরবতার অবসান ঘটিয়ে হৃদ তার গম্ভীর মুখে বাঁকা হাসির রেখা ফুঁটিয়ে তুলে বলল,“আদা, জিরা, মরিচ, পেঁয়াজ এসবের বাহানা না দিয়ে সরাসরি বললেই তো পারেন, হ্যান্ডসাম ছেলে দেখার লোভ সামলাতে পারছেন না!”

সাঁঝ চেতে উঠল। এক হাতে আচারের বাটি সামলিয়ে অন্য হাতের তর্জনী আঙ্গুলটা হৃদের মুখের সামনে তুলে বলল,“দেখুন…”

হৃদ নিজের হাতের একটা আঙ্গুল দিয়ে সাঁঝের হাতের আঙ্গুল নামিয়ে বলল,“উঁহু! আমি ওসব দেখতে অভ্যস্ত নই!”

সাঁঝ আগের চেয়ে আরও বেশি রেগে গেল। রাগে হিতাহিত জ্ঞ্যানশূন্য হয়ে পড়ল। ফুঁসতে লাগল। হৃদ তা দেখে ঠোঁট চেপে হেসে যাচ্ছে। সাঁঝ হাতের মুঠো শক্ত করে চেপে দু’চোখ বন্ধ করে পরপর কয়েকটা শ্বাস ছাড়ল।

নিজেকে ধাতস্থ করে হৃদকে উদ্দেশ্য করে বলল,“খাটাশ হৃৎপিণ্ড কোথাকার!”

হৃদ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। সাঁঝের কথাটা বুঝতে পেরেও হাসল। ডেভিল স্মাইল বলা যায় এটাকে। সেই হাসিটা অধর কোনে ছড়িয়ে বলল,“ওহ্! আই সি! পজিটিভ বলে এটেনশন পাচ্ছেন না বলে এখন গালি গালাজ করে নজরে আসতে চাচ্ছেন? লাভ নেই। আমার একটা ভার্চুয়াল বউ আছে।”

ভার্চুয়াল বউ! শুনতেই সাঁঝ কপাল কুঁচকে তাকাল। হৃদতো ঠোঁট চেপে হেসে যাচ্ছে। সাঁঝ আমতা আমতা করে বলল,“দেখুন আপনার…”

হৃদ তৎক্ষনাৎ ব্যক্ত করল,“ইশ! বললাম তো, আমি এসবে অভ্যস্ত নই। কোনো রকমের আগ্রহও নেই। প্লিজ!”

সাঁঝ ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। চোখ বন্ধ করে নিজের অন্তর আত্মাকে মনে মনে বলে উঠল,“কুল সাঁঝ! কুল! এই হৃৎপিণ্ড তোর চেয়েও ধুরন্ধর! এটাকে শান্ত মস্তিষ্কে হ্যান্ডেল করতে হবে।”

এরপর হৃদের দিকে তাকাল। ঠোঁট এলিয়ে হাসল। জোরপূর্বক ছিল সেই হাসিখানা। হৃদকে উদ্দেশ্য করে বলল,“ভুলে আপনার এখানে এসেছি। ভাগ্যিস এসেছি, নয়ত এমন খাটাশ হৃৎপিণ্ডের বকবকানি দেখতে পেতাম না! আর কী যেন বললেন? ভার্চুয়াল বউ! এসব আমাকে বলছেন কেন? বাই দ্য ওয়ে! আমারও ভার্চুয়াল জামাই আছে। যাই আমি! অপেক্ষায় আছেন আমার ওনি। সংসার করে আসি গিয়ে!”

চলবে…
____________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here