#প্রেমাসুখ
#পর্ব_২০ (অ’প্রিয় অসুখ)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
“আটটা বেজে ছ’মিনিট। ছ’মিনিট লেট। নাও, ইউ ডিজার্ভ অ্যা পানিশমেন্ট।”
সাঁঝ শুকনো ঢোক গিলল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে এখান থেকে বের হওয়ার জন্য কিছু একটা খুঁজল।কিন্তু পেল না, পেলেও লাভ হতো না। ফেরার উপায় নেই।
হৃদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “ইয়ে মানে, আমার ভুল হয়েচে, ক্ষমা কইরে দেন।”
হৃদ অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠল। হাসিটা থামাতে অনেকটা সময় লেগে গেল। সাঁঝ সব ভুলে বিবশ হয়ে এই ছেলেটার হাসি দেখে যাচ্ছিল। হৃদ হাসি থামিয়ে বলল, “আপনি একজন স্টুডেন্ট। আপনার সব থেকে বড়ো দায়িত্ব হলো পাংচুয়াল হওয়া।”
সাঁঝ আলতো কন্ঠে বলল, “হুম।”
“ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন।”
“আচ্ছা।”
“এবার আমার জন্য না হলেও আপনার ভার্চ্যুয়াল বরের জন্য কিছু রান্না করে ধন্য করুন।”
সাঁঝ সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। কী রান্না করবে, বুঝতে পারছে না। তাই ওখান থেকেই হৃদকে জিজ্ঞেস করল, “জি, কী রান্না করব?”
সাঁঝের এমন ডাক শুনে হৃদ মুচকি হাসল।
সাঁঝকে উদ্দেশ্য করে বলল, “রাতে রুটি খাই আমি। চারটি রুটি বানান।”
সাঁঝ মনে মনে বলল, ‘বাব্বাহ! চারটা রুটি খাবে?’ তবে তা প্রকাশ করল না। মুখে বলল, “রুটির সাথে?”
”ওখানে সবজি আছে। সবজি রান্না করুন।”
সাঁঝ মনে মনে আবারও বলল, ‘হুহ! এমন ভাবে বলছে যেন আমি তার বউ।’
পরক্ষনেই আবার বলল,“ বউই তো, সেটা ভার্চ্যুয়ালেই হই না কেন!”
“কী ব্যাপার? শুরু করুন।”
“করছি তো!”
“আচ্ছা, আমি একটু কাজ করব।”
কথাটা বলেই ড্রইং রুমে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল। ইভ পাশেই, সোফাতে ঘুমোচ্ছে। হৃদ ইচ্ছে করেই মেইডকে আসতে বারণ করে দিয়েছে। ভীষণ শখ হয়েছে তার, সাঁঝের হাতের রান্না খাওয়ার।
ফ্রেন্ডস গ্রুপে কল দিল হৃদ, তখনই জয়েন হলো ঊর্মি।
ঊর্মি জিজ্ঞেস করল, “কী রে হৃদ সাহেব, কী খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তোর?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
ঊর্মির মুখের উজ্জ্বলতা দেখে হৃদ প্রশ্ন করল, “কী ব্যপার উরু! মামা-টামা…”
তখনই জয়েন হলো সিয়াম ও রিয়াদ।
সিয়াম ফটাফট জিজ্ঞাসা করল, “কী রে মাম্মা, ভাবি কই?”
“আমাকে মামা ডাকিস আর আমার বউকে ভাবি, এটা কোথাকার নিয়ম?”
ঊর্মি হৃদের প্রশ্নের জবাবে বলল, “এটা বন্ধু জাতির নিয়ম।”
হৃদ বলল, “আগে এটা বল, আমি বিয়ে করলাম কবে? আর ভাবি কোথায় পেলি তোরা?”
সিয়াম বলল, “ওহ হো! তাও তো কথা, হেহে!”
ঊর্মি রিয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কী রে চেঙ্গিস খান! চুপ ক্যান?”
রিয়াদ চেতে উঠে বলল, “এই তুই আমাকে এই নামে ডাকা বন্ধ করা বইন। নয়তো তোকে কিছু একটা করে ফেলব।”
ঊর্মি আবারও বলল, “ঐ চেঙ্গিস খান! আবারও বললাম। এবার বল, কী করবি?”
রিয়াদ বলল, “তোর চশমা আমি ভেঙে দেব।”
ঊর্মি বাঁকা হেসে বলল, “ভাঙ তবে।”
সিয়াম মজা নিচ্ছিল এদের ঝগড়া শুনে। কলেজ লাইফেও এরা এভাবে ঝগড়া করত। একদিন তো মারামারিই লেগে গিয়েছিল। সিয়াম এসব ভেবেই হেসে উঠল। পুরনো দিনগুলো কতই না মজার ছিল!
সিয়ামকে হাসতে দেখে ঊর্মি আর রিয়াদ চেতে বলে উঠল, “তুই হাসছিস ক্যান?”
এতে সিয়াম আরও জোরে হেসে উঠল। সিয়াম আগেও এদের কাহিনি দেখে হাসত, আর ওদের রাগ সব সিয়ামের উপর চলে আসত।
হৃদ এবার কথা বলল, “থামবি তোরা?”
সবাই থেমে গেল।
হৃদ এবার জিজ্ঞাসা করল, “রিয়াদ, মন খারাপ কেন?”
“তোর জন্য।”
“আমি কী করলাম?”
হৃদের কথায় রিয়াদ বলে উঠল, “ডেয়ার দিছিলাম। কিন্তু তোর প্রেম হলো না কেন?”
হৃদ মুচকি হাসল।
রিয়াদ বলল, “হৃদ! তোর পিছে কে?”
হৃদ পিছনে তাকাতেই সাঁঝকে দেখতে পেল। দু’হাত বুকে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদ জিজ্ঞাসা করল, “কিছু লাগবে?”
“হ্যাঁ, লবণ পাচ্ছি না।”
“তিন নম্বর ড্রয়ারে হোয়াইট জারে আছে। জারের গায়ে ‘লবণ’ লেখাও আছে।”
সাঁঝ ‘আচ্ছা’ বলে প্রস্থান করল। হৃদ ল্যাপটপ নিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। ও ভুলেই গিয়েছিল এখানে সাঁঝ আছে। আর ওর যা ফ্রেন্ড সার্কেল! কখন কী বলে ফাঁসিয়ে দেবে বুঝতেই পারবে না।
রুমে এসে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল, সবাই কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হৃদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, “কী?”
সবাই একই সাথে বলে উঠল, “ওটা কে?”
হৃদ মাথা চুলকে হালকা হাসল। হৃদকে হাসতে দেখে ওদের সন্দেহ আরও প্রবল হলো।
ওদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে হৃদ বলল, “ও আমার ভার্চুয়াল বউ। সেই ডেয়ার নেওয়া বউ।”
রিয়াদ বড়ো বড়ো চোখ করে বলে উঠল, “শালা! তুই তো হেব্বি চালু আছিস।”
“হু, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”
সবাই নিজেদের বিস্ময় কাটিয়ে একসাথে হেসে উঠল। বিস্ময়টা কাটাতে হৃদ শুরু থেকে সবটা পরিষ্কার করে বলল।
কথাবার্তা শেষে হৃদ ল্যাপটপে বসে কিছু কাজ করছিল। অনেকক্ষণ বাদে হৃদ একটা ডাক শুনতে পেল, “শুনছেন? হয়ে গিয়েছে।”
সাঁঝের এভাবে বলা কথায় হৃদ ঠোঁট চেপে হাসল। নিজ জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে ডাইনিংয়ের উদ্দেশ্য পা বাড়াল।
সাঁঝ খাবারগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে হৃদকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এবার যাই আমি?”
হৃদ ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠল, “না।”
“ফুপ্পি খুঁজবে।”
“আমি ফোন করে উপমাকে বলে দিয়েছি।”
সাঁঝ চেতে উঠল। যেতে দেবে না কেন? রাগী কন্ঠে বলল, “তো কী করব এখন, আপনাকে পাহারা দেব?”
“খেতে বসুন।”
সাঁঝ ভয় পেয়ে শুকনো ঢোক গিলল। সাঁঝকে বসতে না দেখে হৃদ জোর করল না আর। বাঁকা হেসে কিচেনে চলে গেল। সাঁঝ দাঁত দিয়ে নখ কাটছে আর বোঝার চেষ্টায় আছে, হৃদ কী করছে।
কিছুক্ষণ বাদে হৃদ দু’টো ডিম ভেজে টেবিলে রাখল। সাঁঝকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এবার খান।”
সাঁঝ ভীত হয়ে খেতে বসল। হৃদ না খেয়ে সাঁঝের খাওয়া দেখছে। কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকলে খাওয়া হয়? হয় না তো, সাঁঝের ও হচ্ছে না।
কোনোমতে অর্ধেক রুটি শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “যাই?”
“না।”
“কেন?”
হৃদ পানির গ্লাসটা সাঁঝের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “ড্রিংক ইট।”
সাঁঝ পান করতে গেলেই হৃদ আবারও বাঁধা দিল। সাঁঝ অসহায় চোখে তাকাল।
“বসুন।”
সাঁঝ বসে ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে ওঠে বলল, “এবার যাই?”
“না।”
“আবার কী?”
“ড্রয়িংরুমে বসুন। সোফায় কিছু নোটস রাখা আছে, ওগুলো দেখতে থাকুন। যেগুলো বুঝবেন না, মার্ক করে রাখবেন, আমি খেয়ে আসছি।”
সাঁঝ আমতা আমতা করে বলল, “আমি… আমি কেন আপনার কথা শুনতে যাব?”
হৃদ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “বিকজ আ’ম ইউর ভার্চ্যুয়াল হাবি।”
“সেটা তো ভার্চ্যুয়ালে।”
“স্ক্রিনশট আপনার আব্বুকে দেব?”
“এই না। পড়ছি।”
সাঁঝ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সেখানে গিয়ে বসল। পিছনে ফিরে দেখল, হৃদ আরামসে সবজি-রুটি খেয়ে যাচ্ছে।
সাঁঝ ভ্রু কুঁচকে ধীর কণ্ঠে বলে উঠল, “খাচ্ছে কী করে এত লবণাক্ত খাবার?”
হৃদ শুনতে পেয়েও জিজ্ঞাসা করল, “কিছু বললেন?”
“নাহ! কী বলব? কিছুই নাহ!”
হৃদ আলতো হেসে পরম তৃপ্তি সহকারে এই লবণ ভরা খাবার খেয়ে শেষ করল। যেমনই হোক এতে তো প্রেয়সীর ছোঁয়া মিশে আছে।
এদিকে পড়তে পড়তে চুল সামনে চলে আসায় সাঁঝ সেটা কানের পিঠে গুঁজে নেয়। তখন কিছু একটা হাতে লাগতেই সাঁঝ কপাল কুঁচকে ফেলে। সামনে এনে দেখল, একটা শিউলি!
____________________
“কী রে সাঁঝ কোচিং-এ যাবি না?
“না-রে।”
“কেন?”
“পেট ব্যাথা করছে ভীষণ!”
“আরও ভাজা-পোড়া খা।”
সাঁঝ চুপ থেকে মলিন হাসল। উপমা আবারও বলল, “অদিতিও আসবে না আজ। একা একাই যেতে হবে।”
“ভাইয়াকে নিয়ে যা।”
উপমা কড়া চোখে তাকাল। যখন থেকে সাঁঝ এ বিষয়ে জেনেছে, তখন থেকেই এরকমটা করে যাচ্ছে। তবে, উপমা নিজেও চাইল, অর্ণব কে নিয়ে যেতে। তাই কিছু না বলেই প্রস্থান ঘটাল।
সাঁঝের কোনো পেটে ব্যথা না, তার মন ব্যথা। বিগত কয়েকটা দিন ধরে ‘অসুখ’ লাপাত্তা, কোনো খোঁজ নেই। সাঁঝের নিজে থেকেও মেসেজ দিতে কেমন যেন লাগছে। ওদিকে হৃদেরও খবর নেই। বাসায় থাকে খুবই কম সময়। বেশিরভাগ সময়টা হাসপাতালে ব্যায় করে। বলা যায়, ব্যস্ততা ড. অনয়কে খুব বাজে ভাবে গ্রাস করেছে।
উপমা যাওয়ার পরই সাঁঝ একটা ঠিকানাহীন চিঠি লিখে ফেলল গুটি কয়েক বাক্যের; যাতে মিশে ছিল মনের সকল ব্যথা।
“অ’প্রিয় অসুখ,
প্রিয় অনেকেই হয়, কিন্তু যে প্রিয়’র চেয়েও বেশি প্রিয় হয়ে যায় তাকে কী বলে সম্বোধন করব? এই ‘অ’প্রিয়’-এর মানে কিন্তু ‘প্রিয় না’ এমনটা নয়। এর মানে হচ্ছে ‘অধিকতর প্রিয়’।
অসুখ! আপনার অপূর্ণতা আমায় ক্ষণে ক্ষণে মারছে। সাক্ষাৎ দিন। বাঁচিয়ে দিন আমায়!
ইতি
আপনার সন্ধ্যা।”
চলবে…