প্রেমাসুখ #পর্ব_৩১ (খালি খালি ভাবটা) #লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

0
500

#প্রেমাসুখ
#পর্ব_৩১ (খালি খালি ভাবটা)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

সময়টা মাঝরাত। কুয়াশার টুপটুপ আওয়াজটা বৃষ্টির ধ্বনির ন্যায় কর্ণকুহরে ভেসে আসছে। পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে এই কুয়াশা রূপি বৃষ্টি উপভোগ করছে সাঁঝ। সে বড্ড গম্ভীর হয়ে খেয়াল করল, চারপাশে অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধতা কাজ করছে। তার মাঝে কুয়াশার মেঝে স্পর্শ করার শব্দটা বিকট শোনাচ্ছে। নিস্তব্ধতার প্রভাব এতটাই, যে সাঁঝ নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ অনেক গভীর ভাবে শুনতে পাচ্ছে। খুব করে অনুভব করছে হৃদকে। অন্য দিন হলে কী করত? হৃদকে কল দিত নিশ্চয়ই! আজ তা করছে না। নিজের অনুভূতির সাথে খেলছে। এতে যেন সে মজা পাচ্ছে। তার চেহারায় কোনো রকমের ভাব ভঙ্গি লক্ষ করা যাচ্ছে না। নির্বিকার হয়ে বসে আছে। হয়তো চাচ্ছে, কোথাও হারিয়ে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে? প্রশ্নটা তাকে বরাবরের মতোই ভাবাচ্ছে।

হঠাৎ সাঁঝের কোলের উপর রাখা ফোনটা বেজে উঠল। এখন আর সাইলেন্ট মুডে রাখে না। এই তো সেদিন, হৃদ সন্ধ্যে বেলায় সাঁঝকে ভার্সিটি থেকে নিতে এসেছিল। সাঁঝ ক্লাসে ছিল না। কল দিয়েছে পঞ্চাশোর্ধ। এরপর কিছুটা অভিমান সহ, একা ফিরে গিয়েছিল হৃদ। সাঁঝ তো আয়াত আর প্রণবের সাথে বটতলায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আর অভ্যেসবশত ফোনটা ছিল সাইলেন্ট মুডে। কী বাজে ঘটনাই না ঘটেছিল! তারপর থেকে আর সাঁঝ নিজের ফোন সাইলেন্ট মুডে রাখার সাহস পায়নি।

তড়িঘড়ি করে ফোনটা উঠিয়ে রিসিভ করল সাঁঝ। সে নিশ্চিত, এই অসময়ে অন্য কেউ তাকে কল করবে না।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হৃদ বলল, “ঘুমোওনি?”

“চেনেন না আমায়?”

“হু, এজন্যই কল দিলাম। যদি তোমার ঘুমনোর সম্ভাবনা ১%ও হতো, তবে কল দিতাম না।”

সাঁঝ হালকা হেসে বলল, “আপনার তো এই সময়ে ঘুমনোর সম্ভাবনা ৯৯.৯৯%। ঘুমোননি কেন?”

“অভ্যেস পরিবর্তনশীল।”

“উঁহু, ভুল বললেন।”

“কী?”

“নারী সংস্পর্শে পুরুষের অভ্যেস পরিবর্তনশীল।”

হৃদ এতক্ষণে হাসল। তবে অন্য আরেকটা কারণে আবারও তার হাসি মিইয়ে গেল। গম্ভীর ও কাতর স্বরে বলল, “তুমি পরিবর্তন হচ্ছ, সাঁঝ!”

“হু।”

“শুধু ‘হু’?”

“হু, কারণ এটা আমার জানা বিষয়।”

“তুমি বড্ড অপরিচিত লাগছ।”

“শুধুমাত্র আপনার কাছে।”

“কেন? তুমি কি এটা লক্ষ করছ না?”

“করেছি।”

“তবে? নিজেকে অচেনা লাগছে না?”

“লাগছে না। আমার এই সত্তার সাথে আমি পরিচিত। আমার চেনা সবাই পরিচিত।”

হৃদ বুঝতে পারছে না। চুপ করে আকাশপানে তাকিয়ে রইল। পরনে হুডি। এক হাত পকেটে ও অন্য হাতে ফোন কানে। চাপা কয়েকটা শ্বাস ফেলল হৃদ।

কিছুক্ষণ পর সাঁঝ ডাকল, “ডাক্তার সাহেব!”

হৃদ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, “বলো।”

সাঁঝ অস্থির ও উত্তেজিত হচ্ছে। অশান্ত স্বরে বলল, “আমি আবারও আগের ফর্মে চলে যাচ্ছি। সেই সাঁঝে পরিণত হচ্ছি, যেই সাঁঝকে প্রথম দেখে মায়ায় জড়িয়েছিলেন।”

“চেঞ্জ হয়েছিলে কেন?”

“মানুষ কখন নিজের সত্তা হারায়? আপনার কী মনে হয়?”

হৃদ বেশ কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করল, “প্রেমে পড়লে?”

“হু, প্রেমে পড়েছিলাম এক…”

সাঁঝের কথা শেষ করতে দিল না হৃদ। মিষ্টি হেসে বলল, “ভালোবাসি তোমায়।”

সাঁঝ চোখ বন্ধ করে অনুভব করল। হৃদ আবারও বলল, “ভালোবাসি… ভালোবাসি… ভীষণ ভালোবাসি তোমায়। লোকে বলে, এসব কথা বারবার বলতে নেই। আমি বলি, যতবার নিঃশ্বাস নিচ্ছ, পারলে ততবারই অপর ব্যক্তিকে মনের এই অনুভূতিটা জানিয়ে দাও। লোকে বলে, এসব এত বেশি বললে নাকি সস্তা শব্দ হিসেবে খ্যাতি পায়। কিন্তু আমি বলি, বারংবার বলে যাও, ‘ভালোবাসি’; সেও তোমায় ভালোবাসলে, নতুন লাগবে তার কাছে, যতবার শুনবে। তুমি কী বলো?”

সাঁঝ চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। তার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। চিৎকার করে পুরো দুনিয়াকে সাক্ষী রেখে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, “ভালোবাসি, ডাক্তার সাহেব! আপনাকে ভালোবাসি।”
কিন্তু বলতে পারছে না। হয়তো তার অতীত তাকে আটকাচ্ছে।

হৃদ জিজ্ঞেস করল, “কী?”

সাঁঝ সেই থামিয়ে দেওয়া কথাটা আবারও বলার উদ্দেশ্যে বলল, “শুনবেন না?”

“কোনটা?”

“আমার টক্সিক লাভ স্টোরি।”

“উঁহু, শুনব না।”

“কেন? ছেলেরা তো এসব ব্যাপারে ভীষণ সোচ্চার। সবটা জানার পর বেশির ভাগ ছেলেই সম্পর্ক কন্টিনিউ করে না। তারা তো আবার সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস পছন্দ করে না।”

“ফার্স্ট অফ অল, তুমি কোনো জিনিস নও। আর রইল তোমার পাস্ট! সেটা আমার জানা।”

সাঁঝ চমকিত হল। তার গলার মাঝে কথা আটকে গেল। স্বর বেরোচ্ছে না। খানিকটা সময় পর বলল, “কীভাবে জানলেন?”

“তোমার চিঠি পড়েছিলাম।”

“চিঠি!”

“হ্যাঁ, তোমার অ’প্রিয় অসুখের চিঠি। পড়ানোর সময় তোমার বই থেকে পেয়েছিলাম।”

“আমাকে এই বিষয়ে কিছুই বললেন না?”

“না। তোমার সেই বয়সটাই সেরকম ছিল। তাছাড়া মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়।”

সাঁঝ ডুকরে কেঁদে উঠল। হৃদ অশান্ত কন্ঠে বলল, “হুশ! পাগলী মেয়ে! কাঁদে না লক্ষ্মীটি।”

“আপনি আমায় এত ভালোবাসেন?”

“না। আমি তোমায় শুধুই ভালোবাসি। ভালোবাসা মানেই ভালোবাসা। এটা ভয়ঙ্কর রকমের ভালোলাগার অনুভূতি। কোনো প্রোডাক্ট নয় যে, কম বেশি হবে।”

সাঁঝ কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “বিয়ে করবেন কবে আমায়?”

“তোমার অনার্সটা শেষ হোক। এরপর।”

“আপনাকে খুন করে ফেলব। এই চার বছরে যদি অন্য কেউ এসে আমার কাছ থেকে আপনাকে ছিনিয়ে নিতে চায়?”

“পারবে না। আমি শুধুই তোমার।”

“আপনাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। একে তো আপনি পুরুষ মানুষ। তার উপর যদি কেউ কলোজাদু করে!”

“সিরিয়াসলি, সাঁঝ! তুমি এসব বিশ্বাস করো?”

“না করার কী আছে? আমাদের এলাকার এক আপা আছে। তিন বছরে তিনশরও বেশি ছেলে তাকে দেখতে এসেছিল। কোনো না কোনো কারণে একটাও সম্বন্ধ বিয়ে অবধি গড়ায় না। তারপর এক চাচি, কোত্থেকে যেন একটা কবিরাজ ধরে আনল। সেদিন যেই ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছিল, এসেই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। শুনেছি, বিরিয়ানি পড়া খাইয়েছিল।”

হৃদ সামান্য বিরক্ত হয়ে ডাকল, “সাঁঝ!”

“কী?”

“এই আজগুবি কাহিনী আমাকে শোনাচ্ছ কেন?”

“আজগুবি কীসের? আর…”

“কী? বলো।”

“আর আমি ইনসিকিউরড ফিল করছি।”

হৃদ কোমল কন্ঠে ডাকল, “সাঁঝ!”

“হুম।”

“কবে বিয়ে করতে চাও? বলো।”

“খুব শীঘ্রই।”

“যথা আজ্ঞা, সন্ধ্যাবতী। খুউব শীঘ্রই তোমার বাবার কাছে বিয়ের প্রপোজাল দেব। তোমাকে তো দিয়েছি সেই শুরুতেই। কী যেন বলেছিলাম…? হেই মিস, উইল ইউ বি মাই মিসেস? আর আপনি? সাথে সাথে কবুল করে নিলেন। যদি অন্য কেউ হতো?”

“আমি রেগে ছিলাম।”

“রেগে ছিলে! রাগলে তো মানুষ ব্লক দেয়, তুমি কী করলে?”

“আচ্ছা, মানলাম আমি ভুল করেছি। কিন্তু আপনি কী করলেন?”

“কী করলাম?”

“আমার জায়গায় যদি অন্য কোনো মেয়ে হতো?”

“হলে হতো!”

সাঁঝ রেগে যাচ্ছে। তেজি কন্ঠে বলল, “দেখুন! ভালো হবে না।”

“খারাপও হতো না।”

“হতো। অনেক খারাপ হয়ে যেত। আপনাকে আমি না পেলে, অন্য কারোর হবার জন্য রাখতামও না।”

“কী করতে?”

“খুন করে ফেলতাম।”

“বার বার ‘খুন করবে’-‘খুন করবে’ বলছ কেন? পারবে?”

“পারব। অবশ্যই পারব।”

“আচ্ছা, তবে কর।”

“বলেছি, আপনার উপর পরনারীর ছায়া পড়লে, তবেই করব। তাছাড়া বরহারা হব কেন?”

“আচ্ছা!”

“কী?”

“ভালোবাসি।”

সাঁঝ হাসল। মিষ্টি কন্ঠে বলল, “থ্যাংক ইউ।”

হৃদ হতভম্বের ন্যায় জিজ্ঞেস করল, “ভালোবাসা=থ্যাংক ইউ?”

সাঁঝ হাসতে থাকল। সে ভেবে রেখেছে, মুখ ফুটে ‘ভালোবাসি’ বলবে সেদিন, যেই দিনটা জীবনের সবচেয়ে স্পেশাল দিন হবে।

হৃদ আবারও বলল, “বলো ভালোবাসি। একবার বলো।”

“স্যরি!”

“হায় রে! এই মেয়ে স্যরি, থ্যাংক ইউ সব বলছে। শুধু ভালোবাসিই বলছে না।”

“বারান্দায় আপনি?”

“জি হ্যাঁ।”

“আমিও।”

“জানি।”

সাঁঝ এক হাত এগিয়ে বলল, “ফুল দিন।”

হৃদ মুচকি হেসে তিনটি শিউলি ফুল খুব যত্ন সহকারে সাঁঝের দিকে দিল। একটা ফুল গিয়ে পড়ল সাঁঝের হাতে। সাঁঝ গুনগুন করতে করতে সেটা কানে গুঁজল। কিছুক্ষণ পর সাঁঝ বলল, “ডাক্তার নিজেই অসুখ ছড়াচ্ছে! বাহ্! বাহ্! চমৎকার!”

_____________________
সাঁঝ ও উপমা সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিল। কিছুদিন ভার্সিটি অফ। আরিফ সাহেবও সেদিন সাঁঝকে কল দিয়ে আবেগী হয়ে পড়েছিলেন। অনেক আদরের মেয়েটাকে কতমাস হয়ে গেল, চোখের দেখা দেখেন না। সে কষ্টে তাঁর হার্টের প্রবলেমও বেড়েছে। সেজন্য সাঁঝ ও উপমা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। হৃদ বাস স্টপেজ অবধি এগিয়ে দিয়ে এসেছে।
পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাজল একটা। উপমা ভীষণ টায়ার্ড। বাসে বমি-টমি করে একাকার। জার্নির অভ্যেস তার একদমই নেই। যতবার এসেছে, ততবারই একই অবস্থা। শাওয়ার নিয়ে ঘুমোতে গেল।
অর্ণব অফিস থেকে ফেরেনি। আরিফ সাহেব সাঁঝের আসার পরই মেয়েকে নিয়ে বসে আছেন। সুমিতা বেগম উপমার খেয়াল রাখছে। মুখটা শুকিয়ে কেমন যেন হয়ে আছে উপমার। এই নিয়ে সুমিতা বেগমের যত দুশ্চিন্তা! সাঁঝকে সে যতটা ভালোবাসে ঠিক ততটাই উপমাকেও ভালোবাসে। ছেলে বিয়েই দিয়েছে মূলত এই মেয়েটাকে কাগজে কলমে নিজের মেয়ে বানানোর জন্য।

সাঁঝ আরিফ সাহেবের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আরিফ সাহেব মেয়ের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন। ছোট বেলায় যখন সুমিতা বেগম অর্ণবকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকত, তখন আরিফ সাহেব মেয়ের খেয়াল রাখতেন। রাতে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। এর ফলে সুমিতা বেগমের উপর দিয়ে যে ধকল যেত, তা খানিকটা লাঘব হতো।

পুরোনো দিনের কথা ভেবে আরিফ সাহেব মিহি হাসলেন।

সাঁঝ তখন ডাকল, “বাবা!”

আরিফ সাহেব জবাব দিলেন, “হু, মা। বল।”

“বলছি, কেমন আছ?”

“আলহামদুলিল্লাহ, তুমি?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

সাঁঝ কিছুক্ষণ থেমে আবারও ডাকল, “বাবা!”

“হু, শুনছি। বল।”

“খালি খালি লাগে না?”

“খালি খালি লাগবে কেন? তোমার আম্মু আছে, ভাইয়া আছে। তোমার অভাব বোধ করতাম। এখন তুমিও চলে এসেছ। আর উপমাও আছে।”

“আরে! বুঝতে পারছ না?”

সাঁঝ আরিফ সাহেবের কোল থেকে মাথা তুলে পাশে বসল। উৎসাহিত কন্ঠে বলল, “দ্যাখো আব্বু, আম্মু যেমন খালি খালি ভাবটা কমানোর জন্য উপমাকে আনল। তুমিও একটু ভাব।”

“আর কী ভাবব? উপমাকে তো এনেছেই।”

সাঁঝ কপালে হাত চাপরে উঠে গেল। এখন নিজের বিয়ের কথা কি নিজে বলবে?
আরিফ সাহেব হাসতে লাগলেন। তিনি বিষয়টা বুঝেছেন। সুমিতা বেগম কিছুক্ষণ পর এলেই আরিফ সাহেব ব্যাপারটা খুলে বললেন।

সুমিতা বেগম জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করতে চাচ্ছ?”

আরিফ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, “মেয়েতো বড়ো হয়েছেই। কথা বলে দেখি।”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here