সন্তান পর্ব- ৩ -লাবিবা ইরম

0
754

এক ভন্ড পীরবাবার কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো। সেই পীরবাবা যে অত্যাচার করেছে তদবীরের নামে সেটা আর বলার মতো না। আল্লাহ আল্লাহ বলে মাথা নাড়ায়, রুমে যখন নিয়ে গেলো আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সুরা ফাতেহা পারেন?” এই লোক চোখ বড় বড় করে তাকালো৷ আমি আরো কিছু সুরার নাম, আয়াত পড়ে শুনিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সে জানে নাকি এগুলো। তখন তার তথাকথিত মুরিদ মহিলারা আমাকে ধরে বের করে দিলো। এই ঘটনা নিয়ে আমিন আর আমার শাশুড়ি বেজায় রাগ আমার উপর৷ তবে আমিও বলেছি যে এই পীরের নামে আমি রিপোর্ট করবো পুলিশে। এরপর পীর নামক যন্ত্রণা থেকে বাঁচা গেছে। আমি আমিনের সাথে ঠান্ডাভাবে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছি যে কেন ওদের বংশের প্রথম সন্তান ছেলেই হতে হবে? ওরা এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে যে নিজের সন্তানকেও অন্য কাউকে অন্যায়ভাবে দিতে দ্বিধাবোধ করছেনা? এটির কি কারন থাকতে পারে? অবশ্য আমিন এটি নিয়ে মুখ খোলেনি তবে হাবভাবে যা বুঝলাম যে কিছু তো একটা আছে।

১৫.১১.৯৩
আমার বেতন যেদিন দেয়, আমিন আমার সাথে ব্যাংক এ যায় এবং বেতন ওঠানোর সাথে সাথে তা নিয়ে যায়। আমি ব্যাংকের ম্যানেজারকে অনেক অনুরোধ করে আমার পরিস্থিতি বুঝিয়ে এটা বলেছিলাম যেন আমার বেতনের থেকে ৫ হাজার টাকা কম বলে। উনি আমাকে সাহায্য করেছেন। আমিন আমার বেতন যা জানে তার থেকে ৫ হাজার টাকা বেশি পাই আমি যেটা একাউন্টে থেকে যায়৷ আমি আমার জন্য এই টাকাটা রেখে দিই। আমার দিনগুলো কি এভাবেই যাবে? আগের হাসপাতালে যে নার্স, আয়াদের সাথে যোগাযোগ আমার হয়েছে এটাও ওরা জেনে গেছে। সম্ভবত ওর বন্ধু আমাকে হাসপাতালের আশেপাশে দেখেছে। এখন আবার আরেক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। ডাক্তারেরা নানারকম টেস্ট দিয়েছে। এদের ধারণা আমারই কোন এক সমস্যার জন্য ছেলে সন্তান হচ্ছেনা আমাদের। আমি শুধু এই মূর্খদের কথা শুনি আর হাসি!

১৬.১২.৯৩
মাঝে মাঝে আমার নিজের ভাগ্যের উপর খুব অভিমান হয়। মা মারা গেলেন ১০ বছর বয়সে। আমার শাশুড়ি তখন খালা ছিলেন বলেই হয়তো এত যত্ন করতেন। বাবা আর বিয়ে করলেন না। বড় ভাইয়ের বয়স তখন ১৪। বাবা আমাদেরকে লেখাপড়া করাতেন। কোন প্রয়োজন হলে এই আমার শাশুড়িই তো এগিয়ে আসতেন। তার সাপোর্টেই আমি বি.এ পাশ করে চাকরীটাও পেলাম। বড় ভাই লেখাপড়া ছেড়ে বিদেশে গেলেন। তারপর থেকে সব উলটপালট হয়ে গেলো। যেই মানুষটা খালা হিসেবে চোখে হারাতেন, শাশুড়ি হয়ে তিনিই পারলে কথায় কথায় মারেন আমাকে। আমার খালু মানে আমার শ্বশুর মানুষটা ভালো ছিলেন অনেক৷ তিনি মারা যাওয়ার পর খালা এত সম্পদের মালিক হয়ে অত্যন্ত অহংকারী আর একরোখা হয়ে উঠেছেন। আমি শুধু আল্লাহর কাছে আমার এই অবস্থা থেকে মুক্তি প্রার্থনা করি।

০১.০১.৯৪
বছরের প্রথম দিনেই বাসায় আব্বা আসলেন। আমি তো খুশি হয়েছিলাম, ভেবেছি আমাকে দেখতে এসেছেন। শুনলাম টাকা নিতে এসেছেন আমার শাশুড়ির কাছে। শাশুড়ি বললেন এবার ছেলে একটা হলে এক লাখ টাকা দিব আপনাকে দুলাভাই। পর্দার আড়াল থেকে এ কথা শুনে নিজেকে একটা গাভীর মত মনে হচ্ছিলো। এত কান্না পেলো যে আব্বার সামনেও যাই নাই আর। আব্বাও দেখা করতে আসলেন না ভিতরে৷ বাইরে থেকেই চলে গেলেন।

১৭.০৩.৯৪
গতকাল আমিনের কাছ থেকে এক মজার তথ্য জানলাম। মূলত আমিনের দাদার দাদা নাকি একবার কোন এক পীরবাবার কাছে গিয়েছিলেন সন্তান লাভের আশায়। সেই পীরবাবা নাকি তাকে বলেছিলো যে এই বংশের যেসব পুত্রবধূদের কোলে প্রথম সন্তান ছেলে হবে তারাই বাঁচবে। কোন মেয়ে সন্তান বাঁচবেনা৷ আর যদি বেঁচে যায় সে এই বংশ শেষ করবে। তাই কোনভাবেই প্রথম সন্তান মেয়ে হতে পারবেনা। কাকতালীয় ভাবে ওর দাদার দাদার ঘরে প্রথমে পর পর দুটি মৃত মেয়ে হয়েছিলো। তারপর ছেলেটা হয়েছিলো, সে-ই ওর দাদার দাদা। এরপর থেকে নাকি ওদের বংশে সবসময় প্রথম সন্তান ছেলে হয়। খালি আমাদেরই হয়নি এখনো। অবশ্য আমিন আর আমার শাশুড়ির কর্মকান্ড দেখে আমার সন্দেহ হচ্ছে সে সময়েও কি আসলেই দুটি মৃত মেয়ে হয়েছিলো? আর এত বছর ধরে ওরা এগুলো লুকিয়ে রেখেছে? খালু নিশ্চয়ই এসবে বিশ্বাস করতেন না। নাকি করতেন বুঝতে পারছিনা, এখন আর কোন মানুষকে আমার বিশ্বাস হয় না।

শিউলি খেয়াল করে এরপর দুটো পাতা ছেঁডা। ও ডায়রিটাকে ওলটপালট করে দেখতে থাকে ছেঁড়া পাতা দুটো আছে কি না। ওর মনে হয় ও জাহানারার ডায়রী না, কোন রহস্য গল্প পড়ছে। ছেঁড়া পাতা দুটো পায় না। এদিকে জাহানারাকে জিজ্ঞেস করার কোন উপায় নেই। বোঝাই যাচ্ছে, জাহানারা অনেক সন্তর্পণে এই ডায়রী এতদিন আগলে রেখেছে। তাই এটি নিয়ে বাইরে কথা বলাও জাহানারা পছন্দ করবেন না। শিউলি চিন্তা করতে থাকে, তার শ্বশুর, আমিন, তাকে বেশ ভালোবাসে। তাছাড়া বেশ শান্তশিষ্ট উনি, কোনকিছুতেই কোন অভিযোগও করেন না। এমন কি বাজারে যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করেন, “মা, কি আনবো তোমার জন্য?” কখনোই মা ছাড়া সম্বোধন না করা এই মানুষটা কি আসলেই এমন নির্দ্বিধায় নিজের মেয়ে সন্তান কে আরেকজনের হাতে তুলে দিতে পারে? এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?

এসব ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে যায়। শিউলি ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রতিদিনের কাজকর্মে। জাহানারা এখনো হাসপাতালে, তার ঝুঁকি এখনো কাটেনি তাই ডাক্তারেরা অবজারভেসন এ রেখেছেন। শিউলিও সব নিজ হাতে চেক করছে যেন জাহানারার চিকিৎসার ত্রুটি না হয়।

দুপুরবেলায় জাহানারার কেবিনে বসে আছে শিউলি। শিউলির মাথায় হাত বুলাচ্ছেন জাহানারা।
হঠাৎ বললেন-“তুই এমন শুকিয়ে গেছিস কেন? খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছিস নাকি?”

“কি যে বলো মা! খাচ্ছিই তো ঠিকমতো। তুমি না থাকলে ভালো লাগেনা!” শিউলি একটু হেসে উত্তর দেয়।

“ভালো না লাগলে কিছু করার নেই। অভ্যাস কর, তোকে বিয়ে দিব এবার। আর কতদিন একা থাকবি? এভাবে ঘরে রাখা যাবেনা!” একটু বকার সুরেই জাহানারা বললেন।

“আহা! কয়বার বিয়ে করবো? আমি তোমাদেরকে ছেড়ে যাবো না। বিয়ে করবো না আর!” আবদারের সুরে এ কথা বলে জাহানারা বুকে মাথা রাখে শিউলি।

“এভাবে তোর জীবন নষ্ট হবে নাকি! তোর জীবন নষ্ট হতে দিবো না আমি থাকতে। ভালো একটা ছেলে দেখে ,পরিবার দেখে বিয়ে দিব! তারপর তোর ছেলেমেয়ে হবে, তাই দেখে যদি মরতে পারি আমি! মেয়ে হলে আমি খুশী হবো…”
বিড়বিড় করতে থাকেন জাহানারা।

এদিকে জাহানারার বুকে মাথা দিয়ে বসে থেকেই শিউলি ঘুমিয়ে পড়েছে। এটা দেখে জাহানারার বুক ভেঙে কান্না পেয়ে যায়। মেয়েটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কখন যেন চোখ ভেঙে পানির ধারা নেমে আসতে থাকে…

শিউলির সমস্ত দিনের কাজের মধ্যেও মন পড়ে থাকে ডায়রীতে। সারাদিন ঘটনাগুলো মাথার মধ্যে জট পাকায়। জাহানারাকে জিজ্ঞেসও করতে পারছেনা কিছু। রাতে সব কাজ শেষে এসে বসে পড়ে আবার ডায়রী নিয়ে-

১৪.০৪.৯৪
সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে ওরা। আমি লুকিয়ে ওষুধ খাচ্ছিলাম, তবে লুকাতে পারিনি। আমিন জেনে গেছে৷ কথা কাটাকাটি থেকে মারধোরও করেছে। আমি জিম্মি হয়ে গেছি। একবার চিন্তা করি আব্বা আর ভাইয়ের পরোয়া না করে নিজের দিকে দেখি৷ কিন্তু পরেই মনে হয় এতটা স্বার্থপর কিভাবে হবো? আমার জন্য আমার আব্বা, ভাই কষ্ট পাবে? সেদিন আবার শুনছি আমার শাশুড়ি তার কোন পরিচিত লোকের মেয়ের সাথে আমার ভাইয়ের বিয়ে দিতে চায়। ও এমনিতেই ইনকাম করেনা, বিয়ে দিলে তো আরো আটকিয়ে যাবে। আমি ভাইকে এখন বিয়ে দিতে না করলাম। ভাই উলটা আমাকে কথা শোনালো। বললো আমি নাকি তাদের ভালো দেখতে পারিনা। ভেবেছি আর ওদেরকে নিয়ে কথা বলবো না।

২৮.৫.৯৪
আবারও আমার মাঝে এক সন্তানের অস্তিত্ব। আমার রীতিমতো গা কেঁপে যায় এখন এই ব্যাপারটায়। আমি আল্লাহর কাছে এবার খাস দিলে দোয়া করছি যেন সন্তান টা আসলেই ছেলে হয়। আমি বার বার আমার সন্তানদের হারাতে চাই না।

১৮.০৬.৯৪
এবারে অতিরিক্ত শরীর খারাপ করছে৷ আমি এত দোয়া করছি আল্লাহর কাছে। জানিনা আল্লাহ আরো কত পরীক্ষা নিবেন আমার।

২৮.০৭.৯৪
এবারে আল্লাহই চাইলেন না আমার সন্তান বাঁচুক। চারদিন আগে ব্লিডিং শুরু হলো। বাচ্চাটা আমার পরিপূর্ণতা পাওয়ার আগেই আমার কাছ থেকে বিদায় নিলো। হয়তো এটা আরো ভালো হলো। এখনো শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না। আল্লাহ জানেন কি আছে সামনে।

১৩.০৮.৯৪
আমিন আর আমার শাশুড়ির ধারনা বদনজর লেগে বাচ্চাটা মারা গেছে। কিন্তু ডাক্তার বলছেন, আমার মানসিক হতাশা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ঠিকমতো না খাওয়া এসবের কারনে এই অবস্থা। আমার স্বামী এবং শাশুড়ি এটা নিয়ে আমাকে কথা শোনালেন যে আমার দুশ্চিন্তা কেন? আমার কি খাবারের অভাব? কত আলিশান ভাবে আছি। কোনকিছুর তো কমতি নেই। আমি মনে মনে বললাম, কমতি নেই কোনকিছুরই শুধু মনুষ্যত্ব টাই নেই।

সন্তান
পর্ব- ৩
-লাবিবা ইরম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here