জরুরি কাজে সচিবালয়ে এসেছি, আমার অনলাইন পোর্টালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র হার্ডকপি ছাপা হয়ে আসবে। সেখানে তথ্যমন্ত্রীর একটা শুভেচ্ছা বাণী লাগবে। তথ্যসচিবের সাথে লিংক করে রেখেছি, তিনি বলেছেন বের করে দেবেন। বাণী আমি লিখে নিয়ে এসেছি, মাননীয় মন্ত্রীমশাই অনুমোদন দিয়ে সাইন করে দিলেই হলো। আজকেই কাজটা হয়ে যাওয়া দরকার। আজকের পাসই এরেঞ্জ করে দিয়েছেন ছোটোখালু। ছোটোখালুর সাথে নৌপরিবহন মন্ত্রীর একটা যোগাযোগ আছে, রাবারবাগানে জমি কেনা-বেচা সংক্রান্ত। সেইসূত্রে তিনি আমাকে একটা পাস বের করে দিয়েছেন। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যায় যায়, আমি অপেক্ষা করছি। না তথ্যসচিব অফিসে এসেছেন, না মন্ত্রীর কাছ থেকে এপ্রুভালের সুপারিশ পাচ্ছি!
বিরক্তি চরমে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ আসার নোটিফিকেশন পেতে লাগলাম একের পর এক। মেসেঞ্জার কনভার্সেশনের স্ক্রিনশট। পঁয়তাল্লিশটা। সজীব পাঠিয়েছে। মনটা তেতো হয়ে গেল। এই ছেলেটার কাজ নেই? পড়াশুনা নেই? এসব কেন ঘাটাঘাটি করছে। এসব ঘাটতে গেলে পড়বে কখন? কটাদিন বাদেই পরীক্ষা। আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে এসবে, কিন্তু ওর জন্য সহ্য করা কষ্টের আমি জানি। তবু্ও ফোন করে বকলাম ‘আর কাকে কাকে বলেছিস?’
‘তোমাকে আর বড় আপাকে।’
‘ছোটো আপাকে বলিসনি?’
সজীব একটু ইতঃস্তত করে বলল ‘মেসেজ দিয়েছি, সিন করেনি।’
আমি শব্দ না করে হাসলাম ফোনের এইপাশে ‘আর সাব্বিরকে?’
‘হুম, ছোটোভাইয়াকেও মেসেজ দিয়েছি। কিন্তু আম্মাকে কিছু বলিনি, কসম!’
আম্মাকে বলা আর না বলা সমান আমি জানি। ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবে কিছুক্ষণ। না খেয়ে থাকবে। সিনক্রিয়েট করবে। আত্মহত্যার ভয় দেখাবে। কিন্তু আব্বা দুএকটা কী বোঝাবে, একটা আধটা গয়না কিনে দেবে, নইলে ডিজাইনার শাড়ি। আম্মা সব ভুলে যাবে। ভোগান্তি, লজ্জা, অপমান সবই যেন আমাদের। এখন আর ওসব ভালো লাগে না। আমি সজীবকে মানা করলাম ‘বলার দরকার নেই। এগুলো কোনো ব্যাপার না। আব্বা একটু মজা করে।’
‘এগুলো মজা? কী নোংরা কথাবার্তা!’
‘আব্বা তো বলেনি। ওই মহিলাই বলেছে।’
‘আব্বা প্রশ্রয় না দিলে ওই মহিলার সাহস হয় এগুলো বলার?’
সজীব ক্ষেপে গেছে। ইমোশনে টইটম্বুর হওয়ার বয়সই এটা। এসএসসি পরীক্ষা দেবে। সামনেই পরীক্ষা। মনে পড়ল ওই মহিলার ছেলেটাও এসএসসি দেবে। ভালো ছাত্র শুনেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় শুধু আমরাই কেন মনোঃকষ্টে ভুগব? আর ওই নোংরা মহিলার ছেলে ঠিকই ধুমিয়ে পড়াশোনা করে রেজাল্টের দিন ভিক্টোরি সাইন দেখাবে? ছেলেটার ফোন নম্বর আছে আমার কাছে। সভ্যতা, ভব্যতা ভুলে, বিবেক বিবেচনা আকাশে উঠিয়ে রেখে ওই মহিলার ছেলেটাকে ফোন করে বলতে ইচ্ছে করে ‘তোর মার এত রস হইছে, তো একটা নাঙভাতার ধরে এনে দে না! এর ওর ক্ষেতে মুখ দিয়ে বেড়াচ্ছে! আমার বাপের পেছনে হাত ধুয়ে কেন পড়েছে রে!’
বলা হয় না। ছেলেটা যদি বলে বসে ‘আপনার বাবাকেই সামলে রাখেন না কেন?’
আসলেই এই সাবিনা খানের কী দোষ! এরকম কত জয়া, চৈতি, প্রীতি দেখে এসেছি আমরা! সজীবের বয়সে এইরকম আবেগি আমিও ছিলাম। সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছি তখন। নাকের নিচে পুরান ঢাকার গলির মতো চিকন গোঁফের রেখা। আব্বাকে দেখে তখনো কেউ বলত না, কলেজে পড়া এত বড় একটা ছেলে আছে তার। লম্বা, চওড়া ছাতি, মেদহীন সুঠাম অবয়ব আর গালভরা চমৎকার হাসি। ফেইরিটেলের প্রিন্স চার্মিং, সেই বয়সেও, কলেজে পড়া ছেলের বাবা হয়েও। আমার পরপর আরও চারটা ভাইবোন – আমার বাবাকে দেখে তাকে সেই পঙ্গপালের জনক কেউ বলবে না। আমারও একটা সময় মনে হতো আমাদেরকে হয়তো এতিমখানা থেকেই উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আমার বান্ধবীরা পর্যন্ত আব্বার উপর ক্রাশ খেয়ে মুখে ফেনা তুলত। আমারই ক্লাসমেটরা আমারই সামনে আমারই আব্বাকে ডাকত ‘রাজিব ভাই’, আমি তখনো উপভোগ করতাম ব্যাপারটা এবং এখনো করি। কিন্তু আমার অন্য ভাইবোন সবার জন্য এটা সমান উপভোগ্য ছিল না। আমার পিঠাপিঠি বোন শিমু। ক্লাস নাইনের ছাত্রী ও তখন। আব্বার সাথে আব্বার অফিসে গিয়েছিল ও। আব্বার এক কলিগ ওকে দেখেই চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন ‘রাজিব ভাই তোমার বাবা?’
‘হ্যাঁ।’
শিমুর উত্তর শুনে লোকটা বেশ অবাক হয়ে, দুইচোখ আকাশে তুলে বলেছিলেন ‘কেমন বাবা?’
শিমু খুব ক্ষেপে গিয়েছিল। বাড়িতে এসে লোকটাকে ইচ্ছামত গালাগাল করেছিল ‘বাবা আবার কেমন হয়? চাচতো বাবা, খালাতো বাবা হয় নাকি? কেমন বাবা- এইটা কেমন কথা? আমি যদি এডপ্টেড বাচ্চা হতাম, এই কথাটা শুনে আমার কতটা কষ্ট হতো, বল ভাইয়া?’
‘আরে, কিছু লোক থাকেই ওইরকম অসভ্য! কথার ব্যালেন্স থাকে না। একটা বলে দিলেই হলো।’
সান্ত্বনা দিয়েছিলাম আমি শিমুকে।
কাজটা হলো না। মন্ত্রী আর তথ্যসচিব কেউই আজ অফিস করেননি আজকে। নতুন একটা বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল অন এয়ার হচ্ছে আজ। সেটার কার্যক্রম উদবোধন করতে গেছেন।
আরেকটু খোঁজখবর নিয়ে আসা উচিত ছিল। পাসটা নষ্ট হলো। পোর্টালটা দাঁড় করাতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছি। অনেক চেষ্টা করেছেন আব্বা, কিন্তু তার মত শাইনিং, গ্লোরিয়াস ক্যারিয়ার আমার হয়নি। মাল্টিন্যাশনালের হাইঅফিশিয়ালের ছেলে একটা অনলাইন পোর্টাল দাঁড় করাতে মাথা খুটে মরছি। নিজের খরচই চালাতে পারি না, আব্বার কাছেই এখনো হাত পাততে হয়। বড়োছেলে হিসেবে এটা যে কত লজ্জার সেটা আমার জায়গায় না থাকলে কেউ বুঝবে না। আব্বা প্রতিনিয়ত উৎসাহ দেন, সাপোর্ট দেন। বাবা হিসেবে আমার আব্বা আদর্শ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুইহাতে আয় করেছেন, আমাদের পেছনে চারহাতে ব্যয় করেছেন। লক্ষ টাকা বেতনে চাকরি করেও ঢাকা শহরে আব্বার কোনো রিয়েল প্রপার্টি নেই, এই কথাটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।
সচিবালয় থেকে বেরিয়ে এলাম। চড়চড়ে রোদ। ভেতরের এসির ঠান্ডা হাওয়া থেকে বেরিয়ে হঠাৎ গরমে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। টিএসসিতে যেতে হবে। সিন্থিয়া অপেক্ষা করে আছে। সকাল থেকে আসছি আসছি বলে বসিয়ে রেখেছি ওকে। রোদের তীব্রতা দেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। মাথাব্যথা করছে। সকালে না খেয়ে বেরিয়েছি। এখনো কিছু খাওয়া হয়নি। কয়েক কাপ চা পেটে গেছে। এসিডিটি হয়ে পেটেও ব্যথা শুরু হয়েছে। বাসায় যেতে পারলে ভালো লাগত। মা কী রান্না করেছে দুপুরে? মায়ের কথা মনে পড়তেই সজীবের মেসেজগুলো মাথায় এলো। বাসায় কি রান্না হয়েছে আজ?
গরমটা এখন সয়ে যেতে শুরু করেছে। রোদটা এখন ভালো লাগছে। আমি হাঁটা শুরু করলাম। মিনিট বিশ লাগবে হেঁটে গেলে।
ফোন বাজছে। পকেট থেকে বের করে নাম দেখতে পারলাম না। মোবাইল স্ক্রিনের ব্রাইটনেস কমিয়ে রাখা আছে, নইলে চার্জ চলে যায়। রোদের ভেতর কে ফোন করেছে দেখা যাচ্ছে না। আমি কানে ঠেকালাম ফোনটা।
‘বাবু, কোথায় তুমি?’
‘এই যে আব্বা, সেক্রেটারিয়েট থেকে বেরোলাম।’
‘কাজ হয়েছে?’
‘না, আব্বা। আবার আসতে হবে।’
‘আমার এক ক্লায়েন্ট আছেন, ওনাকে বললে ব্যবস্থা হতো।’
‘দরকার হবে না মনে হয়। এত লোককে ধরাধরি করতে ভালো লাগে না আমার।’
‘কাজ হয়ে যাওয়ার পরে তুমি কাকে ধরেছ, কার হেল্প নিয়েছ সেগুলো আর মনে থাকবে না। দিনশেষে সাকসেসটাই শুধু সত্যি, সেটাই শুধু দৃশ্যমান।’
‘দেখি, কী করা যায়!’
‘বাবু, তোমার আম্মা এইগুলো কী শুরু করেছে আবার? অফিসে কত কাজ থাকে, কত মানুষের ভেতর থাকি। মিটিংয়ে থাকি। এইগুলো তোমার আম্মা কিছু বোঝে না। আজগুবি কথাবার্তা নিয়ে দুইদিন পরপরই তার ড্রামা শুরু হয়। বলো তো, আমিও তো মানুষ। এইগুলো সহ্য হয়?’
‘আপনি যা করতেছেন, তাতে এইটাই তো আউটকাম আসবে আব্বা?’
‘মানে? কী বলতে চাও তুমি? সব দোষ আমার?’
‘দেখেন আব্বা, দোষ গুণ জানি না। যা করতেছেন সেইগুলো ভালো কিছু না। আজগুবি বলে অস্বীকার করার চেষ্টা করবেন না। আমার কাছে আপনার মেসেঞ্জার চ্যাটবক্সের স্ক্রিনশট আছে।’
‘বাপের পেছনে ফেউ লাগাইছ? কুলাঙ্গার কোথাকার?’
‘ফেউ লাগানো লাগে না আব্বা। আমরা একই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করি। আপনার ফেসবুক একাউন্ট, মেইল আইডি আমি খুলে দিয়েছি। নোটিফিকেশন আসে আমার কাছে। দেখতে না চাইলেও চোখে পড়ে সবই।’
আব্বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং বুঝলেও প্রযুক্তিগত ব্যাপার অতটা বোঝেন না। অফিসের কাজে তার পিএ আছে, সাহায্য করতে। তাই এসব বোঝালে ভয়ই পেলেন। আমি সজীবের নামটা নিতে চাইলাম না। আব্বার ল্যাপটপে গেম খেলে ও। ওই এসব লিক করেছে জানতে পারলে আব্বা আর ওকে ল্যাপটপ দেবেন না।
‘তোমার আম্মা পাগলছাগল। সিনক্রিয়েট করে শুধু। তুমি বড় হইছ, তাকে এসব বলাটা ঠিক হইছে তোমার? আমাকে বলতে পারতে।’
‘আপনি আকাম করতে পারবেন আর আমি বলতে পারব না?’
‘বাপের সাথে কী ব্যবহার করছ তুমি? এই তোমার ভাষা? এই তুমি শিক্ষিত ছেলে?’
‘আব্বা, বাপ যদি বাপের মতো না থাকে আমার ব্যবহারও এর চেয়ে ভালো হবে না।’
‘কী চাও তোমরা? আমি আর বাসায় না ফিরি? তাহলে থাকো তোমরা তোমাদের মত। আমি আজ থেকে বাইরেই থাকব! রেলস্টেশনে বসে থাকব।’
আব্বা ফোন রেখে দিলেন। আপাদমস্তক ফ্যামিলিপারসন আমার আব্বা, দিনশেষে ঘরে ফিরতেই হবে তাকে। কিন্তু এভাবেই ব্ল্যাকমেইল করেন আমাদেরকে। সন্তানদেরকে ঘায়েল করার অন্যতম অস্ত্র এটা আব্বার!
আবার ফোন বাজছে। কানে নিতেই আম্মার কান্নায় রুদ্ধ গলা ‘বাবু বাসায় আয় তাড়াতাড়ি!’
ধুশ শালা! ভাল্লাগে না কিছু! ফুটপাতে একটা লাথি মেরে আমি বাসে উঠে গেলাম।
চলবে…
কড়চা – ১
আফসানা আশা
আপনারা পড়লে পুরোটা পোস্ট করব। নইলে ইবুক।