পরনিন্দা |০২| #লেখাঃ_অনন্য_শফিক —-

0
446

#গল্পঃ_পরনিন্দা |০২|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক
—-
পরদিন আমি পুকুর পাড়ে বসে আছি।হাতে ফোন। ঘরে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না বলে এখানে এসে বসেছি। ফেসবুকে স্ক্রল করছি।
ঠিক তখনই পাশে এসে দাঁড়ালো ছোট চাচী।এসে বললো,’ কি করিস তুলি?’
আমার ইচ্ছে করছিলো না উনার সঙ্গে কোনো কথা বলতে। তবুও বললাম,’ এই তো। কিছু না। বসে আছি।’
ছোট চাচী আমায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। তারপর বললো,’ নাকি আদনানের সঙ্গে কথা বলস? আর এখন আমারে দেইখা কথা বলা বন্ধ করে দিছস? ‘
শুনে মেজাজ এতো খারাপ হলো! নিজেকে সামলাতে না পেরে আমি রাগের গলায় বললাম,’ চাচী, বুড়ো হয়েছেন। চরিত্র ঠিক করেন আপনার! আপনি তো আমার নিজের চাচী। আপনি যেরকম আচরণ করেন, শত্রুও এরকম আচরণ করে না! ‘
বলে ওখান থেকে উঠে চলে এলাম।
এর খানিক পরেই ছোট চাচী এসে বাবার কাছে বললো,’ ভাইজান, আপনার কাছে আপনার মেয়ে আর আমার মেয়ে এক কথা না? ভাইঝি আর নিজের মেয়ে এক না? এক রক্তের না?’
বাবা বললেন,’ হ্যা।একই তো।’
ছোট চাচী কেঁদে ফেললো। কেঁদে কেঁদে বললো,’ আপনার মেয়েরে আমি সব সময়ই নিজের মেয়ের মতোই দেখি।কতো আদর করি।আর আজকে আপনার মেয়ে আমারে ডাইকা বলতেছে, আমি কোন সাহসে আমার মেয়েরে আদনানের কাছে বিয়ে দিলাম। সে নাকি আমারে উচিৎ শিক্ষা দিবে। আমার পিঠের চামড়া উঠিয়ে সেই চামড়া দিয়ে তার জুতো বানাবে!’
চাচী হাউমাউ করে কাঁদছে।
বাবা সঙ্গে সঙ্গে আমায় ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন,’ তুলি এসব কি বলেছিস তুই তোর চাচীকে?’
আমার এতো রাগ লাগলো! বাবা এমন কেন? তিনি তো সব জানেন চাচী আর তার মেয়েরা আমার সঙ্গে কি করেছে! এখনও কি করে যাচ্ছে।আর বাবা এরকম একটা মহিলার কথা বিশ্বাস করে ফেললেন?
ছিঃ!
আমি রাগের গলায় বললাম,’ বাবা, এই মহিলাকে আমি এসবের কিছুই বলিনি। কিন্তু বলা উচিৎ ছিল। শুধু বলা না, এর চরিত্র যে পরিমাণ খারাপ। এই মহিলা যে পরিমাণ নোংরা! এর চামড়া দিয়ে জুতো বানাতে পারলেই বরং আমার মনে একটু শান্তি লাগবে!’
বাবা রেগে গেলেন শুনে। বসা থেকে উঠে আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,’ চোখের সামনে থেকে তুই দূর হয়ে যা বলছি! মরতে পারিস না!’
আমি বাবার সামনে থেকে চলে এলাম।এতো কান্না পাচ্ছে আমার! কিন্তু আমি জানি বাবা নিরূপায় হয়ে আমায় মেরেছেন। ছোট চাচা বেঁচে থাকলে অতো কিছু কখনোই হতো না।চাচা নাই বলেই সমস্যাটা হয়েছে।বাবা মুখ থেকে তাদের কিছুই বলেন না।বলতে পারেন না। কোন কিছু না বলার পরেও ফুফুরা এসে নানান কথা বলে। ছোট চাচী যা বলে তাই তারা বিশ্বাস করে।বলে, আমরা নাকি চাচীদের দেখতে পারি না। শান্তিতে থাকতে দেই না। তাদের জমি ভোগ করি।আরো কতো কথা!

ফুফুদের নাম নিতে নিতেই এক ফুফু এসে হাজির।মেজো ফুফু । আমাদের বাড়ি থেকে উনার বাড়ি কাছে। মেজো ফুফু এসে কোন কিছু বাছ বিচার না করেই আমার উপর সবটা দোষ দিলেন। মাকে বললেন,’ মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে পারো না? আর, এর কি কম বয়স হয়েছে? বিয়ে দেও না কেন? বয়স হয়ছে।আর কতো সহ্য করবো? মেয়েরা খারাপ হয় বাপ মায়ের দোষে।সময় মতো বিয়ে দিলে কি শিলার জামাইর সঙ্গে এইসব ঘটাইতো?’
মা জিহ্বায় কামড় দিয়ে ফেললেন। বললেন,’ আপনি এসব কি বলছেন আপা? ওরা যা বলেছে তাই বিশ্বাস করেছেন?’
ছোট ফুফু রেগে গেলেন। বললেন,’ তোমাদের বাড়িতে আসায় উচিৎ না আর। তুমি বলো রাবেয়ার পক্ষ নিছি। রাবেয়া বলে তোমার পক্ষ নিছি।’মেজো ফুফু রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন।
তারপর বড় ফুফু আর ছোট ফুফুকে ফোনে কি বললেন কে জানে!
এরপর থেকে তারা স্ট্রাইক করে বসে রইল।শপথ করলো, আর কোনদিন আমাদের বাড়ির দিকে তারা ফিরবে না!

তাদের ফেরা না ফেরা নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না, যদি ছোট চাচী কিংবা শিলা একটু চুপ থাকতো। আমাদের সঙ্গে অকারণে শত্রুতা বন্ধ করতো।কি জানি কোন কারণে তারা মা মেয়ে আমাদের সঙ্গে বিশেষ করে আমার সঙ্গে একের পর এক শত্রুতা করে যেতে লাগলো।
আজ এর কাছে, কাল ওর কাছে আমার নামে নানান নোংরা নোংরা কথা বলে বেড়াতে লাগলো। এদের কিছু বলাও যায় না।বললেই ফুফুরা রেগেমেগে আগুন হয়ে বাবাকে ধরে।বলে, আমার ভাইটা নাই বলে তোরা এদের সঙ্গে যা তা করছিস।
আমরা নিরূপায়! চুপচাপ সব হজম করি। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা সীমা থাকে।ওরা সীমা লঙ্ঘন করছে। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,সীমা লঙ্ঘন কারী দের তিনি পছন্দ করেন না।আমি সেই আশায় থাকি। আল্লার উপর ছেড়ে দেই সবকিছু।

এরপর বাবা চেষ্টা করতে থাকেন যেভাবেই হোক আমায় বিয়ে দিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু বিয়ের আলাপ আসলেও তা আর বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না। গ্রামের মধ্যে ততোদিনে কথা ছড়িয়ে গেছে আমার চরিত্র ভালো না। চাচাতো ছোট বোনের স্বামীর সঙ্গে আমার খারাপ সম্পর্ক।কেউ কেউ এটাকে বাড়িয়ে অন্য রকম করেছে। আমার পেটে বাচ্চা এসেছিল, তাও ছোট বোন জামাইয়ের থেকে। সেই বাচ্চা নাকি হসপিটালে গিয়ে নষ্ট করে এনেছি।
কোন পরিবার থেকে বিয়ের আলাপ এলে আর তাদের কানে এসব খবর যদি পাড়া প্রতিবেশীরা দিয়ে দেয় তবে কি তারা এই বিয়েতে এগিয়ে আসবে কোনদিন?
বাবা একেবারে ভেঙ্গে পড়েন।এসব নিয়ে বাজে চিন্তা করে তার শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়ে। অল্পতেই বুড়িয়ে যান তিনি। আজকাল কোন কিছু মনে রাখতে পারেন না।রাগও বেড়েছে খুব। বাইরের লোকদের সঙ্গে তিনি রাগ দেখান না।রাগ দেখান ঘরের লোকদের সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে।আর মা সেই রাগ ঢালেন আমার উপর।বলেন, তুই বি*ষ খেয়ে ম*রে যা! বাঁচার দরকার নাই তোর! তোর জন্য লোকদের মুখ দেখাতে পারি না!
মাঝেমধ্যে তিনি খুব কাঁদেন।
একবার ছোট চাচীর হাত ধরে মা বলেছিলেন,’ বোন, তুমি তুলি তো তোমার শিলার মতোই।তুমিই তো বলো শিলাও তোমার কাছে যেমন, তুলিও তোমার কাছে সেরকম।দয়া করে আমার মেয়েটাকে নিয়ে আর মানুষের কাছে কিছু বলো না। আমার মেয়েটার ইজ্জত ভিক্ষা দেও তুমি বোন!’
ছোট চাচী মায়ের এই কথাকে আরো বাড়িয়ে বলিয়ে মানুষের কাছে প্রচার করলেন। বললেন, তার মেয়ে আমার জামাইয়ের সঙ্গে নষ্টামি করবে আর আমি নাকি তা চুপ করে হজম করতাম।সুযোগ দিতাম এইসব করার।কতো বড় খারাপ মহিলা! মেয়ে যেমন মাও তেমন! এদের জাহান্নামেও ঠাঁই হবে না! ‘
এরপর থেকে ওদের কারোর সঙ্গেই মা আর কথা বলেন না। কথা বললেই তো সমস্যা।মান সম্মান একেবারে ধুয়ে দেয় ওরা!

শেষমেষ বড় কষ্ট করে, অনেক চেষ্টা ফিকিরের পর একটা বিয়ের আলাপ মোটামুটি পাকা হলো। ছেলে খুব ভালো। ধর্মভীরু। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।বাবা নাই।মা আছে। সেই ছেলে এসে আমায় দেখে গেল।বললো, তার পছন্দ হয়েছে। এরপর তার মা এলো।আমায় দেখে তার মায়েরও পছন্দ হয়েছে। তার মায়ের আচরণ খুবই ভালো লাগলো। তিনি আমায় পছন্দ করার পর একজনকে বাজারে পাঠালেন একটা তৈরি করা স্বর্ণের আংটি কিনে আনতে গিয়ে। তিনি আমায় আংটি পরিয়ে যাবেন একেবারে। বিয়ে ফাইনাল করে যাবেন।দিন তারিখ ঠিক করবেন এখানে বসেই।কিন্তু ছেলের মায়ের সঙ্গে ছেলের মামীও যে এসেছিল। সেই মামীই সমস্যাটা বাঁধালো। সেই মামী কিভাবে যেন জেনে ফেললো, ছোট বোন জামাইয়ের সঙ্গে আমার খারাপ সম্পর্ক ছিল।কে এই কথা কোন সুযোগে তার কানে বললো কে জানে। সেই মামী আমায় হঠাৎ করেই ডাকলো।বললো,’ এই তুলি, এদিকে একটু শুনে যাও তো তুমি।’
আমি কাছে গেলাম।
এরপর মামী মাকেও ডাকলো। ছেলের মাকেও ডাকলো।
মামী ছেলের মা আর আমার মায়ের সামনে আমায় বললো ,’ তুলি, তুমি একটা সত্য কথা বলবা? ‘
আমি বললাম,’ জ্বি বলবো। বলুন।’
আমি তখনও বুঝতে পারিনি এই বিষয়ে কথা উঠবে এখানে।
এরপর তিনি বললেন,’ তুমি নাকি হসপিটালে গিয়ে একবার গর্ভ নষ্ট করে এসেছো। এই কথাটা কি সত্যি ?’

#চলবে

(#পরনিন্দা গল্পটা লিখছি বাস্তবতা থেকে। আমার নিজের চোখে দেখা একটা পরিবারের গল্প এটা। শুধু চরিত্রের নাম গুলো ভিন্ন।আর সমাজে এখনও এরকম আছে। এই সমস্যাটা ভয়াবহ। এই জন্যই এটা লিখতে ইচ্ছে হলো।আগেও বলেছি এই গল্পে আলাদা কিছু নাই। রহস্য নাই। শুধু একটা পরিবারের ঘটনা বলে যাচ্ছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here