#গল্পঃ_পরনিন্দা |০৩|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক
—-
আমি কি উত্তর করবো তখন বুঝতে পারছিলাম না! রাগ করে কিছু বলতে ইচ্ছে করছিলো মুখের উপর। কিন্তু মনে মনে আরেকটা হিসেবও করলাম আমি। আসলে আমার মতো মানুষের রাগ করলে চলে না।বাবা আমায় বিয়ে দেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা তদবির করছেন। এমনিতেই বিয়েটা হচ্ছে না।পাড়ায় আমার নামে এমনিতেই কতো মিথ্যে অপবাদ ছড়িয়ে আছে। আমার মতো মানুষের থাকা উচিৎ চুপ করে।যে যাই বলুক সব হজম করা উচিৎ! কিছু কিছু মানুষ হয়তো এমনই। কোন অপরাধ না করেও এর দায় তার কাঁধে তুলে নিতে হয়। মানুষের করা অপমান তাকে মুখ বুজে সহ্য করে নিতে হয়। আমিও তেমনই একজন।
আমি কিছুই বললাম না।চুপ করে রইলাম। শুধু টের পেলাম আমার চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে নামছে।
মা ওপাশে মুখ ফিরিয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে ফেললেন।
ছেলের মামী ছেলের মায়ের গায়ে হাত দিয়ে টোকা দিয়ে বললেন,’ বুঝেছি আপা।সব পরিষ্কার। আর এখানে বইসা দেরি করনের দরকার নাই। আগে সব জানলে এইখানে এক গ্লাস পানিও খেতাম না!’
ছেলের মা নম্র ভদ্র স্বভাবের। বুদ্ধিমতী। তিনি এ নিয়ে কিছুই বললেন না আর। চুপচাপ খানিকটা সময় বসে রইলেন। তারপর মাকে বললেন,’ বিয়ের বিষয় তো বোন, একটু শলা পরামর্শ দরকার সবার সাথে। বোঝাপড়া আছে।আমি একা একা যদি এই বিয়ে ঠিক করে চলে যাই তবে সবাই রাগারাগী করবে। ঝামেলা করবে।’
মা কিছুই বললেন না।চুপ করে রইলেন।আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, লজ্জা হবে শুধুমাত্র এই জন্য তিনি কাঁদতে পারছেন না। কিন্তু তার চোখ মুখ দেখে ঠিকই বোঝা যাচ্ছে মা কাঁদতে চাইছেন।
মা কিছু না বললেও ছেলের মা আবার বললেন,’ সবকিছু তাকদির বোন।তাকদিরে থাকলে ভাঙা বিয়েও হয়। আবার তাকদিরে না থাকলে বাড়িতে জামাই এসেও বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে যায়।আমরা যাই বোন। আপনাদের কষ্ট দিয়ে গেলাম।’
ছেলের মা আর মামি চলে গেল।যে লোক আংটি কিনতে গিয়েছিল সে আংটি না কিনে খালি হাতেই ফেরত এসেছে। কারণ এখন আর আংটির প্রয়োজন নাই।বিয়েই তো হবে না, আংটি কিনে আনার দরকার কি তবে?
মেহমান চলে যাবার পর মা হাউমাউ করে কাঁদলেন। কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর কাছে বললেন, ও আল্লাহ, এইটা কোন পরীক্ষায় ফেললা আমারে তুমি! আমি বা আমার মেয়ে আমরা তো কারোর কোন ক্ষতি করি নাই কোনদিন। কারোর ক্ষতি চাই নাই। তাইলে আমার মেয়ের কপালে এই দুঃখ কেন লিখলা? কেন এমন লজ্জায় ফেললা আমাদের!
‘
প্রায় হয়ে যাওয়া বিয়েটা ভেঙ্গে যাবার পর ছোট চাচী আমাদের শুনিয়ে শুনিয়েই মানুষের কাছে বললেন, দেখো, মানুষকে নিয়ে খেললে কি হয়! পরিণাম দেখো। মেয়ে ঘরে বুড়ি হচ্ছে। বিয়ে দিতে পারছে না।দিতেও পারবে না বিয়ে। চরিত্র নষ্ট মেয়েরে কার ছেলের জন্য ঘরের বউ করে নিতে আসবে! দেশে কি বউয়ের অভাব পড়েছে নাকি!
আমার নামে অপবাদ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চাচী নিজের মেয়ের ভীষণ প্রশংসা করে আবার মানুষের কাছে।বলে, ভালো মানুষের মেয়েদের আল্লাহ কষ্ট দেন না। মানুষ শয়তানি করলেও লাভ হয় না। আমার বড় মেয়ের আল্লার রহমতে রাজ কপাল। রানীর হালতে থাকে সেইখানে। ছোট মেয়েও পড়ায় ভালো।কলেজে পড়ে।তারে নিয়ে কেউ কোনদিন একটা মন্দ কথা বলতে পারে নাই। কোনদিন বলতেও পারবে না। মেয়ে আমার এতোই সাদামাটা যে বাটন মোবাইলটাও ব্যবহার করতে জানে না!
মানুষও এসব কথায় খুব তাল দেয়।সুর মিলিয়ে বলে, আপা ঠিকই বলেছেন। আপনার মেয়ে দুইটা লক্ষ্মী। এদের মতো ভালো আচরণের মেয়েই হয় না!
‘
দিন এভাবেই যেতে থাকে। মানুষের গঞ্জনা সহ্য করে। পঁচা নোংরা কথা শুনে।
এক সময় এসব সয়ে যায় শরীরে। কিন্তু বাবার সয়নি!
আমার বাবা সুস্থ সবল একটা মানুষ ছিলেন। তার চোখের দিকে তাকিয়ে মানুষের কথা বলবার সাহস ছিল না। সমাজে তার বিরাট মান মর্যাদা ছিল। তিনি সব সময় সতর্ক হয়ে চলতেন। কেউ মন্দ বলবে তাকে নিয়ে এরকম আচরণ তিনি কোনদিন করতেন না। আমার সহজ সরল সাদামাটা বাবা চাচীর জন্য আর চাচীর মেয়ের জন্য মানুষের কাছে লাঞ্চিত হতে থাকেন দিনের পর দিন। মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তাকে দেখিয়ে বলে, অমুকের মেয়ে এটা করেছে।বাবা এসব সহ্য করতে পারেননি। ভেতরে ভেতরে তিনি ভেঙে পড়েন। তার আগে থেকেই হার্টের সমস্যা ছিল।তা দিনে দিনে বাড়ে। এর কয়েকমাস পর বাবা মারাও যান হার্টের সমস্যায়।
‘
বাবার মৃত্যুর পর আমরা চির অসহায় হয়ে পড়ি। ছোট চাচী এবার বাড়ির হর্তা কর্তা হয়ে যায় একেবারে। তার যা ইচ্ছে তাই করে সে।যা ইচ্ছে তাই বলে। আমাদের উঠোনের একপাশে সবজি করে।গাছ রূপন করে।এ নিয়ে মা কিছু বললেই মার চুল ছিঁড়তে আসে।দশটা কথা শোনায়। গর্জন করে।
আমরা এসব পারি না।গলার আওয়াজ বড় করতে পারি না। ঝগড়া করতে পারি না। লজ্জা করে।বিবেকে বাঁধে।মনে হয়, লোকে কি বলবে?
কিন্তু এই যে আজীবন চুপ থাকা।ভদ্র হয়ে থাকা। এসব করেও তো মানুষের কাছে কোনদিন ভালো হতে পারিনি আমরা। এই সমাজের মানুষ গুলো মূর্খের অধম।এরা প্রমাণ ছাড়াই অপবাদ বিশ্বাস করে।এরা পর মানুষ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে বেশি পছন্দ করে।আর এরা সব সময় দূর্বলের বিরুদ্ধে বাঘ সাজে। সিংহ সাজে।সবলেরা খারাপ লোক হলেও এরা তাদের খুব তোয়াজ করে চলে।
‘
বাবার মৃত্যুর কদিন পরেই মেজো ফুফু আমাদের বাড়িতে আসে।এসে দুদিন থাকে। মায়ের সঙ্গে খুব মিশে থাকার চেষ্টা করে। তারপর একদিন দুপুর বেলা আসল কথাটা বলে।বলে, ‘ বড় বউ, তুলির বাপ বেঁচে নাই। এখন তুলির ভালো খারাপ দেখবার দায়িত্ব আমাদের।শত হোক, তুলি আমাদের রক্তের অংশ। সে আমাদের বংশের মেয়ে।’
মা বললেন,’ জ্বি আপা।’
মেজো ফুফু এবার বললেন,’ বড় বউ, আমি তুলির জন্য একটা ছেলে দেখছি। ভালো ছেলে।সহায় সম্পত্তি আছে।’
মা বললেন,’ বাড়ি কোথায় ছেলের? বিস্তারিত বলেন।’
মেজো ফুফু আমতা আমতা করে বললেন,’ আমার বড় ননদের ছেলে।নাম হারুন।’
মা শুনে চমকে উঠলেন। বললেন,’ এসব কি বলছেন আপা আপনি? আপনি তুলির ফুফু হয়ে এরকম একটা আলাপ কিভাবে নিয়ে এলেন? ‘
মেজো ফুফু বললেন,’ কেন? সমস্যা কি? ‘
মা বললেন,’ আপনিই তো গত বছর এসে বলেছেন, ছেলে তার প্রথম বউরে নিজে ফাঁ*স লাগিয়ে মা*রছে। এরপর সবাইরে বলছে, বউ নিজে ফাঁ*স নিয়ে মা*রা গেছে। আপনি বলেন নাই নিজের মুখে এই কথা?’
মেজো ফুফু খানিক সময় চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,’ আগে ভুল সন্দেহ করছিলাম বউ।পরে জানলাম বৃত্তান্ত। হারুন ভালো ছেলে। সমস্যা তার বউয়ের ছিল। মানসিক সমস্যা।নিজেই ফাঁ*স নিয়ে ম*রছে।’
মায়ের খুব রাগ লাগলো এবার। তিনি রাগের গলায় বললেন,’ খবরদার আপা! এইসব আলাপ নিয়ে আমার কাছে কোনদিন আসবেন না। সাবধান!’
মেজো ফুফু ভীষণ রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে মুখ বিকৃত করে তিনি বললেন,’ হহ্ আমারে সাবধান করো।আর নিজের মেয়েরে দিয়ে নষ্টামি করাও। আমার ভাইটা এই কলঙ্কিনী মাইয়ার জন্য মারা গেছে। মানুষের সামনে আমরা মুখ দেখাইতে পারি না। মানুষ আঙুল দিয়ে দেখাইয়া দেখাইয়া বলে, অমুকের ফুফু! ‘
মা আহত এবং ক্ষোভের গলায় বললেন,’ আপা, আপনার যদি এতোই মান সম্মান ক্ষুন্ন হয় তবে আপনার আর তুলিরে ভাইঝি বাবার প্রয়োজন নাই। আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন লাগবে না। কারোর সাহায্য আমরা চাই না।’
মেজো ফুফু কেঁদেকেটে আমাদের ঘর থেকে গেলেন সেবার।যাবার সময় তার মরা বাপের কসম কেটে বলে গেলেন, ‘আর কোনদিন যদি এই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষি তাইলে আমি আমার মরা বাপের মাথা খাই!’
কিন্তু কদিন পর ঠিকই তিনি আবার এলেন।এসে মাকে বললেন,’ ও বড় বউ, তুলির ভাগ্য খুলছে!’
মা বললেন,’ কিভাবে?’
মেজো ফুফু হাসি হাসি মুখে বললেন,’ হারুন তারে দলিল করে দশ কাঠা জমি লিখে দিবে।আমি বলছি, দশ কাঠা ধানী জমিনে শুধু হবে না, বাজারের জমি থেকে দুই শতক আমার ভাইঝির নামে লিখে দিতে হবে। হারুন প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হলো। আল্লাহ তুলির দিকে মুখ ফিরে তাকাইছে বড় বউ। শুকরিয়া আদায় করো।বলো, আলহামদুলিল্লাহ।’
মা বিরক্ত হয়ে উঠলেন। বললেন,’ আপা, আপনি এখান থেকে যান।আগেও বলেছি, এসব আমার পছন্দ না।আমি লোভী না। আমার মেয়েও লোভী না।’
মেজো ফুফু আবার রেগেমেগে আগুন হয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।যাবার সময় বলে গেলেন, ‘ মেয়ে লোভী না বিরাট ভালো। ভালো মেয়ে দেইখাই তো চাচাতো ছোট বোনের জামাইয়ের সঙ্গে বিয়ে বসে পড়তে চায়!’
মেজো ফুফুর এই আচরণটা আমায় কাঁদালো। মানুষ বলে, ফুফুরা তার ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের জন্য জীবন দিয়ে দিতে চায়। কথাটা সত্যি।আমি আমার বান্ধবীদের বেলায় এমন দেখেছি। তাদের ফুফুরা তাদের জন্য জান জীবন দিয়ে দেয়। ভীষণ আদর করে তাদের। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এর উল্টো। আসলে আমার যে কপাল পোড়া!
‘
দিন সম্ভবত সব সময় সবার ভালো যায় না। খারাপ মানুষদের হয়তো এক সময় পতন আসে। আমার চাচীর ঘরে পতনের শুরু হলো।
হঠাৎ করেই কথাটা শুনলাম।চাচীই ফোন করে কাকে যেন বলছে, শীলার তো বাচ্চা হবে।তাই শীলার কাজে সাহায্য করার জন্য
তার ছোট মেয়ে জেনি সেখানে গিয়েছিল।আর ওখানে গিয়ে জেনি আদনানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি আদনানের সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় শীলার চোখে ধরা পড়েছে সে। এই নিয়ে ওখানে বিরাট ঝামেলা হচ্ছে। শীলার সংসারে আগুন লেগে গিয়েছে ইতিমধ্যে।
‘
#চলবে
#পরনিন্দা
(#গোপনে আজ লিখতে পারিনি। কাল গোপনে দিয়ে শেষ করে দিবো ইনশাআল্লাহ।)