হৃদয়_মাঝে ( দ্বিতীয় পর্ব ) #ঈপ্সিতা_মিত্র

0
350

#হৃদয়_মাঝে ( দ্বিতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৪>
যাইহোক , প্রিয়মের এইসব ভাবনার ভিড়েই এরপর বিয়ের দু রাত পেরিয়ে ফুলসজ্জার রাতটা চলে এলো জীবনে | যদিও বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠানে প্রত্যেকে খেয়াল করেছে প্রিয়মের বিরক্তি , গাম্ভীর্য ! হিয়ার বাবার তো একটু মনটা ভেঙেই গেছে ছেলের এরকম ব্যবহার দেখে | তাও মুখে কিছু বলেনি | নিজেকে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে বিয়ের এতো ধকলের জন্য হয়তো এই গাম্ভীর্য , বিরক্তি | হয়তো আর ভালো লাগছে না সকাল থেকে এতো লোকের ভিড় , এতো নিয়ম কানন ! সবাই চলে গেলে , এই নিয়মগুলো সব শেষ হলে হয়তো জামাই একটু সহজ হবে ! তবে হিয়ার চোখে প্রিয়মের অন্ধকার মুখের কারণটা খুব স্পষ্ট ছিল এই সময়ে | একটা জোরের বিয়ে করছে বলে নিজেরই লজ্জা লাগছিলো ভীষণ | কিন্তু ওর যে কি পরিস্থিতি ! সেটা তো শুধু হিয়াই জানে ! তবে সেই ফুলসজ্জার রাতে ও নিজের পরিস্থিতির কথা প্রিয়মকেও বলার চেষ্টা করেছিল নিজে থেকে | বলার চেষ্টা করেছিল যে ওর বাবার শেষদিনটাই হবে ওদেরও বিয়ের শেষ দিন | ডাক্তার একটা সময় খাতা ধরিয়েই দিয়েছে হাতে | খুব বেশি সময় লাগবে না ওর বাবার সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে ! আর তারপর হিয়াও চলে যাবে প্রিয়মের জীবন থেকে | এই বিয়েটা শুধু মাঝের এই কটা দিনের জন্য

করা কম্প্রোমাইজ | ব্যাস | কিন্তু সেদিন এতো কিছু ভেবে একা ঘরে প্রিয়মের জন্য অপেক্ষা করলেও কিছু বলা হয়নি আর ওর | কারণ প্রিয়ম কিছু শুনতে রাজিই ছিল না | আসলে সেদিন প্রিয়ম ঘরে ঢুকতেই হিয়া ওকে বলে উঠেছিল , ———— ” আমি জানি তুমি আমার ওপর খুব রেগে আছো | তুমি বলার পরেও আমি এই বিয়েটা করতে রাজি হলাম তাই | আসলে আমার বাড়িতে এমন একটা প্রব্লেম হয়েছিল , তাই !”

না , হিয়ার কথাটাকে আর শেষ হতে না দিয়েই প্রিয়ম এবার বলে উঠেছিল , ———– ” তাই বাড়ির সমস্যা মেটাতে একটা বড়োলোক বাড়ির ছেলেকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করাটাই ঠিক বলে মনে হলো , তাই তো ?”

হিয়ার লাইনটা ভীষণ কানে লাগলো যেন | ও অবাক চোখেই প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো নিজের মনে , ———- ” মানে ? কি বলছো এইসব ?”

প্রশ্নটা শুনে প্রিয়ম এবার খুব কঠিনভাবে হিয়াকে পুরোপুরি বুঝিয়ে উত্তরটা দিলো | কিছু কথা সাজিয়ে বললো , ———— ” আমার কথা না বোঝার মতন অতটাও সরল মেয়ে তো তুমি নও হিয়া | যদি হতে তাহলে এই বিয়েটাতে এইভাবে নির্লজ্জের মতন হ্যাঁ বলতে না | আসলে তোমার দোষ না | আমার দোষ | আমি তোমাকে প্রথম দেখে ভালো ভেবেছিলাম , তাই আমার পুরো লাইফের কথা তোমার সঙ্গে শেয়ার করেছিলাম | কিন্তু তখন বুঝিনি যে এই বিয়েটা আসলে তুমি কেন করতে চাইছিলে ! টাকার জন্য | আর স্বাভাবিক , তুমি যেই ফ্যামিলির মেয়ে , তোমার কাছে এই সম্বন্ধ আসাটা তো লটারি পাওয়ার মতন ব্যাপার | তুমি বিয়েটাতে কি করে না বলবে ! ইভেন যদি এরপর আমাদের ডিভোর্সও হয়ে যায় , তাহলেও তোমার লাভ | ভালো মতন একটা এলিম্যানি পাবে , লাইফ সেট , তোমার আর তোমার ফ্যামিলির ! আর কি চাই !:”

হিয়ার কথাগুলো শুনে কিরকম থমকে গিয়েছিলো মুখটা | কেউ ওকে এতটা খারাপ ভাবে এটা আসলে ওর ধারণা ছিল না ! চোখটা নিজের অজান্তেই ভিজে এসেছিলো হঠাৎ | তাও কিছু কথা ভেবে বলেছিলো , ——— ” তুমি ভুল ভাবছো আমাকে ! আমি টাকার জন্য কোনো বিয়ে করিনি |”

কিন্তু প্রিয়ম ওর কথাটাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে নিজেই আবার বলা উঠেছিল , ————– ” প্লিজ ! তোমাকে আমার যত টুকু যা, বোঝা হয়ে গেছে | তাই কোনো গল্প বানিয়ে শুনিয়ো না আমায় | কোনো লাভ হবে না | যাইহোক , মেন্ কথা হলো , তুমিও টাকার জন্য বিয়ে করেছো , আমিও তাই করেছি | এই প্রোপার্টিটাকে এইভাবে ছেড়ে দিতে পারবো না বলে বিয়েটা করেছি | এরপর হয়তো কিছুদিন এই নাটকটা চলবে সবার সামনে | তারপর ডিভোর্স তো হবেই একদিন | কিন্তু একটা কথা আজ শুনে রাখো , আমি টাকা দিয়ে তোমাকে ছাড়বো না হিয়া | তোমার আমার ফ্যামিলির কাছ থেকে টাকা কমানোর যে প্ল্যানটা আছে , সেটা আমি কোনোদিন ফুলফিল হতে দেব না | এন্ড আই প্রমিস ইউ দিস … ”

কথাটা শেষ করেই প্রিয়ম আর হিয়ার সামনে দাঁড়ায়নি | বিছানায় রাখা চাদরটা তুলে ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিল চুপচাপ | কিন্তু হিয়া কিরকম মূর্তির মতন দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ ওই অন্ধকারের মাঝে | চোখে না বলা কথার জল এসে ভিড় করেছিল ওর | নিঃস্তব্ধ কান্না এসে জড়ো হয়েছিল গলায় | এতটা অপমান , এতটা ছোট আজ হতে হবে প্রিয়মের কাছে , এটা আসলে ভাবেনি প্রথমে | ভেবেছিলো বুঝিয়ে বলবে সবটা | বুঝিয়ে বলবে এই বিয়েটা মাত্র কদিনের সত্যি | তারপর হিয়া নিজের শহরে ফিরে যাবে ! যেরকম খালি হাতে এসেছিলো , সেই রকম খালি হাতেই ফিরবে | কিন্তু প্রিয়ম যে অন্য বোঝা নিয়ে ওর সামনে এসেছিলো আজ , এটা হিয়া জানতো না ! তাই স্তব্ধ হয়েই রইলো কিছুক্ষণ এই অন্ধকার ঘরে , ওর ফুলসজ্জার দিনে |

এরপর কটাদিন কিরকম দুটো অচেনা মানুষের একসঙ্গে বাসের মতন কেটে গেলো হিয়া আর প্রিয়মের | হিয়া এর মধ্যে খেয়াল করেছে প্রিয়ম একা ঘরে তো দূরে থাক , বাড়ির লোকের সামনেও ওর সঙ্গে কথা বলে না | ওকে নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না | ওর সঙ্গে এক টেবিলে বসে খায় অব্দি না | তবে অনিন্দবাবু প্রিয়মের এইরকম ব্যবহারে খুবই লজ্জায় পরে গেছে হিয়ার সামনে ! সেই জন্যই হয়তো অষ্টমঙ্গলার আগেরদিন রাতে বেশ ঝামেলা লেগে গিয়েছিলো ওনার সাথে ছেলের | হিয়া নিজের ঘরে বসে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো সব কিছু | প্রিয়ম যে হিয়ার সঙ্গে কিছুতেই হিয়ার বাড়ি যাবে না কাল , এই নিয়েই দুজনের মধ্যে অশান্তি হচ্ছিলো মাঝ রাতে | প্রিয়ম যেন আজ সমস্ত ধৈর্য হারিয়ে প্রচন্ড ফ্রাস্টেটেড হয়েই বাবাকে বলছিলো কথাগুলো | বেশ জোর গলায়ই বলছিলো ও , ———— ” আর সম্ভব না আমার পক্ষে কিছু করা | সত্যি সম্ভব না | আমি তোমার কথায় বিয়ে করেছি | আমার লাইফটা দুটো নৌকোয় পা দিয়ে চলার মতন হয়ে গেছে এরপর | নিজেকে মাঝে মাঝে এতো বোকা লাগে বলে বোঝাতে পারবো না ! তুমি রীতিমতো ব্ল্যাকমেল করে আমাকে এইরকম একটা বিয়ের মধ্যে জড়িয়ে দিলে বাবা ! আর এরপর যদি এক্সপেক্ট করো , আমি অষ্টমঙ্গলায় নিয়ম রক্ষা করতে শ্বশুরবাড়ি যাবো , তাহলে খুব ভুল ভাবছো | আমি কোথাও যেতে পারবো না | তোমার যা ইচ্ছে তাই করে নিতে পারো |”

কথাটার উত্তরে হিয়া শুনতে পেলো অনিন্দবাবু রিকোয়েস্ট করার মতন করে বলছে এবার ছেলেকে , ———- ” তুই বুঝতে পারছিস না ! তুই অষ্টমঙ্গলায় না গেলে ওরা ঠিক কি ভাববে ! আমার কতটা ফেস লস হবে বুঝতে পারছিস না ! আর হিয়া , ও কি ভাববে !”

কথাটার উত্তরে প্রিয়ম এবার বেশ জোর গলায় বললো বাবার মুখের ওপর , ——– ” হিয়ার মতন মেয়ে আমাকে নিয়ে যা খুশি তাই ভাবতে পারে | আমার তাতে কিছু আসে যায় না |”

না , এই কথাটা ওর সত্যি ভীষণ কানে লাগলো এই মুহূর্তে | আর যেন কিছুতেই ঘরে চুপচাপ বসে থাকতে পারলো না হিয়া পুতুলের মতন | ও এবার নিজে থেকেই অনিন্দবাবুর ঘরে গিয়ে হাজির হলো | খোলা দরজা দিয়ে আচমকা হিয়াকে আসতে দেখে অনিন্দবাবুর সঙ্গে প্রিয়মও যেন চুপ হয়ে গেলো হঠাৎ | কিন্তু হিয়া এই সময়ে চুপ না থেকে একটু দৃঢ় গলায় বলে উঠলো দুজনকে ,

————- ” আমি কদিন হলো এই বাড়িতে এসেছি | বেশিদিন হয়তো থাকবোও না এখানে ! তাই প্লিজ আমাকে নিয়ে আপনি আপনার ছেলের সঙ্গে এইভাবে ঝামেলা করবেন না | আর প্রিয়ম আমাকে যেদিন প্রথম দেখতে এসেছিলো , সেইদিনই সব সত্যিটা বলে দিয়েছিলো , যে ও অন্য একজনকে পছন্দ করে | আর এই বিয়েটা জোর করেই আপনি ওকে দিচ্ছেন | আর সব জেনেই আমি এই বিয়েটায় হ্যাঁ বলেছিলাম | তাই নতুন করে আমার খারাপ লাগার মতন কিছুই নেই ! আর প্রিয়মের কাছ থেকে কোনো রকম এক্সপেক্টেশনও নেই আমার প্রথম থেকে | ও যেতে না চাইলে , অষ্টমঙ্গলায় প্রিয়মের যাবার কোনো দরকার নেই | আমি একাই যাবো | হ্যাঁ , আমার মা বাবা সত্যিটা জানে না | কিন্তু সেটা আমার প্রব্লেম | আমি ম্যানেজ করে নেবো |”

কথাগুলো বলেই হিয়া আর থাকেনি অনিন্দবাবুর ঘরে | একটু জোরে পা চালিয়েই চলে এসেছিলো নিজের ঘরে | আসলে নিজেকে এখন খুব অপরাধী বলে মনে হচ্ছে ওর | প্রিয়মের জীবনটা এইভাবে কমপ্লিকেটেড করে দেয়ার তো কোনো রাইট হিয়ার ছিল না ! এইভাবে একটা মানুষকে একটা দু তরফা সম্পর্কে জরিয়ে দেয়া তো সত্যি একটা ভুল | কথাটা ভেবেই হিয়ার এবার মনে হলো খুব তাড়াতাড়ি এমন কিছু একটা করতে হবে , যাতে প্রিয়ম ভরসা করতে পারে হিয়ার ওপর | যাতে মাঝের এই দিনগুলো ওকে এরকম মানসিক অশান্তির মধ্যে কাটাতে না হয় ! এই ভয়ে কাটাতে না হয় যে হিয়া সারা জীবনের মতন প্রিয়মের জীবনে ঝুলে গেলো ! তাই হিয়াকে খুব তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা নিতে হবে | প্রিয়মকে আস্বস্ত করার ব্যবস্থা | হিয়া যে ওর জীবনে থাকবে না , এই সত্যিটা বিশ্বাস করানোর ব্যবস্থা | কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন হিয়া মাটিতে রোজের মতন বিছানা করেছিল | একটা চাদর আর বালিশ নিয়ে তারপর শুয়ে পড়েছিল নিশ্চুপে | না , সেই ফুলসজ্জার দিন থেকেই ও এইভাবে খাট ছেড়ে নিচে শোয় রোজ | যদিও এইসব করতে প্রিয়ম ওকে বলেনি | তবে ওর বাঁধে খুব | দিনের পর দিন ওর সামনে একজন সোফায় ঘুমায় , শুধু হিয়ার কারণে | তাই হিয়াও আরাম করে খাটে শুতে পারেনি আর |

প্রিয়ম তবে আজও ঘরে এসে খেয়াল করলো এই দৃশ্যটা | কিন্তু কিছু বললো না রোজের মতোই | আসলে এই মেয়েটা নিজের লোভের জন্যই নিজের জীবনে এরকম কিছু অন্ধকার দিন ডেকে এনেছে | একটা না চাওয়ার বিয়ে করেছে যখন জেনে বুঝে , তখন তো অশান্তি সহ্য করতে হবেই ওকে ! আর ভালো , এতো লোভ যার , তার এই শিক্ষাটা হওয়া ভালো | প্রিয়মও যেমন অরুণিমার কথা শুনে এই লোভের মধ্যে জরিয়ে নিজের জীবনে জ্বলছে রোজ , সেই রকম হিয়াও জ্বলুক একই যন্ত্রনায় , একই অপমানে | এটা দেখলেও শান্তি | কথাটা ভেবেই ও ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিলো নিজে থেকে | তারপর এক রাশ অন্ধকারের মাঝে দুটো অচেনা দ্বীপের মানুষ আরেকটা রাত পার করলো নিজেদের জীবনের |

<৫>

কিন্তু পরেরদিন প্রিয়মকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হয়েছিল হিয়াদের বাড়ি শেষে | আসলে অনিন্দবাবুর সুগারটা হঠাৎ ফল করে শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ | সেই পরিস্থিতিতে দাদা বৌদি প্রিয়মকে যখন রিকোয়েস্ট করলো হিয়াদের বাড়ি যাওয়ার কথা , নইলে বাবার মেন্টাল স্ট্রেসটা বাড়বে , তখন প্রিয়ম আর না বলতে পারলো না মুখের ওপর | এখনো, এতকিছুর পরেও আসলে বাবাকে ইচ্ছে করে হার্ট করতে পারে না প্রিয়ম | ভাবতে পারে না , ওর জন্য বাবা অসুস্থ হয়ে পরে থাকবে বিছানায় ! তাই জোর করেই নিজের মনকে বুঝিয়ে গিয়েছিলো হিয়ার সাথে ওদের বাড়ি | কিন্তু হিয়াদের বাড়িতে গিয়ে যতই মুখটা গম্ভীর করে রাখার চেষ্টা করুক না কেন , মনের গভীরে মাঝে মাঝে একটা কথা ভেসে আসছিলো ওর , হিয়ার মা বাবার অবস্থা খারাপ হলেও কত যত্ন করে , কত মন থেকে ওরা প্রিয়মের জন্য আয়োজন করেছে সব কিছু | বাথরুমে নতুন হ্যান্ড ওয়াশ আর টাওয়াল রাখা থেকে দুপুরে লাঞ্চ এর মেনু , চিংড়ি মাছ , ইলিশ মাছ , মাংস , কিছুই বাদ রাখেনি রান্না করতে হিয়ার মা ! তার মধ্যে হিয়ার বাবা আবার ওই শরীর নিয়েও বাজারে গেছিলো না কি আজ ! বেছে বেছে মিষ্টি কিনে এনেছেন জামাই এর জন্য | তবে প্রিয়ম এটাও খেয়াল করেছে আজ , হিয়ার বাবার চেহারাটা সত্যি খুব খারাপ | মুখে চোখে একটা অদ্ভুত ক্লান্তি ! আর পা এর পাতার জায়গা , পেটের জায়গা , এগুলো কিন্তু অস্বাভিকভাবে ফোলা | মাঝে মাঝেই কথা বলতে গিয়ে অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট হচ্ছে , সেটাও বোঝা যাচ্ছিলো | আর লোকটার অনেক লিমিটেশনসও | অতো কিছু রান্না হয়েছিল আজ বাড়িতে ! কিন্তু হিয়ার মা প্রিয়মের সামনেই ওনাকে যখন খেতে দিলো তখন প্লেটে ছিল শুধু আলুসিদ্ধ , একটা মশলা ছাড়া তরকারি , আর ভাত অল্প | জলটাও একেবারে মাপা ! তবে সেইটুকুও হিয়ার বাবা ঠিক পুরোটা শেষ করতে পারলো না যেন !

না , প্রিয়ম এইসব কিছু চোখের সামনে দেখে কিছুতেই রুডলি বিহেভ করতে পারলো না ওদের সঙ্গে এরপর | একটু জোর করে হলেও মুখে একটা হাসি নিয়ে দুপুরের খাবারটা খেলো ও | কেমন একটা মায়া হচ্ছিলো আসলে ওর | ওদের রংচটা বাড়িটা , জীর্ণ শরীরের বয়স্ক দুজন মানুষকে দেখে ,আর তাদের অনেক অভাবের মাঝেও আতিথিয়তা আর ভদ্রতা দেখে প্রিয়ম কিছুতেই ঠিক মনটাকে কঠিন করে রাখতে পারলো না এই সময়ে | ওনারা তো ওনার মেয়ের সুখের কথাই ভেবেছে আসলে | যদি হিয়া ওদের সত্যিটা বলেও থাকে , তারপরও হয়তো নিজেদের এই অবস্থার কথা ভেবে প্রিয়মের সঙ্গে বিয়েটা দিতে রাজি হয়ে গেছে দুজনে ! আর যদি হিয়া ওনাদের সত্যিটা না বলে থাকে , নিজে প্ল্যান করে বিয়েটা করে , তাহলে তো হিয়ার বাবা মার্ আরো কোনো দোষ নেই ! কথাগুলো ভেবেই চুপ রইলো আজ প্রিয়ম | হিয়ার সঙ্গেও খারাপভাবে কথা বলতে পারলো না ওই মানুষগুলোর সামনে |

তবে সেদিন হিয়ার ঘরে রেস্ট নেয়ার জন্য গিয়ে একটু অবাক হয়ে গেলো ও কিছুক্ষণের জন্য যেন | খাটের পাশে রাখা শো-কেসটায় রাখা ভর্তি মেডেল , সার্টিফিকেট এইসবের ভিড় দেখে | প্রিয়ম এবার একটু কাছ থেকে গিয়ে সার্টিফিকেট গুলোতে চোখ বোলাতে বুঝলো এইসবই নাচের জন্য পাওয়া হিয়ার | কোনটা স্টেট্ লেভেল অ্যাওয়ার্ড , কোনটা কলকাতার কোথাও হওয়া কম্পিটিশন থেকে পাওয়া সার্টিফিকেট , তো কোনটা অল ইন্ডিয়া বেসিস এ পাওয়া মেডেল আর সম্মানীয় ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন হিয়া ঘরে ঢুকেছিলো প্রিয়মের সামনে | প্রিয়ম যেন এই মুহূর্তে একটু থমকে গিয়েই জিজ্ঞেস করেছিল ওকে , —————- ” এইসব কি ? এগুলো তোমার অ্যাওয়ার্ড ! তুমি নাচতে ?”

হিয়া প্রশ্নটা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ | প্রিয়ম এই প্রথম ওকে সহজ গলায় কিছু একটা প্রশ্ন করলো ! তাই কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে অল্প কোথায় উত্তর দিলো ,

———— ” হ্যাঁ , ওই আর কি ! একটা সময় ক্লাসিক্যাল ডান্সার ছিলাম |”

কথাটা শুনে প্রিয়ম যেন নিজের মনেই বলে উঠলো এবার ,

————– ” এতো ভালো যখন নাচতে , তখন এই ফিল্ডেই তো নিজের কেরিয়ারটা তৈরী করতে পারতে ! এইভাবে জোর করে একটা বিয়ে না করে !”

কথাটা বলে প্রিয়ম হঠাৎ খেয়াল করলো হিয়ার চোখটা কেমন থমকে গেছে ! কিছু একটা না ছোঁয়া জায়গা যেন কেউ হঠাৎ এসে নাড়িয়ে দিয়েছে ওর মনে | প্রিয়ম ঠিক বুঝলো না ব্যাপারটা ! তখন হিয়ায় নিজে থেকে বলে উঠলো আস্তে গলায় , ————– ” দিল্লিতে ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কম্পিটিশন ছিল সেইবার , ২০১৭-র জ্যানুয়ারিতে | স্টেট্ লেভেল থেকে সিলেক্ট হয়ে গিয়েছিলাম , ক্ল্যাসিকাল ডান্সের জন্য | ভরতনাট্যম | সেকেন্ড হয়েছিলাম এতগুলো স্টেটের মধ্যে | শ্রীলংকায় গিয়ে পারফর্ম করারও একটা চান্সও পেয়েছিলাম | প্লাস স্কলারশিপ | ছ মাসের জন্য যে কোনো কেন্দ্রীয় ইউনিভার্সিটি থেকে ক্ল্যাসিকাল ডান্সিং এর ওপর কোর্স করতে পারবো | হয়তো তারপর কোনো একটা বড়ো ডান্স গ্রূপে চান্সও পেয়ে যেতাম ট্রেনার এর পোস্টে ! কিন্তু শ্রীলংকা যাওয়ার সাতদিন আগেই বাবার কিডনির প্রব্লেমটা বেড়ে গেলো খুব | ডায়ালিসিস স্টার্ট হলো | সাতদিন আই.সি.ইউ তে | হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাওই আর যাওয়া হলো না আমার ! আর স্কলারশিপটাও আর নেয়া পসিবল হলো না তারপর | বাবাকে ওই অবস্থায় ফেলে তো আর ছ মাসের জন্য কোর্স করতে যেতে পারি না ! নাচটা তখন থেকেই বাদ হয়ে গেলো জীবনে , হঠাৎ করেই |”

কথাগুলো বলে হিয়া এবার থামলো কয়েক মুহূর্ত | যেন মনের ভেতরের ক্লান্তি এসে জড়ো হয়েছিল ওর গলায় | একটা না পাওয়ার যন্ত্রনা এসে ঘিরে ধরেছিলো হিয়াকে চারিদিক থেকে ! আর প্রিয়মেরও এই মুহূর্তে কিছু বলার ছিল না ! না চাইতেও খারাপ লাগছিলো ঘটনাটা শুনে এই মেয়েটার জন্য ! ঠিক কোনো কথা বলে উঠতে পারছিলো তাই ! তবে হিয়াও আর দাঁড়ালো না প্রিয়মের সামনে | আসলে প্রিয়ম যে ওর ঘরে আছে , সেটা জানতো না হিয়া | আগে জানলে আসতো না এই সময়ে এখানে | কথাটা ভেবেই বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে |

কিন্তু সেদিন মা এরপর হঠাৎ ওকে নিজের ঘরে ডেকে এনে একটা প্রশ্ন করে উঠেছিল নিজে থেকে ! হিয়ার যেই প্রশ্নটা শুনে তালটা কেটে গিয়েছিলো আচমকা সেই মুহূর্তে | মা ওকে সোজাসুজিই জিজ্ঞেস করেছিল আসলে , ———— ” প্রিয়মের সঙ্গে সব কিছু ঠিক আছে তো তোর ? ওকে কিরকম ছাড়া ছাড়া লাগে তোর সঙ্গে দেখে ! কিছু যদি অসুবিধা থাকে তাহলে বল আমাকে | আমি জানি তোর বাবার অবস্থা খুব খারাপ | আমাদের কোনো ভালো সামর্থ নেই আর | কিন্তু এর জন্য তুই ভাবিস না ! আমরা আছি এখনও তোর জন্য | আর বিয়ের সময়ও দেখেছিলাম ও ঠিক খুশি না ! আর আজ আমাদের বাড়িতেও দেখলাম ! আমাদের সাথে কথা বললেও , তোর সঙ্গে তো ওর কোনো কথাই নেই বলে মনে হলো ! ” কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গিয়েছিলো মা | আর হিয়া কিরকম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো আচমকা | আসলে মা কে মিথ্যা বলাটা খুব শক্ত ওর কাছে | কিন্তু সত্যিটাও যে বলার নেই হিয়ার ! অন্তত বাবা যেকটা দিন বেঁচে আছে , সেকটা দিন তো কখনোই সম্ভব না ! তাই একটা বানানো উত্তর ওকে বলতেই হলো আজ মায়ের সামনে | একটা মিথ্যে হাসি নিয়েই হিয়া বললো ,

————- ” তুমি ভুল ভাবছো মা ! প্রিয়ম আসলে একটু ইন্ট্রোভার্ট | কম কথা বলে | একটু সিরিয়াস | ব্যাস | সেই জন্যই তোমার মনে হচ্ছে এইসব | আসলে এগুলো কিছুই না | ও খুব কেয়ারিং | খুব ভালো | আর যদি কোনো অসুবিধা হতো কেন বলতাম না তোমাদের ! আমি তো জানি তোমরা আছো | প্লিজ এইসব নিয়ে ভেবো না | ”

কথাটা শুনে মা সেদিন কিরকম কেঁদে ফেলেছিলো হিয়ার সামনে | একটা অদ্ভুত কষ্টের কান্না ছিল মায়ের গলায় | হিয়া সঙ্গে সঙ্গে মা কে জড়িয়ে ধরেছিলো তখন | চারিদিক দিয়ে ভেঙে পড়া ছন্নছাড়া মা কে যেন আগলে রাখতে চাইছিলো ও | তখনই ওর মা ভাঙা গলায় বলে উঠলো ,

————- ” আসলে তোর বাবা রোজ একটু একটু করে যেন খারাপের দিকে যাচ্ছে ! আমি বুঝি | এখন শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে আরো | আমি বলেছিলাম আরেকবার ডায়ালিসিসের কথা | কিন্তু রাজি হয়নি | অতটা খরচ , আর এতটা শরীরে কষ্ট যেন নিতে চাইছে না আর | তাই নিজেই ইচ্ছে করে আরো তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে চাইছে মৃত্যুর দিকে | আর ভালো লাগে না এইসব | খুব চিন্তা হয় | সব কিছু নিয়ে খুব চিন্তা হয় |”

না , কথাগুলোর কোনো উত্তর দিতে পারেনি হিয়া | কিরকম নির্বাক লাগছিলো নিজেকে | এই শোকের কি সত্যি কোনো স্বান্তনা হয় ! যার যায় সে ই শুধু বোঝে ! আর এতগুলো বছর একটা মানুষের সঙ্গে সংসার করার পর যখন তাকে চোখের সামনে এইভাবে একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে দেখতে হয় , তখন যে কি ভয়ঙ্কর দম বন্ধ করা যন্ত্রনা হয় বুকে , সেটা হিয়া জানে | আর ওর তো বাবা | তাই আরো বুঝতে পারে | কথাগুলো ভেবেই ও জল ভর্তি চোখে খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মা কে | কিছু না বলে শুধু জড়িয়ে রাখলো নিজের সঙ্গে | কিন্তু এই মুহূর্তে এই দৃশ্যটা আরো একজনের চোখে পড়লো দরজার আড়াল থেকে | প্রিয়ম ওই ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো আসলে রান্না ঘরে , জল খাওয়ার জন্য | কিন্তু না চাইতেই থেমে গেছিলো হিয়ার মায়ের ভেজা গলার শব্দে | তারপর দরজার আড়াল থেকে দেখেছিলো সবটা | না , এটা মিথ্যা হতে পারে না ! তার মানে হিয়ার বাবার শরীর সত্যি এতটা খারাপ ! আর ও এতদিন অন্ধের মতন কথাগুলো সত্যি ভাবেনি ! হিয়ার বাবাকে দেখেও খেয়াল করেনি মন দিয়ে ! কথাটা ভেবে নিজের চোখটাই কিরকম নিচে নেমে গেলো ওর | একটা নিজের ওপর খারাপ লাগা তৈরী হলো ভেতর থেকে , এই প্রথম |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here