হৃদয়_মাঝে ( সপ্তম পর্ব ) #ঈপ্সিতা_মিত্র

0
332

#হৃদয়_মাঝে ( সপ্তম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৪>

সেদিন সকাল নটায় এরপর হিয়ার ঘুম ভেঙেছিল | প্রিয়মকে এতো কাছ থেকে দেখে ও এবার একটু ইতঃস্তত হয়ে গেছিলো হঠাৎ | কাল রাতে ঘুমের ঘোরে বোঝেনি , প্রিয়মের হাতের ওপরই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল ! প্রিয়ম এটা দেখে খারাপ ভাববে না তো ! ভাববে না তো ও ইচ্ছে করে এইসব করেছে ! ভাববে না তো হিয়া জোর করে ওদের সম্পর্কটাকে সত্যি করতে চাইছে ! কথাটা ভেবেই হিয়া উঠতে যাচ্ছিলো , কিন্তু খেয়াল করলো প্রিয়ম নিজের হাতে হিয়াকে শক্ত করে ধরে আছে এখন | হয়তো ঘুমের ঘোরেই ওকে এইভাবে আঁকড়ে ধরেছে ছেলেটা ! কথাটা ভেবেই হিয়া এবার খুব সাবধানে প্রিয়মের হাতটা সরালো ওর হাত থেকে | তারপর নিঃস্তব্ধে উঠে বসলো খাটে | তবে এই মুহূর্তে খেয়াল হলো ওর জ্বর নেই তো আর ! ঠিক আছে তো প্রিয়ম এখন ! কথাটা মনে হতেই ও প্রিয়মের কপালে নিজের হাতটা ঠেকালো | ঠান্ডা কপালটা হিয়াকে যেন স্বস্তি দিলো ভীষণ | যাক , জ্বর নেই আর তার মানে | কথাটা ভেবেই হিয়ার মুখে একটা হাসি চলে এলো আনমনে , আর তখনই প্রিয়মের ঘুমটাও ভেঙে গেলো হঠাৎ | ও হিয়ার দিকে কিরকম স্থির ভাবে তাকিয়ে রইলো যেন কিছুক্ষণ চোখ খুলে | প্রিয়ম কি খারাপ কিছু ভাবছে ! ওর দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছে কেন এখন ! কথাটা ভেবেই হিয়া একটু এলোমেলোভাবে কথা সাজিয়ে বলে উঠলো , ——— ” আসলে কাল আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ! বুঝিনি | আসলে জ্বর ছিল খুব তোমার, তাই ! আমি আসছি |”

কথাটা কিরকম এক নিঃশ্বাসে বলেই হিয়া যেতে যাচ্ছিলো প্রিয়মের সামনে থেকে ! আসলে এখন খুব অস্বস্তি হচ্ছে ওর | বুঝতে পারছে না প্রিয়ম ঠিক কি ভাবছে ওকে নিয়ে ! কিন্তু প্রিয়ম যখন হঠাৎ ওর হাতটা আবার ধরে উঠলো , তখন হিয়া থমকে গেলো কেমন | প্রিয়ম এবার ওর দিকে আগের মতন স্থিরভাবে তাকিয়েই বললো উঠে বসে ,

———– ” তোমার কোনো অসুবিধা হয়েছিল কাল আমার সঙ্গে ঘুমোতে ?”

হিয়া এরকম একটা প্রশ্নের ঠিক কোনো মানে খুঁজে পেলো না যেন ! অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো , ———— ” মানে ?”

প্রিয়ম অল্প হেসে উত্তর দিলো , ————- ” মানে আমি কি নাক ডাকি ? তোমার ঘুমের কোনো ডিস্টার্ব হয়েছে ? ”

হিয়া কথাটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো ! তারপর সেই অবাক হয়েই বললো , ———- ” না না ! নাক তো ডাকোনি ! কিন্তু কেন ?”

প্রিয়ম এবার আলতো হেসে একটু দৃঢ় গলায় জিজ্ঞেস করলো , ———— ” তাহলে কি আমি তোমার সাথে এই খাটে এরপর ঘুমোতে পারি ? না কি কাল রাতে জ্বর ছিল বলেই অনলি কনসেশনটা পেলাম ? ”

হিয়া কথাটার ঠিক কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো , ———– ” এ বাবা , না না | ঘুমোবে না কেন ! এটা তো তোমার খাট , আমার পার্মিশনের কি আছে ! রোজ ঘুমোতে পারো | আমি তো প্রথমেই বলেছিলাম আমি খাটে শোবো না ! আর আমি তাহলে এরপর সোফায় ঘুমোবো | প্রব্লেম নেই কোনো !”

হিয়ার কথাটা শুনে এবার প্রিয়ম আকাশ থেকে পড়লো ! ও অবাক হয়েই বললো , ————— ” আমি কি তোমাকে এটা বললাম ? তুমি এতকিছু শুনে এই বুঝলে !”

হিয়া এর ঠিক কি উত্তর দেবে এবার সত্যি বুঝে উঠতে পারলো না ! প্রিয়ম তো বললো ও এরপর থেকে খাটে ঘুমোতে চায় | তার মানে তো হিয়াকে সোফাতেই ঘুমোতে হবে হয়তো ! কথাগুলো নিজের মনে ভেবেই ও একটু কনফিউসড হয়ে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে রইলো ! প্রিয়ম এবার হিয়াকে দেখে হেসে ফেললো হঠাৎ ! সত্যি ! কি করবে ও এই মেয়েটাকে নিয়ে ! কথাটা ভেবেই ও আস্তে গলায় বোঝানোর মতন করে বলে উঠলো , ———– ” হিয়া , আমি জিজ্ঞেস করেছি এরপর আমরা কি এই খাটে ঘুমোতে পারি ? আমরা মানে আমি আর তুমি ! একসঙ্গে ! আমি তো নাক ডাকি না | তোমার প্রব্লেম হবে না ঘুমের কোনো !”

কথাটা শুনে হিয়া এবার আনমনে লজ্জায় হেসে ফেললো হঠাৎ ! একটা অন্যরকম ভালো লাগা এসে ঘিরে ধরলো ওকে যেন | মনে হলো কাঁচের দেয়ালটা ভাঙতে শুরু করেছে | আর কেউ সেটার আড়াল থেকে বেড়িয়ে ধীরে ধীরে খুব স্পষ্টভাবে এসে ধরা দিচ্ছে ওর সামনে | হিয়া তাই আর এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না | সেই আলতো হাসিটা সঙ্গে নিয়েই নিজের চোখটা নামিয়ে একটু আস্তে গলায় বলে উঠলো , ———— ” তুমি কফি খাবে তো ? আমি নিয়ে আসছি |”

কথাটা বলেই ও আর বসে থাকলো না ! প্রিয়মের সামনে থেকে চলে গেলো এই মুহূর্তে | তবে প্রিয়মের মুখেও একটা হাসি এসে জড়ো হলো হঠাৎ | হিয়ার না বলা উত্তরটা বুঝতে পেরেছে প্রিয়ম | তাই একটা অচেনা বসন্ত এসে ভিড় করলো চারিদিকে |

সেই সকালের পর থেকে প্রিয়ম আর হিয়ার মধ্যে দিনগুলো বেশ ভালো কাটছিলো | নতুন কারোর কাছে আসার ফিলিং কে সঙ্গে নিয়ে | মনে হচ্ছিলো অনেকদিনের থেমে থাকা গল্পটা যেন আস্তে আস্তে কমপ্লিট হচ্ছে | ওই খাপছাড়া , মিসিং পাতাগুলোকে হঠাৎ ফিরে পাচ্ছে দুজনে | যেই গল্পটা শুরু থেকেই ইনকমপ্লিট ভেবে লেখা শুরু হয়েছিল , সেটা আজ একটা পরিণতির দিকে এগোচ্ছে , একদম রূপকথার মতন | এর মধ্যে হিয়ার বাবাও অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে অপারেশনের পর | ট্রান্সপ্লান্ট করা কিডনি ঠিকঠাকভাবেই ফাংশন করছে | সাত দিন অবসার্ভেশনে রেখে আজ তাই ছেড়ে দেবে ওনাকে নার্সিংহোম থেকে | হিয়া কাল বিকেলে খবরটা পেয়েছিলো ! তারপর থেকে মনটা অদ্ভুতভাবে ভীষণ হালকা লাগছে | মনে হচ্ছে যা যা ভুল ছিল , যা যা খারাপ লাগা ছিল জীবনে , সব এক এক করে ঠিক হয়ে যাচ্ছে যেন কোনো ম্যাজিকে | যেখানে শেষ ভেবেছিলো , সেখান থেকে যে জীবনটা এইভাবে শুরু হতে পারে , এইভাবে নিষ্প্রাণ শরীর প্রাণ ফিরে পেতে পারে , এটা ঠিক কল্পনাও করেনি এতদিন ! আর সব হয়েছে প্রিয়মের জন্য | ও বাবার জন্য ডোনার জোগাড় করেছিল বলেই তো সবটা হলো | মায়ের মুখে এতদিন বাদে একটা সুন্দর হাসি দেখতে পেলো হিয়া | কথাগুলো ভেবেই এই ছেলেটাকে আরো বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে এখন | মনে হচ্ছে আর নিজের মধ্যে ফিলিংসগুলোকে জমিয়ে না রেখে বলে দিক সব কিছু প্রিয়মকে | সাজিয়ে গুছিয়ে শব্দগুলো শুনিয়ে দিক প্রিয়মকে নিজে থেকে | আর সেই সকালের পর তো হিয়া এটাও জানে, যে প্রিয়মও ওকে ভালোবাসে | ওকে নিজের করে পেতে চায় | তাই ফিলিংস সামনাসামনি একসেপ্ট করতে ভয়ের কিছু নেই আর | এইসব কথা ভেবেই পরেরদিন বাবাকে আনতে গিয়েছিলো নার্সিংহোমে প্রিয়মের সঙ্গে | নার্সিংহোমের কাগজপত্র সব রেডিই ছিল | কিছু সাইন করছিলো প্রিয়ম রিসেপশনে | হিয়া তখন মেল্ ওয়ার্ডে বাবার ব্যাগ গোছাচ্ছিল | মা ও এসেছে চন্দনগর থেকে | প্রিয়ম একটা এম্বুলেন্স ঠিক করেছে , হিয়ার বাবার জন্য | সেদিন এইভাবেই এগোচ্ছিল দিনটা , কিন্তু হঠাৎই রূপকথা ধাক্কা খেলো বাস্তবের সঙ্গে | প্রিয়ম রিসেপশন থেকে সাইন করে হিয়ার বাবার ওয়ার্ডের দিকেই যাচ্ছিলো , কিন্তু থেমে গেলো হঠাৎ দূরে এমার্জেন্সির সামনে বসে থাকা একটা রক্তাত্ব মুখ দেখে | অরিজিৎ না ! অরুণিমার বন্ধু | মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে ছেলেটার | একসিডেন্ট হয়েছে না কি কোনো ! কথাটা ভেবেই ও এগিয়ে গেলো সেই চেনা মুখের দিকে | অরিজিৎ মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল বেঞ্চটায় , হঠাৎ প্রিয়ম ওর সামনে আসাতে যেন একটু অসহায়ের মতন বলে উঠলো , ———– ” প্রিয়মদা তুমি ? এখানে ! থ্যাংক গড …”

প্রিয়ম এবার নিজেও প্রশ্ন করে উঠলো , ————– ” কি হয়েছে তোমার ? একসিডেন্ট ?”

কথাটা শুনে অরিজিতের কিছু বলার আগেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সটা বলে উঠলো , ————- ” ড্রিংক এন্ড ড্রাইভের কেস | সঙ্গে একটা মেয়েও আছে | ইমার্জেন্সিতে ফার্স্ট এড চলছে | ও তো এই ছেলেটার থেকেও বেশি নেশা করেছে | সঙ্গে আবার ড্রাগসও নিয়েছে | সকাল সকালই | যত সব !”

কথাটা শুনে প্রিয়ম অবাক হয়েই একটু গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বললো , ————— ” তুমি নেশা করে ড্রাইভ করছিলে ! সিরিয়াসলি ! আর কে আছে সঙ্গে তোমার ?”

কথাটার উত্তরে অরিজিৎ এবার কেঁদেই ফেললো কয়েক সেকেন্ডে | তারপর একটু কথা সাজিয়ে বললো , ———— ” প্লিজ প্রিয়মদা , একটু হেল্প করো | এরা পুলিশ কেস দিয়ে দেবে বলছে ! ফেঁসে যাবো পুরো আমরা | ইন্ডাস্ট্রিতে জানতে পারলে বাজে রেপুটেশন হয়ে যাবে | আমি তো একা নোই | অরুনিমাও আছে | ওরও কেরিয়ারে প্রব্লেম হয়ে যাবে | প্লিজ হেল্প করো প্রিয়মদা | অরুনিমা ভীষণ ইনজিওর্ড ও | তুমি নিজে গিয়ে দেখো | ”

কথাটা শুনে প্রিয়ম যেন থমকে গেলো কিরকম | এখন এই পরিস্থিতে অরুণিমাকে দেখতে হবে , এটা ভাবেনি আসলে | তবে এই মুহূর্তে ঠিক এখানে দাঁড়িয়েও থাকতে পারলো না | অনেকদিনের চেনা অরুনিমা ওর | সেই পুরোনো দিনগুলোর জন্যই হয়তো ও এগিয়ে গেলো এমার্জেন্সির ভেতরে | তারপর আরেকবার থমকে গেলো | দরজার পাশে একটা স্ট্রেচারের ওপর বসে আছে মেয়েটা | কালো টিশার্টটায় রক্ত জমে লাল হয়ে গেছে | কপালে কিছুটা জায়গায় ব্যান্ডেজ বাঁধা | ডান হাতটাও ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো | তবে এই সময়ে অরুনিমাও ওকে খেয়াল করলো দরজার সামনে | ও প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো প্রিয়মের নাম ধরে | ওর চোখ থেকে হঠাৎ কিরকম জল পড়তে শুরু করলো হঠাৎ দেখার ! প্রিয়ম এরপর কাছে আসতেই অরুনিমা জড়িয়ে ধরলো ওকে ভীষণ শক্তভাবে | তারপর কিরকম জরানো গলায় এলোমেলো ভাবে বললো , ———— ” আই মিসড ইউ সো মাচ …. কেন চলে গেলে তুমি ! আমি বুঝেছি , আই ওয়াস রং .. আমার ভুল ছিল | আমি আর কোনোদিন এরকম করবো না | প্লিজ ডোন্ট গো প্রিয়ম .. ডোন্ট লেট্ মি ফিল এলোন এগেন !”

কথাগুলোর মধ্যে এলকোহলের গন্ধটাও ভীষণভাবে নাকে এলো প্রিয়মের | বুঝতে পারলো অরুনিমা ঠিক নিজের মধ্যে নেই | নেশার মধ্যে হারিয়ে আছে ও | তাই এইসব ইমোশনাল কথা বেরিয়ে আসছে হঠাৎ | ও এবার একটু জোর করেই ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো অরুণিমার কাছ থেকে নিজেকে , কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলো পাশের দরজায় একজন কিরকম স্থিরভাবে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে যেন | হিয়া অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে | কিরকম কালো হয়ে এসেছে মুখটা ওর | প্রিয়ম হিয়াকে দেখেই এবার ঝাঁকিয়ে প্রায় অরুণিমাকে সরিয়ে দিলো নিজের ওপর থেকে | কিন্তু ততক্ষণে হিয়াও ঠিক আর অপেক্ষা করলো না | প্রিয়মের কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে ও লম্বা টানা করিডোরটায় হাঁটতে শুরু করলো জোর পায়ে | যেন মনে হচ্ছে এই সময় পালিয়ে যেতে চাইছে ও | এই কঠিন বাস্তবটা থেকে , ওর ভাঙা স্বপ্নগুলোর কাছ থেকে , অনেক দূরে পালিয়ে যেতে চাইছে হিয়া | সত্যি কি বোকা ও ! কিছুক্ষণ আগেও ও প্রিয়মকে নিয়ে ফিল করছিলো মন থেকে | ওকে অনেকটা সময় ওয়ার্ডে ফিরে আসতে না দেখে নিজে গেছিলো তাই রিসেপশনে খোঁজ নিতে | তখন রিসেপশনিস্টের মুখেই শুনেছিলো প্রিয়মের এমার্জেন্সির দিকে যাওয়ার কথাটা | সেই মুহূর্তে কিছু না ভেবেই তাই এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে এসেছিলো হিয়া | কিন্তু এরকম দৃশ্য দেখবে ঠিক , ভাবেনি | অরুণিমার একটা ছবি দেখেছিলো আসলে হিয়া অনেকদিন আগে প্রিয়মের আলমারিতে | তাই আজ প্রথমবার ওকে সামনে থেকে দেখে এক সেকেন্ডের জন্যও চিনতে অসুবিধা হয়নি ওর | আর চিনতে অসুবিধা হয়নি নিজের জায়গাটাও |

<১৫>

সেই সময়ে হিয়া আর কোনোদিকে না তাকিয়ে মেল্ ওয়ার্ডে বাবা মার্ কাছে চলে এসেছিলো | প্রিয়ম ডেকেছিল পেছন থেকে কয়েকবার ! তবে হিয়া আর শোনেনি সেই ডাক | জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো মা বাবার কাছে | আসলে মনে হচ্ছিলো প্রিয়মের সঙ্গে আর একলা হওয়া যাবে না কোনোভাবেই | ওর সঙ্গে এক সেকেন্ডে যেন হাজার লক্ষ মাইল দূরত্ব এসে জমা হয়েছে হিয়ার | আর সেই দূরত্ব পেড়িয়ে এই ছেলেটার কাছে যাওয়া হবে না আর কখনো | আর কাছে গিয়ে শুনবেই বা কি ! অরুনিমা ফিরে এসেছে ! তাই আর প্রিয়ম নিজেকে সামলাতে পারেনি | আঁকড়ে ধরেছে ওকে | আর সব থেকে বড়ো কথা এতো এক্সপ্লিনেশন দেবেই বা কেন ছেলেটা হিয়াকে ! একটা মিথ্যে বিয়ের জন্য | একটা নামহীন , কয়েকদিনের লোক দেখানো সম্পর্কের জন্য ! এইসবের তো কোনো দরকার নেই | হিয়ার প্রতি কোনো দ্বায় নেই প্রিয়মের | কোনো কমিটমেন্ট নেই | তাই হিয়ারও কিছু শোনার নেই | কথাগুলো ভেবেই সেদিন ডিসিশন নিয়েছিল হিয়া কয়েক সেকেন্ডে | কলকাতা ছেড়ে চন্দননগর ফিরে যাওয়ার ডিসিশন | প্রিয়ম ওর আসার কিছুক্ষণের মধ্যে মেল্ ওয়ার্ডে ঢুকলে হিয়া আস্তে গলায় বাবা মার্ সামনে বলে উঠেছিল ওকে ,

———— ” আমি মা বাবার সঙ্গে চন্দননগর যাচ্ছি | এখন ওখানেই থাকবো | বাবার শরীরটা তো এখনো খারাপ | ওদের একা থাকাটা ঠিক না | ”

প্রিয়ম এই কথাগুলোর মানে বুঝেছিলো খুব স্পষ্টভাবে | বুঝেছিলো ওর আর হিয়ার মাঝে হঠাৎ একটা দেয়াল উঠে গেছে ! তাই হিয়া এইভাবে সরিয়ে নিচ্ছে নিজেকে | কিন্তু প্রিয়মের কিছু বলার আগেই হিয়ার মা বলে উঠেছিল ওকে , ————– ” সেটা কি করে হয় ! এখন তো তোদের বাড়ি খালি | মানে অনিন্দদা , প্রিয়মের দাদা , সবাই তো কলকাতার বাইরে ব্যবসার কাজে | প্রিয়মের একা থাকতে অসুবিধা হবে না !”

কথাটা শুনে হিয়া কিরকম যেন নিজের মনেই প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল , ————– ” প্রিয়ম একা নেই তো | অনেকে আছে |”

হিয়ার কথাটার মানে প্রিয়ম এই মুহূর্তে ভীষণ ভালোভাবে বুঝলেও হিয়ার মা ঠিক বুঝতে পারেনি | তাই অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেছিল , ———– ” মানে ? কে আছে ?”

হিয়া প্রশ্নটা শুনে একটু যেন নিজেকে সামলে কথা সাজিয়ে উত্তর দিয়েছিলো , ———- ” না , মানে , অনেক কাজের লোক আছে | অসুবিধা হবে না কোনো !”

প্রিয়ম এই কথাটা শুনে নিজেও কেমন থমকে গেছিলো | বুঝতে পারছিলো না হিয়াকে সবটা এক্সপ্লেন করবে কি করে ! ওর মা বাবার সামনে তো কিছু বলতেও পারবে না মেয়েটাকে ! সব যেন কিরকম এলোমেলো লাগছিলো ওর | নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিলো ভীষণ | কি দরকার ছিল অরুণিমাকে দেখতে যাওয়ার ! যেই মেয়েটা ওকে দিনের পর দিন ঠকিয়েছে , ড্রিংক করে ড্রাগস নিয়ে একটা একসিডেন্ট করেছে , সেই মেয়েটার জন্য সিম্প্যাথেটিক হওয়ারই বা কি ছিল ! আর যদি দেখতে যেতেও হয় , হিয়াকে সঙ্গে নিয়েই যেত | তাহলে এইভাবে একটা ভুল বোঝাবুঝি হতো না মেয়েটার সঙ্গে ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন সবটা যেন অন্ধকার লাগছিলো ওর , আর হিয়া সেই অন্ধকারের মাঝে ওর চোখের সামনে এম্বুলেন্স উঠে বসেছিল বাবা মায়ের সঙ্গে | ও আর ফিরে তাকায়নি প্রিয়মের দিকে | যেন এম্বুলেন্সের দরজার ওপার থেকে কিছু না বলে বুঝিয়ে দিয়েছিলো দূরত্বটা | আর এদিকে প্রিয়মেরও আজ খুব ইম্পরট্যান্ট একটা মিটিং আছে দুপুরে অফিসে ! , তাই চাইলেও হিয়াদের সঙ্গে চন্দননগর যেতে পারেনি ও | শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে হিয়ার নিঃস্তব্ধে চলে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখতে হয়েছিল প্রিয়মকে ! আর গল্পের এই পৃষ্ঠাতে এসে প্রিয়মের চারিদিকটা শূন্য হয়ে এসেছিলো হঠাৎ | বসন্তের নতুন আসা রংগুলো যেন কিরকম ফিকে হয়ে গেছিলো ওর সামনে | এক মুহূর্তেই |

এরপরের সাতটা দিন কিরকম প্রাণহীন , নিঃস্তব্ধতায় কেটে গেলো প্রিয়মের | একজনের চব্বিশ ঘন্টা সঙ্গে থাকার অভ্যাসটা ঠিক কিরকম , প্রিয়ম এটা এই একলা ঘরটায় এসে, ফাঁকা অফিসের ডেস্কটাকে দেখে রোজ বুঝতে শুরু করলো | সেই সময় কিরকম নিজের চারিদিকটা ফাঁকা , অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিলো যেন ওর | হঠাৎ মনে হচ্ছিলো খুব কাছের একজন হারিয়ে গেছে কিছু না বলে | চুপচাপ চলে গেছে সব কিছুকে একা করে | প্রিয়ম এর মধ্যে হিয়াকে ফোন করেছে বেশ কয়েকবার | কিন্তু হিয়া কিছুতেই একবারও ফোন ধরেনি ওর | উল্টে স্যালারির সমস্ত টাকা কিছু না বলে প্রিয়মের একাউন্টে ট্রান্সফার করে দিয়েছে চন্দননগর যাওয়ার দুদিনের মধ্যে | প্রিয়ম এইসবের মানে খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে এখন | হিয়া ওদের বিয়েটাকে ভেঙে দেয়ার কথাই ভাবছে ! আগের শর্তের মতন তাই চলে গেছে চন্দননগর , আর না ফেরার জন্য | আর সত্যি কি অদ্ভুত মেয়ে ! একটা কি দেখলো , ব্যাস , সব শেষ করে দেয়ার কথা ভাবছে এইভাবে ! লোকে তো একবার অন্তত কথাটা শোনে ! খুন করলেও আসামীকে ফাঁসির সাজা শোনানোর আগে নিজের হয়ে কিছু বলার জন্য সুযোগ দেয় কোর্ট | আর এদিকে হিয়া , একবার ফোনটা তোলার ও দরকার বোধ করছে না | এইভাবে মাঝপথে সব কথা বন্ধ করলে হয় ! এতদিনের সম্পর্ক ওদের ! বিয়েটাও তো হয়েছিল | সবার সামনে লোক খাইয়ে প্রিয়ম হিয়াকে সিঁদুর পড়িয়েছিলো | মানছে , তারপর ওদের মধ্যে কিছু ঠিক ছিল না ! প্রিয়মের ভুলের জন্যই ঠিক ছিল না | কিন্তু সেসব তো পুরোনো কথা | এই শেষ কটা মাসে ওদের মধ্যে তো নতুন শুরু হয়েছিল সম্পর্কের | প্রথমে বন্ধুত্ব , তারপর ভালোবাসা , টান সবই তো তৈরী হয়েছিল দুজনের ! না কি প্রিয়ম মুখে কখনো ‘ভালোবাসি’ বলেনি বলে হিয়াও মন থেকে কিছু বিশ্বাস করতে পারেনি ! তাই প্রিয়মকে কিছু বলার , কিছু এক্সপ্লেন করার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো এইভাবে | কথাগুলো যেন চব্বিশ ঘন্টা মনে হতে শুরু করলো প্রিয়মের | তবে এইভাবে চুপ করে কলকাতায় বসে থাকলে আর কিছু হবে না | একদম সামনাসামনি গিয়ে না দাঁড়ালে হিয়া হয়তো সত্যি ভেঙে দেবে বিয়েটা | এই ভাবনাটাও প্রিয়মের মনে এসে জমা হলো | তাই ও আর দেরি না করে কলকাতার অফিসের সব কাজ মিটিয়ে এই রবিবার সোজা চন্দননগরের রাস্তা ধরলো হাইওয়ে দিয়ে | ড্রাইভ করে সাতদিনের দূরত্ব দেড় ঘন্টায় মিটিয়ে প্রিয়ম অবশেষে পৌঁছেও গেলো হিয়ার সামনে , ওর চন্দননগরের বাড়িতে |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here