ছেলেটা বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কী বললেন আপনি? ”
আমি আগের মতোই সিরিয়াস গলায় শাসিয়ে বললাম, এক থাপ্পড়ে আপনার বত্রিশ দাঁত ফেলে দেব।
ছেলেটা নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না যেন এখনো। বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। সিড়ি দিয়ে নামার সময় গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগলে, আমাকে স্যরি বলেছিল। কিন্তু আমার ইচ্ছে হলো শয়তানী করার। এই ছেলেটা আমাদের নতুন ভাড়াটিয়া আন্টি আঙ্কেলের ছেলে। যাদের কাজ হলো চব্বিশ ঘণ্টা আমার বাবা, মা’র কানের কাছে গুনধর ছেলের গুনকীর্তন করা। তাই এটাকে দেখলেই গা জ্বালা করে। কিন্তু বাছাধন অতি ভদ্র। তিনি মেয়েদের দিকে তাকানও না। এই যে ধাক্কাটা লাগলো তখনও সে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখে নি। অন্যদিকে তাকিয়েই স্যরি বলল। আরে ব্যটা দ্যাখ একটু তাকিয়ে! কী সুন্দর ডানাকাটা পরী ডানার অভাবে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে।
কিন্তু যখনই বললাম, ফাজিল ছেলে মেয়ে দেখলে ধাক্কা দিতে মন চায়! এক থাপ্পড়ে বত্রিশ টা দাঁত ফেলে দেব তখন ঠিক ই তাকিয়ে দেখল। তারপর আবার বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখছে।
আমি আবারও বললাম, আপনার বাবার কাছে বিচার দেব যে আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন।
আমাকে অবাক করে দিয়ে বদমায়েশ টা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আপনি কী ঐশ্বরিয়া যে আপনাকে ধাক্কা দেব।”
আমি বললাম, আমি ওই বিড়ালচোখা হতে যাব কোন দুঃখে। ওকে তো আমার বাসার বুয়া হিসেবেও রাখব না। ”
“আপনি একটা বেয়াদব মেয়ে। ”
কথাটা বলে হন হন করে হেটে চলে গেল। আমাকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দিলো না। আমি রাগে গজ গজ করে বললাম, তোকে আমি দেখে নেব শালা।
ছেলেটা শুনতে পেল না। ও হ্যাঁ বদমায়েশ ছেলেটার নাম নিলয়। সেদিন সন্ধ্যায় নিলয়ের মা এক বাটি পায়েশ হাতে আমাদের ঘরে এলো। সচরাচর উনি এলে মায়ের সাথেই বক বক করে। কিন্তু সেদিন এসে আমাকে ডেকে বলল, প্রত্যাশা জানো আজ কী হয়েছে? একটা চূড়ান্ত বেয়াদব মেয়ে আজ আমার নিলুকে বাজে কথা বলেছে।
আমি একটা শুকনো ঢোক গিললাম। মাগো! এ তো দেখছি টিপিক্যাল মাম্মাস বয়। আমি আমার সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে হেসে বললাম, কী বলছেন আন্টি? কোন মেয়ে?
“তা তো জানিনা। ও তো নাম বলতে পারলো না। এইজন্য ই তো তোমার কাছে এলাম, তুমি তো এই বিল্ডিং এর সব মেয়েকে চেন! তুমি একটু খোঁজ নিও তো।”
আমি আমার দাঁত কপাটি বের করে বললাম, নিশ্চয়ই আন্টি। নিলু ভাইয়ের মতো একজন ডিসেন্ট ছেলের সাথে কে বেয়াদবি করেছে সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব তো আমার ই। আমি কাল ই খুঁজে বের করব।
আন্টি হৃষ্টচিত্তে ফিরে গেলেন আর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই মাম্মাস বয় কে আরেকটা শিক্ষা দেয়ার।
পরদিন আন্টির বাটি ফিরিয়ে দেবার নাম করে তার বাসায় গেলাম। আন্টি তো আইসক্রিমের মতো গলে গলে পড়ছে আমাকে দেখে । কী খাওয়াবে সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি হাসি মুখে অত্যাচার সহ্য করছি। অবশ্য অত্যাচার বললে ভুল হবে, মধুর অত্যাচার। খাওয়া দাওয়ার এক পর্যায়ে আন্টিকে বললাম,
“আন্টি নিলয় ভাইয়া বাসায় নেই? থাকলে জেনে নিতাম যে কোন মেয়ে তার উপর মিথ্যে অভিযোগ করছে। ”
আন্টি আনন্দিত গলায় বলল, আরে আছে তো। জানো না প্রত্যাশা নিলয় তো সারাদিন পড়ে। ইউনিভার্সিটির পাঠ চুকিয়েছে ঠিকই তবুও ছেলেটা একদম ই বই ছেড়ে ওঠে না।
আমি আবারও সাদা ঝকঝকে দাঁত গুলো বের করে আন্টিকে দেখালাম। আন্টিও ছেলের গুনগান করেই যাচ্ছে। শেষমেস কায়দা করে নিলয় ওরফে আন্টির পেয়ারের নিলুর কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলাম।
****
“কেমন আছেন নিলু ভাইয়া?”
নিলু ভাইয়া কম্পিউটারে কিছু একটা দেখছিল। আমার গলা শুনে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি দেখলাম সে একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আছে। সে আমাকে দেখে বলল,
“আপনি? আপনি এখানে কী করছেন?”
আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম, আপনাকে মেরে তক্তা বানাতে এসেছি। আমাকে ধাক্কা মেরে আবার মায়ের কাছে সাধু সাজা? একদম মেরে চেহারার আকৃতি পালটে দেব।
নিলু ভাইয়া চিউ চিউ করে দু’বার তার মা’কে ডাকলো। আমি শাসিয়ে বললাম, শয়তান ছেলে বিকেলে লুকিয়ে লুকিয়ে ছাদে বসে সিগারেট খেয়েছেন সেটা যদি এখন আন্টিকে বলে দেই!
নিলু ভাইয়ার চোয়াল ঝুলে পড়লো। আবারও চিউ চিউ করে বলল, আপনার সমস্যা কী?
এই তো ব্যটা লাইনে এসেছে। আমি মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বললাম, বেশী কিছু না। বারান্দায় যে কাঠগোলাপ গাছ টা আছে সেটা দিয়ে দিলেই হবে।
নিলু ভাইয়া অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। যার অর্থ হলো তোকে এক্ষুনি ভষ্ম করে দেব।
আমি বললাম, তাহলে যাই আন্টিকে বলি যে আপনার গুনধর ছেলে পড়ার নাম করে বইয়ের মাঝখানে পঁচা পঁচা নায়িকাদের ঠ্যাং দেখছিল।
“এসব মিথ্যে। ”
“কিন্তু আমি এমনভাবে বলব যে আন্টি বিশ্বাস করে ফেলবে। ”
নিলু ভাইয়ার ফর্সা মুখখানা রাগে লাল হয়ে গেল। বলল, আপনি একটা অসভ্য মেয়ে।
আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম, আমি আরও বানিয়ে বানিয়ে বলব যে ছাদে সিগারেট খেতে খেতে ভিডিও কলে আপনি একটা মেয়েকে চুমুও খেয়েছেন।
নিলু ভাইয়া অধৈর্য্য গলায় বলল, আপনার সমস্যা কী?
“আমার সমস্যা হলো আপনার মা সারাদিন কানের কাছে ভ্যজর ভ্যজর করে আপনার গুন গায়। সেটা সহ্য হয় না৷ পড়ুয়া ছেলেপেলে আমার পছন্দ না। তার উপর আপনার বারান্দার গাছগুলোর উপর আমার নজর পড়েছে। তাই একটু….
নিলু ভাইয়া অল্পতেই হাল ছেড়ে বলল, ওকে ফাইন। আপনি যা বলছেন তাই হবে।
আমি হেসে বললাম, আচ্ছা। এরপর একটু নিজের মা’কেও বলে দেবেন যেন একটু ভ্যজর ভ্যজর কম করে। আখেরে তো তাতে আপনার ই লাভ।
নিলু ভাই আমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে যে আমাকে শ’ খানেক অশ্রাব্য গালি দিলো সেটা বুঝলাম।
হতভম্ব নিলু ভাইকে রেখে তার কাঠগোলাপ গাছ নিয়ে ঘরের দিকে রওনা হলাম। আন্টি বলল, একি নিলু তোমাকে গাছ টা দিয়ে দিলো!
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আসলে ওই খচ্চর মেয়েটাকে খুঁজে বের করার জন্য ঘুষ দিলেন।
নিলু ভাই তার অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটা ভয়ংকর কাজ করলাম। তাকে একটা চোখ মেরে কাঠগোলাপ গাছ টা হাতে নিয়ে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে চলে এলাম।
****
তার পরের দিনের ঘটনা। বিকেলে পাড়া বেড়াতে যাচ্ছি তখন দেখি নিলু ভাই ঘর থেকে বের হচ্ছে। একদম সেজেগুজে টিপটপ হয়ে বেরোচ্ছে। নিশ্চয়ই ব্যটা ডেট করতে যাচ্ছে। ইচ্ছে হলো মেজাজ টা খিচিয়ে দেই। সিড়ি দিয়ে নামার সময় দেখলাম আমাকে এক নজর দেখে উপরে উঠে গেল। অর্থাৎ আমি নেমে যাব তারপর সে নামবে। আমি একটু ভদ্রতা করে বললাম, আহা ভাইয়ায়ায়া আপনি দাঁড়িয়ে কেন! আপনি আগে নামুন না!
নিলু আমার মিষ্টি কথায় একটু ভরকে গেল। আবার অতিদ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েও বলল,
“আপনি আগে চলে যান। আমি পরে যাচ্ছি। ”
আমি অবাক গলায় বললাম, ওমা! তা কী করে হয়! আপনি বড় মানুষ আপনি আগে যাবেন। আপনার একটা সম্মান আছে না!
নিলু চোখ গোল করে বলল, আচ্ছা! ও হ্যাঁ আপনি তো বড়দের খুব সম্মান করেন। ইতিমধ্যে তার নমুনা তো এক ঝলক আমি দেখেই নিয়েছি।
ওর মেজাজ খিচিয়ে দিতে গিয়ে আমার নিজের মেজাজ ই খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে করলো কানের পর্দা ফাটিয়ে দেই, কিন্তু না।
আমি বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, এই ব্যটা আপনার কী মনে হয় আপনি হৃত্তিক রোশান?
নিলু এবার চোখ বড় করে বলল, তোমার সমস্যা কী?
এবার আমার চোখ কপালে ওঠার পালা। মাম্মাস বয় আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে! তারমানে তাকে যেমন টি ভেবেছিলাম বাছাধন তেমন নন!
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, এমন মেয়েদের পোশাক পরে কোথায় যাচ্ছেন নিলু ভাই?
নিলু ভাইয়ের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“মেয়েদের পোশাক মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন?”
আমি দুঃখী গলায় বললাম, লাল শার্টে আপনাকে একদম মেয়েদের মতো লাগছে। চোখে এক ফোটা কাজল, আর ঠোঁটে একটু লিপস্টিক ছুইয়ে দিলেই এ পাড়ার সব ছেলে প্রেমপত্র লিখতে শুরু করবে।
নিলু ভাই বাঘের মতো গর্জন করে উঠলো। অতি উত্তেজনায় একটা কথাও স্পষ্ট হলো না। রাগে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করলো।
আমি মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করলাম। আফটার অল ভদ্রতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে না কি!
সেদিন সন্ধ্যাবেলা আমার প্রানের বন্ধু জেরিন দের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। পাড়ার মোড়ের ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকানে দেখলাম নিলু ভাই দাঁড়িয়ে আছে। কালো টিশার্ট পরে নেমেছে। অজান্তেই হেসে ফেললাম। ব্যটা তার মানে আমার জন্য শার্ট চেঞ্জ করে নিয়েছে! অথচ লাল শার্টে নিলুকে কতো সুন্দর লাগছিল! উফ! এত্তো সুন্দর তো আমার রনবীর কাপুর কেও লাগে না। কেন যে ওই বদমায়েশী টুকু করতে গেলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম কাল নিলুকে গিয়ে স্যরি বলব। আর ওর কাঠগোলাপ গাছও ফিরিয়ে দেব আর এটাও বলব যে শুনুন, আমি কিন্তু অতো বদমায়েশ না। আপনার সাথেই প্রথম বদমায়েশী করেছি।
জেরিন দের বাসা থেকে ফিরে দেখলাম বাবা, মা, ভাইয়া তিনজনেই থমথমে মুখে বসে আছে। আমি আমার বাবা মায়ের অতি আহ্লাদের মেয়ে। ভাইয়ের জন্মের আট বছর পর তাদের কোলে এসেছি বলেই একটু বেশীই ভালোবাসে। তিনজনের থমথমে মুখ দেখে আমি ভাবলাম হয়তো কোনো বিপদ ঘটেছে বুঝি। কিন্তু বাবা যখন গম্ভীর গলায় বলল, টাকা পয়সা খরচা করে পড়াশুনা করে তুমি একটা বেয়াদব তৈরী হচ্ছো!
তখন আমি বুঝলাম যে নিলুটা আছোলা বাঁশ দিয়েছে। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবার যোগাড়। মা কিংবা ভাইয়া এই কথাগুলো বললে আমি কিছু মনে করতাম না। কিন্তু বাবা কখনো আমায় বকেন না, তার কাছে এমন বকা শুনে ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে আমার চোখে পানি এসে গেল। বাবা বকাঝকা করলেন ইচ্ছেমতো। মা আর ভাইয়া আমার চোখের জল দেখে গলে গেল। তারা বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠালেন যে আমি আর এমন করব না। বাবা প্রথম ও শেষবারের মতন ক্ষমা করলেন আর ওয়ার্নিং দিলেন যে ভবিষ্যতে এমন হলে সে আমাকে আর ক্ষমা করবে না।
রাতে কেঁদে কেটে সকালে জ্বর বাধিয়ে কলেজে যাওয়া বন্ধ হলো। মা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। নিলয় শয়তান টার কাছে ক্ষমা চাওয়ার চিন্তা আপাতত বাদ দিলাম। ওর দেয়া কাঠগোলাপ গাছ টা বারান্দায় এখনো আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম ওটা আর ফেরত দেব না। শালা আমাকে এতো বড় কেস খাইয়েছে! ওকে আরও একবার দেখে নেব।
সারা সকাল, দুপুর ঘুমিয়ে কাটলো। বিকেলে একটু শরীর ফুরফুরে লাগায় মা’কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছাদে গেলাম।
ছাদে দেখা হলো বদমায়েশ টা’র সঙ্গে। এই প্রথম পূর্ন দৃষ্টিতে আমি বদমায়েশ টার দিকে তাকালাল। ছোট ছোট ছাট দেয়া চুল, কী সুন্দর গভীর দুটো চোখ, আর মনভোলানো হাসি! কী চমৎকার সব মিলিয়ে। আমার তাকিয়ে থাকা নিলয়ের চোখে পড়লো। নিলয় টবে মাটি ঠিক করতে করতে বলল,
“কাল তোমার বাবার কাছে তোমার ব্যাপারে বলেছি। তোমার যে আদব কায়দা শেখার দরকার সেটা তাকে বলেছি। আই থিংক এরপর তুমি বুঝেশুনে কথা বলবে অচেনা লোকের সাথে।
রাগে আমার মাথাটা ছিড়ে যাবার উপক্রম। একে তো জ্বর, তার উপর এই বদমায়েশ টা খারাপ খারাপ কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। আমি হাত উচিয়ে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ মাথাটা দুলে উঠলো। চোখ বন্ধ হবার আগে দেখলাম নিলু আমার দিকে ছুটে আসছে।
চলবে……
#কাঠগোলাপের সাদার মায়ায়
#পর্ব-১
(তিন বছর আগের লেখা। যারা পড়েছেন আরও একবার পড়ুন। ভালো লাগবে।)
সাবিকুন নাহার নিপা
পর্ব-২ https://www.facebook.com/100063560477904/posts/967987408663266/
পর্ব-৩https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=968706235258050&id=100063560477904&mibextid=Nif5oz