#কাঠগোলাপের সাদার মায়ায়
#পর্ব-৮
নিলয় কাঠগোলাপ গাছের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“আমি একবার কাউকে কোনো জিনিস দিলে তা আর ফেরত নেই না। এটাই আমার ক্যারেক্টার। ”
আমি হেসে ফেললাম। হাসি থামিয়ে বললাম,
“আমার আবার স্বভাব হলো সবার কাছ থেকে সব কেড়ে নেবার। আমাদের বাসায় এর আগে যারা এসেছে তাদের সবার কাছ থেকেই আমি কিছু না কিছু এমনি করে কেড়ে নিয়েছি। আবার পরে ফেরত ও দিয়ে দিয়েছি। এটা হলো আমার ক্যারেক্টার। ”
নিলয় আমার দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল,
“হঠাৎ ঢাকা যাচ্ছ যে?”
“পড়াশুনা টা এবার সিরিয়াসলি নেব ভাবছি। লাইফে সবকিছু তো হেলাফেলায় খুইয়েছি তাই ভাবলাম সুযোগ আর সময় যেহেতু আছে, একটাবার চেষ্টা করে দেখি। ”
নিলয় ঠোঁট উলটে ভ্রু নাচিয়ে বলল, গুড ডিসিশন। তা হঠাৎ এই বোধদয়? ”
“এই প্রশ্নের উত্তর টা জানা কী খুব জরুরী? ”
“অবশ্যই না। ”
“আপনি পারলে আমায় ক্ষমা করে দিবেন। ”
নিলয় চমকে উঠে আমার দিকে তাকালো। তারপর বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলো। এই হাসির অর্থ আমি বুঝলাম না তবে নিলয়ের হাসিমুখ আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখলাম।
আমার সবকিছু এলোমেলো লাগছে। নিলয়ের সামনে বেশীক্ষন থাকা যাবে না। আমি নিলয় কে বললাম,
“আমি আজ আসি। ”
নিলয় বলল, এগেইন উইশ ইউ বেস্ট অফ লাক।
“সেইম টু ইউ। ”
এই ছিলো নিলয়ের সাথে আমার শেষ দেখা। পরদিন সকালে কাঁদতে কাঁদতে আমার শহর ছেড়েছিলাম। কাঠগোলাপ গাছ টা নিলয়ের বাসাতেই রয়ে গেছে। আমার আর আনা হয় নি। একবার মনে হয়েছে নিয়ে আসি। স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবে। তারপর মনে হলো কী দরকার! মানুষ টা যেহেতু কাছের কেউ না, তখন কী দরকার তার স্মৃতি জমিয়ে রাখা।
****
নতুন শহরে আমার ঘুম ভাঙে এলার্মের শব্দে। যেখানে আজীবন নয়টা, দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে প্রায় ই ক্লাস মিস করেছি সেখানে আমার ঘুম ভাঙে ভোর ছ’টায়। আমার দুই রুমমেট দিবা আর আশার সাথে ইতিমধ্যে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ইউনিভার্সিটি তে ক্লাসও করছি রেগুলার। বাবা, ভাইয়া নিয়ম করে দেখতে আসেন। মা চাইছিলেন ঢাকা এসে আমার সঙ্গে থাকবেন। কিন্তু আমি সেটা চাইলাম না। নিজের জগৎ টা একা একা একটু সাজাই।
জাদুর শহরে আমি অল্প দিনের মধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। মোটামুটি অনেকগুলি বন্ধুও জুটে গেছে সকালে উঠি, ব্রেকফাস্ট করে ইউনিভার্সিটি তে যাই, লাইব্রেরী তে যাই। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই হোস্টেলে ফিরে পড়াশুনা করি। এর বাইরে আরেকটা কাজ করি, সেটা হলো নিলয়ের টাইমলাইন টা রোজ একবার করে ঘুরে আসি। আমার একাউন্ট থেকে ব্লক দেয়া বলে ফেইক একাউন্ট থেকে দেখি।
মাস দুয়েক পরের ঘটনা। এক সকালে আমাকে খবর দেয়া হলো যে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। বাবা কিংবা ভাইয়া প্রতি সপ্তাহেই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, কিন্তু সেটা আমাকে ফোন করে জানায়। তাই আমি একটু অবাক হলাম। কে আসতে পারে।
মোটামুটি রেডি হয়ে নিচে নামলাম। কিন্তু নিচে আমার জন্য যে চমক অপেক্ষা করছিল সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। নিলয় দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। একটা চকলেট কালারের শার্ট পরা, চুলে জেল দেয়া, খোচাখোচা দাঁড়িতে নিলয় কে দেখে আনন্দে বুক কেঁপে উঠলো আমার। আমি বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনি!”
নিলয় হাসলো। মাতাল করা এই হাসি আমি প্রথম দেখলাম। নিলয় বলল,
“তোমার কাছে বিদায় নিতে এলাম। কাল দেশ ছাড়ছি তো। ”
শুধুমাত্র এই কথাতেই আমার চোখে পানি এসে গেল। এর কোনো মানে হয়! যাকে ভুলে যাবার জন্য এতোকিছু তার জন্যে এখনো অল্পতেই চোখে পানি এসে যাচ্ছে!
নিলয় বলল, চলো কোথাও ঘুরে আসি।
আমার বলতে চাইলাম যে আমার ক্লাস আছে। কিন্তু বলতে পারলাম না। নিলয়ের পিছু পিছু হাটতে লাগলাম।
রিকশায় পাশাপাশি দুজন বসে আছি কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছি না। আমি একটু দূরে সরে বসলাম যেন নিলয়ের গায়ে গা লেগে না যায়। নিলয় সেটা দেখে রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে বলল, মামা আপনার রিকশা টা একটু ছোট হয়ে গেছে। আইমিন আপনার রিকশাটা প্রেমিক, প্রেমিকাদের জন্য। আম জনতাদের জন্য না, এরপর থেকে রিকশায় শুধু প্রেমিক, প্রেমিকা ওঠাবেন।
আমি আড়চোখে নিলয়ের দিকে তাকালাম। নিলয় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।
একটা জায়গায় রিকশা থামিয়ে বলল,
“আসো আজ তোমাকে দুনিয়ার বেস্ট ফুসকা খাওয়াবো। ”
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম।
আমি সরাসরি নিলয়ের দিকে তাকাতে পারছি না। তাই সবসময়ই নিচের দিকে তাকিয়ে থাকছি। কখন যেন আবার আমার চোখের জল দেখে ফেলে!
ফুসকার অর্ডার দিয়ে আমাকে বলল,
“তোমার দিনকাল কেমন চলছে?”
“ভালো। ”
“বাহ! তোমাকে সিরিয়াস হতে দেখে ভালো লাগছে। ”
আমি বিড়বিড় করে বললাম, আমি সিরিয়াস হলে তোর কী শালা। কে বলেছে তোকে এখানে আসতে!
নিলয় স্পষ্ট শুনতে পেল না। তাই বলল,
“কিছু বললে? ”
“না। ”
“কিছু একটা তো নিশ্চয়ই বিড়বিড় করছিলে। ”
“হ্যাঁ। বলেছি যে সিরিয়াস পড়াশুনা করছি যেন স্টাবলিশড জামাই পাই। ”
নিলয় হো হো করে হাসলো। বলল, বাহ! তুমি তো বেশ জ্ঞানী।
“মানে?”
“মানে ভবিষ্যতের ভাবনাই তো জ্ঞানীর কাজ। তাইনা?”
আমি জবাব দিলাম না। ফুসকার প্লেট এসে গেছে। নিলয় নিজের জন্যও ফুসকা অর্ডার করেছে। আমি বললাম,
“আপনি না ফুসকা খান না?”
নিলয় ফিসফিস করে বলল, ফুসকা এখন আমার প্রিয় হয়ে গেছে।
আমি অবাক চোখে নিলয় কে দেখতে লাগলাম।
নিলয় ফুসকা মুখে দিচ্ছে। আমি যে তাকিয়ে দেখছি সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
ফুসকা শেষ করে বলল, বিল টা তুমি দিয়ে দাও। এর আগে আমি একদিন খাইয়েছিলাম না! সেটা শোধ করে দাও তাহলে আর ঋন থাকবে না।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ব্যটা শেষ সময়টা’তেও আমাকে জ্বালিয়ে যাবে।
এরপর গেলাম আইসক্রিম খেতে। আগে একদিন আমাকে আইসক্রিম খাইয়েছিল। তারপর আবারও রিকশায় উঠলাম। রিকশায় উঠে নিলয় আবারও গম্ভীর হয়ে গেল। হাবভাব দেখে মনে হলো যে মেরে ধরে জোর করে রিকশায় বসানো হয়েছে।
গেটের সামনে আমাকে নামিয়ে দিয়ে বলল, ভালো থেকো।
আমি কিছু বলতে পারলাম না। কান্নার দমকে গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হলো না। শয়তান টা কী একবার বলতে পারতো না, প্রত্যাশা আমি তোমাকে পঁচা পঁচা কথা শুনিয়েছি ঠিক ই কিন্তু আমি তোমায় ভালোবাসি। তাই তো ছুটে এলাম।
এই কথাগুলো বললে আমি কী ওকে ক্ষমা করে দিতাম? নিশ্চয়ই দিতাম। ভালোবাসার চেয়ে বড়কিছু পৃথিবীতে আছে! এটুকু ক্ষমা তো করাই যেত। কিন্তু শয়তান টা তো কিছু বলল ই না! এতো খারাপ একটা মানুষ!
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে শয়তান ছেলেটা’কে ভালোবেসে ফেলেছি। এখন এই পাপীকে ক্ষমা করে তার মন থেকে শয়তান টা’কে ভুলিয়ে দাও।
****
নিলয় চলে গেল। আমার কয়েকটা দিন কীভাবে গেল সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। খেতে ভালো লাগে না, ঘুমাতে ভালো লাগে না কিচ্ছু ভালো লাগে না। কয়েকদিন এমন হলেও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পড়ার চাপে সিধা হয়ে গেলাম। আবারও শুরু হলো শহুরে যান্ত্রিক জীবনের ছোটাছুটি।
একদিন ব্যাগে একটা কাগজ খুঁজতে গিয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া একটা কাগজ পেলাম। ঝুড়িতে ফেলে দেবার জন্য রেখে দিয়ে অন্যান্য কাজ করলাম৷ রাতে বিছানা ঝাট দিতে গিয়ে সেই কাগজ টা আবারও চোখে পড়লো। ফেলে দিতে গিয়ে কী ভেবে যেন কাগজ টা খুললাম। দেখি তাতে লেখা আছে,
“শোন মেয়ে, আমার জিনিসপত্রের জন্য আমার খুব মায়া। একটু খারাপ ভাবে বলতে গেলে আমি ভীষণ হিংসুটে ছেলে। আজ পর্যন্ত কখনো কাউকে একটা পেন্সিল, ইরেজার পর্যন্ত ধারও দেই নি। সেই আমি তোমাকে আমার প্রিয় কাঠগোলাপ দিয়েছিলাম। আর তুমি সেটা ফিরিয়ে দিলে! ফিরিয়ে দিলেই বা কেন আমি ফেরত নেব! বারান্দার সবগুলো গাছ তোমায় দিয়ে গেলাম। আমার প্রিয় জিনিস, আমার প্রানের চেয়েও দামী তাই ওগুলোর যত্ন নিও।
চলবে….
(শেষ পর্ব বাকী)