একঝাঁক_জোনাকি #পর্ব |০৩| #ইশরাত_জাহান_অধরা

0
509

#একঝাঁক_জোনাকি
#পর্ব |০৩|
#ইশরাত_জাহান_অধরা

– “দেখুন আপনার বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল আমার বোনের জন্য। সেখানে আমি কি করে আপনাকে বিয়ে করব?আমার মান সম্মান বলে কিছু একটা আছে৷ আমার রুচিতে বাধবে আপনাকে বিয়ে করতে। এতে আমার পরিবারের মানুষরা কষ্ট পাবে।আমি চাই না আমার জন্য আমার পরিবারের মানুষজন কষ্ট পাক।”

নিহান অনিমার কথা শুনে হাসল।নিহানকে আসতে দেখে অনিমা ভ্রু কুচকে বলল,
– “আপনি হাসছেন কেন?”

নিহান হাসতে হাসতেই জবাব দিল,
– “আপনার বোকার মতো কথা শুনে।”

– “মানে?”

– “আচ্ছা আপনি আমাকো জাস্ট একটা প্রশ্নের এন্সার দিন।আপনি যাদেরকে নিজের পরিবার বলে মনে করেন তারা কি আপনার আদৌ নিজের পরিবারের কেও বলে মনে করে?”

এতক্ষন অনিমা মাথা নিচু করে ছিল।নিহানের কথা শুনেই মাথা উচু করে নিহানের দিকে তাকাল।

নিহান অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “আমাকে এন্সার দেওয়া লাগবে না।জাস্ট নিজের প্রশ্ন করুন।আপনি যতটা আপনার পরিবারের জন্য করেছেন,যতটুকু ওদেরকে নিয়ে ভেবেছেন তার এক ভাগও কি তারা আপনাকে নিয়ে ভেবেছে?”

সত্যিই তো!মা মারা যাবার পর তার বাবা তাকে কাছে ডেকে কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি তার কি লাগবে না লাগবে। তিথি যা বলত তাই সাথে সাথে এনে দিত।কিন্তু অনিমা যদি সামান্য চকলেটের কথা বললেও বাবা ভুলে যাবার নাম করে তার জন্য চকলেট নিয়ে আসে নি কোনদিন।কোন আবদার আজ অব্দি পুরন করেনি।আচ্ছা মা মা-রা গেলে কি বাবারা এরকম পর হয়ে যায়?আগের সন্তানের জন্য কি তাদের মনে একটুও ভালোবাসা থাকে না? অনিমার নিজের আপন বলতে তো শুধু মাত্র তার বাবাই ছিল।সেই বাবাও তাকে অবহেলা করত!মা যা বলত তাই শুনত!একবারও ওকে ডেকে নিয়ে কথাটার সত্যটা যাচাই করে নি।

এসব ভাবতে ভাবতেই অনিমার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা ঘটনা।সবে সে ক্লাস ৯ এ উঠেছে।পড়ালেখায় বরাবরই ভালো স্টুডেন্ট ছিল সে।ক্লাস ৯ এ পড়াকালীন তার এক টিচার তাকে যত্ন করে একটা কলম উপহার দিয়েছিল।কারন অই টিচারের পছন্দের স্টুডেন্ট ছিল সে।কলমটা দেখতে ভারি সুন্দর ছিল।এরকম কলম সে আগে দেখেনি।খুশিমনে কলমটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বাড়িতে ঢুকতেই তিথি প্রশ্ন করে উঠল,

– “আপু!তোর হাতে ওটা কি?”

অনিমা হেসে বলল,
– “কলম।স্যারের কাছ থেকে উপহার পেয়েছি।”

– “কলমটা তো অনেক সুন্দর।আমাকে দিয়ে দে কলমটা।”

– “কিন্তু এটা তো আমার কলম!তোকে কেন দিব?”

ব্যাস এই কথা বলতেই তিথি দৌড়ে তার বাবার রুমে চলে গেল গিয়ে কান্না করতে করতে বলল,

– “আব্বু জানো আজকে স্কুলের স্যার আমার উপর খুশি হয়ে একটা কলম দিয়েছিল।অনিমা আপু সেই কলমটা নিয়ে গিয়েছে আমার থেকে।আমি চাওয়াতে আমাকে মেরেছে।”

রহমান হক তিথির মুখে এমন কথা শুনে ঘর থেকে বের হয়ে অনিমাকে ডাকল।অনিমা এসে বলল,

– “কি হয়েছে আব্বু?কিছু বলবে?”

রহমান সাহেব অনিমার গালে চড় দিয়ে বলল,
– “এত অধঃপতন হয়েছে তোর?নিজের ছোট বোনের গায়ে হাত তুলার আগে একটুও বিবেকে বাধল না?সামান্য কলমের জন্য তুই তিথির গায়ে হাত তুলেছিস?নিজের যোগ্যতায় তো পাস নি কলম। তাহলে কিসের ভিত্তিতে তুই তিথির কলমে অধিকার খাটাস?এত হিংসে করিস তিথিকে?”

অনিমা স্তব্দ হয়ে গেল কথাগুলো শুনে। ও কখন তিথিকে মেরেছে?আর কখনই বা কলম নেওয়ার কথা বলেছে?বরং তিথিই তো ওর কাছে এসে কলম চাইল।
এসব ভেবে তিথির দিকে তাকাতেই দেখল তিথি অনিমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

– “আব্বু!আমার কলমটা দিতে বলো!”

– “কি হলো?কথা কানে যাচ্ছে না?ওর কলম ওকে দে!”

অনিমা সেইদিন কিছু না বলে কলমটা দিয়ে দিয়েছিল। যেখানে ওর নিজের আপন বাবাই কোন সত্যতা যাচাই না করে গায়ে হাত দিতে দ্বিধাবোধ করল না সেখানে ও তিথিকে দোষ দিবে কিসের ভিত্তিতে?বাবা কি পারত না বলতে যে তিথি যা বলছে তা সত্য কি না?আমি সত্যিই ওকে মেরেছি কিনা বা ওর থেকে কলমটা নিয়েছি কিনা!আদৌও কলমটা ওর কিনা?নাহ বলেনি।


এসব ভাবতে ভাবতেই ছাদে উঠে এক কোণায় দাঁড়িয়েছিল অনিমা।মনে মনে বলছিল,

– “তুমি আর আগের মতো নেই আব্বু।অনেক পালটে গিয়েছো।যে তুমি আমাকে কোন মারোনি সেই তুমি আজকে অকারণে আমাকে মারলে!আম্মু মারে এতে কোন অসুবিধে ছিল না আমার। কারন সে আমার জম্মদাতা মা না। কিন্তু তুমি?তুমি কি করে পারলে আমার গায়ে হাত তুলতে?”

– “এখানে একা একা কি বিড়বিড় করছেন আপনি অনিমা?”

চোখের পানি মুছে পিছে তাকাতেই দেখল ১২ বছরের মাহিরকে। গোল গোল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

– “আপনি কান্না করছেন কেন?কিছু কি হয়েছে?কেও কি আপনাকে মেরেছে অনিমা?”

– “কিছুনা।চোখে কি যেন পরেছে।”

মাহির অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “একটু নিচু হোন তো?”

অনিমা ভ্রু কুচকে বললো,
– “কেন?”

– “আহা এত প্রশ্ন করছেন কেন?হোন না!”

অনিমা নিচু হতেই মাহির হাত দিয়ে অনিমার চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

– “আমি জানিনা আপনার সাথে কি হয়েছে যার জন্য আপনি কান্না করছেন।কিন্তু আপনার চোখে কান্না মানায় না।প্লিজ কাঁদবেন না।একদিন দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

———–
অনিমা নিজেকে সামলিয়ে বলল,
– “দেখুন আমি আমার বাবা মার অমতে সোহানকে বিয়ে করেছিলাম।আর সেই সোহানই আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। তাই তার এটা ঠিক মানতে পারছেন না।সবচেয়ে বড় কথা কোন বাবা মা ই চান না তার মেয়ের ডিভোর্স হয়ে যাক।তাই তারা একটু রেগে আছেন আমার উপর।আপনি যা ভাবছেন অইরকম কিছুই না।”

নিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “আপনি কি সত্যিই কিছু বুঝতে পারেন না নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করেন?”

– “মানে?”

– “আপনার ফ্যামিলির কাছে যে আপনার কোন ভেল্যু নেই সেটা কি আপনি বুঝতে পারেন না?ওরা যে জাস্ট আপনাকে ইউজ করছে এটা কি বুঝতে পারেন না?এতটাও ছোট নন আপনি অনিমা যে সামান্য এই বিষয়টা বুঝতে হবেন না। কবে একটু বুঝদার হবেন আপনি?”

নিহান একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল,

– “দেখুন আপনার গর্ভে যে বেড়ে উঠছে তার একটা পরিচয় প্রয়োজন।একজন বাবা থাকা তার জন্য আবশ্যক। আপনি নিশ্চয়ই ওকে বাবার স্নেহ থেকে বন্ঞিত করবেন না।আমি জাস্ট চাচ্ছি ওর বাবা হতে।ও যখন বড় হবে তখন ওর ক্লাসমেটরা নিশ্চয়ই ওর বাবা নেই বলে ঠাট্তা করবে।আর আপনি একজন ডিভোর্সি মহিলা।এই সমাজে চলা আপনার জন্য কষ্ট হয়ে যাবে।আপনার সন্তানকে বড় করতে কষ্ট হবে।তাই আমি জাস্ট আপনাকে একটু হেল্প করতে চাইছি।আমি চাইছি আপনাদ সন্তানের পরিচয় হতে।আশা করি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছেন।আর আপনার বোন তিথির কথা ভাবছেন তো ওর জন্য সুযোগ্য পাত্রের কোন অভাব হবে না।কিন্তু আপনি যদি আমাকে বিয়ে না করেন তাহলে বিপদে পরবেন আপনি।আপনি নিশ্চয়ই জানেন একজন ডিভোর্সি মেয়েকে সমাজ কিরকম চোখে দেখে!”

– “আমার ভাবার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন।”

নিহান হালকা হেসে বলল,
– “আপনি যত খুশি সময় নেন।আমার কোন অসুবিধে নেই।আমি আপনার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করব।”

অনিমা ছোট্ত করে উত্তর দিল,
– “ধন্যবাদ।”

– “কি খাবেন বলুন।”

– “কিছু খাবো না।আমি খেয়ে এসেছি।”

– “মিথ্যা বলছেন কেন?আপনার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সারাদিন কিছু খান নি।আচ্ছা আপনাকে বলতে হবে না।আমি নিজেই অর্ডার দিচ্ছি।”

কিছুক্ষনের মধ্যেই ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেল।
অনিমা খাবার দেখে নিজেকে আটকাতে পারল না।সারাদিন ধরে পানি ছাড়া কিছুই পেটে পরেনি অনিমার।খাবার দেখে ক্ষিধেটা যেন ঝড়ের স্পিডে বেড়ে গেল।সামলাতে পারল না নিজেকে।প্লেট নিজের কাছে নিয়েই খেতে শুরু করল।কয়েক লোকমা মুখে দেবার পর হঠাত নিহানের কথা মনে পরল।সামনে তাকাতেই দেখল নিহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।নিশ্চয়ই ছেলেটার অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।তাই তো অমন করে তাকিয়ে আছে।মায়া হলো অনেক।
মুখের খাবারটা গিলে নিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

– “আপনি খাবেন না?”

– “নাহ ”

– “মিথ্যা বলছেন কেন?নিশ্চয়ই আপনার ক্ষিধে পেয়েছে।নইলে তখন থেকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

নিহান অন্যদিকে তাকিয়ে হাসল।এতটাও বোকা মানুষ হয়?ও তো তাকিয়ে ছিল অনিমার দিকে খাবারের দিকে নয়!অনেকগুলা খাবার এক সাথে মুখে দেওয়ার কারনে গাল দুটো খাবারে ভর্তি হয়ে আছে।পুরা বাচ্চাদের মতো লাগছে।কে বলবে ও আরেক বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে!মেয়েটাকে এত্ত কিউট লাগছিল।নিজেকে আটকাতে পারল না।বোকা মেয়েটা কিনা ভেবে বসল খাবারের দিকে তাকিয়ে ছিল সে?পরক্ষনেই হঠাত একটা অদ্ভত ইচ্ছে জাগ্রত হলো নিহানের মনে।চামচ নিয়ে অনিমার দিকে আগাতেই অনিমার চোখ দুটো বড় হয়ে আসল।উনি হঠাৎ এগিয়ে আসছেন কেন?

– “আপনি এগিয়ে আসছেন কেন?”

নিহান কিছু না বলে আরেকটু এগিয়ে অনিমার প্লেট থেকে খাবার নিয়ে ২ চামচ খেয়ে নিজের সিটে বসতে বসতে বলল,

– “আসলে আপনার খাওয়া দেখে মনে হলো খাবারটা বুঝি খুব টেস্টি তাই টেস্ট করলাম।”

অনিমা এতক্ষন নিজের আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

– “তাহলে আলাদা করে অর্ডার দিতেন।আমার এটো করা খাবার খাওয়ার কি দরকার ছিল?”

নিহান বলল,
– “আমার এতে কোন সমস্যা নেই।”

(চলবে)…
#গল্পঃ_একঝাঁক_জোনাকি

(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন, পরবর্তী পর্ব নিয়ে খুব শীঘ্রই আসছি…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here