আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️ #লেখিকা_মালিহা_খান❤️ #পর্ব-৩৬

0
74

#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৬

নিস্তব্ধ রজনী।পুরো বাড়ি অন্ধকার।শুধু আরিয়ানের রুমে লাইট জ্বলছে।
মায়া বসে আছে বিছানার মাঝখানটায়।তার সামনে দুটো প্লেট রাখা।একটায় পাস্তা,আরেকটায় নুডলস্।
পাস্তার প্লেটটা ইতিমধ্যেই খালি।আর নুডুলস এর টায় একটু আছে।সেটাই খাচ্ছে মায়া।
আরিয়ান বসে আছে তার মুখোমুখি সোফায়।তার একহাতে ফোন।তবে তার দৃষ্টি সেদিকে নয় সে চেয়ে আছে মায়ার দিকে।মেয়েটার এতো ক্ষুধা পেয়েছে!রাতেও বলছিলো ক্ষুধা লেগেছে।হঠাৎ এতো ক্ষুধা লাগছে কেনো?আগে তো দু’চামচ খেয়েই বলতো “পেট ভরে গেছে”,”আর খাবোনা”আরো কতোরকম বাহানা।
নাহ,মেয়েটার খাওয়া দাওয়ার দিকে আরো যত্নশীল হতে হবে তাকে।নয়তো কি শুধু শুধুই মাঝরাতে এতো ক্ষুধা থাকে পেটে!

নুডুলসের শেষ চামচটা মুখে দেয়ার আগে মায়া বললো,
—“শেষ কিন্তু।খাবেন একবার?”এর মধ্যে আরো পাঁচ ছয়বার মায়া জিজ্ঞেস করে ফেলেছে তাকে খাওয়ার কথা।প্রতিবারই আরিয়ান মানা করেছে।এবারো মানা করার পর মায়া তেঁতে উঠলো।নুডুলসটা মুখে তুলে চিবাতে চিবাতে বললো,
—“তা খাবেন কেন?এটা খেলেতো আপনার পেট খারাপ হবে!!আপনি একমাস অসুস্থ থাকবেন!।

আরিয়ান চোখ কুচকায়।মায়ার আজকাল ঘন ঘন মুড সুইং হয়।শুধু শুধুই চিল্লিয়ে উঠে আবার পরক্ষনেই শান্ত হয়ে যায়।

চুপচাপ ফোনটা রেখে উঠে যায় সে।প্লেট দুটো একসাথে করে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দিয়ে মায়াকে পানির গ্লাস দেয়।পানি খাওয়া শেষে হাত দিয়ে ঠোঁট মুছিয়ে দিয়ে বলে,
—“শোও তুমি।আমি আসছি।”

আরিয়ানের পরণে শুধু ধুসর রংয়ের ট্রাওজার।উপরে টি-শার্ট পরেনি সে।গরম পরেছে বেশ।রুমে এসি ছাড়া বিধায় বোঝা যায় না।কিন্তু একটু বাইরে বের হলেই জীবন শেষ।রাতের বেলা হলরুমের এসি বন্ধ ছিলো।একজন সার্ভেন্ট কে মায়ার জন্য খাবার বানাতে বলে একটু বসেছিলো সেখানে।ব্যস!সেখানেই দরদর করে ঘাম ছুটে গেলো।ছোট থেকেই গরম সহ্য হয়না তার!।
ওয়াশরুমে যেয়ে চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিতেই দরজায় জোরে জোরে বাড়ি দেয়ার শব্দ হলো।মায়া চাপা স্বরে ডাকছে,”দরজা খুলেন,জলদি।”
আরিয়ান দ্রুত দরজা খুলে দিতেই তাকে সরিয়ে বেসিনের উপর হরহর করে বমি করে দিলো মায়া।
মায়ার হঠাৎ এমন করায় বিচলিত হয়ে পরে আরিয়ান।মুখ উপর করে বমি করছে মায়া।আরিয়ান তার থুবড়ে পরা চুলগুলো একহাতে মুঠ করে ধরে।পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।মেয়েটার এতো শরীর খারাপ সে বুঝতেই পারলোনা!।ততক্ষনে বমি থেমেছে মায়ার।দুহাতের আজলায় পানি নিয়ে কুলি করে মুখে পানি দিয়ে চোখ বন্ধ করে আরিয়ানের বুকে সাইড করে মাথা ঠেকায় সে।আরিয়ান পাশে ঝোলানো টাওয়ালটা হাতে নেয়।সারামুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,
—“বেশি খারাপ লাগছে মায়া?”

মায়া উওর দেয়না।আবারো গা গোলাচ্ছে তার।আরিয়ান টাওয়ালটা জায়গামতো ঝুলিয়ে রাখতেই আবারো বমি করে মায়া।এতক্ষন যা খেয়েছিলো কিছুই হজম হয়নি তার।আরিয়ান এবার নিজেই ট্যাপ ছেড়ে দেয়।চিন্তায় অস্থির লাগছে।মেয়েটা এতো অসুস্থ কখন হলো?ফুড পয়েজন হলো নাকি?নতুবা এতো বমি হচ্ছে কেন?এই ভোরবেলা ডাক্তারইবা পাবে কোথায়?
মায়া তার বুকে মাথা এলিয়ে রেখেছে।আরিয়ান নরম শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
—“রুমে নিয়ে যাবো?নাকি আরো বমি হবে?”

মায়া অস্পষ্ট স্বরে বলে,
—“বমি হবে।কিন্তু আসছেনা।”

আরিয়ান ফাঁকা একটা ঢোক গিলে।বমি আসলেও বমি না করতে পারা যে কতটা কষ্টের তার জ্বর হলে বুঝতে পারে।মায়ার থেকে বেশি অস্থির লাগছে তার।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সে বলে,
—“আচ্ছা,একটু ওয়েট্ করি।হয়ে যাবে।”

পাঁচমিনিট পার হয়ে গেলে দুবার জোরে জোরে কাশি দেয় মায়া।সাথে সাথে মুখভর্তি বমি হয় তার।তৃতীয়বারের মতো মুখ মুছিয়ে দিয়ে আরিয়ান নিরস কন্ঠে বলে,
—“আরো বমি করবে মায়াবতী?”

মায়া দু’পাশে মাথা নাড়ায়।আর বমি হবেনা তার।পেটে যা ছিলো সব বের করে দিয়েছে।তিনবার বমি করে প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।আরিয়ান তাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়।পরণের জামা গলার দিকে ভিজে গেছে।লাইট নিভিয়ে মায়ার জামা চেন্জ করে দেয়।ততক্ষনে ঘুমিয়ে পরেছে মায়া।আরিয়ান তার পাশে সুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ক্রমাগত।সারারাতেও একবারও তার মাথা থেকে হাত সরায়না।

আজকাল নিজের কাজে নিজেই অবাক হয় আরিয়ান।আগে নিজে বমি করলেও ঘেন্না হতো।বমির দিকে তাকাতে পারতনা পর্যন্ত।রাস্তাঘাটে কাউকে বমি করতে দেখলেও গা গোলাতো।অথচ আজ মায়ার প্রতি ঘেন্না তো দূর একফোঁটা বিরক্তিও আসেনি তার।বরং মেয়েটার অসুস্থতায় অজানা একটা ভয় কাজ করছিলো।
__________
সকাল সকাল মায়াকে দ্রুত রেডি হতে বলেছে আরিয়ান।তাকে নিয়ে হসপিটালে যাবে।যদিও ঘুম থেকে উঠার পর দূর্বলতার ছিঁটে ফোঁটাও ছিলোনা তার মধ্য।আরামে নাস্তা খেয়ে বাগানে বসে জ্যাক আর জেনির সাথে খেলা করছিলো।তখনই আরিয়ানের কড়া আদেশ।”দ্রুত তৈরি হও,হসপিটালে যাবো”।মায়া মানা করলেও শুনেনি সে।অগত্যা রেডি হতে হচ্ছে।
ক্রিম কালারের থ্রিপিস পরে চুলগুলো হাল্কা করে ঝুটি করে নিলো মায়া।
আরিয়ান বসে বসে কফি খাচ্ছে আর মনোযোগ দিয়ে মোবাইল স্ক্রল করছে।মায়া ওড়নাটা দু’কাধে দিয়ে হাতে সেফটিপিন নিয়ে আরিয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
—“আটকে দিন।”

আরিয়ান পিন হাতে নিয়ে মায়ার দিকে তাকায়।মায়াকে একদম স্বাভাবিক লাগছে এখন।বোঝাই যাচ্ছেনা কাল রাতে এত অসুস্থ ছিল মেয়েটা।
ওড়না আটকে দিতে দিতে সে স্বাভাবিকভাবেই বলে,
—“তোমার পিরিয়ড মিস হয়েছিলোনা লাস্ট মান্থে?”

মায়া চমকে তাকায়।লজ্জা লাগে তার।কোনরকম উপরনিচে মাথা দোলায় সে।আরিয়ান এককাঁধের পিন আটকে আরেক কাঁধেরটা আটকে দিতে দিতে তীযর্ক কন্ঠে বলে,
—“এই মাসে?”

মায়া দৃষ্টি নিচের দিকে নিয়ে মিহি স্বরে বলে,
—“ডেট আসেনি এখনো।”

আরিয়ান ওড়নাটা ঠিক করে দিয়ে উঠে দাড়ায়।সে যা ধারণা করছে তাই যদি ঠিক হয়?হাহ্!হসপিটালে গেলেই বোঝা যাবে।

আজকে আবার তন্ময়ের বাবা,মা আসবে।তারা গ্রামে থাকেন।তন্ময়রে বিয়ে এখানেই হবে তাই আসবেন।
যদিও একয়বছরে হাজারবার আরিয়ান তাদের এখানে থাকার কথা বলেছে।কিন্তু তারা থাকবেনা।গ্রাম ছাড়া নাকি তাদের ভালো লাগেনা।তন্ময় প্রতিমাসে যেয়ে দেখে আসে।তন্ময় শহরে এসেছিলো পড়াশোনার সুবাদে।তারপর এখানেই আরিয়ানের সাথে দেখা সাক্ষাত।কাজকর্মের ভীড়ে আর গ্রামে ফিরেনি সে।

_______________
মায়ার অসুস্থতার লক্ষন গুলা শুনেই ড.মিতালী সর্বপ্রথম মায়াকে যেই কথাটা বলেন তা হলো,
—“আপনি কি প্রেগন্যান্ট?টেস্ট করিয়েছেন?”

মায়া থতমত খেয়ে যায়।তার পাশে বসেছিলো আরিয়ান।সেই উওর দেয়,
—“নাহ্,টেস্ট করেনি।”

ড.মিতালী মুচকি হেসে তার ড্রয়ার থেকে একটা প্রেগন্যান্সি কিট বের করে দেয়।মায়ার দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে দিকে ইঙ্গিত করে বলে,
—“আপনি টেস্ট করে আসেন।আমার ধারণা ভুল নাহলে খুব সম্ভবত আপনি কনসিভ করেছেন।”

মায়া আমতা আমতা করে আরিয়ানের দিকে তাকায়।তার মেজাজের গতিবিধি লক্ষ্য করার চেষ্টা করে।ড.মিতালী বলার এক মাইক্রোসেকেন্ড আগেও তার মাথায় প্রেগন্যান্সির বিষয়টা আসেনি।সে আসলেই খুব বোকা।এজন্যইতো আরিয়ান সকালে ওসব বলছিলো।তখনো বিষয়টা মাথায় আসেনি তার।


স্পষ্ট দুটো লাল দাগ।মায়া কয়েকবার ঢোক গিলে।জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।
খুশিতে চোখ টলমল করছে তার।ঠোঁট কাঁপছে।চোখের জলটা মুছে সে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বের হলো।

ড.মিতালীর দিকে সেটা এগিয়ে দিতেই উনি উজ্জল হেসে বললেন,
—“কংগ্রেচুলেশন!সি ইজ্ প্রেগন্যান্ট।”

আরিয়ানের মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা যায়।জোড়ে একটা শ্বাস ছেড়ে সে বলে,
—“থ্যাংকস ডক্টর।কিন্তু ওর প্রেগন্যান্সিতে কি কোনো কমপ্লিকেশন আছে?আই মিন,ও তো ছোট এখনো।
রিস্কি হবেনা ব্যাপারটা?”

ড.মিতালী স্মিত হাসে।সাধারণত কাউকে এখবরটা দেয়ার পর প্রথমে সে নিজের সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করে।বলে”আমার বেবি ঠি ক আছেতো?”তারপর আসে স্ত্রীর কথায়।তবে আরিয়ানের ভালবাসা দেখে সে সত্যিই মুগ্ধ।
আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল রেখে হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করে টেবিলের উপর রেখে সে বলে,
—“দেখুন মি.আরিয়ান।”মা হওয়া” এই বিষয়টাই খুব সেনসিটিভ।খুব সহজ ব্যাপার এটা নয়।আপনি রেগুলার চেকআপ করাবেন।স্ত্রীর যত্ন নিবেন।বাকিটা আল্লাহর হাতে।
আমি বুঝতে পারছি আপনার কনসার্নটা।আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে আপনি খুবই সিরিয়াস।নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি,সাধারণত এমনটা দেখা যায়না।এদিক দিয়ে আপনার স্ত্রী খুব লাকি।”
যাইহোক,আপনার স্ত্রী মেইবি দেড়মাসের অন্ত:সত্তা।তবুও আপনারা টেস্ট করিয়ে নেন।শিওর হওয়ার জন্য।রিপোর্ট আমি দেখে দিবোনে।নো প্রবলেম।”
|
|
গাড়ি চলছে।আরিয়ান ধীরগতিতে ড্রাইভ করছে।কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
মায়া চুপচাপ বসে আড়চোখে আরিয়ানকে পর্যবেক্ষন করছে।আরিয়ানের মেজাজটা ঠি ক বুঝে উঠতে পারছেনা সে।লোকটা কি রেগে আছে?নাকি খুশি হয়েছে?নাকি অন্যকিছু?কিছুই বুঝতে পারছেনা।
সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত,সাবলীল দৃষ্টিতে ড্রাইভ করছে সে।চোখে মুখে কোনো অনুভূতি নেই।
বেশ খানিকক্ষন পর গাড়ি জ্যামে আটকায়।গাড়ির জানালা আটকানো।ভিতরে এসি ছাড়া।তাই আজ আর গরম লাগছেনা দুজনের।
ধৈর্যহারা হয়ে মায়াই জিজ্ঞেস করে,
—“আপনি কি খুশি হননি?”

আরিয়ান শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়।ঠোঁটের কোঁণে হাসি ফুটিয়ে একেবারে মায়ার দিকে ঝুকে যায়।বলিষ্ঠ হাতজোড়া মায়ার দু’গালে রেখে কপালে গভীর থেকে গভীরতম উষ্ম ঠোঁটের স্পর্শ দেয়।কয়েকমিনিট কেটে গেলেও ঠোঁট সরায়না সে।মায়া চোখ বন্ধ করে রেখেছে।কপালে চুমু দিলে এতো শান্তি লাগে কেনো?স্নিগ্ধ পবিত্র স্পর্শ।
মায়া অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলতে নিলেই আরিয়ান ঠোঁট সরায়।তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

—“মায়াবতী,আমার এই গোটা জীবনে হাতে গোনা দু’বার শুধু আমি বাস্তবিকভাবে খুশি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি।এক যেদিন আমি আমার মা বাবার খুনিকে শাস্তি দিতে পেরেছি।আর দ্বিতীয়ত যেদিন তোমাকে আমি সম্পূর্ণ রুপে নিজের করে পেয়েছি।তাছাড়া খুশি শব্দটা আমার উপভোগ করার সুযোগ হয়নি।আজ তৃতীয়বারের মতো আমি খুশি।একেবারে বাঁধভাঙা খুশি।আমার থেকে খুশি এই পৃথিবীতে কেউ আছে নাকি সন্দেহ আছে।
তবে অতিরিক্ত খুশিতে আমি অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছি।নিজেকে প্রকাশ করতে পারছিনা।
কেমন যেন লাগছে!আমি বাবা হবো ভাবতেও শ্বাস আটকে আসছে।
এটুকু বলতেই থামে আরিয়ান।কাঁধে একফোঁটা পানির অস্তিত্ব অনুভব করে মায়া।থমকে গেছে সে।
বেশি খুশি হলে কি মানুষ কাঁদে?অনুভূতি গুলো কি জলরূপে বেরিয়ে যায়?হয়তো যায়।
আরিয়ান নিজেকে সামলায়।একহাতে মায়ার গলা জড়িয়ে গালে চুমু খেয়ে বলে,

—“আপনার সকল সুখ,ভালবাসা,আবেগ,অনুভূতি শুধু এবং শুধু তোমাকে ঘিরেই হোক মায়াবতী।”

~চলবে~

বি:দ্র-রি-চেক হয়নি।বানান ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here