#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৯.
‘খালামনি যে সবকিছু রাফসানের কথায় করেছে, সেটা কি তুই জানিস ঐচ্ছি?’
ঐচ্ছি ঠোঁট গুঁজ করে দাঁড়াল। জানে সে। তার মা বাবা এখন রাফসানের নিয়ন্ত্রণে আছে সেটা সে খুব ভালো করেই জানে। তবে সাইভিদকে সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না। ঐচ্ছি শান্ত কন্ঠে জবাব দেয়,
‘তুমি ভুল ভাবছো, ভাইয়া। মা বাবার আচরণে আমি নিজেও রীতিমত শকড। তবে এর পেছনে রাফসানের কোনো হাত নেই। তুমি অযথা উনাকে সন্দেহ করো না।’
ঠোঁট কামড়ে মৃদু হাসে সাইভিদ। অবশিষ্ট সিগারেটটায় এক টান দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারে সে। ঐচ্ছির দিকে অরুনলোচন চোখে তাকিয়ে তপ্ত গলায় বলে,
‘বাহ, এত বিশ্বাস হবু স্বামীর উপর। গুড, ভেরি গুড।’
কথাটা বলেই তাচ্ছিল্যস্বরূপ এক হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সাইভিদ। ঐচ্ছি কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে, আজকাল বড্ড মিথ্যে বলতে শিখে গিয়েছে সে। আর সবই হচ্ছে ঐ রাফসানটার জন্য। বিরক্তি ভরা এক তিক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐচ্ছি। গুঁটি গুঁটি পায়ে সেও বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
.
অনেক কান্নাকাটি হলো, মান অভিমানের এক বিশাল পর্ব চললো। ঐচ্ছি রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল সবটা। মাঝে মাঝে এটা ওটা বলে সাইভিদকে বুঝিয়েছে, মায়ের কান্না থামিয়েছে। খালামনির কথায় মিষ্টি হেসেছে। সাইভিদের মনও অবশেষে গললো। সেও তার খালামনিকে জড়িয়ে ধরল। তাতেই যেন তাহেরা বেগমের মন উৎফুল্লে ভরে গেল। আরেক দফা প্রাণ ফিরে পেয়েছেন তিনি। ঐচ্ছি মনের দেয়ালে এক অন্যরকম প্রশান্তি পায়। পরিবারের মানুষগুলো যখন একসাথে হাসে, একসাথে ভালোবাসে, ভালো থাকে তখনই এই অন্যরকম প্রশান্তিটা মনে আসে।
.
ঘড়ির কাটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। তাহেরা বেগম ব্যস্ত ভঙিতে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। তার সাথে হাতে হাতে সাহায্য করছে তানিয়াও। কাজের মাঝে এক আধটুও গল্পও করছেন তারা।
ঐচ্ছি তখন থেকে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। সায়মার সাথে ছোট খাটো এক ঝগড়া হয়েছে তার। মেয়েটাকে কোনো ভাবেই রুম থেকে বের করতে পারছে না সে। সাইভিদের ভয়ে মেয়েটা কাট হয়ে আছে। অদ্ভুত তো, সাইভিদ ভাইয়া কি বাঘ না ভাল্লুক? সায়মাকে দেখলেই উনি ওকে গিলে খাবে নাকি? যতসব আজাইরা ঢং। ইচ্ছে মতো সায়মাকে কিছুক্ষণ বকেছে সে। তাও এই মেয়ের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। ঐচ্ছি রাগে ফেটে পড়ছে। রাগে দাঁতে দাঁত চিপে বললো,
‘খাবারটাও কি রুমে খাবি তুই?’
সায়মা অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘হুম।’
ঐচ্ছি এবার দাঁত কামড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। একে অন্যভাবে সায়েস্তা করতে হবে। ঐচ্ছি গনগনিয়ে গিয়ে সাইভিদের রুমে ঢুকল। ডিভাইনে বসে লেপটপ টিপছিলো সাইভিদ। ঐচ্ছিকে হুট করেই রুমে ঢুকতে দেখে বিরক্ত হয় সে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘আজব তো! কারো রুমে ঢোকার আগে যে অনুমতি নিতে হয় সেইটুকুও জানিস না নাকি?’
ঐচ্ছি রাগি কন্ঠে জবাব দেয়,
‘আরে জানি জানি। তোমার সাথে খুব ইমপরটেন্ট একটা কথা ছিল তাই এইভাবে চলে আসা।’
সাইভিদ এক ব্রু উঁচিয়ে সন্দিহান কন্ঠে জিগ্যেস করলো,
‘আমার সাথে আবার কি ইমপোরটেন্ট কথা?’
ঐচ্ছি ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে সাইভিদকে তাড়া দিয়ে বললো,
‘আমার রুমে চলো।’
সাইভিদ অনেকটাই অবাক হয়। লেপটপটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠে,
‘কেন, তোর রুমে গিয়ে কি হবে?’
ঐচ্ছি বিরক্ত হলো। ব্যগ্র কন্ঠে বললো,
‘উফফ, আগে চলতো তারপরই সব বুঝবে।’
সাইভিদ কিছু বুঝল না। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বললো,
‘ঠিক আছে চল।’
সায়মা বিষন্ন মনে বিছানার এক কোণে বসে ছিল। মনে মনে নিজেকে সাহস দিচ্ছিল। এটা ওটা বলে নিজের মনকে বুঝাচ্ছিলো, এত ভয় না পেতে। সাইভিদ ভাই তাকে খেয়ে ফেলবে না। আর এতদিনে উনি তার কথা ভুলেও গিয়েছেন। অযথা এত ভয় পাওয়ার কোনো মানেই হয়না। আর ঐচ্ছি তো আছেই তাকে বাঁচানোর জন্য। নিজের মনে যথেষ্ট সাহস জুগিয়েছে সে। কিন্তু বেশি সময় নিল না, সমস্ত সাহস ফুঁস করে উড়ে গেল দরজা ঠেলে এক সুদর্শন পুরুষের আগমন দেখে। যতটা না সাহস জুগিয়েছে এখন তার থেকেও বেশি ভয় করছে তার। সায়মার ভয়ার্ত মুখ দেখে ঐচ্ছি ঠোঁট চেপে হাসে। বেচারি সামু, এখন বোধ হয় কেঁদেই ফেলবে। ঐচ্ছি গলা ঝেরে বলে উঠে,
‘সাইভিদ ভাইয়া, তোমার সাথে একজনের পরিচিয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে এখানে এনেছি। এই যে ও হলো আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বান্দরনী ও সরি বান্ধবী, সায়মা। আর সায়মা ইনি হলেন, থাক বলতে হবে না; আমি জানি তুই চিনতে পেরেছিস।’
সাইভিদ বিস্মিত চোখে সায়মা আপাদমস্তক পরখ করে। সাইভিদের কাছে সায়মাকে যেন কোনো ভিন গ্রহের এলিয়েন মনে হলো। মেয়েটাকে কি এতক্ষণ এখানেই ছিল? সাইভিদ ব্রু কুঁচকে বললো,
‘তোর বান্ধবীকে কি এতক্ষণ রুমে আটকে রেখেছিলি নাকি? এখন হুট করেই কোথ থেকে ও উদয় হলো?’
ঐচ্ছি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,
‘আরে না ও তো তোমার ভয়েই রুম থেকে বের হচ্ছিল না।’
সায়মা বড় বড় চোখ করে ঐচ্ছির দিকে তাকায়। নাক ফুলিয়ে দাঁত চেপে মনে মনে কিছুক্ষণ ঐচ্ছিকে বকে নেয়। কিন্তু ঐচ্ছি তো ঐদিকে বেশ মজা নিচ্ছে। সাইভিদ কিছুটা বিরক্ত হলেও অবাক মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
‘আমার ভয়ে মানে? আমাকে ভয় পাওয়ার কি আছে, অদ্ভুত!’
ঐচ্ছি ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
‘হুম সেটাই তো আমি তখন থেকে ওকে বোঝাচ্ছি, যে আমাদের সাইভিদ ভাইয়া ভীষণ ভালো। উনার মতো ভালো ছেলে দুনিয়াতে আর একটাও নেই। উনাকে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। উনি বেশ নরম মনের একজন মানুষ। তুই কথা বললেই বুঝতে পারবি। কিন্তু ও তো আমার কোনো কথা শুনছিলোই না। সেই রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তা এখন দেখেছিস তো সাইভিদ ভাইয়াকে? কত নরম, ভদ্র, শান্ত শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট একটা প্রাণী। ও সরি লেজ কোথ থেকে আসবে? লেজ তো গরুর থাকে আর সাইভিদ ভাইয়া তো আর গরু না মানুষ। ভুলে বলে ফেলেছিলাম সাইভিদ ভাইয়া, সরি।’
সাইভিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঐচ্ছির দিকে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে সরু চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর গম্ভীর স্বরে বলে,
‘তুই কি কোনোভাবে আমাকে নিয়ে মজা করছিস, ঐচ্ছি।’
ঐচ্ছি বড় বড় চোখ করে প্রসন্ন দৃষ্টিতে সাইভিদের দিকে তাকায়। গালে দুহাত দিয়ে তওবা করার ভঙ্গিমা করে উদ্বিগ্ন সুরে বলে,
‘তওবা তওবা, তুমি আমার বড় ভাই; তোমাকে নিয়ে কি আমি মজা করতে পারি বলো? জীবনেও পারি না। আমি তো জাস্ট সামুকে বুঝাচ্ছিলাম। তাই না সামু?’
সামু আদৌ কিছু বুঝল না। তারপরও সে উপর নিচ মাথা নাড়াল। রাফসান ভীষণ বিরক্ত হলো। অক্ষিপল্লবের দৃষ্টি সূচের মতো তীক্ষ্ণ করে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই রমনীর দিকে তাকাল। তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হুট করেই দরজা খোলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
সাইভিদ বেরিয়ে যেতেই হাসিতে ফেটে পড়ে দুজন। ঐচ্ছি পেট চাপড়ে হেসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সায়মাও হাসতে হাসতে তার পাশে গা এলিয়ে দেয়। ঐচ্ছি তখন কোনোরকমে হাসি থামিয়ে সায়মার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘বলেছিলাম না ভাইয়া সব ভুলে গিয়েছে, তুই অযথায় এত ভয় পাচ্ছিস। দেখেছিস তো, মিলেছে না আমার কথা?’
সায়মা হেসে জবাব দিল,
‘হ্যাঁ সেটাই তো দেখছি। তা এই ভুলো ব্রেইন নিয়েই কি তোর ভাই পড়াশোনায় এত ভালো করেছে? কেমনে পারলো রে?’
ঐচ্ছি ঠোঁট উল্টে বললো,
‘কি জানি। যাকগে ভুলে গেলেই ভালো।’
____________________
ডাইনিং এ বসে বড়রা সবাই খাবার খাচ্ছে। ঐচ্ছি আর সায়মা তাদের খাবারের প্লেট নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসেছে। টিভি দেখবে আর খাবে। বেশ কিছুক্ষণ পর সেই রুমে হুট করে সাইভিদ এল হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে। ঐচ্ছি আর সায়মা দুজনেই অবাক। ঐচ্ছি অবাক কন্ঠে বললো,
‘কি হলো ভাইয়া, তুমি এখানে?’
‘তোদের সাথে খাবো, তাই চলে এলাম।’
মুচকি হেসে কথাটা বলেই আলাদা একটা সোফায় বেশ আরাম করে সাইভিদ বসে। ঐচ্ছি আর সায়মা সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাইভিদ ব্রু নাচিয়ে বলে,
‘কিরে তোরা দুইটা এমন বলদের মতো তাকিয়ে আছিস কেন?’
ঐচ্ছি মুখ বাকিয়ে বলে,
‘উফফ, ঢং! উনার দিকে যেমন তাকানোও যাবে না। এই সামু তাকাস না আর। তাড়াতাড়ি নিজের খাওয়া শেষ কর।’
ঐচ্ছি আর সায়মা টিভি দেখছে আর খাচ্ছে। সাইভিদও খাচ্ছে। তবে খাওয়ার মাঝখানে সায়মাকেও আড়চোখে দেখছে সে। সাইভিদ ব্রু কুঁচকালো। থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে তীক্ষ্ণ স্বরে সায়মাকে বললো,
‘আচ্ছা, তুমিই কি ঐচ্ছির সেই ফ্রেন্ড যার সারে সেদিন আমার ফোনে কথা হয়েছিল?’
মুখের খাবারটা গলায় আটকে যায় সায়মার। জোরে জোরে কাশতে থাকে সে। সাইভিদ তাড়াহুড়ো করে তার পানির গ্লাসটা সায়মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘নাও নাও পানি খাও।’
ঢকঢক করে গ্লাসের পুরো পানিটা খেয়ে নেয় সায়মা। তারপর অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় সাইভিদের দিকে। সাইভিদ সরু চোখে সায়মার দিকে তাকিয়ে আছে। সায়মা ছোট্ট একটা ঢোক গিললো, কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
‘জ-জ্বি।’
চলবে..