#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২২.
কাঠফাটা রৌদ্দুর, তার মাঝেই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ঐচ্ছি আর রাফসান। রাফসান এতটা না ঘামলেও ঐচ্ছি খুব ঘামছে। লাল নাকের ডগায় লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো চিক চিক করছে। ঠোঁট আর নাকের মাঝখান জায়গাটাতেও বেশ আরাম করে বসে আছে এই লবণাক্ত পদার্থগুলো। রাফসান অপলক চেয়ে রইল ঐচ্ছির দিকে। গরমে মুখটা লাল হয়ে আছে। তাতে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছে তার প্রেয়সীকে। ঐচ্ছি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখের ঘামগুলো মুছে, রাফসানের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘এখন কেন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন? এতক্ষণ তো খুব ইগনোর করছিলেন।’
কথাটা বলেই নাক ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরায় ঐচ্ছি। বিপরীতে রাফসান স্মিত হাসে। বুকের উপর হাত ভাজ করে জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে,
‘আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে, ঐচ্ছি?’
ঐচ্ছি বাঁকা চোখে রাফসানের দিকে তাকায়। রাফসানের শান্ত দৃষ্টি খোলা আকাশে। ঐচ্ছি রাফসানের হাতের দিকে তাকায়। হাত যুগল ভাজ করায় তার বাহুর মাংসপেশী গুলো ফুলে আছে। ঐচ্ছির খুব ইচ্ছে করছে এই জায়গাটাতে খুব জোরে একটা চিমটি কাটতে। কিন্তু রাফসান কি না কি ভাববে, সেই ভেবে সে দমে গেল। মুখ ঘুরিয়ে সেও আকাশের দিকে তাকাল। গম্ভীর স্বরে বললো,
‘আপনার প্রমাণের কি হলো?’
থমথমে হয়ে উঠল রাফসানের চোখ মুখ। কাতর চোখে ঐচ্ছির দিকে তাকাল সে। কিন্তু ঐচ্ছি তাকাল না, বরাবরের মতোই আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমি যা বলেছি আপনি তা করতে না পারলে আমি কখনোই বিশ্বাস করবো না যে আপনি আমাকে ভালোবাসেন। ‘
রাফসান ধরা গলায় বললো,
‘ঐচ্ছি, আপনি খুব ভালো করেই জানেন যে আপনার মা বাবা আমার নিমন্ত্রণে আছেন। সজ্ঞানে উনারা কখনোই আমার সাথে আপনার বিয়ে হতে দিবেন না। এখন যদি আমি উনাদের উপর থেকে আমার নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে ফেলি তাহলে উনারা এই বিয়েতে বাধা দিবেন। আর আমি কিন্তু কোনো বাধাই মেনে নিব না ঐচ্ছি। আগেও বলেছি আর এখনো বলছি বিয়ে আপনাকে আমাকেই করতে হবে। আর নয়তো সারাজীবন কুমারী থাকতে হবে। আপনাকে অন্য কারোর বউ হতে আমি দেব না। যতদিন পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকবো ততদিন পর্যন্ত আপনি আমার নজরের বাইরে যেতে পারবেন না। আমাদের বিয়ে হোক আর না হোক আপনি সবসময় আমারই থাকবেন। বুঝতে পেরেছেন?’
ঐচ্ছি নিশ্চুপ। রাফসান কিছুটা শান্ত হলো, জিভ দিয়ে তার ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠল,
‘চিন্তা করবেন না, কাল সকালের মধ্যে আপনার মা বাবা ঠিক হয়ে যাবে ঐচ্ছি। তবে আমি আপনাকে আগে থেকেই সাবধান করছি, এই বিয়েতে কেউ বাধা দিতে আসলে আর সে যেই হোক না কেন আমি কিন্তু কাউকে পরোয়া করবো না(একটু থেমে) এমনকি আপনার মা বাবাকেও না।’
শেষের কথাটা অনেকটা জোর গলায় বলে উঠে রাফসান। ঐচ্ছি ভীত সন্ত্রস্ত চোখে রাফসানের দিকে তাকায়। এতক্ষণ রোদে থেকেও রাফসানের মুখটা লাল হয়নি, কিন্তু এখন তার মুখটা লাল হয়ে আছে। নীল চোখগুলো যেন একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছে। ঐচ্ছি কিছুটা ঘাবড়ে যায়। ভয়ে ভয়ে রাফসানের দিকে এগিয়ে যায়। রাফসান স্থির দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঐচ্ছি ধীরে ধীরে রাফসানের কাছে গিয়ে আস্তে করে রাফসানের মুখের উপর ফুঁ দিল। রাফসান বড় বড় চোখ করে ঐচ্ছির দিকে তাকায়। মেয়েটা কখন কি করে এক আল্লাহই জানেন। ঐচ্ছি ফট করেই দূরে সরে যায়। ঠোঁট টিপে হেসে বলে,
‘আপনি রেগে গেলে আপনাকে আরো বেশি কিউট লাগে, রাফসান।’
চরম অবাক রাফসান। হুট করেই মেয়েটার হলো কি? একটু আগেও তো রেগে ছিল, আর এখন এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে। রাফসান ব্রু কুঁচকে ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আপনার কি হয়েছে, ঐচ্ছি?’
কোমরে হাত রেখে বিরক্ত ভঙ্গিতে ঐচ্ছি বলে উঠে,
‘আজব তো! আমার আবার কি হবে? আপনি আমাকে সুন্দর বলতে পারেন, আর আমি আপনাকে কিউট বলতে পারি না?’
রাফসান নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে ঐচ্ছির দিকে খুব মনোযোগীর দৃষ্টিতে তাকায়। ঐচ্ছি চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। হেয়ালির সুরে বলে উঠে,
‘এই যে মি. জ্বীন, আমাকে সাবধান করে আপনি নিজে ঠোঁট কামড়াচ্ছেন? এটা কিন্তু মোটেও ঠিক হচ্ছে না মি. জ্বীন। আপনি ঠোঁট কামড়ালে কিন্তু আমিও ঠোঁট কামড়াবো এই বলে রাখলাম।’
রাফসান ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে গলা ঝাড়লো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
‘আপনার হুট হাট করে কি হয় বলুন তো? হুট করেই রেগে যান, আবার হুট করেই আপনার রাগ ভ্যানিস? আর এখন আবার এই অদ্ভুত ব্যবহার, আমার তো কিছুই হজম হচ্ছে না।’
‘হজমী খান, সব হজম হয়ে যাবে।’
দাঁত কেলিয়ে বলে উঠে ঐচ্ছি। রাফসান ব্রু কুঁচকায়। ঐচ্ছি রাফসানের কিছুটা কাছে এসে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বলে উঠে,
‘আমার মা বাবাকে ঠিক করে দিন রাফসান। আমি যদি আপনার ভাগ্যে থেকে থাকি তবে পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাকে আপনার থেকে আলাদা করতে পারবে না। আমি শুধু এইটুকুই চায় যে, আমার মা বাবা যেন আবার ঠিক হয়ে যায়। প্লিজ।’
ঐচ্ছির চোখের গভীরতায় রাফসান হারিয়ে যায়। মায়া যেন উপচে পড়ছে ঐ কালো হরিণী চোখ দুটো তে। রাফসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কোমল কন্ঠে বলে উঠে,
‘ঠিক আছে ঐচ্ছি, আপনি যা চান তাই হবে।’
চোখে হাসে ঐচ্ছি। বেড়াল পায়ে নেমে যায় ছাদ থেকে। রাফসান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে সামনের পিচ ঢালা রাস্তাটার দিকে। তারপর সেও ধীর পায়ে নিচে নেমে যায়।
_____________________
মাগরিবের আযানের পর চোখ খুললো, ঐচ্ছি। সারাদিনের ক্লান্তিতে রাফসানরা চলে যেতেই বিশাল ঘুম দেয় সে। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। পায়ের নিচে সায়মাকে বসে থাকতে দেখে। হাতে তার লাল টকটকে এক গোলাপ। ঐচ্ছি ব্রু কুঁচকে সেদিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছোঁ মেরে সায়মার হাত থেকে গোলাপটা নিয়ে নেয় সে। গোলাপটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে ঐচ্ছি বলে উঠে,
‘গোলাপ কই থেকে পাইলি?’
লজ্জায় মাথা নিচু করে সায়মা। ঐচ্ছি বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকায়। ঝাঁঝাল কন্ঠে বলে উঠে,
‘আজব তো! এমন নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পাচ্ছিস কেন? কে দিয়েছে এটা?’
সায়মা মৃদু হেসে, আস্তে করে বলে,
‘সাইভিদ ভাই।’
ঐচ্ছির যেন বিশ্বাস হলো না সায়মার কথা। চিৎকার দিয়ে উঠে বললো,
‘কি?’
সায়মা চোখ মুখ কুঁচকে ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আরে আস্তে। এত জোরে চিল্লাস না।’
‘চিল্লাবো না মানে। তুই কি বলছিস তুই জানিস? সাইভিদ ভাই তোকে এই গোলাপ দিয়েছে? সিরিয়াসলি?’
সায়মা অত্যন্ত বিরক্তির সুরে বললো,
‘আরে বাবা হ্যাঁ। কিছু বলতে না চাইলে তো মাথা খাস, আর বললে বিশ্বাস করিস না। কোন দিকে যাবো বলতো আমি?’
ঐচ্ছির এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। কবে ঘটল এত কিছু। গোলাপটার দিকে তাকিয়ে থেকে ঐচ্ছি দরাজ গলায় বলে উঠল,
‘ভাইয়া কি তোকে প্রপোস করেছে?’
সায়মা তেতিয়ে উঠে বলে,
‘আরে না। তুই না বিকেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলি। পরে আমি একা একা বোর হচ্ছিলাম বলে উনি আমাকে বললো বাইরে হাটতে যাবো কিনা? ভাবলাম একা একা বোর হওয়ার চাইতে একটু বাইরে গিয়ে ঘুরে আসা ভালো। আন্টিকে বলে উনার সাথে বাইরে চলে গেলাম। তারপরই হাটতে হাটতে রাস্তার উপারে গেলাম। ঐদিকেই একটা ছোট্ট গোলাপ গাছ ছিল। আর এই একটাই ফুল ফুটেছিল সেই গাছে। তখন সাইভিদ ভাই নিজ থেকেই গিয়ে এই ফুলটা ছিঁড়ে আমাকে দিলেন। ব্যস, এইটুকুই। ফুল দিতে কি প্রপোস করা লাগে নাকি, আজব!’
ঐচ্ছির হাত থেকে ফুলটা নিয়ে সায়মা তার ব্যাগে রেখে দেয়। আর ঐচ্ছি ভাবতে থাকে। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা তার কাছে। সাইভিদ তো এমন ছেলে না। ঐচ্ছি ছাড়া ও আর কোনো মেয়ের সাথেই এত সহজে মিশে না। হঠাৎ সায়মার সাথে এত ভালো বন্ডিং কি করে তৈরি হলো যে তাকে ফুল দিয়ে দিল। তাও আবার তার নিজের সবথেকে প্রিয় ফুল। ঐচ্ছির কাছে পুরো ব্যাপারটাই কেন যেন সন্দেহ সন্দেহ লাগছে। সাইভিদ ভাইয়া আসলে চাইছেটা কি? কি উদ্দেশ্য নিয়ে উনি এসব করছেন? উনি কি সায়মাকে পছন্দ করেন? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?
চলবে..