কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ২৪.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

২৪.
আজ ঘুম ভাঙতে একটু বেশিই লেইট হয়ে গিয়েছে ঐচ্ছি আর সায়মার। এক প্রকার তাড়াহুড়ো করে তারা নাস্তা সারল। তারপর দুজনেই বেড়িয়ে পড়ল ভার্সিটির পথে।

প্রথম দুই ক্লাস শেষ হওয়ার পরই ঐচ্ছি পেট চাপড়ে বললো,

‘দোস্ত, আমার না খিদা লেগেছে।’

সায়মা কলমের ক্যাপটা লাগিয়ে সেটা ব্যাগে রাখতে রাখতে বললো,

‘চল ক্যান্টিনে যাই।’

ঐচ্ছি ঠোঁট উল্টে মিঁইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,

‘কিন্তু, আমার না বাইরের ঐ মামার দোকানের ফুচকা খেতে মন চাইছে।’

সায়মা তাকে বাধা দিয়ে কড়া গলায় বললো,

‘একদম না। সকালে আমরা কেউই ভালো করে কিছু খেতে পারেনি। ধরতে গেলে আমাদের পেট এখনো খালি, আর এই খালি পেটে ঐ ঝাল ফুচকা খেলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। সামনে পরীক্ষা এমনিতেই তোর বিয়ের ঝামেলায় তোর কিছু পড়া হচ্ছে না এখন যদি আবার এইসব খেয়ে অসুস্থ হোস তাহলে এই পড়া আর পরীক্ষা দুটোই চাঙ্গে উঠবে তোর। খিদে লাগলে ক্যান্টিন আছে, সেখানে ভালো ভালো খাবার আছে এখন সেগুলোই খাবো আমরা। দরকার পড়লে ছুটির পর না হয় ফুচকা খাওয়া যাবে। এখন ক্যান্টিনে চল।’

ঐচ্ছি ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ সায়মার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটার কত কেয়ার তাকে নিয়ে। কত ভালোবাসা! ঐচ্ছি ঝাপটে ধরে সায়মার গালে চুমু খায়, তারপর আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠে,

‘লাভ ইউ, দোস্ত।’

সায়মা চোখে মুখে মেকি রাগ ফুটিয়ে তুলে বলে,

‘ইয়াক, এমনে চুম্মা চুম্মি করস ক্যান? আমি কি তোর জামাই লাগি নাকি?’

ঐচ্ছি নাক ফুলিয়ে সায়মার চুলে টান দেয়। তারপর মুচকি হেসে বলে,

‘জামাই না সতীন লাগিস। চল এবার।’

_________________________

ছুটির পর, সায়মা আর ঐচ্ছির সাথে তাদের বাড়িতে যায়নি, সে সোজা নিজের বাসায় চলে গিয়েছে। ঐচ্ছির কিছুটা মন খারাপ হয়। সামুটা পাশে থাকলে অলঅয়েজ তার মন ভালো থাকে। ইচ্ছে করে মেয়েটাকে নিজের সাথেই রেখে দিতে। কিন্তু এটা তো আর পসিবল না। মুখটাকে কালো করে বাসায় ঢুকে ঐচ্ছি। সাইভিদ তখন বাইরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছিল। ঐচ্ছিকে একা বাসায় ঢুকতে দেখে সাইভিদ তাকে জিগ্যেস করলো,

‘কিরে ঐচ্ছি তোর সাথের ঐ পিচ্চিটা কই?’

ঐচ্ছি চোখ মুখ কুঁচকে সেদিকে তাকায়। কালকে সন্ধ্যায় তাকে এত বকে এখন আবার কথা বলতে এসেছে। কথাই বলবে না সে। এই ভেবে ঐচ্ছি সাইভিদের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই বাসার ভেতরে চলে গেল। ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে নিজেও গা এলিয়ে দিল তাতে। বাইরের এই ফকফকা রোদে ঘেমে তার শরীর চুপচুপ হয়ে আছে। ফ্যানের ঠান্ডা বাতাস যেন ঘামগুলোকে শুষে নিচ্ছে। বেশ আরাম পাচ্ছে ঐচ্ছি। চোখ বুজে নির্নিমেষ শুয়ে রইল সেখানে। হুট করেই রুমে এল তাহেরা বেগম। চেচিয়ে উঠে বললেন,

‘এই মেয়ে, এই ঘামানো শরীর নিয়ে এমন চিত হয়ে শুয়ে আছিস কেন? উঠে গোসল করতে যা।’

ঐচ্ছি ভারি গলায় বললো,

‘যাচ্ছি মা।’

‘যাচ্ছি মা না, এক্ষুণি যা। আমাকে যেন আর বলতে না হয়। গোসল সেরে তাড়াতাড়ি এসে খেতে বস।’

এইবলে তিনি চলে যাচ্ছিলেন হঠাৎই কি ভেবে আবার পেছনে ফেরেন। আস্তে করে ঐচ্ছির পাশে এসে বসেন। ঐচ্ছির ডান হাতটা তার হাতে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেন। অনেক কৌতুহল নিয়ে জিগ্যেস করেন,

‘তোর হাতের এই রিংটা কে দিয়েছে রে? দেখে তো মনে হচ্ছে সোনার।’

ঐচ্ছি চমকে উঠে চোখ মেলে তাকায়। তার মা এই আংটি টা চিনতে পারছে না? এটাতো রাফসানের দেওয়া আংটি। কাল না সবার সামনে পরালো, তাহলে মা আবার এসব কেন জিগ্যেস করছে? ঐচ্ছি শোয়া থেকে উঠে বসে। মায়ের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে বলে,

‘এসব কি বলছো মা? তুমি জানো না এই আংটি আমাকে কে দিয়েছে?’

তাহেরা বেগম যেন কিছুই জানেন না। ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে পরিষ্কার গলায় বললেন,

‘না তো। কে দিয়েছে এটা?’

ঐচ্ছি এবার আরো অবাক হয়। হলোটা কি মায়ের? তার মা তার সাথে কখনো কোনো বিষয় নিয়ে মজা করেন না, তাহলে কি তিনি সত্যি সত্যিই ভুলে গিয়েছেন? অদ্ভুত তো!

ঐচ্ছিকে চুপ থাকতে দেখে তাহেরা বেগম তাকে তাড়া দিয়ে বললেন,

‘কি হলো, বল?

ঐচ্ছি কিছু বলে না। চোখের পাতা প্রশ্বস্থ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর ভাবতে থাকে হঠাৎ তার মায়ের কি হলো? সর্ট মেমোরি লস? নাকি অন্যকিছু? হঠাৎই তার মনে পড়ল, রাফসান কি তবে সত্যি সত্যিই তার মা বাবার উপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে নিয়েছে? সেই জন্যই কি তার মা কিছু মনে করতে পারছে না? ঐচ্ছি সিউর হতে পারছে না। মাকে এখন কি জবাব দিবে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। মিথ্যে বলবে নাকি সত্যি? ঐচ্ছি জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট জোড়া ভেজাল। ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে তার খালামনি চলে আসে।

‘আপা, একটু আমার সাথে আমার রুমে আসো তো। তোমার সাথে একটু জরুরি কথা আছে।’

তাহেরা বেগম আর বসলেন না, মেয়ের কথাটা শোনার প্রয়োজন বোধও করলেন না। বোনের সাথেই তার রুমে চলে গেলেন। ঐচ্ছি হাফ ছেড়ে বাঁচল। জোরে জোরে দুটো নিশ্বাস ফেলে তাড়াহুড়ো করে রাফসানকে কল লাগাল। আগে তাকে সিউর হতে হবে। নয়তো আন্দাজে কিছু বলে ফেললে পরে আরো ঝামেলা লাগতে পারে। কল কেটে দিল রাফসান। তারপর কল ব্যাক করে সালাম দিল ঐচ্ছিকে। ঐচ্ছি সালামের জবাব দিয়ে তাকে জিগ্যেস করলো,

‘আচ্ছা, আপনি কি আমার মা বাবার উপর থেকে আপনার নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে ফেলেছেন।’

রাফসান থমথমে গলায় জবাব দিল,

‘জ্বি।’

ঐচ্ছি কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। এতদিন ধরে সে যা চেয়েছিল আজ তো তাই হয়েছে। কিন্তু ঐচ্ছি জানতোও না যে তার মা বাবা আবার স্বজ্ঞানে ফিরে আসলে ঠিক কি পরিমান ঝামেলা হতে পারে। ঐচ্ছি ঘাবড়ে যায়, না জানি এখন তাকে কত কিছু সামলাতে হয়। রাফসান শুকনো কন্ঠে বলে উঠল,

‘আপনি তো এমনটাই চেয়েছিলেন ঐচ্ছি। আর তাই হয়েছে। আপনার মা বাবা এখন আগের মতো হয়ে গিয়েছে। তাই এখন আর উনাদের আমার সাথে সম্পর্কিত আর কোনো কিছুই মনে থাকবে না। ইনফেক্ট আপনার যে এংগেইজমেন্ট হয়েছে, বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে এইসব কিছুই উনারা ভুলে গিয়েছেন। উনাদের জন্য সবকিছু আবার নতুন করে শুরু হবে। আর সেই শুরুটা করবেন আপনি।’

ঐচ্ছি কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,

‘আমি?’

‘জ্বি, আপনি। আপনার কথামতো তো আমি আমার ভালোবাসার প্রমাণ আপনাকে দিয়েছি। এবার এই বিয়েটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করানোর দায়িত্বটা আপনার। ভাবুন ঐচ্ছি, কিভাবে কি করবেন ভাবতে থাকুন। এখন তাহলে রাখছি, আল্লাহ হাফেজ।’

ফোনটা কান থেকে নামিয়ে অসহায় ভাবে বসে থাকে ঐচ্ছি। এখন কিনা এত সব ঝড় তাকে সামলাতে হবে। কেন? সে তো রাফসানকে ভালোবাসে না তাহলে সে কেন সামলামে এত কিছু? নিজের উপরই এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। কাল রাতে যখন রাফসান তাকে বিয়ে ভাঙার কথা বলছিল তখন সে চুপ হয়ে ছিল। তখন সরাসরি বলে দিলেই পারতো, ‘হ্যাঁ আপনি বিয়ে ভাঙলে আমি খুশি হবো।’ তা না করে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল। কেন পারল না সে? এতদিন বিয়ে ভাঙার জন্য কত প্ল্যানিং করছিল কিন্তু এখন বিয়ের ভাঙার এত সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারছে না সে। ইশ, এই মনেরও হয়েছে এক জ্বালা। কি যে চায় বোঝা মুশকিল। কিন্তু এইটুকু সে আপাদত বুঝে গিয়েছে, সামনে যত মসিবত আছে তা সবই তার উপর দিয়েই যাবে। ঐচ্ছির এবার কান্না করতে মন চাইছে। সব প্যারা এই এক বিয়েকেই নিয়ে। বিয়ে করলেই কি সব প্যারা মিটে যাবে? যদি তাই হয় তবে সে তাই করবে। রাফসানকেই বিয়ে করবে সে। আর সেটা তার মা বাবার সম্মতি নিয়েই।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here