#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৭.
মাথায় বড়সড় একটা ঘোমটা দিয়ে নাজমুল হুজুরের সামনে এসে বসলো ঐচ্ছি। চোখ মুখ শুকিয়ে আছে মেয়েটার। সরু নাকটা লাল হয়ে আছে। নাজমুল হুজুর কিছুটা নড়ে চড়ে বসলেন। ঐচ্ছিকে সালাম দিয়ে জিগ্যেস করলেন,
‘কেমন আছেন, ঐচ্ছি?’
ঐচ্ছি কাতর চোখে হুজুরের দিকে তাকাল। ঐচ্ছির চোখ মুখ দেখে নাজমুল হুজুর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঐচ্ছির মা বাবার দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললেন,
‘আমি ঐচ্ছির সাথে একটু একা কথা বলতে চাই, যদি আপনাদের অনুমতি থাকে।’
ঐচ্ছির মা বাবা একজন অন্যজনের মুখের দিকে তাকালেন। হুজুর যখন সবকিছু জানেনই তখন তিনি ঠিক কিছু না কিছু একটা করতে পারবেন, সেই বিশ্বাস আছে তাদের। তাই উনারা হুজুরের কথায় সম্মতি জানিয়ে সেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। উনারা বেরিয়ে যেতেই নাজমুল হুজুর টি টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে পানিটা পান করলেন। তারপর জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে ঐচ্ছির দিকে ঘুরে বসলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন,
‘রাফসান হোসাইনকে ভালোবাসেন ঐচ্ছি?’
ঐচ্ছি ছোট্ট একটা ঢোক গিলে উপর নিচ মাথা নাড়াল। হুজুর তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললেন,
‘কিন্তু উনি তো জ্বীন ঐচ্ছি। মানুষ হয়ে জ্বীনকে ভালোবাসাটা কি ঠিক ঐচ্ছি?’
ঐচ্ছি কাঁদো কাঁদো মুখে নাক টানল। অসহায় কন্ঠে বললো,
‘এই বেঠিক কাজটাই তো আমি করে ফেলেছি হুজুর। ভালোবেসে ফেলেছি আমি। হুজুর, আপনি বলেছিলেন না, আমি যদি কোনোদিন রাফসানকে ভালোবাসি তবে আপনি স্বয়ং আমাদের বিয়ের কাজী হবেন? আপনার সেই কথা রাখার সময় এসে গিয়েছে হুজুর। আমার মা বাবা এখানে আপনাকে কেন ডেকেছেন সেটা আমি জানি। কিন্তু আমি এও জানি আপনি আপনার কথার হেরফের করবেন না। আপনার উপর আমার বিশ্বাস আছে হুজুর। এখন একমাত্র আপনিই আমার ভরসা। আমার মা বাবাকে এই বিয়েতে রাজি করান হুজুর, প্লিজ।’
ঐচ্ছি হাত দুটো জোর করে হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হুজুরের চোখে মুখে তখন উৎকন্ঠা। এ তো মহা বিপদ। মা বাবা উনাকে ডেকেছে বিয়ে ভাঙ্গার জন্য আর মেয়ে বলছে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। উনি এখন কি করবে? নাজমুল হুজুর চোখ মুখ কুঁচকে ঐচ্ছির দিকে তাকায়। ভারী গলায় বলে উঠে,
‘আপনার মা বাবা কোনোমতেই এই বিয়েতে রাজি হবেন না ঐচ্ছি। আর মা বাবা অমতে বিয়ে করলে সেই বিয়েতে আল্লাহর সন্তুষ্ট থাকে না। আমি সেই দিন সেই কথাটা বলেছিলাম, কারণ আমি ভেবেছিলাম আপনার মা বাবা এই বিয়েতে রাজি শুধু আপনিই রাজি না। আর আমার বিশ্বাস ছিল আপনি কোনোদিন রাজিও হবেন না। বলতে পারেন নিজের মনের অত্যধিক আত্মবিশ্বাস থেকে আমি কথাটা বলেছিলাম। কিন্তু, এখন তো আপনিও রাজি আর এবার আপনার মা বাবা বেঁকে বসেছে। এই বিয়েটা করতে হলে আপনাকে আপনার মা বাবার অমতেই করতে হবে তাদেরকে কষ্ট দিয়ে, এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এখন আপনিই দেখুন আপনি কি করবেন।’
ঐচ্ছির মনটা এবার একেবারেই ভেঙ্গে যায়। শেষ আশার আলোটাও যে নিভে গিয়েছে। এখন সে কি করবে? বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। বুকের ভেতরে অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। বসে বসে দুহাত কচলে ছটফট করতে থাকে সে। বাবা মাকেও যেমন কষ্ট দিতে পারবে না তেমনি রাফসানকেও ছাড়তে পারবে না। ঐচ্ছি আর বসে থাকতে পারে না। ছুটে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। মাথার উড়নাটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে ধুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সবকিছু অসহ্য লাগছে তার কাছে। আর পেরে উঠছে না সে। এতদিন এই বিয়েটা ভাঙ্গার টেনশনে অস্থির হয়ে থাকতো আর এখন আবার এই বিয়েটা করার টেনশনে অস্থির হয়ে উঠছে। এই এক মাসে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ভয়, অস্থিরতাই রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছে সে। আর পারছে না। নিজের মনের সাথেও কম যুদ্ধ করতে হয়নি তাকে। এতসব অশান্তিতে শরীরটা এখন বড্ড খারাপ লাগছে তার। ঐচ্ছি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। আস্তে করে উঠে বসে তার মোবাইলটা হাতে নিল। রাফসানকে কল দেয়। কলটা ভালোভাবে বাজতেও পারেনি রাফসান সেটা রিসিভ করে নেয়। বরাবরের মতোই ঐচ্ছি তেতিয়ে উঠে বললো,
‘আমি আপনাকে এক্ষুণি বিয়ে করতে চাই রাফসান।’
রাফসান শান্ত কন্ঠে বলে,
‘আবেগের বশে নেয়া সিদ্ধান্তে আপনিই পরে আফসোস করবেন ঐচ্ছি।’
ঐচ্ছি নাক ফুলিয়ে অভিমানের সুরে বলে উঠে,
‘তো আমি কি করবো? জানেন কি হয়েছে, মা বাবা নাজমুল হুজুরকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছে এই বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য।’
রাফসান ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বললো,
‘জ্বি, জানি।’
ঐচ্ছি ক্ষেপে উঠল রাফসানের কথায়। রাগ দেখিয়ে বললো,
‘সব যখন জানেনই তখন এমন চুপ করে বসে আছেন কেন? অদ্ভুত তো! আর সকালে যখন সাইভিদ ভাইয়া আপনাকে মারলো তখন আপনি অমন হ্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? আপনার হাত ছিল না। আপনি একটু ঘুষি দিলেই তো সে ঐ রাস্তার ওপারে গিয়ে পড়তো। তা না, উনি রোবটের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন।’
রাফসান মৃদু শব্দে হাসে। ঐচ্ছি তাতে আরো রেগে যায়। চোখ মুখ খিঁচে বলে উঠে,
‘হাসবেন না একদম।’
রাফসান হাসি থামাল, বললো,
‘ঠিক আছে। হাসলাম না।’
ঐচ্ছি নরম সুরে বললো,
‘আমার না আমার মা বাবাকেও লাগবে আর আপনাকেও লাগবে। আপনাদের তিনজনকেই আমার চাই। কাউকে ছাড়াই আমি থাকতে পারবো না। কিন্তু, আমার মা বাবা আমার সেই চাওয়াটা পূর্ণ হতে দিচ্ছে না রাফসান। আপনি কিছু একটা করুন না প্লিজ।’
রাফসান নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে দৃঢ় ভাবে তাকাল মোবাইলের স্ক্রিনটার দিকে। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো তার। বুক চিরে বেরিয়ে আসলো এক প্রশান্তিময় নিশ্বাস। ফোনটা আবারো কানে লাগাল। ফিচেল হেসে বলে উঠল,
‘কিছু তো একটা করতেই হবে ঐচ্ছি। আপনার চাওয়াটা যেকোনো মূল্যে পূর্ণ করতে হবে।’
ঐচ্ছি মনের অস্থিরতাটা এবার কিছুটা হলেও কমলো। সেও ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। তৃপ্তির হাসি। রাফসানের কথার উপর এক অগাধ বিশ্বাস রেখে কলটা কাটলো সে। রাফসান নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে। করতে যে হবে তাকে। ঐচ্ছির মতো তো রাফসানও চায় যে, তাদের জীবটা যেন কোনো বিচ্ছেদের ধ্বংসাবশেষ না হয়ে এক সুখী প্রণয়নের শেষ অধ্যায় হয়।
চলবে..
(পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত।)