#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৮.
জানালার নীল সাদা পর্দাগুলো বাতাসের দরুন হালকা পাতলা উড়ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে, ঐচ্ছি এখনো রুমে দোর দিয়ে বসে আছে। চোখ মুখ বিষন্ন তার। জালানার গ্রিলটাতে মাথা ঠেকিয়ে এক মনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। জানলাটা তার দক্ষিণ দিকে, বাইরে তাকালেই দেখা যায় বিশাল বড় এক খোলা মাঠ। শহরের বুকে আজকাল এমন সবুজ প্রান্তর দেখা যায় না বললেই চলে। শুধুমাত্র এই একটা জিনিসের জন্যই এই বাড়িটা ঐচ্ছির এত পছন্দ। আদনান সাহেব যখন বাড়িটা কিনেন তখন ঐচ্ছির ভীষণ মন খারাপ ছিল। কারণ তাদের এই বাড়িটা শহর থেকে একটু সাইডে হয়ে গিয়েছে। আশে পাশে অল্প কিছু বিল্ডিং রয়েছে। তাও অনেকটা দূরে দূরে। আর এর ফলে মানুষের কোলাহলটাও খুব কম। প্রথম প্রথম এই জায়গাটা ঐচ্ছির পছন্দ না হলেও এখন তার প্রিয় হয়ে উঠেছে। দক্ষিণে জানলা দিয়ে সে যখন বাইরের সেই সবুজ প্রান্তরটা দেখে তখন তার মন ফুরফুরে হয়ে উঠে। দূরের শিউলি ফুলের গাছটাও ঐচ্ছির খুব প্রিয়। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে সে মুঠো ভরে শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনে। ঐচ্ছি ব্রু জোড়া কুঁচকে শিউলি গাছটার দিকে তাকায়। আজও তার নিচে অজস্র ফুল পড়ে আছে। ঐচ্ছির হুট করেই বড্ড ইচ্ছে করে ফুলগুলোকে একটু ছুঁইয়ে দিতে। মুচকি হাসি ফোটে ঐচ্ছির অধর কোণে। বিছানার উপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাফসানকে কল দেয়। রাফসান কল রিসিভ করতেই ঐচ্ছি তাকে সালাম দেয়। রাফসান তার সালামের জবাব দিয়ে বলে উঠে,
‘আজ কি আমায় একটু বেশিই মিস করছেন?’
ঐচ্ছি ঠোঁট চেপে হাসে। তারপর গলা ঝেড়ে বলে উঠে,
‘মোটেও না। মিস করার কি আছে? একটা প্রয়োজনে আপনাক কল দিয়েছি। ফ্রি আছেন?’
‘যদি বলি ফ্রি না, তাহলে কি সেই প্রয়োজনের কথাটা বলবেন না?’
‘কেন বলবো না? অবশ্যই বলবো। ফ্রি না থাকলেও আপনাকে এখন আমার কথা শুনতে হবে।’
রাফসান স্মিত হেসে বললো,
‘তহালে বলে ফেলুন।’
ঐচ্ছি একটু থেমে বলে উঠে,
‘আমার না শিউলি ফুল লাগবে। আমাদের এইদিকে একটা শিউলি ফুলের গাছ আছে। অনেকগুলো ফুল গাছের নিচে পড়ে আছে। আমিই চাইলে গিয়ে আনতে পারি। কিন্তু দরজা খুলে রুম থেকে বের হতেই ইচ্ছে করছে না। আপনি কি একটু ঐ ফুলগুলো আমাকে এনে দিবেন?’
রাফসান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠে,
‘কেন, আমি কেন?’
ঐচ্ছি কপাল কুঁচকে ফেলে। বিরক্তির ভঙ্গিতে বলে,
‘তো আর কে দিবে? আপনি তো ফুড়ুৎ করে এসে ফুড়ুৎ করে সবকিছু করে ফেলতে পারেন তাই আপনাকে বলেছি। এখন আর কথা না বলে জলদি চলে আসুন।’
রাফসান ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
‘আমি কেন অযথা এত কষ্ট করতে যাবো বলুন তো? নিজের ইচ্ছে না করলে অন্য কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিন।’
ঐচ্ছি এবার রাগি গলায় বলে,
‘উফ, এত ঢং করছেন কেন? যান লাগবে না। রাখছি।’
কলটা কেটে দেয় ঐচ্ছি। নাক মুখ ফুলিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে সে। অভদ্র, অসভ্য জ্বীন একটা, ভাব দেখলে গা জ্বলে উঠে। ঐচ্ছি নিজের উপরই এবার নিজে ক্ষেপে যায়। কি দরকার ছিল এত আহ্লাদি করে এই জ্বীনকে ফুল আনার কথা বলার। নিজে গিয়ে নিয়ে আসলেই তো হতো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চোখ বুজে ফেলে সে। রাগে এবার ঘুমায়েই পড়বে। লাগবে না কোনো ফুলের, আর জীবনেও ঐ রাফসানের কাছে কিছু চাইবে না সে, হু।
গভীর ঘুমে ডুবে আছে ঐচ্ছি। রাগ দেখিয়ে শুয়ে থেকে সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। ঘুমের মাঝেই ডান হাতটা মাথার উপর তুলতেই কোনো কিছুর তীব্র ঘ্রাণ তার নাকে গিয়ে ঠেকে। হাতের উপর নরম কিছুর উপস্থিত টের পাচ্ছে সে। ঘুমের মাঝেই সেই হাতটা এনে নাকের কাছে ধরে। কি তীব্র এই ঘ্রাণ। খুব চেনা। ফট করেই চোখ মেলে তাকায় সে। ডান হাতটার দিকে তাকিয়ে যেন সে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ধরফরিয়ে উঠে বসে। ডান হাতটা বাম হাতে দিয়ে ধরে ভালোভাবে দেখছে সে। সে ঠিক দেখছে তো? নাকি ঘুমের ঘোরে ভুল কিছু দেখছে? ডান হাতের উপর শিউলি ফুলের মালা। ঐচ্ছি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকে সেটা। এই মালাটা তার হাতে কি করে এল? অনেক বড় মালা হাতের বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে পেঁচিয়ে আছে। ঐচ্ছি তার হাতের উপর জড়িয়ে থাকা মালাটা একটু নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখল। তার তো কিছু মাথাই আসছে না। তবে কি রাফসানই এমনটা করেছে? শিউলি ফুলের মালা এনে তার হাতে পরিয়ে দিয়েছে? কখন করলো এসব? তার ঘুমের মাঝে এত কিছু হয়ে গেল আর সে টেরও পেল না। কি মরার ঘুম ঘুমিয়েছে সে। মানে রাফসান তার রুমে এসে তার হাতে এই শিউলি ফুলের মালাটা পরিয়ে চলেও গেল অথচ সে টেরও পেল না। ঐচ্ছি শুধু অবাক না রীতিমতো হতভম্ব। বালিশের কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে রাফসানকে কল লাগায়। নাম্বার বিজি দেখাচ্ছে। আর কল না দিয়ে মোবাইলটা পাশে রেখে আবারও সে হাতের দিকে মনোযোগ দিল। হঠাৎই তার অধর কোণে চমৎকার এক হাসি ফুটে উঠল। রাফসান নিশ্চয়ই খুব যত্ন করে তাকে এই মালাটা পরিয়ে দিয়েছে! আচ্ছা, রাফসান যখন এসে দেখল সে ঘুমাচ্ছে তখন নিশ্চয়ই সে তার ঘুমন্ত মুখটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সে নিশ্চয়ই আবারও নতুন করে তার প্রেমে পড়েছিল। আচ্ছা, রাফসান আবার তার ঘুমের সুযোগ নিয়ে উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলেনি তো? ফট করেই ঐচ্ছি তার ঠোঁটের উপর হাত রাখে। জোরে একটা শ্বাস ফেলে পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে বলে, ধুর না, রাফসান এমন কিছুই করেনি। রাফসানের উপর সেইটুকু বিশ্বাস আছে তার।
বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে হাতের মালাটা দেখল ঐচ্ছি। মাঝে মাঝে নিজের মনেই মুচকি মুচকি হাসল। কখনো আবার সেই শিউলি ফুলের নরম পাপড়িগুলোতে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। তার হাতে যেন আজ জ্বলজ্বল করছে কারোর এক মুঠো ভালোবাসা। মনের মাঝে এক উন্মাদনা বয়ে যায় ঐচ্ছির। নতুন এক প্রেমের উন্মাদনা, নতুন এক প্রণয় সূচনার উন্মাদনা।
শিউলের ফুলের মালাটা হাত থেকে খুলে তার ড্রেসিংটেবিলের এক কোণায় ঝুলিয়ে রাখে। তারপর সে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আছড়াচ্ছে ঐচ্ছি। মনোযোগটা তার ঐ শিউলি ফুলের মালার দিকে। সব সময় দেখে আসা এই সাধারণ ফুলগুলোকেই আজ তার কাছে অসাধারণ লাগছে। ঐচ্ছি মুচকি হাসে। প্রেমে পড়লে বুঝি এমনি হয়। সাধারণ জিনিসগুলোকেও তখন অসাধারণ লাগে। ঐচ্ছি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে কখনোই ভাবেনি রাফসানকে সে কোনোদিন এইভাবে ভালোবাসবে। মানুষের মন সাংঘাতিক এক জিনিস। কিছুদিন আগেও যে মানুষটাকে সবথেকে ঘৃণা করতো এখন হুট করেই সেই মানুষটাকে বড্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। কি অদ্ভুত তাই না? মনের ইচ্ছেগুলো কেন জানি এমন অদ্ভুত অদ্ভুত হয়। স্বাভাবিক কোনো ইচ্ছা মনে আসেই না। সবসময় যত আজগুবি কর্মকান্ড করে। কি দরকার ছিল রাফসানকে ভালোবাসার? ঐচ্ছি তার মনকে শাসিয়ে বলে, ‘কোনো দরকার ছিল না। তাও তুমি ঐ জ্বীনের প্রেমে পড়লে। এবার যে তোমার মধ্যকার প্রেম ভালোবাসা আমার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে তার কি হবে? কে নিবে এই দায়? হুম একটু ভালোবাসা পেয়েই মোমের মতো গলে গিয়েছে। তোমার তো কিছু হবে না তুমি তো তোমার ভালোবাসাকে নিয়ে ঠিকই ভালো থাকবে। মাঝখান থেকে যত বাঁশ সব আমার। ধুর!’
ভারি গলায় নিজের মনকে কিছুক্ষণ শাঁসালো সে। তারপর চুলগুলো বেনি করে বিছানায় গিয়ে বসলো। দরজাটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, তার মা বাবার কি হলো? আজ একবারও তাকে ডাকতে এলো না। দরজা খোলার কথাও কেউ বলছে না। বাইরে থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না। ব্যাপার কি? সাইভিদ ভাইয়া, খালামনি উনারা কেউও তাকে ডাকতে এলো না। কেউ তার রাগ ভাঙ্গাতে এল না। সবাই তাকে ইগনোর করছে। সে যে এতক্ষণ যাবত না খেয়ে ঘরে দোর দিয়ে বসে আছে তাতে কারোর বিন্দুমাত্র কোনো মাথা ব্যাথা নেই। বাইরে কি কিছু হচ্ছে নাকি? একবার বাইরে যাওয়া উচিত। রুমে বসে থাকলে কিছুই বুঝবে না সে। ঐচ্ছি উঠে আস্তে করে দরজাটা খুলে। উঁকি দিয়ে দেখে এইদিকে কেউ নেই। রান্নাঘরের সামনে গিয়ে উঁকি দেয়। না এখানেও কেউ নেই। এবার সে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় ড্রয়িং রুমের দিকে। ড্রয়িং রুমের কাছে গিয়েই পা থেমে যায় তার। এই রুমেই সবাই আছে। পর্দাটা একটু ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দেয় সে। সবাই অমন গম্ভীর মুখে বসে আছে কেন? কোনো মিটিং চলছে নাকি? নির্ঘাত তার বিয়ে ভাঙার মিটিংএ বসেছে সবাই। ঐচ্ছি গান খাড়া করে ভেতরের কথোপকথনগুলো শোনার জন্য। হঠাৎ তাহেরা বেগমের বলা একটা কথা শোনে ঐচ্ছির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে কোনো ভাবেই মেনে নিবে না এই বিয়ে, মরে গেলেও না।
চলবে..