#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৯.
রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আছে ঐচ্ছি। রাগে যেন তার শরীরের রক্ত টকবক করে ছুটে চলছে। সবকিছু ভেঙ্গে চুরে ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। তার মা বাবা এমন একটা সিদ্ধান্ত কি করে নিতে পারে। না সে পারবে না, কোনোভাবেই পারবে না। রাফসানের ভালোবাসায় বড্ড দূর্বল হয়ে পড়েছে সে। এখন সেই ভালোবাসা আর কাউকে দিতে পারবে না সে। এত কিছুর মাঝে মা কি করে তার বিয়ে সাইভিদের সাথে ঠিক করতে পারলো? একবারও তার কথা ভাবলো না? ঐচ্ছি ঢুকরে কেঁদে উঠে। তাহেরা বেগমের মুখে তার আর সাইভিদের বিয়ের কথা শুনেই আবারও রুমে এসে দোর দিয়েছে সে। মরে গেলেও এবার আর সে দরজা খুলবে না। ঐচ্ছি নাক মুখ টেনে কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তার। কি করবে? কি করা উচিত? কিছুই বুঝতে পারছে না সে। উফফ, এত যন্ত্রণা কেন এই জীবনে? সবকিছু সহজে কেন হয়ে যায় না? কেন এত অশান্তি? ঐচ্ছি ঠোঁট কামড়ে বসে বসে ভাবতে থাকে কি করবে সে? কিভাবে সবটা সামলাবে? ভাবতে ভাবতেই তার সায়মার কথা মনে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে তাকে কল দিল। প্রায় এক ঘন্টা যাবত কথা বলে সায়মাকে পুরো ঘটনা খুলে বললো সে। সায়মা তো রীতিমতো হা হয়ে গিয়েছে ঐচ্ছির সব কথা শোনে। সে অত্যন্ত অবাক কন্ঠে বলে উঠল,
‘মানে এত কিছু ঘটে গেল আর তুই আমাকে কিছু জানাসনি? কত বড় হারামী তুই!’
ঐচ্ছি হতাশ গলায় বলে,
‘মন মেজাজ ভালো ছিল না রে তাই কিছু বলতে পারেনি। দোস্ত, এবার তুইই বল কি করবো আমি? রাফসানকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। উনাকে ছাড়া আর কাউকেই আমি বিয়ে করতে পারবো না। এখন তুইই আমার একমাত্র ভরসা।’
সায়মা ভ্রুকুটি করে বললো,
‘আমি? আমি কি করবো?’
ঐচ্ছি কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘সাইভিদ ভাইয়াকে তুই বিয়ে করে নে।’
সায়মা বড় বড় চোখ করে চেচিয়ে উঠে বললো,
‘কি? মাথা খারাপ তোর? কি বলছিস এসব?’
ঐচ্ছি কাঁদো কাঁদো মুখে বললো,
‘প্লিজ দোস্ত, এই সাইভিদ ভাইয়াকে আমার আর রাফসানের মাঝখান থেকে সরাতে হবে। উনিই আমাদের বিয়ের সব থেকে বড় বাধা। আর এই কাজটা একমাত্র তুইই করতে পারিস। আমি আছি তো তোর পাশে, সবটুকু দিয়ে তোকে সাহায্য করবো।’
সায়মা নাক মুখ ফুলিয়ে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘কিন্তু আমি করবো টা কি?’
ঐচ্ছি ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে,
‘প্রপোস করবি ভাইয়াকে। ভাইয়ার মনে তোর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করবি। এমন ভাবে ভাইয়াকে তোর ভালোবাসায় অন্ধ করবি যেন ভাইয়া সামু ছাড়া আর কিছু না বুঝে। আর এমনিতেও তো তুই ভাইয়াকে পছন্দ করিস তাই না? এজন্যই বলছি প্লিজ দোস্ত, আমাকে সাহায্য কর। আমি সাইভিদ ভাইয়াকে বিয়ে করবো না।’
সায়মা পড়ে যায় মহা ফ্যাসাদে। সে কি করে ঐ রাগি, এরোগেন্ট মানুষটাকে প্রপোস করবে? আর এখন তো সাইভিদ বুঝেই গিয়েছে যে সায়মাও তাকে মিথ্যাই বলেছে। এখন নিশ্চয়ই আবারও সে ক্ষেপে গিয়েছে তার উপর। না জানি কতটা ক্ষেপে আছে। কথা বলতে গেলে এবার আর আগের মতো শুধু ধমকাবে না মাথায় তুলে আছাড় দিবে। যা ভয়ংকর রাগ উনার। কিন্তু ঐচ্ছির উপরও ভীষণ মায়া হচ্ছে তার। মেয়েটাও খুব কষ্টে আছে। এক বিশাল সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। সায়মারও খারাপ লাগে। ঐচ্ছির কষ্টতে সেও কষ্ট পায়। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও এই মেয়েটার সাথে তার এক চমৎকার আত্মিক সম্পর্ক আছে। তাই এক অদ্ভুত আত্মার টান অনুভব করে সে। ঐচ্ছিও সেই টান অনুভব করে। তাই তো সে তার সামুকে এতটা ভালোবাসে।
সায়মা অনেক ভাবলো। ঐচ্ছিকে সে সাহায্য করবে। তবে কিভাবে? সাইভিদকে প্রপোস করা আর এভারেস্ট জয় করা তার কাছে একই। তাও কিছু একটা তো তাকে করতেই হবে। সায়মা ঐচ্ছিকে আশ্বস্ত করে বললো,
‘আচ্ছা দোস্ত, আমাকে ভাবতে দে। আর তুই রাফসান ভাইয়ার সাথে কথা বলে দেখ, উনি কি বলে?’
ঐচ্ছি কিছু একটা ভেবে বললো,
‘না উনাকে এখন এসব জানানো যাবেনা। সাইভিদ ভাইয়ার উপর এমনিতেই উনি ক্ষেপে আছেন আর এখন যদি বিয়ের কথা শুনে তাহলে আরো রেগে যাবেন। তখন রাগের মাথায় কি না কি করে বসেন। তার চেয়ে না জানানোই ভালো। আমরা নিজেরাই ভাবি। দেখিনা বিয়েটা আটকাতে পারি কিনা। আর শেষ পর্যন্তও না পারলে তখন না হয় রাফসানকে জানানো যাবে। এখন দরকার নেই।’
‘ওকে তাহলে, এখন ভাব কি করবি। আর আমি আছি তোর পাশে। দরকার পড়লে তোর জন্য নিজের জানও দিয়ে দিব।’
ফিচেল হেসে ঐচ্ছি বলে,
‘থাক বোন, তোর জান আমার প্রয়োজন নেই। আপাতত তোকে ভাবি বানানোর প্রয়োজন, তাই এখন সেটা নিয়েই ভাবতে হবে।’
সায়মা ভেংচি কেটে বললো,
‘এএ কচু করবা তুমি। আমিও দেখি কি করে তুমি আমাকে তোমার ভাবি বানাও।’
ঐচ্ছি হেসে বললো,
‘ওকে বেবি, জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ’
–
________________________________
ঘড়ির কাটায় আটটা বাজে। ঐচ্ছির দরজায় তখন থেকে করাঘাত হয়েই চলছে। কিন্তু ঐচ্ছি বিছানার উপর ঘাপটি মেরে বসে আছে। দরজা খুলবে না। মরে গেলেও না। ঐচ্ছির মা তাহেরা বেগম এবার ভীষণ রেগে যান। এত ধাক্কানোর পরও যখন ঐচ্ছি দরজা খুললো না তখন তিনি গলা ফাটিয়ে ঐচ্ছিকে বকতে শুরু করেন। ঐচ্ছির মধ্যে তাও কোনো হেরফের এলো না। সে এখনো আগের মতোই শান্ত ভঙ্গিতে খাটে বসে রইল। তানিয়া জুবায়ের বোনকে বোঝাচ্ছেন। কিন্তু, তাহেরা বেগমের রাগ ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলছে। রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে তার। মেয়েটা তার এত বেয়াদব হলো কি করে? সে এতবার করে ডাকছে তাও সে দরজা খুলছে না। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দও করছে না। রাগে মাথার ভেতরটা তার ধপধপ করে লাফাচ্ছে। বোনের এমন হাবভাব দেখে তানিয়াও বোঝে যায় আজ তার বোন ভালোমতোই ক্ষেপেছে। তাই তিনি ঐচ্ছির দরজায় নক দিয়ে ক্ষীণ সুরে বলে উঠে,
‘মা, দরজাটা খোল না। কেন এমন করছিস? তুই না আমাদের লক্ষী মামুনি। প্লিজ মা দরজাটা খোল।’
এতক্ষণে ঐচ্ছির মৌনতা ভাঙলো। সে চেচিয়ে উঠে বললো,
‘না খুলবো না। কেন খুলবো আমি? তোমাদের কারোর কাছে আমার কোনো মূল্য নেই। কেউ আমায় ভালোবাসো না। আমার মা বাবাও আমায় ভালোবাসে না। নয়তো তারা আমার অনুমতি ছাড়া আমার বিয়ে ঠিক করতো না। তোমরা একটা বার আমার সাথে এই ব্যাপারে কথাও বললে না। অথচ কি সুন্দর সাইভিদ ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেললে। ঠিক আছে তবে আমার কথাও শুনে রাখো, আমি সাইভিদ ভাইয়াকে বিয়ে করবো না। আমি শুধু রাফসানকেই বিয়ে করবো। শুনেছো তোমরা? বিয়ে করতে হলে আমি রাফসানকেই করবো নয়তো করবোই না।’
আক্রোশে ফেটে পড়লেন তাহেরা বেগম। ঐচ্ছিকে সামনে পেলে হয়তো থাপ্পড় দিয়ে গাল দুটো ফাটিয়ে ফেলতেন। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে তিনি বলে উঠলেন,
‘এই অসভ্য মেয়ে। তুমি এত বেয়াদব হলে কবে থেকে? বড়দের মুখে মুখে কথা বলছো? তোমার ব্যবহার দেখে আমি রীতিমত অবাক। কতটা অধঃপতন হয়েছে তোমার, তা কোনো ধারণা আছে। ছি! ভাবতেও অবাক লাগে, তুমি একটা জ্বীনকে বিয়ে করার জন্য আমাদের সাথে এই ব্যবহার করছো। ঐচ্ছি, সব কিছুর একটা লিমিট থাকে। তুমি তোমার লিমিট ক্রস করো না। তোমার সাইভিদকে বিয়ে করার ইচ্ছে না থাকলে করো না। তবে ঐ জ্বীনকে বিয়ে করার চিন্তাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কারণ এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। যথেষ্ঠ বড় হয়েছো, তাই ভালো মন্দ বিচার করে সিদ্ধান্ত নাও। যেই সিদ্ধান্তে তুমি ভালো থাকতে পারবে, তোমার মা বাবা ভালো থাকতে পারবে। আশা করি আমার কথাটা তুমি বুঝতে পেরেছো। এবার লক্ষী মেয়ের মতো আমাকে আর না রাগিয়ে দরজা খুলে বাইরে আসো।’
ভেতর থেকে ঐচ্ছির কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তাহেরা বেগম শান্ত দৃষ্টিতে ঐচ্ছির দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। নিজের মেয়েকে চেনেন তিনি। কিছুক্ষণ বাদেই ঐচ্ছি দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। চোখ মুখ তার বিধ্বস্ত। মেয়ের চোখ মুখ দেখে তাহেরা বেগমের বুক চিনচিন করে উঠল। নিমিষেই উবে গেল তার সমস্ত রাগ। ঐচ্ছির কাছে গিয়ে তাকে বুকের মাঝে চেপে ধরলেন। ঐচ্ছি প্রথমে বেশ অবাক হলেও পরক্ষণেই মায়ের বুকে একেবারে মিশে যায়। হঠাৎ তাহেরা বেগমের কান্নার শব্দ পেয়ে চমকে উঠে ঐচ্ছি তার দিকে তাকায়। মায়ের চোখে নোনতা জল দেখে ঐচ্ছি যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে। দুহাত দিয়ে মায়ের চোখ মুছে দিয়ে ঐচ্ছি অস্থির গলায় বলে উঠে,
‘মা, তুমি কাঁদছো কেন? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো? সরি মা, আমি আর কোনোদিন এইভাবে কথা বলবো না, প্রমিস। তুমি কেঁদো না প্লিজ। তোমার কান্না দেখলে আমার খুব কষ্ট লাগে। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো মা। যাকে বলবে তাকে বিয়ে করবো। তাও কেঁদো না প্লিজ। আমার জন্য তোমার চোখে পানি আসুক সেটা আমি চাই না মা। প্লিজ কান্না বন্ধ করো।’
মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তাহেরা বেগম। ছেলে মারা যাওয়ার পর এই মেয়েই তার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ হয়ে উঠে। কিন্তু আজ এই মেয়ের চোখ মুখ দেখে তার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। তার জন্য তার মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। যার সুখের কথা ভেবে তারা এত কিছু করছে শেষ পর্যন্ত সেই যদি সুখী হতে না পারে তাহলে এত কিছু করে কি লাভ? তাহেরা বেগম মনস্থির করলেন। তকদিরে যা আছে তা তো হবেই। যদি ঐচ্ছির ভাগ্যে রাফসান থেকে থাকে তবে তারা হাজার চেষ্টা করেও ঐচ্ছিকে তার থেকে আলাদা করতে পারবেন না। তাই আর এত বিরোধ বিদ্বেষ করে কি লাভ যেখানে ভাগ্যের কথাতেই সবকিছু হয়। তাহেরা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠলেন,
‘বিয়েটা তো ভাগ্যে লেখা থাকে মা। তাহলে এবার আমরাও দেখবো তোর ভাগ্যে কি আছে। যদি সত্যি রাফসানই তোর ভাগ্যে থেকে থাকে তবে আমরাও হার মেনে নিবো। তোর সুখেই আমরা সুখী। এবার তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি তাই হবে।’
চলবে..