কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ৩২.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৩২.
আজ আকাশটা সুন্দর। আকাশ তো সবসময়ই সুন্দর, তবে আজ একটু বেশিই সুন্দর, যাকে বলা যায় এক অন্যরকম সুন্দর। এই সুন্দর আকাশের কোল জুড়ে আছে এক সুন্দর চাঁদ। পূর্ণিমার চাঁদ না হলেও বেশ গোল। চাঁদ মেঘেতে মিশে আছে ঐ সুন্দর আকাশ। আহা, কি ভালোবাসা, কি মায়া দুজনার। লজ্জায় লাল হয়ে উঠে ঐচ্ছির ফর্সা মুখটা। বিকেলে রাফসানের বলে যাওয়া কথাটা সে যতবার ভাবছে ততবারই তার সারা শরীরে শিহরণ দিয়ে উঠছে। এমনিতেই তো দিনকে দিন সেই ঐ জ্বীনের প্রেমে দিশেহারা হয়ে উঠছে। আর বিয়ের পর, রাফসান যে বললো তাকে আরো উন্মাদ বানিয়ে ছাড়বে তখন তার কি হবে। ইশ, লজ্জায় লাল হয়ে উঠে তার গালগুলো। বারান্দায় আর দাঁড়াল না। চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ বুজলেই অক্ষিপটে তার ভেসে উঠে রাফসানের ঐ দুষ্টুমাখা হাসিটা। মারাত্মক অসভ্য এই জ্বীনটা। এমনিতে তো খুব গম্ভীর গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকে আর একবার কথা বলার সুযোগ পেলে ঐচ্ছিকে লজ্জায় লাল বানিয়ে ফেলে। ঠোঁট চেপে হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐচ্ছি। অবশেষে ভালো কিছু হতে যাচ্ছে। বিয়ের পর যখন ঐচ্ছির বাবা মা দেখবে ঐচ্ছি রাফসানের সাথে ভালো আছে, সুখে আছে তখন তারাও হাসি মুখে এই বিয়েটা মেনে নিবে। ঐচ্ছি জানে সেটা। তার সুখেতেই যে তার মা বাবা সুখী। চোখ বুজে জোরে এক শ্বাস নেয় সে। আজ তার মন জুড়ে প্রশান্তির হাওয়া বইছে। মনের অস্থিরতাটা কিছুটা হলেও কমেছে। আর ঠিক এইভাবেই যেন সমস্ত অস্থিরতা কেটে যায়। আবারও যেন পুরো দমে তার জীবনে প্রশান্তি ফিরে আসে এইটাই এখন তার চাওয়া।

__________________________

‘কিরে মন খারাপ?’

সায়মা মাথা দুলিয়ে না বলে। ঐচ্ছি ব্রু কুঁচকে সন্দিহান কন্ঠে বললো,

‘উমম, না বললে তো হবে না। তোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে মন খারাপ। কি হয়েছে জলদি জলদি বলে ফেল তো।’

সায়মা কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে প্লাস্টিকের সেই কাপটা ডাস্টবিনের দিকে ছুড়ে মারলো। তারপর চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসে গম্ভীর সুরে বললো,

‘সাইভিদ ভাইয়া কাল রাতে আমাকে কল দিয়েছিলো।’

ঐচ্ছি চমকে উঠে। টেবিলের উপর কিছুটা ঝুঁকে এসে বলে,

‘কি? সাইভিদ ভাইয়া তোকে কল দিয়েছিল, কিন্তু কেন?’

সায়মা মুখ কালো করে ফেলে। কপালে পড়ে থাকা ছোট চুলগুলো কানের পিছে গুঁছে দিয়ে আস্তে করে বললো,

‘আমাকে খুব বকেছে। আমি যে দুই দুবার ভাইয়াকে মিথ্যে বলেছি তাই।’

ঐচ্ছি চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে সায়মার কথা শুনে। এই লোকটার সমস্যা কি? যখন তখন তার বেস্টিকে কল দিয়ে বকাবকি করবে আর সে কিচ্ছু বলবে না। ঐচ্ছির এবার রাগ হয়। চেয়ারের হাতলটা শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘দাঁড়া এক্ষুণি ঐ বেটার খবর নিচ্ছি। এত সাহস কেন ঐ লোকের, যখন তখন তোকে কল দিয়ে বকাবকি করবে। পেয়েছেটা কি? তুই শুধু দুইবার কেন দুইশো বার মিথ্যে বলবি তাতে উনার কি?’

কথাটুকু বলেই ঐচ্ছি ব্যাগ থেকে তার ফোনটা বের করে রাফসানের নাম্বারে কল দেয়। সায়মা বুঝে যায়, এখন এই মেয়ে আরো ঝামেলা পাকাবে তাই সে ফোনটা নিয়ে নিতে চেয়েও পারলো না। আর ঐদিক থেকে সাইভিদও কল রিসিভ করে ফেললো,

‘হ্যালো!’

‘হ্যালো, ভাইয়া! কই তুমি?’

সাইভিদ বিরক্তির সুরে বলে উঠে,

‘বাসায় আছি। কেন?’

‘ভাইয়া, প্লিজ তাড়াতাড়ি আমার ভার্সিটিতে আসো। আমি না বড়ো বিপদে পড়েছি। প্লিজ তাড়াতাড়ি আসো।’

এই বলে ঐচ্ছি আর সাইভিদকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। ফট করেই কলটা কেটে দিল। ওপাশ থেকে সাইভিদ হ্যালো হ্যালো করতেই থাকে। বেচারা বুঝেই উঠতে পারেনা আসলে হয়েছেটা কি। তবে ঐচ্ছির অমন আতঙ্কিত কন্ঠ শুনে সাইভিদ মনে মনে ভেবে নেয় ঐচ্ছি সত্যি সত্যিই কোনো বিপদে পড়েছে। তাই সে আর কোন কিছু না ভেবেই তাড়াহুড়ো করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।

সায়মা হা করে ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা এত এক্টিং কোথ থেকে শিখলো? সায়মার তাকানো দেখে ঐচ্ছি হেসে ফেলে। ডানহাতটা দিয়ে নিজেকে একটু বাতাস দিয়ে ভাব নিয়ে বলে উঠে,

‘ওও কাম অন বেবি, আমি জানি আমি খুব সুন্দরী। তাই বলে এমন হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে না।’

সায়মা চোখ ছোট ছোট করে ঐচ্ছির দিকে তাকায়। ঐচ্ছি ঠোঁট টিপে হাসে। সায়মা এগিয়ে এসে ঐচ্ছির মাথায় চাটি মেরে বলে,

‘ভাইয়াকে মিথ্যে বললি কেন? এখন তো উনি এসে আবার আমাকে বকবে।’

ঐচ্ছি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। মাছি তাড়ানোর মতো ডান হাতটা মুখের সামনে নাড়িয়ে বলে,

‘তোমার উনি তোমাকে কিছুই বলবে না। সো নো টেনশন, ডো ফূর্তি।’

চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে সায়মা। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,

‘আমার উনি আবার কি?’

ঐচ্ছি স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

‘তোমার উনি মানে তোমার উনি। মানে তোমার জামাই।’

সায়মা ক্ষেপে যায়। রাগি গলায় বলে,

‘ঐচ্ছি, বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।’

ঐচ্ছি ঠোঁট বাকিয়ে হেসে, মৃদু সুরে বলে উঠে,

‘বেশি না বেবি কমই হচ্ছে। আজ হোক কাল হোক, ঐ বিলাতি ইন্দুরটাকে তো তোমার জামাই বানিয়েই ছাড়বো।’

সায়মা চোখ মুখ ফুলিয়ে ঐচ্ছির দিকে রাগি চোখে তাকায়। ঐচ্ছি হেয়ালির সুরে বলে উঠে,

‘এইভাবে সাইভিদ ভাইয়ার দিকে তাকাস, নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যাবে।’

সায়মা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠে,

‘লাথি খেতে মন চাচ্ছে তোর?’

ঐচ্ছি দাঁত কেলিয়ে বলে উঠে,

‘না, চুমু খেতে।’

সায়মা ফোঁস ফোঁস করে বলে,

‘তাহলে রাফসান ভাইয়ের কাছে যা। আমাকে কেন বলছিস?’

‘না, উনার কাছে গিয়েও লাভ নেই। উনি কিছুই দিবেন না।’

সায়মা দুষ্টু হেসে বললো,

‘না দিলে জোর করে নিবি, তাহলেই তো হয়।’

ঐচ্ছি নাকের পাল্লা ফুলিয়ে বলে উঠে,

‘তাহলে তুইই আগে সাইভিদ ভাইয়ার কাছ থেকে প্র্যাকটিক্যালি চুমু নিয়ে দেখা, তাহলে আমিও একটু বুঝতে পারতাম আরকি কিভাবে জোর করে চুমু নিতে হয়।’

সায়মা এবার ভীষণ ক্ষেপে উঠে। ঐচ্ছির দিকে তেড়ে আসতেই ঐচ্ছি চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌঁড়। তার পেছন পেছন সায়মাও ছুটতে থাকে। আজ সে তাকে একবার হাত পেলে মাথার একটা চুলও আর রাখবে না।

_______________

তীক্ষ্ণ চোখে ঐচ্ছি আর সায়মাকে পরখ করছে সাইভিদ। দুজনের মধ্যে কারোরই চোখে মুখে কোন বিপদের বিন্দুমাত্র রেশ পাওয়া যাচ্ছে না। দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। সাইভিদ এবার ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠে। ধমকে উঠে বলে,

‘কি হয়েছে তোদের? আমাকে এইভাবে ডেকে এনে এখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছিস কেন? আর কিসের বিপদের কথা বলছিলি? কি সমস্যা?’

ঐচ্ছি আড়চোখে সায়মার দিকে তাকায়। বেচারি ভয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। ঐচ্চি এবার সোজা হয়ে বসে। খানিকটা জোর গলায় বলে উঠে,

‘সরি বলো?’

সাইভিদ ব্রু কুঁচকে বললো,

‘মানে?’

‘মানে হলো, সায়মাকে তুমি এখন সরি বলবে। তোমার সমস্যাটা কি বলোতো, যখন তখন মেয়েটাকে কল দিয়ে বকছো? পেয়েছোটা কি হ্যাঁ? আমার এই নিরীহ বান্ধবীটাকে একা পেয়ে যা খুশি তাই বলো, এত সাহস হয় কি করে তোমার? সায়মা দেখে তোমায় কিছু বলে না, আমি হলে এতক্ষণে মাথা ফাটিয়ে দিতাম। অনেক হয়েছে, এবার সরি বলো। বলো যে আর জীবনেও তুমি সায়মার সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না।’

সাইভিদ মেকি হাসলো। দায়সারা ভাবে বললো,

‘যদি না বলি?’

ঐচ্ছি ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,

‘তাহলে কিন্তু আমি..আমি, খালামনির কাছে বিচার দিবো।’

সাইভিদ বাঁকা হেসে বললো,

‘দে বিচার। আমার কি?’

ঐচ্ছি এবার রেগে যায়। ক্রুদ্ধ গলায় বলে উঠে,

‘ভাইয়া, তুমি সরি বলবা?’

সাইভিদ পকেট থেকে তার ফোনটা বের করে সেখানে তার দৃষ্টি মনোনিবেশ করে। ঐচ্ছির কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,

‘কি খাবি বল? আজ তোদের ট্রিট দিবো। যা ইচ্ছে অর্ডার করে নে।’

ঐচ্ছি মুখ ফুলিয়ে বলে উঠে,

‘লাগবে না তোমার ট্রিটের। আগে সায়মাকে সরি বলো তারপর বাকিসব।’

সায়মা ঐচ্ছির হাত ধরে আস্তে করে বলে,

‘থাক না ঐচ্ছি।’

ঐচ্ছি ক্ষেপে উঠে বলে,

‘না থাকবে কেন? এই ভাইয়া তুমি তাড়াতাড়ি সায়মাকে সরি বলো, নয়তো কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।’

সাইভিদ চোখ উঠিয়ে একবার সায়মার দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়তেই সায়মা তার চোখ নামিয়ে ফেলে। সাইভিদ বাঁকা হেসে বলে,

‘আমার ইচ্ছে আমি সায়মাকে যা খুশি তাই বলবো, তোর কি?’

ঐচ্ছি বড়ো বড়ো চোখ করে চেচিয়ে উঠে বলে,

‘কেন, সায়মা তোমার কি হয় শুনি; যে তুমি তাকে যা খুশি তাই বলবা?’

সাইভিদ সোজা হয়ে বসে। সায়মাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে বলে উঠে,

‘বউ হয়। না বলতে পারিস হবু বউ। লাইক ইউ এন্ড রাফসান, হবু বর বউ।’

ঐচ্ছি, সায়মা দুজনেই যেন হকচকিয়ে উঠে সাইভিদের কথা শুনে। ঐচ্ছি চোখ মুখ কুঁচকে বলে উঠে,

‘মজা করছো ভাইয়া?’

সাইভিদ মৃদু হেসে জবাব দেয়,

‘তোর আর রাফসানের সম্পর্কটা যদি মজার না হয় তবে আমাদের সম্পর্কটাও মজার না।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here