কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ৩৪.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৩৪.
সায়মা অস্থির হয়ে পুরো রুমে ছুটোছুটি করছে। ঐচ্ছি তখন থেকে মেয়েটাকে শান্ত হতে বলছে, অথচ এই মেয়েতে তো তার কথা কানেই তুলছে না। ঐচ্ছি এবার ভীষণ বিরক্ত হয়। রাগে সায়মাকে ধমক দিয়ে বলে উঠে,

‘এই পাগল, ছাগলের মতো এমন ছুটাছুটি না করে একটু বস না।’

সায়মা ছুটে আসে ঐচ্ছির কাছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠে,

‘দোস্ত, দেখ আমার হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। মানে তুই ভাবতে পারছিস, কথা নাই বার্তা নাই সাইভিদ ভাই ডিরেক্ট এংগেইজমেন্ট করতে চলে আসছে। আমি তো ভেবেছিলাম সেদিন বুঝি উনি মজার ছলে কথাগুলো বলেছেন। কিন্তু, এখন আমি বিস্মিত! উনি সত্যি সত্যিই আমায় বিয়ে করতে চাইছেন? সিরিয়াসলি দোস্ত?’

ঐচ্ছি তপ্ত নিশ্বাস ফেলে। সায়মার হাতটা টেনে তাকে তার পাশে বসায়। তারপর শান্ত গলায় বলে উঠে,

‘হ্যাঁ, একদম সিরিয়াস। এই নিয়ে বাড়িতে এই কয়দিন অনেক কথা হয়েছে। খালুও এসেছে, আমি তোর সম্পর্কে খালুকে সব বলেছি, তোর ছবিও দেখিয়েছি। উনারও তোকে পছন্দ হয়েছে। তাই উনিও ভাইয়ার কথায় রাজি হয়ে গিয়েছেন। আর আমি তোকে এইটুকু আশ্বস্ত করতে পারি, ভাইয়া তোকে ঠকাবে না। হয়তো হুট করেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছে, কিন্তু আমি জানি ভাইয়া তার সিদ্ধান্তে অটুট। এখন দুনিয়া উল্টে গেলেও ভাইয়া তোকেই বিয়ে করবে।’

সায়মা উদাস হয়ে বসে রইল। ঐচ্ছি তার কাঁধে হাত রেখে হালকা হেসে বললো,

‘মন খারাপ করছিস কেন? তোর কি ভাইয়াকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই? এমনটা হলে আমাকে বলতে পারিস, আমি আগে থেকেই খালামনির সাথে কথা বলবো।’

সায়মা চোখের পাতা প্রশস্ত করে ঐচ্ছির দিকে তাকাল। মুচকি হেসে বললো,

‘না তেমন কিছু না। আসলে আমি ভাবছি অন্য কথা, উনি তো এতদিন তোকে পছন্দ করতো এখন হুট করেই আবার আমাকে কেন বিয়ে করতে চাইছেন? উনার সাথে তো বলতে গেলে আমার ভালো করে কথাই হয়নি। যে কয়বার কথা হয়েছে প্রতিবারই আমাকে উনার ধমক খেতে হয়েছে। কিন্তু সেদিন এমন কি হলো, যে উনার মনে আমাকে বিয়ে করার চিন্তা চলে এলো?’

সায়মা ভাবুক মুখটা দেখে ঐচ্ছি কপাল কুঁচকালো। ভারি গলায় বললো,

‘তুইও দেখছি রাফসানেরই মতো কথা বলছিস। আচ্ছা, একটা মানুষ কি সারাজীবন একজনকেই পছন্দ করে বসে থাকবে? এবার সে যদি তার পছন্দের মানুষকে না পায়, তবে; তবে কি সে সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরে বেড়াবে? অন্য কাউকে কি পছন্দ করতে পারবে না? কাউকে নতুন করে ভালোবেসে সুন্দর একটা জীবনের স্বপ্ন কি সেই মানুষটা দেখতে পারবে না? হু, বলতো সায়মা? ভাইয়ার হয়তো হুট করেই তোকে পছন্দ করে ফেলছে। হয়তো, তোকে ভালোও বেসে ফেলেছে। হতে পারে না এমনটা? আমাদের মানুষের মনের কি কোনো ভরসা আছে বল তো? যত দোষ সব তো এই মনের। নাহলে তুই’ই দেখনা, যেই লোকটাকে আমি দুইদিন আগেও সহ্য করতে পারতাম না অযচ আজ তার প্রেমে আমি দিশেহারা। যেখানে একসময় আমি বিয়েটা ভাঙার জন্য এত কিছু করেছি সেখানে আজ আমি নিজে থেকে বিয়েটা করতে চাইছি। এইসব কিছু তো এই মনের দোষেই হচ্ছে। সেই তো তার ভেতরে রাফসানকে জড়িয়ে নিয়েছে। এখন যে আমি হাজার চেষ্টা করলেও রাফসানকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবো না। তাই বলছি, সাইভিদ ভাইয়াও হয়তো তার মনের কাছে হেরে গিয়েছে। ভালোবেসে ফেলেছে তোকে। নয়তো উনি কখনোই তোকে বিয়ে করতে চাইতো না। এত ভাবিস না তো, দেখবি সব ভালোই হবে।’

সায়মা মৃদু হেসে বলে,

‘আই হোপ, তোর কথাটাই যেন সত্যি হয়।’

ঐচ্ছি এবার সায়মাকে তাড়া দিয়ে বলে,

‘হুম, একশো বার সত্যি হবে। তো এবার তাড়াতাড়ি রেডি হো। ভাইয়ারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে। আমার এংগেইজমেন্টে তুই আমাকে সাজিয়ে দিয়েছিলি, আর আজ তোর এংগেইজমেন্টে আমি তোকে সাজিয়ে দিবো। এই জন্যই তো আমি আগে আগে চলে এসেছি। এবার যা তাড়াতাড়ি, ফ্রেশ হয়ে আয়।’
.
.
বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ আসতেই ঐচ্ছি অস্থির হয়ে বলে,

‘ঐ যে ভাইয়ারা বোধ হয় চলে এসেছে। আজ তো ভাইয়া তোকে দেখে একবারে প্রেমে শহীদই হয়ে যাবে। আহা, কি লাগছে আমার বান্ধবীটাকে। আমি নিজেই তো ক্রাশ খেয়ে ফেলেছি। ছেলে হলে এক্ষুণি বিয়ে করে ফেলতাম।’

সায়মা ঐচ্ছির কথা শোনে চোখ রাঙিয়ে তার দিকে তাকায়। কঠিন গলায় বলে,

‘আর একটাও ফাউ কথা বললে, ঠাস করে থাপ্পড় খাবি।’

ঐচ্ছি নাক ফুলিয়ে বললো,

‘ফাউ কথা কোনটা? এখন তোমাকে সুন্দর লাগছে তো আমি কি বলবো? বলবো যে, তোমাকে বান্দাদের মতো লাগছে?’

সায়মা কানে দুল পড়তে পড়তে বলে,

‘না তা কেন বলবি? আমি তো অলটাইমই সুন্দরী, আর আমার মতো এমন সুন্দরী, রূপবতী, রূপসী মেয়েকে দেখলে যে কেউই প্রেমে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তোর ভাই ভাগ্যবান যে আমার মতো এমন সুন্দরী একটা বউ পাচ্ছে।’

হু হা করে হেসে উঠে ঐচ্ছি। হাসতে হাসতে পেট চাপড়ে বিছানায় বসে পড়ে। ঐচ্ছির হাসি দেখে সায়মা চোখ মুখ কুঁচকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,

‘আজব তো, হাসছিস কেন?’

ঐচ্ছি কোনোমতে হাসি আটকিয়ে বলে উঠল,

‘উফ, দোস্ত তুই এত ফানি কথা কিভাবে বলিস বলতো? মানে, সুন্দরী তাও আবার তুই? নিজেকে জীবনেও আয়নায় দেখেছিস? আমি না হয় তোকে একটু পাম দেওয়ার জন্য সুন্দরী বলেছি তাই বলে তুইও ভেবে নিবি তুই সুন্দরী। হাউ ফানি! বিশ্বাস কর দোস্ত, আমার কি মনে হয় জানিস? তোর এই ডাইনী মার্কা চেহারা দেখে তোর এই আয়নাও নিশ্চয় ভয়ে কেঁদে ফেলে। বেচারার তো আর আমাদের মতো মুখ নেই তাই বলতে পারেনা। আহারে, তোর এই আয়নাটার জন্য আমার এখন ভীষণ মায়া হচ্ছে।’

ঐচ্ছি অসহায় মুখ করে কথাটা বললো। সায়মা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো তার দিকে চেয়ে আছে। ইচ্ছে করছে তাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। ঐচ্ছি বুঝে যায়, আবহাওয়া এখন গরম হয়ে উঠেছে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ায় ভালো। ঐচ্ছি দাঁত কেলিয়ে হেসে এক দৌঁড়ে রুমের বাইরে চলে গেল। দরজার কাছে গিয়ে একবার পেছনে ফেরে হেসে বললো,

‘তোর এই ভয়ংকর রূপে আমার ভাই নির্ঘাত আজ হার্ট অ্যাটাক করবে।’

সায়মা চেতে উঠে বলে,

‘ঐচ্ছিইই!’

ঐচ্ছিকে আর পায় কে। সে ছুটে সায়মাদের ড্রয়িং রুমে চলে যায়। সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সে। সকলে তার সালামের জবাব দেয়। ঐচ্ছি দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

‘আপনাদের আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

ঐচ্ছির খালু হেসে জবাব দেয়,

‘না না একদমই না। তা আপনি মেয়ের কি হোন, শুনি?’

ঐচ্ছিও হেসে হেসে বললো,

‘আমি তো পাত্রীর দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বান্ধবী। তা আপনারা সবাই বুঝি পাত্রের বাড়ির লোক?’

ঐচ্ছির খালামনি বলে,

‘জ্বি। আমি পাত্রের মা। তা এবার আপনি আপনার বান্ধবীকে নিয়ে আসুন। আমরাও একটু পাত্রীকে দেখি।’

ঐচ্ছি ব্রু কুঁচকে বলে,

‘ওমা এত সহজে না। আসলে আমার বান্ধবী আমার কথায় চলে। পাত্র যদি আমার পছন্দ হয় তবে তারও পছন্দ হবে। আর পাত্র যদি আমার পছন্দ না হয় তবে তারও পছন্দ হবে না। বলতে পারেন পুরো সিদ্ধান্ত আমি নিবো। আচ্ছা তো, পাত্র কোনটা? এইটা নাকি?'(সাইভিদের দিকে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে)

সাইভিদ বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে ঐচ্ছির দিকে তাকায়। ঐচ্ছি তার আপাদমস্তক পরখ করে নাক ছিটকে বলে উঠে,

‘ইয়াক এটা পাত্র? একে কোথ থেকে তুলে এনেছেন বলুন তো? আমাজান জঙ্গল থেকে নাকি? এর সাথে ভুলেও আমি আমার বান্ধবীর বিয়ে দিবো না। নো, নেবার, কখনোই না।’

রাফসান ক্ষেপে যায়। ধমকের সুরে বলে,

‘মার খেতে না চাইলে এক্ষুণি গিয়ে সায়মাকে নিয়ে আয়।’

ঐচ্ছি মুখ বাঁকিয়ে বললো,

‘আনবো না। কি করবা তুমি?’

সাইভিদ চোয়াল শক্ত করে রাগি চোখে ঐচ্ছির দিকে তাকায়। ঐচ্ছি ভেংচি কেটে বলে,

‘এএএ, পাত্রকে আমার মোটেও পছন্দ হয়নি, শুধুমাত্র পাত্রের পরিবারকে আমার পছন্দ হয়েছে বলেই পাত্রীকে নিয়ে আসছি। নয়তো এমন বিলাতি ইন্দুরের কাছে জীবনেও আমি আমার বান্ধবীর বিয়ে দিতাম না।’

সাইভিদ দাঁত কিড়মিড়িয়ে ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে বলে,

‘তবে রে’

ঐচ্ছি ভোঁ দৌঁড়। ঐচ্ছির এমন অবস্থা দেখে সকলেই একসঙ্গে হেসে উঠে। সায়মার মা তখন চায়ের ট্রে টা এগিয়ে দিয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘সবাই বসে আছেন কেন? চা নিন।’

সাইভিদের মা চায়ের একটা কাপ হাতে নিলো, তাতে হালকা চুমুক দিয়ে মৃদু হেসে বললো,

‘সায়মার বাবা কি করেন, আপা? উনাকে দেখছি না যে?’

সঙ্গে সঙ্গে সায়মার মার মুখ কালো যায়। ভয় হয়, এই মানুষটার কথা শুনলে উনারা আবার এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিবেন না তো?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here