কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ৩৬.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৩৬.
রাফসান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘অনেক খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি।’

কপাল কুঁচকে ফেলে ঐচ্ছি। বিরক্ত ভঙ্গিতে রাফসানের দিকে তাকায়। তেতো মুখে বলে,

‘মন দিয়ে খুঁজলে সব কিছুই পাওয়া যায়। আপনি মন দিয়ে খুঁজেননি সেটা বলুন।’

রাফসান হতাশ গলায় বলে,

‘কুমিল্লার এমন একটা ফুলের দোকানও বাকি নেই যেখানে আমি খুঁজিনি। কিন্তু, বিশ্বাস করুন কারো কাছেই এই ফুল নেই। আর এই ফুল কোথায় পাবো সেটাও কেউ জানে না। এখন আপনিই বলুন, আর কি করতে পারি আমি?’

ঐচ্ছি গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরায়। ফ্যাচফ্যাচ করতে করতে বলে,

‘এমন কি চেয়েছি আমি। একটা ফুলই তো চেয়েছি, তাও এনে দিতে পারলেন না।’

রাফসান প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। কাপে থাকা অবশিষ্ট কফিটা খেয়ে গলা ঝাড়ে। তারপর আলতো করে টেবিলের উপর রাখা অস্থির হাতের উপর হাত রাখে। ঐচ্ছি ব্রু কুঁচকে রাফসানের দিকে তাকায়। হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলেই রাফসান সেটাকে আরো আঁকড়ে ধরে। হালকা হেসে বলে,

‘আচ্ছা, আর কিছুদিন সময় দিন। নিয়ে আসবো আমি। আপনার কৃষ্ণগোলাপ আপনি পাবেন। যেখান থেকেই হোক না কেন সেটা আমি খুঁজে আনবোই।’

সঙ্গে সঙ্গেই চমৎকার হাসি ফুটে ঐচ্ছির অধর কোণে। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে বলে উঠে,

‘সত্যি?’

রাফসান মাথা দুলিয়ে জবাব দেয়,

‘জ্বি।’

ঐচ্ছি ব্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,

‘কিন্তু, কোথায় পাবেন?’

রাফসান কিছু ভাবার ভঙ্গিমা করে বলে,

‘আছে তো কোথাও। খুঁজে বের করবো।’

ঐচ্ছি হেসে বলে,

‘তাহলে আপনি এই ফুলটা এনে আমাকে ফুলটা দিয়ে প্রপোস করবেন। ঠিক সিনেমার হিরোদের মতো।’

রাফসান ঠোঁট বাকিয়ে হাসে, বলে,

‘সিনেমায় প্রপোসের পর কি হয় জানেন?’

ঐচ্ছি দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

‘হু জানি তো। হিরো প্রপোস করার পর হিরোইন কিছুদিন ঢং করে। ইচ্ছে করে হিরোকে তার পেছনে ঘুরায়। কিন্তু আমি অমন না। আমি আমার হিরোর প্রপোস সাথে সাথে একসেপ্ট করে ফেলবো।’

রাফসান হেসে বলে,

‘তারপর?’

ঐচ্ছি ভেবে বলে,

‘তারপর কি? হিরো হিরোইনের মিল হবে!’

রাফসান আবারও বলে,

‘তারপর?’

ঐচ্ছি সরু চোখে তাকিয়ে বলে,

‘কি তারপর তারপর শুরু করেছেন? তারপর আর কি হবে হিরো হিরোইনের বিয়ে হবে, তারপর তাদের বাচ্চা হবে, তারপর সেই বাচ্চা বড় হবে, তারপর সেই বাচ্চার বিয়ে দিয়ে তারা শ্বশুড় শাশুড়ি হবে, তারপর তাদের বাচ্চার আবার বাচ্চা হবে, তারা তখন বুড়ো হবে, নানি নানা হবে আর তারপর…তারপর তারা মারা যাবে। ব্যস, শেষ কাহিনী।’

চেয়ারে ঠেস দিয়ে আরাম করে বসে ঐচ্ছি। দেখে রাফসান তারদিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। ঐচ্ছি মনে মনে ভাবে বেশি কিছু বলে ফেলেছে নাকি? রাফসান ধরা গলায় বলে উঠে,

‘বাহ, আপনার তো দেখছি বিয়ের পর বাচ্চা কাচ্চার প্ল্যানিং করাও হয়ে গিয়েছে। ইনফ্যাক্ট শুধু নিজের বাচ্চা কাচ্চা না, বাচ্চার বাচ্চার প্ল্যানিংও হয়ে গিয়েছে। আপনি তো দেখছি খুব ফাস্ট, ঐচ্ছি।’

ঐচ্ছি চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে রাফসানের কথায়। খবিশ জ্বীনটা আবার তাকে লজ্জায় ফেলছে। কোন কথা কি স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া যায় না। এতো গভীর ভাবে ভাবতে কে বলে একে। ঐচ্ছি মুখ কাঁচুমাচু করে বলে,

‘আপনি একটু বেশিই বুঝেন। আমি তো জাস্ট হিরো হিরোইনের কথা বলছিলাম।’

রাফসান ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলে,

‘তা সেই হিরো হিরোইন দুজন কারা শুনি। কাদের জীবন নিয়ে বসে বসে আপনি এতো সব প্ল্যানিং করেছেন বলুন তো?’

ঐচ্ছি ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘আপনার না জানলেও চলবে। আমাকে এখন বাড়ি নিয়ে চলুন আমি বাড়ি যাবো। এমনিতেই পরশু থেকে মন মেজাজ ভালো নেই। এখন আপনি আমার মেজাজ আরো বেশি খারাপ করে তুলছেন। আপনার সাথে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। দেখা যাবে পরে আমার মেজাজ আরো হাই পাওয়ারে গরম হয়ে ফেটে টেটে যেতে পারে। তাই তাড়াতাড়ি আমায় বাসায় দিয়ে আসুন।’

রাফসানের প্রচুর হাসি পায় ঐচ্ছির কথা শুনে। কিন্তু এখন হাসা, আর তার নিজের জন্য ঘূর্ণিঝড় আয়লাকে ডেকে আনা একই কথা। তাই সে কোনোরকমে চেপে গেল হাসিটা। গলা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো। শার্টের হাতাটা ঠিক করতে করতে বললো,

‘আচ্ছা, চলুন তাহলে। অন্যদিন না হয় উত্তরটা দিয়ে দিয়েন।’

ঐচ্ছি চোখ রাঙিয়ে রাফসানের দিকে তাকাতেই রাফসান চোখ টিপে বাঁকা হেসে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। রাফসান চলে যেতেই ঐচ্ছি বুকের উপর হাত রেখে ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠে,

‘হায়! মে মারজাভা’

তারপর সেও মুচকি হেসে রেস্ট্ররেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে।
.
.
বাসায় আসতে আসতে ঐচ্ছির সন্ধ্যা হয়ে গেল। ঐচ্ছিকে নামিয়ে দিয়েই রাফসান চলে যায় তার গন্তব্যের দিকে। বাসায় এসেই দেখে সায়মা ড্রয়িং রুমে বসা। ঐচ্ছি তাতে বেশ বিরক্ত হয়। সায়মাকে কোনো প্রকার পাত্তা না দিয়েই সোজা নিজের রুমে চলে যায় সে। যেন সায়মাকে সে দেখেইনি। সায়মার তাতে ভীষণ মন খারাপ হয়, সাথে ঐ সাইভিদের উপরও ভীষণ রাগ হয় তার। ঐ সাইভিদটার জন্যই সব হয়েছে। কি দরকার ছিল ঐদিন এমন ভাবে দরজা আটকে দেওয়ার? তারপর আবার ঐচ্ছিকে এমন ত্যাড়া ত্যাড়া কথা শুনানোর? ইচ্ছে করে এই লোকটা এমন করেছে। সায়মাকেও তখন কিছু বলতে দেইনি। মুখ চেপে ধরে আটকে রেখেছিল যেন সে কোনো কথা না বলতে পারে। এই মেয়েটাকে রাগিয়ে যে সে কি এত মজা পায় তা এক আল্লাহই জানেন।
সায়মা মনে মনে সাইভিদকে বকতে বকতে ঐচ্ছির রুমে ঢোকে। ঐচ্ছি রুমে নেই, ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসতেই বুঝতে পারে সে ওয়াশরুমে। সায়মা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে তাকাতেই দেখে রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে সাইভিদ কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। সায়মা চোখ ছোট ছোট করে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সাইভিদকে। একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর গ্রে কালারের টি শার্ট পরা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের উপর অযত্নে পড়ে আছে। গালের উপর বেশ বড় বড় দাঁড়ি। এটাকে পুরো দাঁড়িও বলা যায় না আবার চাপ দাঁড়িও বলা যায় না। তবে সাইভিদের এই দাঁড়িগুলো সায়মার বেশ লাগে। ইচ্ছে করে দাঁড়িগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে। কি সুন্দর লাগছে এই মানুষটাকে! এতটাও অগোছালো, তাও ভালো লাগছে। সুন্দর লাগছে তাকে। সায়মা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে ভাবে, সত্যিই এই মানুষটা তার হতে চলছে? যেন সবকিছু বড্ড অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। কিছুদিন আগেও তো ভালোভাবে তাকে চিনতো না। অথচ আজ তার দেওয়া অঙ্গীকার নামা বহন করে ঘুরছে সে। আর মাত্র দুই সপ্তাহ তারপর সে নিজেও পুরোপুরি তার হয়ে যাবে। এই সম্পূর্ণ মানুষটা একান্তই তার হবে। তার সম্পদ, তার স্বামী। কথাটা মনে পড়তেই সারা শরীরে শিহরণ দিয়ে উঠে তার। এই সুন্দর মানুষটা আর কিছুদিন পর তার স্বামী হবে। অন্যরকম এক অনুভুতি হয় সায়মার মনে। মনে মনে ঠিক করে নেয়, সে খুব করে এই মানুষটাকে ভালোবাসবে। এতটা ভালোবাসা দিবে যে এই মানুষটা একদিন ক্লান্ত হয়ে তাকে বলবে, ‘এতটা ভালো না বাসলেও পারতে সায়মা। তোমার এত এত ভালোবাসা যে আমাকে বাঁচতে দিচ্ছে না। মেরে ফেলছে আমায়। এমন করলে তো একদিন সত্যি সত্যিই তোমার ভালোবাসায় মরে যাবো আমি। তখন কি হবে বলো তো?’
সায়মা তখন লজ্জা পাবে, ভীষণ রকম লজ্জা পেয়ে সাইভিদের বুকে মুখ লুকাবে। সাইভিদও তখন তাকে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে নিবে।

ইশ, কত কি ভাবছে সে। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠে তার। এতকিছু ভাবার মাঝে সে খেয়ালই করেনি, সাইভিদ যে ফোন রেখে অনেকক্ষণ যাবত তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হঠাৎই তার ভীষণ লজ্জা লাগতে শুরু করে, যাকে বলে একেবারে মরে যাওয়া টাইপ লজ্জা। আর এক মিনিটও বারান্দায় থাকে না সে, দ্রুত রুমে চলে আসে। বিছানায় বসে বড় বড় শ্বাস নেয়। তারপর আস্তে করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। ঐচ্ছির জন্য অপেক্ষা করছিল, তার আগেই হুট করে সাইভিদ সেই রুমে চলে আসে। তাকে দেখে মাত্রই সায়মা ভৃত দেখার মতো চমকে উঠে কাঁপাকাঁপা গলায় বলে,

‘আ-আপনি?’

সাইভিদ ব্রু কুঁচকে বলে উঠে,

‘ব্যাপার কি বলোতো? আমাকে গিলে ফেলতে এসেছো নাকি? এমন ভাবে কেন তাকিয়ে থাকো? যেন চোখ দিয়েই আমায় এক্ষুণি গিলে খেয়ে ফেলবে। বাসায় কিছু খেতে টেতে পাওয়া নাকি?’

সায়মা লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী রঙ ধারণ করতে থাকে। আর মনে মনে দোয়া করে, ‘আল্লাহ, এক্ষুণি আমাকে তোমার কাছে তুলে নাও। আমি আর এক মুহূর্তও এই মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই না। প্লিজ আমাকে উঠিয়ে নাও, প্লিজ।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here