#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৭.
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সায়মা আর সাইভিদকে এক সঙ্গে তার রুমে দেখে ঐচ্ছির মেজাজ বিগড়ে গেল।
ঐচ্ছি ক্রুর কন্ঠে বলে উঠল,
‘কি সমস্যা? তোমরা দুজন আমার রুমে কি করছো?’
সাইভিদ তেরছা ভাবে উত্তর দিল,
‘আমি আমার হবু বউয়ের সাথে কথা বলতে এসেছি, তোর এত সমস্যা হলে তুই রুম থেকে বেরিয়ে যা।’
ঐচ্ছির তো এবার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রাগে কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে তার। কত বড় সাহস, তার রুমে দাঁড়িয়ে তাকেই বেরিয়ে যেতে বলছে। ঐচ্ছি প্রচন্ড রাগ নিয়ে সাইভিদের সামনে এসে দাঁড়ায়। দাঁত কিড়মিড়িয়ে সাইভিদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তোমার সাহস তো কম না, আমার রুমে দাঁড়িয়ে তুমি আমাকেই রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলছো? দেখো ভাইয়া আমার মাথা কিন্ত এখন খুব গরম হয়ে আছে, জলদি জলদি তোমার এই হবু বউকে নিয়ে কেটে পড়, নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।’
সাইভিদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বুকের উপর দু হাত ভাজ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। হেয়ালির সুরে বললো,
‘না গেলে কি করবি তুই?’
ঐচ্ছি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সাইভিদের দিকে তাকায়। ইচ্ছে করছে চোখ দিয়ে আগুন বের করে এক্ষুণি এই বিলাতি ইন্দুরটাকে ভস্ম করে দিতে। ঐচ্ছি এবার বাঁকা চোখে সায়মার দিকে তাকাল। সায়মা বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুই ভাই বোনের কান্ড দেখছে। কাউকেই থামানোর মতো সাহস তার নেই। ঐচ্ছি হুট করেই সায়মার ডানহাতটা সাইভিদের বাম হাতের সাথে চেপে ধরে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
‘নে বইন, তোর জামাইরে নিয়ে তুই দয়া করে এখান থেকে বিদায় হো। আমাকে আর রাগাস না।’
সাইভিদ বিরক্তির সুরে বলে উঠে,
‘তোর রাগে আমাদের কিছু যায় আসে না। রাগে মরে যা তুই আমাদের কি?’
ঐচ্ছি রাগে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে থাকে। সায়মা তখন ছোট্ট একটা ঢুক গিলে, ক্ষীণ সুরে বলে,
‘সাইভিদ, আপনি প্লিজ এখন যান। আমার ঐচ্ছির সাথে একটু কথা আছে।’
সাইভিদের কপালে ভাঁজ পড়ে, অত্যন্ত বিরক্ত কন্ঠে বলে,
‘কি কথা?’
ঐচ্ছি ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে,
‘তুমি শুনে কি করবা? তোমাকে যেতে বলেছে না যাও এখান থেকে।’
সাইভিদ সরু চোখে তীক্ষ্ণ ভাবে কিছুক্ষণ দুই বান্ধবীকে পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর পকেটে দুহাত গুঁজে সায়মার দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বিগলিত গলায় বলে উঠল,
‘ঠিক আছে, ঐচ্ছির সাথে কথা বলা শেষে আমার রুমে এসো। আমার প্রশ্নের উত্তরও তো দিতে হবে, তাই না?’
সায়মা কাতর চোখে সাইভিদের দিকে তাকায়। সাইভিদ তখন বাঁকা হেসে ঐচ্ছির রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ঐচ্ছি সায়মার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
‘খুব প্রেম চলছে তাই না? মানে এত এত প্রেম হচ্ছে যে প্রেমের ঠেলায় নিজের বান্ধবীর কথাটাও ভুলে গিয়েছেন। ওয়াও আপনাকে তো ওয়ার্ল্ডের বেস্ট প্রেমিকার এওয়্যার্ড দেওয়ার দরকার। ডাফার কোথাকার! কেন এসছিস এখানে? কি বলতে এসছিস? সরি বলতে? তাহলে শুনে রাখ তোর সরি আমি জীবনেও একসেপ্ট করবো না। সেদিন কত করে আমি বলছিলাম, দরজাটা খোলার জন্য কিন্তু খুললি না। তুইও ঐ বিলাতি ইন্দুরের মতো আমার সাথে শয়তানি করলি। জানিস আমার কত কষ্ট লেগেছিল? মনটা ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। আমি আর জীবনেও তোর সাথে কথা বলবো না, জীবনেও না।’
কথাগুলো বলে ঐচ্ছি আহ্লাদী করে নাক টানে। তারপর সায়মার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। কান্নার ভাব করে বলে,
‘তুই আমার সাথে এমনটা কি করে করতে পারলি সামু? তোর বুকটা কি একটুও কাঁপলো না। হাউ সেলফিস ইউ আর!’
ঐচ্ছি বাচ্চাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদে। সায়মা ফুঁস করে নিশ্বাস ফেলে ঐচ্ছির পাশে গিয়ে বসে। ঐচ্ছি ঠোঁট উল্টিয়ে কান্নার ভাব ধরে বসে আছে। সায়মা বিরক্ত চোখে কিছুক্ষণ ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,
‘তোর ঢং শেষ হয়ে থাকলে আমার কথাটা একটু শোন।’
ঐচ্ছি চোখ ঘুরিয়ে সায়মার দিকে তাকায়। রাগ দেখাতে গিয়েও দেখালো না। সাবলীল গলায় বললো,
‘বল!’
সায়মা দুঃখি দুঃখি গলায় বলে,
‘আসলে সেদিন সাইভিদের জন্য আমি দরজাটা খুলতে পারেনি। উনি তোর সাথে কথা বলার সময় আমার মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেন কিছু বলতে না পারি। ইনফেক্ট আমাকে জোর করে আটকে রেখেছিলেন যেন আমি দরছা খুলতে না পারি। আমি তো চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু উনার সাথে পারা কি সম্ভব বল? আর এই কথাটা বলার জন্য তোকে কত কল দিয়েছি, ম্যাসেজ দিয়েছি, কিন্তু তুই তো কোনকিছুরই রিপ্লাই দিলি না। তাই আজকে বাধ্য হয়ে তোর বাসায় আসতে হয়েছে। এবার তো আর রাগ করে থাকিস না প্লিজ।’
ঐচ্ছি কিছু ভাবে। সায়মার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই একরাশ উত্তেজনা নিয়ে সে বলে উঠে,
‘আচ্ছা দরজা আটকিয়ে কি করছিলি তোরা? সত্যি সত্যিই বাসর..’
‘আরে না।’
চেঁচিয়ে উঠে বলে সায়মা। নাক ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে,
‘বিরক্তিকর লোক একটা। বসে বসে আমার রুম দেখছিল। কোথায় কি রেখেছি, কেন রেখেছি এসবই জিগ্যেস করছিল। তারপর আবার পড়াশোনার ব্যাপারেও অনেক কিছু জিগ্যেস করেছে। এই লোকটা পুরাই একটা পানসা। একটা বার ভালো করে আমার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। উনার আমার থেকে আমার রুমে ইন্টারেস্ট বেশি ছিল। পুরোটা সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রুমটাই দেখে গিয়েছে।’
ঐচ্ছি চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
‘কি রুম দেখেছে? আমি তো আরো ভাবলাম কত কি করে ফেলেছে।’
কথাটা বলে ঐচ্ছি দাঁত কেলিয়ে হাসে। সায়মা রাগি লুকে ঐচ্ছির দিকে তাকায়। ঐচ্ছি সায়মার রাগকে কোনরূপ পাত্তা না দিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে চুল আচ্ছড়াতে থাকে। সায়মা বসে বসে কিছুক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে ঐচ্ছির সাথে অনেক কথা বললো। তাদের বিয়ের পর পরই তাদের এক্সাম শুরু এই নিয়ে সায়মার এক আকাশ চিন্তা থাকলেও ঐচ্ছি বরাবরের মতোই চিল মুডে আছে। এই মেয়ে পড়া নিয়ে একদমই প্যারা নিতে চায় না, সারা বছর না পড়ে পরীক্ষার আগের দিন রাতে পড়ে ঠিক ভালো রেজাল্ট করে ফেলে। তাই সে সবসময়ই চিল মুডে থাকে, যত টেনশন শুধু একা সায়মার।
.
রাত ১০টা। সায়মা আর ঐচ্ছি পড়ার টেবিলে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে। সায়মা চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ঐচ্ছি আর তার মা তাকে যেতে দেয়নি। বাধ্য হয়েই থেকে যেতে হয় তাকে।
ঐচ্ছি চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে বসলো, ক্লান্ত কন্ঠে বললো,
‘বহুত পড়েছি, আর পড়তে পারবো না।’
সায়মা ভীষণ রকম বিরক্ত হয়ে বললো,
‘পড়তেই বসলি নয়টার দিকে আর এখন বাজে দশটা। এক ঘন্টা পড়েই তুই ক্লান্ত হয়ে পড়লি। এত এত পড়া যে বাকি, কি করে শেষ করবি শুনি?’
ঐচ্ছি উদাস গলায় বললো,
‘আরে হয়ে যাবে। ঐসব এক রাত পড়লেই সব কমপ্লিট হয়ে যাবে। নো টেনশন।’
সায়মা তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। ঐচ্ছিকে কিছু বলেও লাভ নেই জেনে, সে তার পড়ায় মনোযোগ দিল।
__________________
খাওয়া শেষ করেই বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধুচ্ছিলো সায়মা। পেছন থেকে তখন হুট করেই সাইভিদ এসে সায়মার হাতের উপর দিয়ে তার হাত ধুয়া শুরু করলো। সায়মা বিরক্ত হয়ে সাইভিদের দিকে তাকায়। সাইভিদ তাতে পাত্তা দিল না। নিজের মতো হাত ধুলো, চলে যাওয়ার সময় সায়মার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে গেল,
‘হাত ধুয়ে আমার রুমে এসো।’
সাইভিদের এমন নরম সুরে সায়মা খানিকটা কেঁপে উঠল। সাথে সাথে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল সে। এখন সাইভিদের রুমে গেলে সে আবারও বিকেলের কথায় পড়ে যাবে। ইচ্ছে করে সায়মাকে লজ্জায় ফেলার ফন্দি করছে। সায়মা ফুঁস ফুঁস করে সাইভিদকে কিছুক্ষণ বকলো। তারপর বিরক্ত হয়ে এগিয়ে গেল সাইভিদের রুমের দিকে।
চলবে..