#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৯.
হলুদের পর্ব শেষ হতেই ঐচ্ছি নিজের রুমে চলে এল ফ্রেশ হতে। ছাদের উপর ছোট্ট একটা স্টেজ করে তাদের হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। ঐচ্ছি ছাদ থেকে নামতেই সবাই সাইভিদকে নিয়ে ছাদে গেল। এবার তার হলুদের পালা। সাদা রঙের সুতি পাঞ্জাবীতে সুন্দর লাগছে তাকে।
ঐচ্ছি ফ্রেশ হয়ে এলো। গায়ের শাড়িটা খুলে একটা থ্রি পিস পরে আবারও ছাদে গেল। সাইভিদকে ইতিমধ্যেই হলুদ দেওয়া হয়ে গিয়েছে। ঐচ্ছিও গেল তার কাছে। সাইভিদের পাশে বসে তার গালে আলতো স্পর্শে খানিকটা হলুদ লাগাল। অস্ফুট হাসলো সাইভিদ। ক্ষীণ সুরে বললো,
‘সবকিছু কেমন অন্যরকম হয়ে গেল তাই না, ঐচ্ছি?’
ঐচ্ছি হয়তো বুঝলো সাইভিদের কথার মানে। তাও না বোঝার ভান করে বললো,
‘কি অন্যরকম হয়েছে, ভাইয়া?’
সাইভিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঐচ্ছির দিকে তাকাল, গম্ভীর সুরে বললো,
‘সায়মার জায়গায় আজ তো তোর থাকার কথা ছিল!’
ঐচ্ছি বিব্রত হলো। হয়তো কিছুটা কষ্টও পেল কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না। সে হাসলো, তবে ঠোঁটের কোণে তার সেই হাসির রেশ ততটাও বোঝা গেল না। সাইভিদের দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললো,
‘সবাই সবার জায়গাতেই আছে ভাইয়া। আসলে কি বলতো আমাদের জীবনে এমন অনেক কিছু ঘটে যায় যেটা আমরা কখনো কল্পনাও করি না। এই যেমন দেখো না রাফসান আর আমার বিয়ে আবার তোমার আর সায়মার বিয়ে; কখনো কি ভেবেছিলাম এমন কিছু হবে, না তুমি ভেবেছিলে? আমরা কেউই এসব ভাবিনি বরং অন্যরকমই কিছু ভেবেছিলাম। ছোট বেলা থেকেই তোমাকে ঘিরে আমার অনেক ভাবনা ছিল ভাইয়া। তবে তিক্ত সত্যিটা কি জানো, আজ সেই সম্পূর্ণ ভাবনা জুড়েই কেবল রাফসানের অস্তিত্ব ছড়িয়ে আছে। তুমি সেই ভাবনার কোথাও নেই ভাইয়া, কোত্থাও না।’
এইটুকু বলে ঐচ্ছি থামলো। জোরে শ্বাস টানল, অতঃপর বললো,
‘ভাইয়া, আমি জানি না তুমি কি কারণে সায়মাকে বিয়ে করছো। তোমার ওকে আদৌ পছন্দ কিনা সেটাও আমার জানা নেই। আর আমি তোমাকে এসব কিছু জিগ্যেসও করবো না। তবে শুধু এইটুকুই বলতে চাই ভাইয়া, সায়মা খুব ভালো মেয়ে। ও হয়তো তোমাকে ভীষণ পছন্দ করে। ওকে তুমি কষ্ট দিও না। ভালোবাসতে না পারো, অন্তত ওর ভালোবাসাকে অপমান করো না। অনুরোধ রইল ভাইয়া।’
এই বলে ঐচ্ছি আর এক মুহূর্তও বসলো না। ছুটে নিচে নেমে গেল। সাইভিদ ঐচ্ছির যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
.
.
রুমে বসে বসে মেহেদি পরছে সায়মা। তার কাজিন রিপা দারুণ মেহেদি পরায়। সেই এখন তাকে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে। মেহেদির শেষে রিপা সায়মার হাতে পিঠে ছোট্ট করে সাইভিদের নামটা লিখে দিল। তা দেখে সায়মা মুচকি হাসল। সায়মার ফোনটা তখন বেজে উঠল, দেখল ঐচ্ছি তাকে ভিডিও কল দিচ্ছে। লাফিয়ে উঠল সে। হাতে মেহেদি থাকায় সে রিপাকে তাড়া দিয়ে বললো,
‘এই রিপা কলটা রিসিভ কর। ঐচ্ছি কল দিচ্ছে।’
রিপা কলটা রিসিভ করে সায়মার মুখ বরাবর ধরল। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল ঐচ্ছির হাস্যজ্জ্বল মুখটা। সায়মাও হেসে বললো,
‘কি করছিস?’
ঐচ্ছি জবাবে বললো,
‘এই তো হলুদ শেষে এখন রুমে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছি। ছাদে এখন সাইভিদ ভাইয়ার হলুদ চলছে। তুই কি করছিস?’
সায়মা ঝমঝমিয়ে বলে উঠল,
‘মেহেদি পরছি। তুই মেহেদি পরেছিস?’
ঐচ্ছি মুখটা কালো হয়ে গেল। উদাস গলায় বললো,
‘আমার এখানে কে আছে যে মেহেদি পরিয়ে দিবে?’
সায়মা বলে উঠল,
‘আরে তুই তো নিজেই পারিস। বাম হাতে পরে ফেলনা।’
ঐচ্ছি ক্লান্ত কন্ঠে বললো,
‘এখন আর ইচ্ছে করছে নারে। ঘুম পাচ্ছে অনেক।’
সায়মা রেগে গেল। নাক মুখ কুঁচকে রাগি গলায় বললো,
‘থাপ্পড় খাস না ঐচ্ছি। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে মেহেদি পর। অল্প হলেও পরতে হবে। নয়তো কিন্তু আমি খুব কষ্ট পাবো।’
ঐচ্ছি সায়মার কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল হাসল। সায়মা তখন আরো তেজ দেখিয়ে বললো,
‘এবার কিন্তু সত্যি সত্যিই থাপ্পড় খাবি ঐচ্ছির বাচ্চা। জলদি গিয়ে মেহেদি পর। নয়তো থাপড়াতে থাপড়াতে এখন তোর গাল ফাটিয়ে ফেলবো। পরে কাল বাসর রাতে রাফসান ভাই চুমু দেওয়ার জন্য আর গালই খুঁজে পাবে না।’
ঐচ্ছির চোখ চড়কগাছ। চেচিয়ে উঠে বলে,
‘এই অসভ্য, কি বলছিস তুই?’
সায়মা ঠোঁট টিপে হাসে। তারপর খলা ঝেড়ে বলে,
‘থাক, সামনে ছোট বোন আছে বলে আর কিছু বললাম না।’
ঐচ্ছি এবার লাফিয়ে উঠে বসে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠে,
‘মানে কে আছে তোর সামনে? কোন বোন? কার সামনে তুই এসব বলছিস?’
সায়মা স্মিত হেসে বললো,
‘আরে এত হাইপার হতে হবে না। রিপা আছে। ঐই তো আমাকে মেহেদি পরিয়ে দিয়েছে নয়তো আমি পারি নাকি মেহেদি পরতে?’
ঐচ্ছি কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
‘ঐ কুত্তি, তুই রিপার সামনে এসব বলছিলি? লজ্জা সরম নেই তোর? ছোট বোনের সামনে কি বলতে হয় না হয় সেটাও জানিস না। ইডিয়েড একটা!’
সায়মা বিরক্ত হয়ে বলে,
‘আরে চুপ করতো। রিপা কি আর এমন ছোট? এবার এইচ এস সি দিবে। আমাদের থেকে ও এসব ব্যাপারে আরো বেশি পাকা।’
সঙ্গে সঙ্গে চেচিয়ে উঠল রিপা,
‘আপু! কি বলছো এসব?’
ফোনের ওপাশ থেকে ঐচ্ছি বলে উঠল,
‘দেখেছো রিপা, তোমার বোনটা কি পাজি। ওকে ঠাস ঠাস করে দুইটা দাও তো। সাথে আমার তরফ থেকেও একটা ফ্রিতে দিয়ে দিও, কেমন?’
সায়মা চোখ রাঙিয়ে ঐচ্ছি আর রিপার দিকে তাকাল। রিপা তখন দাঁত কেলিয়ে হেসে হাতের মোবাইলটা বালিশের সাথে ঠেস দিয়ে রাখলো, তারপর হুট করেই সায়মার বাম হাতের বাহুতে জোরে একটা চিমটি কেটে ভো দৌড় দিল। ব্যথায় চেচিয়ে উঠে সায়মা বলে উঠল,
‘রিপার বাচ্চি, তোরে খালি একবার পাই হাতে; ভর্তা বানিয়ে ছাড়বো।’
ওপাশ থেকে ঐচ্ছি হেসে কুটি কুটি। সায়মার তাতে আরো রাগ হলো। নাকের পাল্লা ফুলিয়ে সে ধমকের সুরে বলে উঠল,
‘চুপ কর কুত্তা।’
ঐচ্ছির হাসি থামেই না। সায়মা গাল ফুলিয়ে রাখায় তার গালগুলো রসগোল্লার মতো ফুলে আছে। ঐচ্ছি হাসতে হাসতে বললো,
‘দোস্ত সাবধান, সাইভিদ ভাইয়ার সামনে কিন্তু ভুলেও এমন ভাবে গাল ফুলাস না। নয়তো ভাইয়া রসগোল্লা ভেবে টুকুস করে গালে কামড় বসিয়ে দিতে পারে।’
কথাটা বলেই ঐচ্ছি হাসিতে ফেটে পড়ে। ঐদিকে সায়মা রাগে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সায়মা মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঐচ্ছি ফট করে কলটা কেটে দেয়। ঐচ্ছি জানে এখন সায়মা আরো বেশি রেগে যাবে। সে তার রাগ ঝাড়তে পারেনি। রাগে যে সে ফুঁস ফাঁস শুরু করবে সেটাও সে বেশ বুঝতে পারছে। তাতে ঐচ্ছির কি? তার তো এখন শুধু হাসিই পাচ্ছে।
.
ঐচ্ছির চোখে আজ ভীষণ ঘুম। অল্প কিছু খেয়ে এসে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমানোর আগে রাফসানকে একটা টেক্সট পাঠিয়ে বললো,’রাতে আর কল দিয়েন না। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমিয়ে পড়ছি। আপনিও খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন, গুড নাইট।’
________________________
সকাল সাতটা কি আটটা বাজে। ঐচ্ছিকে ঘুম থেকে টেনে টুনে উঠানো গেলেও সাইভিদকে কোনো ভাবেই উঠানো যাচ্ছে না। সে নাকি দশটার আগে কোনো ভাবেই ঘুম থেকে উঠবে না। এই নিয়ে তানিয়া জুবাইয়ের বাড়িতে এক হুলস্থুল কান্ড বাধিয়ে দিয়েছেন। সকলের সাথে সাথে ঐচ্ছিরও এবার খুব রাগ হয়। এই ছেলেটার আজ একটু তাড়াতাড়ি উঠলে কি হয় শুনি? অসহ্য, ইচ্ছে করে সবাইকে এত প্যারা দেয়। ঐচ্ছি বিরক্ত হয়ে সায়মাকে কল দেয়। সায়মা কল ধরতেই তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঐচ্ছি বলে উঠে,
‘এই সামু, তোর জামাই ঘুম থেকে উঠছে না। খালামনি তাকে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত। সে নাকি সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে দশটার আগে সে উঠবে না। কিন্তু দশটায় উঠলে বাকিসব কাজ করতে লেইট হয়ে যাবে তাই তাকে এখনই উঠতে হবে। আর এই মহান পুরুষকে ঘুম থেকে জাগানোর মহান দায়িত্বটা তোকে দেওয়া হলো। তোর জামাইকে তুই উঠা। আর তুই যদি আধ ঘন্টার মধ্যে ভাইয়াকে জাগিয়ে তুলে রুম থেকে বের করতে পারিস তবে তোকে প্রমিস করছি আগামী এক সপ্তাহ তুই যা বলবি আমি তাই করবো। তোর সব কথা মেনে চলবো। তাই তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়, ওকে বেবি? রাখছি তাহলে।’
সায়মা খুশি হয়ে যায়। এই তো সুযোগ! সে সঙ্গে সঙ্গেই সাইভিদকে কল দিয়ে ফেলে…
চলবে..