জীবনের জলছবি (পর্ব ২৮)

জীবনের জলছবি
পর্ব ২৮
এতো টা রাস্তা ঘুরে যাবি!

কলেজে ছুটির পরে ওকে অন্য রাস্তায যেতে দেখে বললো সোমা, টুসি কোনো উত্তর দিলো না। সেদিন বরযাত্রী থেকে আসার পর থেকেই ইচ্ছে করেই হসপিটালের সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে না ও। এই রাস্তাটা দিয়ে গেলে অনেকটা ঘুরে যেতে হয়, কিন্তু তাও তপু দার সঙ্গে দেখা হবার কোনো সুযোগ নেই।

শুভ দার বিয়ের বরযাত্রী গিয়ে ও এতটাই অপমানিত হয়েছিলো তপু র কাছে, সেদিন থেকেই আর কথা বলবে না বলে ঠিক করেই নিয়েছিলো টুসি। এমনকি বৌভাতের দিন বাবা, মা গেলেও শরীর খারাপের অজুহাতে ও যায়নি সেদিন।

কেনো যাবি না? ভীষণ অসামাজিক হয়ে যাচ্ছিস তুই!

কোথায় মা? তুমি যেখানেই বলো সেখানেই তো যাই, বাবাদের ক্লাবের পার্টির সময়েও তুমি একই কথা বলেছিলে! আমি গিয়েছিলাম তো? এমনকি তোমরা যাওনি তাও তো আমি বরযাত্রী গিয়েছি! বলো ঠিক কিনা! এবার সত্যি আমার শরীর ভালো লাগছে না,

টুসি র জবাব শুনে মা আর কিছু বলেনি সেদিন, মনে মনে একটু ক্ষুব্ধ যে হয়েছে সেটা মা ফিরে আসার পর বুঝেছিলো ও।

শীলা, তপু দুজনেই তোর কথা জানতে চাইছিলো, গেলেই পারতিস!

ওই জন্যেই তো আসলে ও যেতে চায়নি, একটুও তপু দার মুখোমুখি ও হতে চায়নি আর, সেটা আর মা কে বলতে পারেনি ও। তপু বোধহয় টুসি যে বৌভাতে না আসতে পারে এটা ভাবেনি একটুও, তাই ওকে যেতে না দেখে পরের দিন কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো।

এর আগে ওর কলেজের সামনে কোনো দিনও আসেনি তপু তাই ওকে দেখেই একদম অবাক হয়ে গিয়েছিলো টুসি।

কাল এলিনা কেনো?

শরীর ভালো ছিলোনা,

একটু রুক্ষ স্বরে বলেছিলো ও,

কলেজে আসার সময় শরীর ভালো হয়ে গেলো! আমি ভেবেছিলাম, তোর শরীর সত্যিই খারাপ!

তপু দার কথায় খুব রাগ হয়ে গিয়েছিলো টুসির,

সত্যি, মিথ্যের কি আছে! আমার শরীর খারাপ হোক বা ভালো, তোমার জানার দরকার নেই! তুমি যাও এখন, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না!

সেই তো! তোর প্রয়োজনে আমাকে ডাকবি, আর প্রয়োজন মিটে গেলেই আর আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করবে না,

তপু র কথায় একটু থমকে ছিলো টুসি, একটু বেশি কড়া করে বলা হয়ে গেলো নাকি! তপু দা কি খুব রেগে গেলো! কিন্তু ওরও তো অভিমান হয়েছে, কি খারাপ ব্যবহারটাই না করেছে ওর সঙ্গে কদিন ধরে। ও তো কতো আশা করেছিলো, তপু দা ওকে বলবে কিছু, কিন্তু আর কিছুই তো বললো না সেদিনের পর থেকে। উল্টে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে সীমার সঙ্গে সময় কাটিয়েছে।

এবার তপু দা যখন ওকে নিজে থেকে ডেকে বলবে সব কথা, সেদিনই ও কথা বলবে ওর সঙ্গে, তার আগে কিছুতেই তপু দার মুখোমুখি হবে না ও। সেই থেকেই ও অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে বাড়ি যাচ্ছে, তপু দা ওকে সত্যিই ভালোবাসে কিনা দেখতে চায় টুসি।

কিন্তু ওর কপালটাই খারাপ, অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে আসতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তপু দার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো ওর। রাস্তা পার হবার সময় রাস্তার পাশে তোপুদার গাড়ি টা দাঁড় করানো দেখেই চমকে তাকালো টুসি, গাড়িতে তপু দা নেই, কিন্তু পাশের সিটে সীমা বসে আছে! কিন্তু তোপুদা গেলো কোথায়? ভাবতে ভাবতেই উল্টোদিকের দোকানটা থেকে সিগারেটের প্যাকেট হাতে তপু দা কে বেরিয়ে আসতে দেখেই মাথাটা নীচু করে নিলো টুসি।

এদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?

ও যে তপু দা কে এড়ানোর জন্যে এই রাস্তা দিয়ে আসছিলো সেটা কি আর বলা যায়, তার মধ্যে সীমা কে গাড়িতে দেখেই ওর খুব মন খারাপ লাগছিলো।

অন্য একটা কাজ ছিলো এদিকে

তপুর দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলো ও, এই মুহূর্তে তপু দার দিকে তাকালেই ওর চোখে জল এসে যাবে!

বাড়ি যাচ্ছিস তো? চল গাড়িতে ওঠ, তোকে নামিয়ে দিয়ে যাবো,

যে গাড়িতে সীমা বসে আছে সেই গাড়িতে ও কিছুতেই উঠবে না, টুসির খুব অভিমান হচ্ছিলো, আজ ও হটাৎ দেখতে না পেলে তো জানতেও পারতো না যে তপু দা সীমা কে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে!

নাহ! তোমরা চলে যাও, আমি বাস ধরে চলে যাবো,

তোর খুব জেদ টুসি! এতো জেদ ভালো না! একদিন তুই নিজেই ভুগবি, এর জন্য।

এবার আরো রাগ হয়ে গেলো টুসির, ওর জেদ! আর তপু দা কি করেছে কদিন ধরে ওর সঙ্গে! আজও তো সেই সীমাকে নিয়েই যাচ্ছে!

আমি তো বললাম আমি যাবো না! যাকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছিলে তাকে নিয়েই যাও না!

চাপা স্বরে বললো ও,

বেড়াতে যাচ্ছি! কে বললো তোকে ? নিজে নিজেই ঠিক করে নিয়েছিস সব? জানিস, বাবার অবস্থা কতো খারাপ? বাবা কোথায় থাকে সেটা মাসিরা জানে! মাসি বাড়ি নিয়ে ব্যস্ত, তাই সীমা কে নিয়ে যাচ্ছি, আমি তো ওদের ওখানে কিছুই চিনি না! তোর মানসিকতা দেখে খুব খারাপ লাগছে! সত্যি তোকে এরকম ভাবিনি আমি!

ইসস! কাকু অসুস্থ, আর ও কতো কিছু ভেবে ফেলেছে! এবার নিজেরই লজ্জা লাগছে ওর, সত্যি তপু দা ওকে খুব খারাপ ভাবলো, ও কি তাহলে গাড়িতে উঠে যাবে! কিন্তু এই মুহূর্তে ও যা জেদ দেখিয়ে ফেলেছে! আর কিছুতেই পিছিয়ে আসা সম্ভব নয় এখন। নিজের ভেতরের লজ্জা, জেদ সব মিলিয়েই কিছুতেই ওকে গাড়িতে উঠতে দিলো না আর।

এতো কথা বলার পরও তুই উঠলিনা গাড়িতে! বাবা এখন কেমন আছে, সেটুকুও জানতে চাইলি না!

এতক্ষনে চমক ভাঙলো টুসির, কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো ও, এবার তড়িঘড়ি বললো,

কেমন আছেন কাকু এখন?

তুই নিজে থেকে জানতে চাসনি যখন, তখন আর উত্তরটা দেবার প্রয়োজন মনে করলাম না,

বিদ্রুপের গলায় বললো তপু, টুসির খুব লজ্জা লাগছিলো, সত্যি ওর নিজেরই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো, ধুৎ! সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ওর, কেনো যে ওদের সঙ্গে দেখা হলো! ও তো বেশ ভালই ছিলো, ভেবেই নিয়েছিলো যতদিন না তপু দা ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে ততদিন ও আর আসবে না তপু দার কাছে।

ঠিক আছে, আমি উঠছি গাড়িতে,

নাহ! তুই বাসেই চলে যা বরং, আমার তাড়া আছে!

টুসি কে কথা শেষ করতে না দিয়েই বললো তপু, টুসির ভীষণ অপমানিত লাগছিলো। ওর সামনে দিয়েই তপু গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো, একবারও আর ওর দিকে ফিরেও তাকালো না। কিছুক্ষন একাই দাঁড়িয়ে থেকে ও বাসে উঠে পড়লো।

বাড়িতে ঢুকে দেখলো বাবা আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে এসে গেছে, মা রান্না ঘরে চা করছিলো ওকে দেখে বেরিয়ে এলো।

তোর কি শরীর আবার খারাপ হয়েছে নাকি! কদিন ধরেই দেখছি ভালো করে খাওয়া দাওয়াও করছিস না, সেদিন বৌভাতেও তো গেলিনা! মুখ চোখ কেমন শুকনো শুকনো লাগছে!

মা এর কথার কোনো উত্তর না দিয়েই ঘরে ঢুকে এলো ও, এই মুহূর্তে ওর কিছুই ভালো লাগছিলো না।

কিছু খাবি নাকি?

একটু পরেই মা ঘরে ঢুকে এসে বসলো ওর পাশে, মা সাধারণত সন্ধ্যে বেলা রান্না ঘরেই থাকে, টুসি একটু অবাক হলো।

কিছু বলবে মা?

ঘর দোরের কি অবস্থা করে রাখিস! একটা বাইরের লোক এলেও লজ্জা লাগে! একটু গুছিয়ে রাখতে পারিস তো!

একে ভীষণ বিরক্ত হয়ে ছিলো ও, তার মধ্যে মা এর কথায় আরও বিরক্ত লাগলো, সবে সারাদিন পরে ও বাড়িতে ঢুকেছে, মা কে এক্ষুনি এসব বলতে হবে!

কে তোমার বিশিষ্ট অতিথি আসবে বলতো? যার জন্যে আমাকে ঘর গুছিয়ে রাখতে হবে!!

বেশ চিৎকার করেই বলে উঠলো ও, মা কিছু বলার আগেই বাবা ঘরে ঢুকে এল। বাবা কে দেখেই একটু থমকালো টুসি, বাবা যে আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছে সেটা ভুলেই গিয়েছিলো ও।

বড্ড বেশি স্বাধীন হয়ে যাচ্ছো আজ কাল! সেদিন অতো বার বলা সত্বেও বৌভাতে গেলে না, বন্ধুদের সঙ্গে নিজের মতো বেড়াতে চলে যাচ্ছো, মায়ের সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলার ক্ষমতাও হয়েছে দেখছি,

বাবার কথা শুনে আর কোনো কিছু বলার সাহস দেখালো না ও, মা এর ওপর খুব রাগ হচ্ছে। প্রতিটা কথা বাবা কে বলতে হবে নাকি! ও তখনই জানতো মা সেবক যাওয়ার কথা বাবা কে বলবেই। সব সময় এতো শাসন ভালো লাগে নাকি!
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here