কৃষ্ণাবতী
২৬তম_পর্ব
সেদিনের পর থেকে অন্নাকে কেনো যেনো আর আগের মতো লাগছে না অর্জুনের কাছে। ব্যাপারটা বিরক্তিকর। খুবই বিরক্তিকর। বইটা বন্ধ করে বুকসেল্ফের কাছে গেলো অর্জুন। বিষয় বদলালে হয়তো চিন্তাটা বদলাবে। হঠাৎ কারোর সাথে ধাক্কা লাগলে অর্জুনের হাতে থাকা বই টি পড়ে যায়। সামনের মানুষের হাতেও কিছু বই ছিলো। সেগুলো পড়ে গেলো। তুলে দিতে গিয়ে খেয়াল করলো সামনে থাকা মানুষটি অন্য কেউ নয় বরং তার হৃদয়ের ক্ষত কৃষ্ণাবতী। সেদিনের পর থেকে কৃষ্ণাকে অনেকটা এড়িয়ে চলছিলো সে। কিন্তু এভাবে সামনে এসে উপস্থিত হবে বুঝে উঠতে পারে নি। বই গুলো কোশনো মতে তার হাতে ধরিয়ে উঠে চলে যেতে নিলে পিছু ডাকে কৃষ্ণা।
– অর্জুন দা?
কৃষ্ণার ডাকে অর্জুনের পা জোড়া থেমে যায়। জোর পূর্বক মুখে হাসি টেনে পেছনে ফিরে বলে,
– কিছু বলবে?
– আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো
– বলো
– আপনি আমায় ক্ষমা করেছেন তো?
কৃষ্ণার নম্র স্বরে করা প্রশ্নটি অর্জুনের হৃদয়ে তীরের মতো লাগে। কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলো না। বুক থেকে অচিরেই একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অর্জুনের চোখ কৃষ্ণার দিকে, মেয়েটিকে দোষারোপ করাটা তার জন্য নিতান্ত বোকামি হবে। সে তো ইচ্ছে করে তাকে ঠকায় নি। শুধু ভাগ্য তার জন্য এই মেয়েটিকে বরাদ্ধ করে রাখে নি। কৃষ্ণার অপরাধী মুখটা তার দেখতে ভালো লাগছে না। মুখটা ফিরিয়ে শক্ত গলায় বললো,
– যা আমার নয় তা নিয়ে আক্ষেপ করাটা আমার স্বভাবে নেই। ভালোবেসেছিলাম এটা ঠিক, কিন্তু তা কেবল এক পাক্ষিক। তুমি চিন্তা করো না। একটা সময় ঠিক সামলে নিতে পারবো। আর ক্ষমা, তোমার উপর তো আমার রাগ ছিলো না। তাহলে ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কোথায়! অহেতুক ব্যাপারগুলো নিয়ে চিন্তা করো না।
– শুনে ভালো লাগলো, আমিও চাই আপনি সামলে নেন। আর একটা কথা, আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। এমন অনেকে আছে যাদের চিন্তাধারা আপনাকে কেন্দ্র করে ঘুরে। অবহেলায় তাদের হারাবেন না। আসি অর্জুনদা৷
কৃষ্ণা বই গুলো শক্ত হাতে ধরে তার গন্তব্যের দিকে হাটা ধরলো। অর্জুন তার যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। শুভাকাঙ্ক্ষী বলতে কাকে বুঝিয়েছে কৃষ্ণা? যাওতার আগের কথাগুলো বেশ ভাবাচ্ছে অর্জুনকে। ভাবনার ফাকে একটি নাম মস্তিষ্ক লাল অক্ষরে বড় করে দেখাতে লাগলো। “অন্না”। অর্জুনের শুভাকাঙ্ক্ষী কি হবে অন্না! কৃষ্ণা কি তাকে অবহেলায় না হারানোর কথা বলে গেলো! কে জানে!
২১.
সময় বহমান, সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। জুলাই এর প্রথম সপ্তাহ। বৃষ্টির মৌশুম শুরু হয়েছে। একবার বর্ষণ শুরু হলে আর থামতে চায় না। যেমন এখনো একাধারে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণা। শাড়ির আঁচল গড়াচ্ছে। বৃষ্টির ঝাপটা চোখে মুখে পড়ছে তার। অতীতের স্মৃতি চোখে ভাসছে কৃষ্ণার। দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর কেটে গেছে। কৃষ্ণা এবং অন্না এখন অনার্সের ছাত্রী। বিগত পাঁচ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে ভট্টাচার্য মঞ্জিলে। প্রদীপ বাবু পরলোকগমন করেছেন। নারায়ন বাবুর কৃষ্ণার প্রতি চিন্তাধারাটা অনেক বদলেছে। কৃষ্ণার সাথে তিনি খারাপ ব্যবহার করেন না। কৃষ্ণাও তার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই আচারণ করে। যাতে তিনি কোনোভাবেই অপ্রস্তুত না হয়। এখন নারায়ন বাবুর তার পুত্রবধুকে তিনি গর্ব ও হয়। কৃষ্ণা তার মেধার দ্বারা খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলো উচ্চ মাধ্যমিকে। এখনো তার রেজাল্ট বেশ ভালোই রয়েছে। দেবব্রতের ইচ্ছে তার কৃষ্ণাকে উচ্চ শিক্ষিত করতে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে সকলভাবে সহায়তা করছে সে। দেবব্রত না থাকলে হয়তো এই পর্যন্ত আসাই হতো না কৃষ্ণার। ভাবতেই অবাক লাগে কৃষ্ণার, এই ভট্টাচার্য মঞ্জিলে দেখতে দেখতে তার সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেছে। বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছর। সময়টা কম নয়, তবে কিছু জিনিস চাইলেও বদলাতে পারছে না কৃষ্ণা। বিয়ের এতোটা বছর হয়ে যাবার পরও তার কোলে এখনো কোনো বাচ্চা আসে নি। অবন্তীকা দেবীর আক্ষেপের শেষ নেই৷ এই তো সেদিন তার প্রতিবেশী দু-তিন জন মহিলা বাসায় এসেছিলো। তাদের আদর যত্নের কোনো কমতি রাখে নি কৃষ্ণা। কিন্তু কথায় কথায় তারা অবন্তীকা দেবীকে বলেন,
– বৌদি কোনো সুখবর কি আছে?
– সুখবর বলতে?
– ছেলের বিয়ে তো কম বছর হলো না। ছেলের বয়স এখন একত্রিশে পড়েছে। এখন বাচ্চা না নিলে হবে কিভাবে?
– আসলে কৃষ্ণা তো এখন পড়াশুনা করছে তাই আর কি!
– আরে বৌদি রাখেন তো, মেয়ে মানুষের এতো পড়াশোনা দিয়ে কি হবে? ছেলেতো কম কামাই করে না। সে তো আর বাহিরে কামাবে না। তাহলে! নাকি বউ মা আপনার বাচ্চা দেবার ই ক্ষমতা নেই!
বলেই তারা টিটকারিমূলক হাসাহাসি শুরু করলেন। সেদিন অবন্তীকা দেবী কোনো কথা বলতে পারেন নি। এরপর থেকেই কৃষ্ণার উপর খানিকটা গোসা তিনি। তারও বয়স হয়েছে৷ নাতি-নাতনিদের মুখ তার ও দেখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু দেবব্রতের সামনে কিছুই বলতে পারেন না। তার যা রাগ। তাই কৃষ্ণার সাথেই তার যত চোটপাট। যখন তখন কৃষ্ণার সাথে চেচামেচি করবেন। নয়তো তার সাথে কোনো কথাই বলবেন না। এই বছরের শেষে কৃষ্ণার অনার্সও শেষ হবে। তাহলে এখন বাচ্চা নিতে কি সমস্যা। কৃষ্ণার শাশুড়ী মায়ের এরুপ বিরুপ আচারণের কারণটা যে অজানা তা কিন্তু নয়। অথচ তার কিছুই করার নেই৷ বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছর হলেও তাদের মাঝে এখনো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা সকল স্বামী স্ত্রীর মতো নয়। দেবব্রত কৃষ্ণার পুরোপুরি গড়ে ওঠার অপেক্ষায় নিজেকে অনেক সংযত করে রেখেছে। বাচ্চাকাচ্চা এখন অহেতুক লাগছে তার কাছে। কৃষ্ণার মনোযোগ যেনো শুধুমাত্র লেখাপড়ায় থাকে সেটাই তার ইচ্ছে। মুখফুটে কৃষ্ণাও কিছু বলতে পারে না। মেয়েমানুষ কি মুখ ফুটে বলাটা শোভা পায়! বৃষ্টি হচ্ছে, কৃষ্ণা হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি ছোয়ার তালে আছে। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরেছে। পেছনে না ফিরেও বলতে পারবে লোকটি কে। দেবব্রত তার কোমড় জড়িয়ে মাথায় মুখ ঠেকালো। ধীর কন্ঠে বললো,
– কি হইছে? বৃষ্টিবিলাশ করা হচ্ছে বুঝি?
– বৃষ্টিবিলাশ বললে ভুল হবে, আকাশের সাথে কথা ভাগ করে নিচ্ছিলাম
– আমাকে বলা যাবে না সেসব কথা?
– তোমার কি সে সময়টা হবে?
– একিরকম কথা? আমার কিশোরী বউটির জন্যই তো আমার সারাটা সময়।
টাইটা ঢিলে করতে করতে দেবব্রত বললো। দেবব্রতের কথা শুনে ম্লান হাসি হাসে কৃষ্ণা।
– কফি খাবে?
– উহু তুই যাস না, ফ্রেশ হয়ে আমি করে আনছি। তুই আমার পাশে বয়।
– আমি এখন পড়তে বসবো না, ভালো লাগছে না এখন।
– আমি বুঝি তোকে শুধু পড়াবার সময় পাশে বসাই!
– ভুল তো কিছু বলি নি।
কৃষ্ণার নির্লিপ্তভাবে বলা কথায় দেবব্রত কোনো উত্তর দিতে পারে নি। এটাই যে সত্যি। কিন্তু দেবব্রত যে নিরুপায়। বাবার সাথে দেওয়া বাজিতে যে তার জিততে হবে। সে কৃষ্ণাবতীকে এমন পর্যায়ে দেখতে চায় যেখানে তার জন্মপরিচয় কিংবা পিতৃপরিচয় নিয়ে কেউ কোনো কথা না বলতে পারে। সেও চায় বাকি দম্পতির মতো স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটাতে কিন্তু এখন যে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। কৃষ্ণার রেজাল্ট খুব ভালো, তার স্কোলারশিপ পাবার সম্ভাবনা অনেক। সুতরাং এখন কোনোভাবেই লক্ষ্যচ্যুত হওয়া চলবে না কৃষ্ণার। বুকে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে দেবব্রতের। ধীর কন্ঠে বলে,
– কারণটা তো তোর অজানা নয়। আচ্ছা মা কি আজকেও কোনো কান্ড করেছেন?
– না, আজকাল তিনি আমার সাথে কথা বলেন না। আচ্ছা মাষ্টারমশাই আমরা কি একটা বাচ্চা নেবার কথা ভাবতে পারি না?
কৃষ্ণার আকুতিময় কন্ঠ দেবব্রতের ভেতরটাকে ঝাঝরা করে ফেলছে। কিন্তু তার কিছু করার নেই। উঠে দাঁড়িয়ে কড়া কন্ঠে বলে,
– প্রতিদিন এক ঘ্যানঘ্যান আমার ভালো লাগে না কৃষ্ণা। তুই বাচ্চা নস, প্রতিদিন কেনো এক কথা বুঝানো লাগে তোকে। আমি এখন কোনো বাচ্চা চাচ্ছি না। বাচ্চা নেবার সময় কি শেষ হয়ে যাচ্ছে? এই বাচ্চামি গুলো আমার কিন্তু বিতৃষ্ণা লাগে।
বলেই গটগট করে হেটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো দেবব্রত। পেছনে ফিরলে হয়তো দেখতে পেতো তার কিশোরী বউটির চোখ ছলছল করছে। কৃষ্ণা সেই ছলছল নয়নেই দেবব্রতের দিকে তাকিয়ে থাকলো, লোকটার কাছে তার চাহিদাগুলো কেবলই বাচ্চামি মনে হয়। কৃষ্ণার চোখ থেকে অশ্রুগুলো মুক্তি পেলো আক্ষেপের রুপে______
বৃষ্টির মাঝে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে অন্না। অপেক্ষার প্রহর মোটেই কাটতে চাচ্ছে না তার৷ এই একটা মানুষের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত সে। পায়জামার নিচ অবধি ভিজে গেছে। প্রায় ঘন্টা হতে গেলো সে অপেক্ষা করে রয়েছে। আজকাল তার জীবনেও কেউ এসেছে তার জন্য তার রাতগুলো স্বপ্নবহর হয়। অতীতের বেদনা গুলো সব ভুলে গিয়েছে এই পাঁচটা বছরে। কিশোরী মনের সেই ভালোবাসাটাকে তার কিশোরী মনের আবেগ বলে মনে হয়। সেই সব স্মৃতি এখন কেবলই স্মৃতি। তার জীবনের বর্তমান লোকটি অতীতের সকল কন্টকময় স্মৃতিগুলোকে স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ রেখেছে। অন্নার বর্তমানটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে সে। অন্নার চিন্তাধারায় এখন আর অতীতের অর্জুনদা নেই। এসব শুধু সেই লোকের অবদান। এখনো লোকটা আসে নি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অন্না। তখনই একটি বাইক এসে তার সামনে ব্রেক মারলো। বাইকে একজন লোক কালো হেলমেট এবং রেইনকোট পড়া। অন্না চোখ কুচকে তাকিয়ে আছে। এরপর সামনে হাটা ধরলো। বাইকের লোকটি বাইক নিয়ে তার পেছন পেছন ছুটলো। অন্না এবার থেমে বললো,
– কি সমস্যা?
– কোনো সমস্যা নেই
– তবে?
– রোডে চলা কি অপরাধ?
– তা অপরাধ নয়, কিন্তু আমার পিছু নেওয়া অপরাধ। আমার পিছু নিচ্ছেন কেনো?
এবার লোকটা তার হেলমেট খুললো। মুখে সেই ভুবন ভুলানো হাসি, সে হাসি অন্নার বুকে তীরে মত লাগে। এই হাসিতে সে সব কিছু বাজি দিতে রাজি। লোকটি তখন বলে,
…………
চলবে
[দেরি হবার জন্য ক্ষমাপার্থী। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। কার্টেসী ব্যাতীত দয়া করে কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি