হৃদয়_রেখেছি_জমা পর্ব ৬

0
660

#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৬

পার্কিং লটে একা দাঁড়িয়ে আছে মেহরিন। তাঁর গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে সোহাগকে ফোন করেছে সাহায্যের জন্য। এদিকে ইরফান সাহেব সোহাগকে পার্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকতে বলেছেন। তাই সোহাগ আবার সাহায্যের জন্যে মাহমুদের কাছে ফোন করলো।

সহকর্মীদের সাথে গ্রুপে ছবি তুলছিলো মাহমুদ। ফোন বাজতেই ভিড় থেকে আড়ালে সরে গেলো। স্ক্রিনে সোহাগের নাম দেখে এদিক ওদিক চাইলো সে খুঁজলো। সোহাগ নেই। ইরফান আহমেদের বৈঠক খানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে তাঁকে। কি যেন জরুরি আলাপ করবেন বলেছেন। সেখান থেকেই ফোন করেছে সোহাগ। মাহমুদ ফোন রিসিভ করে বললো,’হ্যাঁ। সোহাগ বলো।’

সংক্ষেপে সমস্যার কথা খুলে বললো সোহাগ। সব শুনে মাহমুদ গম্ভীর কন্ঠে বললো,’আমি কি গাড়ির মিস্ত্রি?’

-‘মেহরিন আমাকে ফোন করে সাহায্যের কথা বলেছিলো। কিন্তু বস আমাকে ছাড়ছেন না। প্লিজ স্যার, আপনি একটু দেখুন না।’

-‘ঠিক আছে যাচ্ছি আমি।’

স্বাস নিশ্বাস ফেললো সোহাগ। মাহমুদ যখন যাবে বলেছে তখন আর কোন চিন্তা নেই। এবার দুজনের ঝগড়া না হলেই হয় কেবল!
মাহমুদ হেলে দুলে পার্কিং এর দিকে গেলো। মেহরিন গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডানহাতে ফোন, বামহাত পকেটে ঢোকানো।

কোন রকম কথাবার্তা ছাড়াই গাড়ির বনেট খুললো মাহমুদ। টুকটাক সমস্যা হলে সে নিজেই সারাতে পারবে। নতুবা মেকানিকের কাছে পাঠাতে হবে। মেহরিন ফোন থেকে মুখ না তুলেই বললো,’লাভ নেই। আমি দেখেছি। ইঞ্জিন গেছে।’

ঢাকনা বন্ধ করে ফিরে এলো মাহমুদ। মেহরিনের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,’সোহাগ আসতে পারবে না। তাঁকে বস আটকে রেখেছে।’

ফোন থেকে মুখ তাঁর দিকে চাইলো মেহরিন। কথাটা বোধগম্য হতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেলো। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে ঘড়ি দেখলো। বারোটা পঁয়ত্রিশ। অনেক রাত! এত রাতে গাড়ি ঘোড়া পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। মাহমুদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিজে থেকেই তাঁর গাড়ির সামনের দরজা খুলে দিয়ে বললো,’চলো। আমিও বেরোবো। যাওয়ার পথে তোমাকে ড্রপ করে দেবো।’

কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মেহরিন। তারপর গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ির ভেতরে ভ্যানিটি ব্যাগ রয়ে গেছে মেহরিন। নিতে ভুলে গেছে। পুনরায় তাঁর গাড়ির কাছে ফিরে গেলো মাহমুদ। ভ্যানিটিব্যাগটা নিয়ে এসে মেহরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’তোমার ব্যাগ।’ জবাবে কৃতজ্ঞ কণ্ঠে তাঁকে ‘ধন্যবাদ’ জানালো মেহরিন।


কিছুদূর যেতে না যেতেই এনার ফোন। মাহমুদকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে বাধ্য হয়ে ফোন করেছে সে। মাহমুদ রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে এনা কি বললো সেটা মেহরিনের শুনতে পেলো না। জবাবে মাহমুদ শুধু বললো,’হ্যাঁ আমি বেরিয়ে গেছি। তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম ধরো নি কেন?’

ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলো এনা তাই বলতে পারবে না। কথা শেষ করে মাহমুদ ফোন রেখে দিলো।’ এনার কি তোমার সঙ্গে ফেরার কথা ছিলো?’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নটা করলো মেহরিন।

-‘হ্যাঁ।’

-‘তাহলে? ওকে নিয়ে এলে না যে?’

-‘ওর আরো দেরীতে ফেরার কথা।’

-‘তোমার?’

-‘এনা ইনসিস্ট না করলে আরো আগেই বেরিয়ে যেতাম। কালরাতে ভালো ঘুম হয় নি।

মেহরিন আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মাহমুদ মুচকি হাসলো। পুরোনো অনেক স্মৃতি মনের আনাচে কানাচে উঁকি দিচ্ছে তাঁর। মেহরিনকে প্রথম গাড়িতে বসেই প্রপোজ করেছিলো সে। মেহরিন জবাব দেয় নি। টানা তিনমাস ঘুরানোর পর হঠাৎ একদিন গাড়িতে বসেই মাহমুদের গলা জড়িয়ে ধরলো। ডানহাতের তর্জনীটা তাঁর বুকের বাম পাশে ঠেকিয়ে বললো,’এই যে এই হৃদয়! আজ থেকে এই হৃদয়টা আমার। ভালোবাসার বিনিময়ে জমা নিয়ে নিলাম। আর কখনো ফেরত দেবো না। এখানে শুধু আমার নাম থাকবে।’ তারপর থেকেই দুজনের ভালোবাসায় মাতামাতি! প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া! তারপর আবার সবকিছু এলোমেলো! মাহমুদ পুরোনো স্মৃতি থেকে ফিরে এসে বললো,’একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

মেহরিন সরাসরি জবাব দিলো না তবে প্রশ্নের অপেক্ষায় মাহমুদের মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

-‘চাচ্চুকে তোমার বাবা ডাকতে ইচ্ছে করে না?’

-‘করে।’

-‘তাহলে ডাকো না কেন? তিনি প্রায়ই আক্ষেপ করেন আমার কাছে। মাঝেমধ্যে তো ডাকলেও পারো। খুশি হবেন।’

মেহরিন জবাব না দিয়ে ফের মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এর মানে এই ব্যপারে আলোচনা করতে অনিচ্ছুক সে। মাহমুদ আর কথা বাড়ালো না।
মেহরিনের মা লায়লা শারাফাতের সাথে ইরফান সাহেবের মনোমালিন্য অনেক আগেই মিটে গেছে। যদিও ক্ষমা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে উনাকে কিন্তু মেয়ের মন ফেরাতে পারেন নি। মেহরিন সব মনে রেখেছে। বাবার প্রতি পুরোনো ক্ষোভ রয়ে গেছে তাঁর। কাজের কথা ছাড়া পারতপক্ষে বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে না সে। মাকে নিয়ে এখনো আলাদা বাসাতেই থাকে। ইরফান সাহেবও মেয়ের ওপর কখনো জোর করেন নি। মাঝে মাঝে খুব বেশি কষ্ট হলে মাহমুদের কাছে শেয়ার করেন।

মাঝরাস্তায় এসে মাহমুদের গাড়িতে সমস্যা শুরু হলো। কিছুদূর গিয়েই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। আবার স্টার্ট দিলে আবার কিছুদূর যায়। তারপর আবার বন্ধ হয়ে যায়। এমন করতে করতে গোটাই ইঞ্জিনই গেলো। মেহরিন বেশ বিরক্ত হলো। বিদ্রুপ করে বললো,’মানুষের সঙ্গে তামাসা করতে করতে এখন তোমার গাড়ি তোমার সঙ্গে তামাশা করছে।’

-‘তুমি তো খুব ভালো। তাহলে তোমার গাড়ি নষ্ট হলো কেন?’

রেগে গেলেও প্রতিউত্তরে বলার মতন কিছু খুঁজে পেলো না মেহরিন। ঘড়িতে অলরেডি দেড়টা বেজে গেছে। চারদিকে জনমানবশূন্য! মেহরিন বাসায় ফিরবে কখন? মাহমুদকে অবশ্য ততটা চিন্তিত দেখাচ্ছে না। গাড়ি থেকে বেরিয়ে গুনগুন করে গান গাইছে সে। মেহরিন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্ত কন্ঠে বললো,’যাবো কীভাবে?’

-‘উড়ে উড়ে। আমার পিঠে উঠে বসো। আমি উড়িয়ে নিয়ে যাবো।’

চোখ গরম করে তাঁর দিকে চাইলো মেহরিন। মাহমুদ হেসে ফেললো। বললো,’অন্য কোন গাড়ি পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। না পেলে সোহাগকে ফোন করবো। ‘

প্রায় দশমিনিটের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো দুজন। একটা গাড়ির যদি দেখা মিলতো। মেহরিন বিরক্ত হয়ে বললো,’আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো।’
মাহমুদ পকেট থেকে ফোন বের করে সোহাগের নাম্বারে ডায়াল করলো। দুবার রিং হওয়ার পর কেটে গেলো। নেটওয়ার্কে সমস্যা বোধহয়। সোহাগ নিজেই আবার কল ব্যাক। ওর সাথে কথা শেষ করে ফোন রাখতেই হঠাৎ শাঁ করে একটা বাইক তীব্রগতিতে ছুটে গেলো তাদের সামনে দিয়ে। আচমকা ভয়ে মেহরিন দুপা পিছিয়ে গেলো। মাহমুদও অবাক হয়ে সামনে চাইলো। আরেকটু হলেও চাপা পড়তো দুজনে। তিনটে উঠতি বয়সের তিনটা ছেলে শিস দিতে দিতে মাঝরাতে বাইকিং করছে।

কিছুদূর গিয়ে আবারো ফিরে এলো তাঁরা। এবার যাওয়ার সময় মেহরিনকে উদ্দেশ্য শিস দিয়ে গেলো। হাবভাব দেখে মনে হলো আবার আসবে। চট করে কোমরের খাঁজ থেকে রিভলভারটা বের করলো মেহরিন। বাইকের পেছনের চাকা বরাবর টার্গেট করলো শুট করার জন্য, কিন্তু তাঁর আগেই ধরে ফেললো মাহমুদ। বাধা দিয়ে বললো,’কি করছো। অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে তো।’

তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রিভলভার নামিয়ে নিলো মেহরিন। তবে চেহারা থমথমে। তাঁর ধারণাই ঠিক হলো। খানিকবাদে আবার ফিরে এলো ছেলেগুলো। মাঝরাত একা দুটো নরনারীকে দেখতে পেয়ে শয়তানি চেপেছে এদের। এবার মাহমুদ ইশারায় বাইক থামাতে বললো।

থেমে গেলো! তিনজনেই কুৎসিত ভাবে হাসছে। মাহমুদ কাছে এগিয়ে গেলো। ইশারায় মেহরিনকে দেখিয়ে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,’শোনো ছোট ভাইয়েরা। ঐ যে আপুটাকে দেখছো তাঁর কাছে একটা লাইসেন্সধারী একটা রিভলভার আছে। যেটা দিয়ে একটু আগে সে তোমাদের শুট করতে চেয়েছিলো, আমি দেই নি। কিন্তু এবার যদি তোমরা আবার ফিরে এসেছে তাহলে আর বাধা দেবো না। গুলি করে তোমাদের মাথার খুলি উড়িয়ে দেবে সে। টার্গেট? একেবারে নিখুঁত। অতএব লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, জানের মালিক তুমি আল্লাহ্ করতে করতে বাড়ি ফিরে যাও।’

ছেলেগুলো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একবার মেহরিনের দিকে চাইলো। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিন। তাঁর মুখোভঙ্গি দেখে মাহমুদের কথা অবিশ্বাস করার সাহস হলো না তাদের। মাহমুদ তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে ফের একঝলক মেহরিনের দিকে চাইলো। তারপর মুচকি হেসে বললো,’পিস্তল অবশ্য আমার কাছেও আছে কিন্তু আমি গুলি করবো না। যতক্ষণ না তোমরা আমার ওপর শারীরিক ভাবে আক্রমণ করছো ততক্ষণ আমিও চুপচাপ থাকবো। কিন্তু আপুর মেজাজ খুব গরম! এমনিতে মানুষ ভালো তবে রাগ উঠলো হুঁশ থাকে না। চুপচাপ বাড়ি ফিরে যাও ভাই। আর ঝামেলা করো না।’

তার কথা শেষ হতে না হতেই ছেলেগুলো দ্রুত বাইক স্টার্ট দিয়ে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গেলো। মেহরিন তীক্ষ্ণ চোখে তাদের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো। শয়তানগুলোকে কানের নিচে দুটো দিতে পারলে শান্তি লাগতো। কিন্তু মাহমুদের জন্য সেটা হলো না। মাহমুদ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আশ্বস্ত করে বললো,’আর আসবে না। ভয় পেয়েছে।’
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here