হৃদয়_রেখেছি_জমা পর্ব ৭

0
573

#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৭

সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরী হয়ে গেলো মেহরিনের। গতকাল রাত তিনটার দিকে বাসায় পৌঁছেছে সে। ফ্রেশ হয়ে শুতে শুতে প্রায় সাড়ে তিনটার বেজে গেছিলো। তারপর বিছানায় যেতেই ঘুমে! এক ঘুমে বারোটা!

ব্রেকফাস্ট সেরে তাড়াহুড়ো করে হেড কোয়ার্টারের দিকে ছুটলো সে। আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হওয়ার কথা ছিলো। ইরফান সাহেব নিশ্চয়ই আজকে কতগুলো শক্ত কথা শুনিয়ে দেবেন তাঁকে। বিরক্তিতে মুখ কালো হয়ে গেলো তাঁর। এই লোক যতক্ষণ অফিসে থাকেন ততক্ষণ একেবারে অন্যরকম। একমাত্র কাজ ছাড়া অন্য সকল সম্পর্কের কথা ভুলে যান তিনি।
কাজের সাথেই তাঁর সমস্ত সম্পর্ক। কাজে গাফলতি হলে মাহমুদ, মেহরিন কাউকেই ছাড় দেন না তিনি। তবে মাহমুদের ব্যপারটা কেবল লোক দেখানো বলেই মেহরিনের ধারণা। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ভাইয়ের ছেলে বলে মাহমুদের প্রতি ইরফান সাহেব একটু বেশিই স্নেহশীল। কিন্তু তার যে একটা কারণ আছে সেটা মেহরিন স্বীকার করতে রাজি নয়। পারতপক্ষে, ইরফান আহমেদের নির্দেশ কখনো অমান্য করে না মাহমুদ। যতই কঠিন কাজই হোক না কেন ইরফান সাহেব যদি একবার আদেশ করেন বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যাবে মাহমুদ। বাবা মা মারা যাওয়ার পর চাচার কাছেই মানুষ হয়েছে সে। বাইরের মানুষের কাছে তিনি যতই গম্ভীর হোক না কেন, ছোট বেলা নিজের ছেলের মতন বড় করেছেন মাহমুদকে। মেহরিনের কাছে হয়ত তাঁর পিতার হাজারটা দোষ আছে, থাকাটাই স্বাভাবিক কিন্তু মাহমুদের কাছে তিনি সবার ওপরে।

পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দেড়টা বেজে গেলো মেহরিনের। ভেতরে ঢুকতেই ডেস্কের কাছে প্রথম এনার সঙ্গে দেখা। মিষ্টি হেসে আন্তরিক গলায় বললো,’গুড নুন মেহরিন আপু।’

-‘গুড নুন!’, আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলো মেহরিনও। তারপর গলার স্বরটা খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’বস কি ইতোমধ্যে আমার খোঁজ করেছেন?’

জবাবে না সূচক মাথা দোলালো এনা। গতকালের ঘটনা সোহাগের কাছে জানতে পেরেছেন ইরফান সাহেব। তাই মেহরিনের দেরী নিয়ে কিছু বললেন না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো মেহরিন। বাঁচা গেছে! আজকে আর কতগুলো বেহুদা কথা শুনতে হবে না তাঁকে। এই ভেবে খানিকটা আনন্দও হচ্ছে।

এনা নীল রংয়ের ফাইল বাড়িয়ে দিলো তাঁর দিকে। ফাইলের ওপর তিনটা স্টার মার্ক করা, তারমানে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল। হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নিলো মেহরিন। এনা মুখের হাসি বজায় রেখে বললো,’মাহমুদ আপনাকে দিতে বলেছিলো। ফাইলে এবারের মিশনের পুরো কেইস স্টাডি আর কিছু ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনালদের রিপোর্ট করা আছে। আপনাকে সেটা আরেকটা কপি তৈরী করে মূলকপিটা ফেরত দিতে। প্রয়োজন মনে করলে নতুন করে ইনফরমেশন এ্যাড করতে পারবেন।’

-‘মাহমুদ আসে নি?’, আনমনেই প্রশ্নটা করে ফেললো মেহরিন।

-‘ন’টার দিকে এসেছিলো। শরীর খারাপ তাই ছুটি নিয়ে চলে গেছে। বললো, বাসায় বসেই নাকি বাকি কাজ সারবে।

-‘নতুন কপি কবে নাগাদ লাগবে?’

-‘কালকের মধ্যে। মিনিস্ট্রিতে নাকি জমা দেবেন বস।’

-‘ঠিক আছে। হয়ে যাবে।’

বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো এনা। মেহরিন ফাইল খুলে রিপোর্ট তৈরীর কাজে মনোযোগ দিলো। কাজের মাঝখানে হঠাৎ মনে পড়লো মাহমুদের শরীর খারাপের কথা বলছিলো এনা। কি হয়েছে তাঁর? শরীর কি সত্যিই খারাপ? নাকি অন্যকিছু?
তাই হবে! সেরকম হলে এনা নিশ্চয়ই বলতো। অতএব, অনুমানের ওপর ভিত্তি করে মাহমুদের ছুটে নেওয়ার একটা কারণ দাঁড় করিয়ে ফেললো সে। কারণটা হলো, গতকাল রাতে দেরীতে বাসায় ফিরেছে মাহমুদ। ঠিকমতন ঘুমাতে পারে নি। তাই শরীর খারাপের অযুহাত দিয়ে বাসায় গিয়ে ঘুমানোর প্ল্যান করেছে। মাথা থেকে মাহমুদের চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে পুনরায় কাজে মনোযোগ দিলো মেহরিন।

বাস্তবিকই বাসায় গিয়ে ঘুমানোর প্ল্যান করেছে মাহমুদ কিন্তু তাঁর শরীর সত্যিই খারাপ। সকালে অফিসে ঢোকার সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম দেখে আর দেরী করে নি। দ্রুত কাজ সেরে বেরিয়ে গেছে।


সেদিন রাতে ফাইলের জন্য মেহরিনের কাছে ফোন করলো মাহমুদ। রিসিভ করলো সোহাগ। মেহরিনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সারপ্রাইজের অ্যারেঞ্জ করেছে তাঁরা। বাসার ভেতরে হৈ-হুল্লোড় চলছে। সিনিয়র জুনিয়র অনেক কলিগ এসেছে।

ফোন রিসিভ করলেও কথা বললো না সোহাগ। মেহরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’মাহমুদ ভাই।’

ভিড় থেকে সরে এলো মেহরিন। ঘরভর্তি লোকজনের গমগমিতে অপরপ্রান্তের মানুষটা ঠিক ভাবে শুনতে পাবে কিনা সেই চিন্তা করে খানিকটা চেঁচিয়েই ‘হ্যালো’ বললো সে।

তাঁর গলার আওয়াজ পেয়েই ওপাশ থেকে মাহমুদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,’হ্যাঁ মেহরিন?’

-‘বলো! শুনছি।’

-‘সকালে এনা তোমাকে যেই ডকুমেন্ট পেপারটা রেডি করতে বলেছিলো সেটা কি রেডি?’

-‘হ্যাঁ।’

-কোথায় রেখেছো? খুঁজে পাচ্ছি না তো?’

-‘তুমি অফিসে?’, অবাক হলো মেহরিন।

-‘হ্যাঁ। কিছু জরুরী কাগজপত্র আর ফাইলটা হঠাৎ করেই দরকার পড়লো। সেগুলো নিতে এসেছি।’

-‘ওটা তো আমার ড্রয়ারে। তালাবন্ধ!’

-‘হায় হায়! বলো কি? আমার যে এক্ষুনি লাগবে।’

-‘জরুরি ফাইল তাই ড্রয়ারে তালা মেরে এসেছিলাম।’

-‘তোমার কাছে কি ফাইলের সফট কপি আছে?’

-‘সফট কপি তো পুরোটা রেডি করতে পারি নি। ভেবেছিলাম কালকে সকালে গিয়ে করবো।’

-‘তাহলে এখন?’ হতাশ শোনালো মাহমুদের কণ্ঠস্বর!

ফাইলের আবশ্যকতা বুঝতে পেরে মেহরিন একমুহূর্তও ভাবলো। তারপর নিজে থেকেই প্রস্তাব করলো,’আমি কি সোহাগকে দিয়ে চাবি পাঠাবো?’

হাসি ফুটে উঠলো মাহমুদের ঠোঁটে। ডকুমেন্টটা এক্ষুনি লাগবে তাঁর। কিন্তু এতরাতে সোহাগকে পাবে কোথায় মেহরিন? নাকি সোহাগের কথা বলে মেহরিন নিজে আসবে?
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে উচ্চস্বরে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কৌতূহল বশতই প্রশ্ন করলো সে,’এত শোরগোল কিসের? তোমার বাসায় কি মেহমান?’

-‘আজকে আমার জন্মদিন। সোহাগরা কেক নিয়ে এসেছে সেলিব্রেট করার জন্য।’

-‘তাই নাকি? হ্যাপি বার্থডে।’

-‘থ্যাংক ইউ।’

-‘কত হলো এবার? পঁচিশ না ছাব্বিশ?’

-‘ছাব্বিশ।’

-‘সেকি? গতবার না চব্বিশ ছিলো?’

-‘উহুঁ। গতবার পঁচিশতম জন্মদিন সেলিব্রেট করেছিলাম।’

মাহমুদ ঠাট্টার সুরে বললো,’তাহলে তো বুড়ো হয়ে গেলে। এবার অন্তত বিয়েটা করো!’

বিয়ের প্রসঙ্গটা উঠতেই বিব্রত হলো মেহরিন। দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো,’আমি কি চাবি পাঠাবো?’,

-‘এক্ষুনি পাঠানোর দরকার নেই। তোমাদের পার্টি শেষ হলে পাঠাও।’

-‘কিসের পার্টি? আজকে কোন পার্টি হচ্ছে না।’

-‘তুমি না বললে সবাই এসেছে?’

-‘ওরা সারপ্রাইজ দিতে এসেছে। পার্টি হবে আগামীকাল।’

বস্তুত জন্মদিন নিয়ে মেহরিনের বিশেষ কোন খেয়াল ছিলো না। আগ্রহ কিংবা উচ্ছ্বাস তো নেই বললেই চলে। কিন্তু কলিগদের অনুরোধে পার্টিটা রাখতে হচ্ছে তাঁকে। সবাই এত করে অনুরোধ করেছে যে না করতে পারে নি।

মাহমুদ তাঁর কথার জবাবে বাধ্য ছেলেদের মতন করে বললো,’আচ্ছা। তাহলে এক্ষুনি পাঠিয়ে দাও।’ ফোন রেখে দিচ্ছিলো সে। কিন্তু মেহরিনের প্রশ্নটা শুনে থমকে গেলো।

-‘তুমি আসবে কাল?’, হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করে বসলো মেহরিন। কেন করলো সে নিজেও জানে না। কালকে অফিসে দেখা হলে বাকি সবার মত মাহমুদকেও ইনভাইট করতে পারতো সে। আলাদা করে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজনই ছিলো না। বিশেষ করে এইমুহূর্তে! এমনভাবে! নিজের ওপর রাগ হলো। সবসময় বোকার মতন কাজ করে সে।

প্রতিউত্তরে মাহমুদ হাসলো। অনেকটা কথা আদায় করে নেওয়ার মতন করেই বললো,’ইনভাইট করছো?’

  • -‘এসো, এনাকে নিয়ে। আমি চাবি পাঠাচ্ছি।’ দ্রুত ফোন রেখে দিলো মেহরিন। তাঁর শেষের কথাগুলো অনেক বেশি ভারী শোনালো। ফোন হাতে নিয়ে স্থিরভাবে কিছুক্ষণ বসে রইলো মাহমুদ। আবার শরীর খারাপ লাগছে তাঁর। মাথা ঝিমঝিম করছে। তথাপি সোহাগ আসার অপেক্ষা করে বসে রইলো। সোহাগ এলে ফাইল নিয়ে তারপর বেরোবে। কাজটা যেভাবেই হোক শেষ করতে হবে তাঁকে।
    .
    .
    .
    চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here