যেদিন আমার ডিভোর্স হবে, সেদিনই আমি জানতে পারলাম; আমার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর তাও আবার মিসক্যারেজ হওয়ার মাধ্যমে। ডিভোর্সটা মিউচুয়্যাল ভাবেই হয়েছিল। অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতোই আমার ভেতরটা তখন ছিল অনুভূতি শূন্য। ভালোবাসার মানুষের সাথে ডিভোর্স সচারাচর দেখা যায়। তেমনই আমার জীবনের ঘটা দূর্ঘটনা সর্বসাধারণের মতোই।
_______
দুই ভাইয়ের ছোটো বোন আমি অরুমিতা; বাবা-মা নেই আমাদের। বড়ো ভাই প্রবাসী হওয়ার আগে বিয়ে করে যায় নতুন বাড়ি গড়ে। ভাবির বড়ো ভাইয়ের মাধ্যমে বিদেশ গমন করার আগে ভাবির কাছে রেখে যায়। ভাবি যে অতোটা পছন্দ করে না আমাকে, তাঁর ছোটো খাটো বিরক্তিকর আচরণেই বোঝা যেত। শুধু ভাইয়ের ভয়ে কিছু বলে না। ছোটো ভাই ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে, মফস্বল এলাকায় তার আবার খাপ খায় না। নতুন জায়গাতে নতুন বাড়ি তৈরি করে ভাইয়ার বিয়ে হওয়া নিয়ে সকল ঝুটঝামেলায় আমার কলেজে ভর্তি দেরিতে হয়। শৈশব থেকেই নাচের প্রতি আলাদা আকর্ষণ কাজ করে বিধায় নাচের ক্লাসে আলাদাভাবে ভর্তি হই। লেখাপড়ার চেয়ে নাচের ফলাফল বেশ ভালো হত। বাবা-মা নেই বলে ভাইয়েরা-ও আমায় বেশ একটা শাসনে রাখত না। কলেজে নতুন ছাত্রী হওয়ায় কাউকে খুব বেশি চিনি না। তবে মিতু নামের মেয়ের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে হয়তো মেয়েটা আগ বাড়িয়ে কথা বলাতে; আমি আবার একটু চুপচাপ ধরনের। কলেজের সাথেই ভার্সিটি, যার দরুন বিরাট বড়ো মাঠ পার হয়ে একমাত্র গেট দিয়েই বের হতে হয়। মাঠের একপাশে পুরোনো আম গাছের গোড়াতে রাজনীতি করা সিনিয়র ছাত্র সকলের কাছে পরিচিত নাম কুড়ানো সুদর্শন যুবক কুশাল; প্রতিদিনের মতো আজও আমাকে তার নজরবন্দি করছিল। তার পরিচিতির ব্যাপারটা মিতুর কাছ থেকেই জানা। মেয়েদের বোঝার ক্ষমতা বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একটু বেশিই প্রখর হয় সম্ভবত। কারণ বেশ ক’দিন যাবৎ আমার মন জানান দিচ্ছিল যে, কেউ আমাকে ফলো করে। সেই ফলো করার বিষয়টা পাকাপোক্তভাবে সঠিকতায় রূপ নেয়, নাচের ক্লাস থেকে রাতে ফেরার সময়।
নাচের ক্লাস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হওয়ার কারণ সিনিয়রদের বিদায় এবং নবীনদের বরণ। কলেজ থেকে বাড়ি বেশ দূরেও না আবার অতটা কাছেও না। তবুও মনে সাহস জুগিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় পেছন থেকে বলিষ্ঠ হাতের বাঁধা প্রাপ্ত হই। পিছনে কুশালের দিকে তাকিয়ে খুব একটা অবাক হই না। কারণ সে যে আমার পিছু নেয় তা আমার বেশ জানা।
“কী হলো অবাক হলে না যে?”
“অবাক হওয়ার মতো কিছু ঘটেছে?”
“বাহ! প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন করার সাহস আছে দেখছি। তাও আবার তুখোড় রাজনীতি করা সিনিয়র ছাত্র কুশালের সাথে।”
এটা সত্য আমার খুব সহজে সারপ্রাইজ বা অবাক হওয়ার প্রবণতা কমই। এদিকটা আমার অনেক ভালোই বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে। কিন্তু একটা সময় সেই বিচক্ষণতা সম্পন্ন বুদ্ধি-ও কাজে আসে না। মন-মস্তিষ্কে যখন ভালোবাসা নামক পোকারা কিলবিল শুরু করে দেয়। তখন মরিচা ধরা লোহার কুড়ালের মতোই মন-মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়ে। আমার-ও হয়েছিল অতি সন্নিকটে প্রহরের শেষাংশে এসে।
“কেন প্রশ্ন করতে আবার ছোটো বড়ো লাগে না কি?”
“না লাগলেও মানুষ বোঝে কথা বলা উচিত। বুঝেছ বালিকা?”
“সেই যাহোক। আমার পিছু নিচ্ছেন কেন?”
এখন অবাক হওয়ার পালা বোধহয় কুশালের। পিছু নেয়ার বিষয়ে আমার অবগত হওয়ায় বেশ ধাক্কা খেল যার দরুন চক্ষু তার কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম।
“জানলে কীভাবে?”
আমার স্বাভাবিক স্বর,
“মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সম্পর্ক জানেন না? অথচ সেই মেয়েরা আপনাকে যে কেন চায়; আমার বোধগম্য হয় না।”
“তুমি চাও না?”
খুব কাছে নিশ্বাসের প্রগাঢ়তা গোণা যায়; এতটাই কাছে এসে আমাকে প্রশ্নটা করে কুশাল। অত্যধিক গৌড় বর্ণের, কুচকুচে কালো চোখের সম্মোহনী মায়ায় পড়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকি সেই চোখে। অনুষ্ঠানে হালকা গোলাপি রঙা শাড়ি পরে এসেছিলাম। চোখে মোটা কাজল টানা। উজ্জল শ্যামলা গাত্রে শাড়ির রংটা মানিয়েছিল বলে, আমাকে খুব সুন্দরী দেখা যাচ্ছে; মিতু বারবার বলছিল কথাটা। শীতল বাতাস বারবার সেই শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে যাচ্ছে। তাই বেসামাল হয়ে যাচ্ছে আঁচলটা। হঠাৎ করে আঁচল গলিয়ে কটিদেশে শীতল হাতের স্পর্শে চমকে ওঠি। দিকবিদিকশুন্য হয়ে মুখের ঝুঁকতে থাকা কুশালের গালে থাপ্পড় দিয়ে ফেলি। কীভাবে কী হয়ে গেল, বুঝেও ওঠতে পারিনি। এদিকে আমি ভয়ে অতিষ্ঠে অস্থিরতার কুলে, অথচ কুশাল তখনও শান্ত দৃষ্টিতে বিরাজ করে আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কী ছিল জানা ছিল না আমার, অস্থিরতা আরো দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়ে বুকের মাঝে কাঁটার মতো বিঁধল। নুইয়ে পড়ি অপরাধ বোধে। যদি-ও আমার অপরাধ ছিল না, স্বাভাবিকই বিষয়টাতে আমার মতোই রিয়েকশন হবে অন্যসব মেয়েদের ক্ষেত্রেও।
“তোমাকে প্রথম নাচের ক্লাসে নাচ অনুশীলন করতে দেখে মুগ্ধতার রেশ ধরে ভালোলাগাটা আজও অনুষ্ঠানে নৃত্য করতে দেখে ভালোবাসাতে আগায়, অরুমিতা।”
থাপ্পড় খেয়েও কুশালের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ ঠান্ডা, ধীরস্থির। কিন্তু তার কথা শুনে দুরুদুরু করে বুক কাঁপতে থাকে আমার। উশখুশ করা গলায় বলি,
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
সেদিন তো উপেক্ষা করে এসেছিলাম কুশাল’কে। কিন্তু কলেজে গিয়ে প্রতিনিয়ত তার নজরবন্দি হতে হয়েছিল। তবুও এড়িয়ে চলছিলাম। সেটা আর বেশিক্ষণ স্থগিত রইল না। ক্যান্টিনে বসেছিলাম তখনই বন্ধুদের সাথে কুশালের-ও আগমন ঘটে। মুখ বরাবর চেয়ার টেনে বসে একধ্যানে তাকিয়ে থাকে, স্পষ্টত আমি সেটা বুঝতে পারি দেখেই মিতুকে নিয়ে চলে আসতে নিয়েছিলাম। অথচ সেই চাওয়াকে ভেঙে গুঁড়িয়ে পেছন থেকে হাত টেনে ধরে বলে ওঠে,
“এমন এভয়েড করছ কেন?”
আশেপাশে সকলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ফালাতে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাচ্ছিলাম।
“হাত ছাড়ুন।”
কণ্ঠস্বর বেশ ধারালো। হকচকিত হয়ে হাত ছেড়ে মুখের সামনে এসে মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“রাগ করার কথা আমার অথচ ইগনোর করছ তুমি! এটা কি ঠিক?”
“ঠিক-বেঠিকের হিসাব কষার মতো আমাদের সম্পর্ক নয়। তাহলে অযথায় আমাকে বদনাম করবেন না। পথ ছাড়ুন দয়া করে।”
দৃঢ়তার সহিত হাত জোড় করে বলা কথায়, কুশাল সরে দাঁড়ায়। আমি দ্রুততার সাথে গেট পেরিয়ে রিকশা ডেকে মিতুকে নিয়ে ওঠে পড়ি। ফেলে আসি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা কুশাল’কে।
রিকশাতে ওঠতে ওঠতেই সাথে সাথে প্রশ্ন করে বসল,
“তোকে কি প্রপোজ করেছে কুশাল?”
পাশ ফিরে মিতুর ভ্রু কুঁচকে উদ্বিগ্নতা নিয়ে আমার উত্তর শোনার অপেক্ষাতে দেখতে পাই।
“হুম করেছিল। আমি না করে দিয়েছি।”
“তবুও তোকে একটা কথা বলে রাখি। কুশালের বাপ-ভাই’রা-ও রাজনীতি কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। উপরন্তু কুশাল সবার খুব আদরের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তোর সাথে মানায় না। অযতাই ভুল করে ভুলেও মন দিয়ে বসিস না। পস্তানোর রাস্তাও খোঁজে পাবি না।”
অল্প কথায় দুনিয়া বুঝিয়ে দিলো মিতু আমাকে। কথাগুলোও ফেলনা নয়৷ সত্যিই তো আমি শ্যামলা গাত্রবর্ণের মেয়ে কোনোদিক দিয়েই কুশালের সমানেও যাই না। সেদিক দিয়ে সকলের পছন্দের বহু মেয়ের আকাঙ্ক্ষিত পাত্র কুশাল। আমাকে তো মানায় না একেবারেই না। আকাশ পানে তীব্র সূর্যের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, ওই সূর্যটা কুশাল যার দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যায়।
______
কথায় আছে, “বিধির লিখন না যায় খণ্ডন। কপালে যদি দুঃখ, হাজার টানিলেও আসিবে না সুখ।”
যেখানে কখনো বাবা-মা’য়ের আদরযত্ন পাইনি, সেখানে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে খুব করে আদুরে ডাকেও দৃষ্টিভ্রম হলো প্রেমের জালে। যদিওবা ভাইয়েরা আমাকে ভালোবাসে, তবুও আলগাভাবের যত্নআত্তি বোঝার জ্ঞানবোধ যথেষ্ট আমার। সেই বোধশক্তি সবকিছুই নিষ্প্রাণ, নিষ্প্রভ হয় একটা সময় আমার ক্ষেত্রে নয়, সকলের-ই হয়।
“ভালোবাসা তো নয়,
ভ্রম সেটা প্রেমময়!
পড়লে আঁটকে জালে,
বিঁধল কাঁটা গলে।”
চলবে….
প্রহরের শেষাংশ |১|
© মান্নাত মিম