প্রহরের শেষাংশ পর্ব ৪

0
1901

প্রহরের শেষাংশে |৪|
লেখা : মান্নাত মিম
______________

“কী ব্যাপার এমন দেরি করে এলে যে?”

ড্রেসিংটেবিলে কুশাল ওয়ালেট রাখছিল, তখনই আমি প্রশ্নটা করি। ইদানিং দেখা যাচ্ছে রাতে দেরি করে ফিরছে। সেই সকালে যায়, আসে রাত বারোটার পরে। লেখাপড়াও তার শেষ বি.এ.-টা কমপ্লিট। তারপরও ভার্সিটিতে কীসের যাতায়াত আমার বুঝে আসে না। সেদিন এতো করে বললাম,

“ক’দিন আর খালার বাড়িতে থাকব একটা চাকরি-বাকরি খোঁজ এবার।”

নাহ, সে গোঁ ধরে বলেছিল,

“এখানে থাকছি খালামনি’রা তো কিছু বলছে না তাহলে তোমার সমস্যা হচ্ছে কোথায়?”

আমি-ও তার কলার ঠিক করতে করতে বলেছিলাম,

“আত্মসম্মানে সমস্যা হচ্ছে। বুঝেছ?”

আমার গালে হাত রেখে আহত কণ্ঠে বলেছিল,

“দেখ, এখন পরিস্থিতি খুব খারাপ যাচ্ছে। বিয়ের মাত্র কিছুদিন হলো। এরইমধ্যে জায়গাটা পরিবর্তন করা সেফ হবে না। আর জানোই তো আমি অন্যের অধীনে কাজ করা পছন্দ করি না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন যে, কোনো কাজ ছাড়াই বাইরে সময় কাটাচ্ছে।

“কোথায় দেরি দেখলে?”

“আজব তো! রাত বাজে বারোটা এখন আসার সময় হলো? তুমি কি চাকরি করো যে এমন দেরি করে আসো? চাকরি করলেও তো এতো সময় হয় না।”

বিরক্তিকর কণ্ঠে কুশাল বলল,

“কী শুরু করছ? ঝগড়া করতাছ কেন? দেরি হয়েছে দেখে এমনে বলবা?”

“আজই তো এমন দেরি দেখছি না। বেশ ক’দিন ধরেই তো এমনটা করতাছ।”

আমতাআমতা করে কোনমতে জবাব দিলো,

“আড্ডা দিতে দিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবার বেশ দূরেও তো এলাকাটা। তাই দেরি হয়ে যায়।”

আমার আর তার সাথে কোনো কথাই বলতে ইচ্ছে করছে না। বোঝাই যাচ্ছে মিথ্যে বলছিল। তাকে ভালোবাসি, তার প্রতিটি লোমকূপের সাথে পরিচিত। সে যে কিছু লুকাচ্ছে মুখ দেখে তা বোঝাই যাচ্ছে। রাতের আর খাবার গলা দিয়ে নামল না, কুশাল ঠিকই গলাধঃকরণ করল। তবে আমি যে রেগে, চোরা চোখে কয়েকবার তাকিয়ে দেখল সেটা। বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম আজ আর কুশালের জন্য অপেক্ষা করলাম না। ঘুমানোর আগে দু’জন প্রতিদিন খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে তাকিয়ে নিজের সাথে খুনসুটিতে মেতে ওঠি। কিন্তু আজ বিঘ্ন ঘটল ঝগড়ার কারণে। পেছন থেকে ঠান্ডা দু’হাত এসে জড়িয়ে ধরল। কুশাল ছাড়া কেউ হবে না জানা কথা। সরিয়ে দিয়েও ব্যর্থ হলাম। দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে। সব ছেড়ে তার হাত ধরলাম, সে অবশেষে এমন আচরণ করল! আমার মতো তার কষ্ট হলো না বা আমার কষ্টটা তার চক্ষুগোচর হলো না? ঘুরিয়ে কুশালের দিকে ফেরাল আমাকে। অতি সন্তর্পণে চোখ মুছে দিয়ে বলল,

“এমন করছ কেন? জানো না তোমার কান্না আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে।”

ভেজা চোখে তাকিয়ে বললাম,

“মাত্রই বিয়ের দু’মাস হলো। এরইমধ্যে তোমার পাল্টে যাওয়া আমাকে ভীতিগ্রস্ত করছে।”

মুচকি হেসে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু এঁকে বলল,

“ভয়ের কিছু নেই। আমি তোমার’ই আছি। গ্যারান্টি দিলাম।”

তার লোমশ বুকে মুখ ঘষে বলি,

“আজকাল দলিলের গ্যারান্টিও কাজে দেয় না। আর তো মুখের কথা।”

বলেই টুকুস করে তার বুকে কামড় বসালাম। আমাকে তার নিচে ফেলে বুকের কামড়ের স্থানে ঢলতে ঢলতে বলল,

“তাহলে এক কাজ করি, গ্যারান্টি হিসেবে কাউকে স্বাক্ষী রাখি।”

কথাটা বোধগম্য হলো না। মজায় মজায় বলেছি, আর সে এসব বিষয়ে স্বাক্ষী রাখতে চাইছে। কে-ইবা হবে? ভ্রু কুঁচকে ভাবুক নয়নে কুশাল’কে প্রশ্ন করি,

“তোমার এই ফালতু বিষয়ে কে নিজের নাক গলাতে আসবে?”

আমার দিকে ঝুঁকে নাকে আলতো কামড় দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

“আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন-ই হবে; ভালোবাসার স্বাক্ষী।”

অতি সুখের আবেশে মুদিত আঁখিদ্বয় হতে, সেখান থেকে অশ্রু কণা নির্গত হলো। ভালোবাসার ভেলায় নতুন অস্তিত্বের আগমনের পথে দু’জন পাড়ি দিলাম। কিন্তু তার রেশ ধরে জীবন্মৃত হতে হবে জানতামই না। সুখের ভেলায় যে আগুন ধরবে, আপন মানুষ দ্বারাই বেখবর ছিলাম। ভবিষ্যৎ কে-ইবা জানে, আমি-ও তাদের মতোই।
______

সময় বেশি গড়ায়নি। সাঝের বেলাতেও কেন যেন আকাশে মেঘ জমেছে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হওয়ার আশংকায় ভীত নই, যতোটা না ভীতিগ্রস্ত কুশালের না আসায়। আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে বলেও গভীর রাতে পাশে মানুষটাকে পাইনি। কেন এলো না? কোথায় বা রাতটুকু যাপন করল? পরেরদিন বিকেলে গোধূলির হলদে রঙা আলোর সাথে লাল রক্তে রাঙা শার্ট পরিধানকৃত কুশালের আগমনে বুকটা আমার ধক করে উঠল। রাগাভিমান ভুলে এগিয়ে গিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলি,

“এই তোমার শার্টে রক্তভরা কেন? কী হইছে? কোথায় আছিলা?”

আমাকে সরিয়ে দিয়ে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় কুশাল। আর আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রই। কতক্ষণ সময় কাটল খেয়াল নেই। ধ্যান ভঙ্গের সাথে হৃদয় ভঙ্গুর সত্ত্বেও নিচে গিয়ে কুশালের জন্য খাবার নিয়ে ওপরে এসে দেখি সে বারান্দায় কারো সাথে কথা বলছে। এগিয়ে গিয়ে শোনতে পাই,

“ওকে নিয়ে আসা কি সম্ভব না?”

ওপাশের কথা শোনা গেল না তবে এপাশের জবাব,

“তাহলে কী বলব ওকে?”

ফের বলল,

“আচ্ছা বুঝিয়ে বলে আসব নে।”

যতটুকু শোনলাম ততটুকুতে বোঝা গেল না আমায় নিয়ে কথা হচ্ছে না কি অন্য বিষয় নিয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই দ্বিধা ভঙ্গ করল কুশাল। পেছনে ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে সোফায় বসতে ইশারা করল। আমি-ও বাধ্যের মতো গিয়ে বসি। অতঃপর সে পাশে বসে কথা শুরু করে,

“আমি যে দেরি করে আসতাম, তার কারণ ছিল বড়ো ভাইয়ার কাজ করে দিতাম। রাজনৈতিক কাজ বুঝতেই তো পারছ ঝামেলা, মারামারি এসবের মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হতো। কাল এমনই মারামারির মাঝে আমার হাতে খুন হয় বিরোধিতা দলের লোক।”

কথাটা শুনেই আঁতকে ওঠে মুখে হাত পড়ে আমার। আতংকে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে অথচ কুশাল শুধু একবার আমার দিকে তাকিয়ে নির্ভয়ে অবাধে বলে চলল,

“থানা-পুলিশ আমাদের কাছে ডাল-ভাত। তবুও অপরপক্ষ বিষয়টাকে জটিলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই আপাততের জন্য আমাকে গা ঢাকা দিতে বিদেশে পাড়ি জমাতে হবে।”

রক্তশূণ্য চেহারায় ভরসাস্থল হারানোর মতো আর কোনো বোধশক্তি কাজ করছে না; শুধু চোখের জল গড়িয়ে পড়া ছাড়া। এবার কুশাল নতমস্তকে আমতাআমতা করতে করতে বলল,

“কিছু মনে করো না প্লিজ। আমার যাওয়ারটা জরুরি। একটু রিস্ক আছে বলেই তোমাকে রেখে যাচ্ছি। নাহলে এসময়ে তোমাকে একা রেখে যেতাম না। আর তুমি-ও এখান থেকে কোথাও যেও না। তাহলে তোমাকে আমার দূর্বলতা হিসেবে কাজে লাগাবে।”

তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম মনে মনে তবে মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

“কবে যাচ্ছ?”

এবার মাথা উঁচিয়ে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,

“আমার পাসপোর্ট আগে থেকেই করা। কারণ বি.এ. কমপ্লিট করার পর বিদেশে গিয়ে লেখাপড়ার কথা ছিল। সেহেতু পরশু যাওয়ার ডেট পড়েছে।”

“বাহ! বেশ তো সবকিছু আগে থেকলই তৈরি তাহলে।”

এবার মনে মনে করা তাচ্ছিল্য মুখ নিসৃত করেই ফেললাম। সেটা শুনে এগিয়ে এসে আমার দু-হাত ধরে আকুল আবেদন কণ্ঠে কুশাল বলল,

“বোঝার চেষ্টা করো। আচ্ছা, তুমি কি চাও না আমি ভালো থাকি?”

অবাক হয়ে কথাটার অর্থ খুঁজতে ব্যস্ত আমি। কিন্তু অর্থ বোধগম্য হওয়ার চেয়ে প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার মতো যথার্থ জবাব খোঁজে পেলাম না। মানে কী আমি কুশালের ভালো চাই না, আমি! ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে এ-ও শোনতে হলো! একদৃষ্টিতে কুশালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ঘোলা হয়ে টুপ করে একফোঁটা জল বেহায়ার মতো পড়েই গেল। কুশালের হাত ছেড়ে চোখ মুছে বললাম,

“তুমি দায়িত্ববানের মতো কাজ করেছ। তোমার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছ, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাহায্য করেছ। তুমি তাঁদের জন্য, তাঁরা তোমার জন্য। যেহেতু সবকিছু বুঝে-শুনে ঠিক হয়ে গেছে, সেহেতু এখানে তোমাকে আঁটকে রাখার দায় আমার বর্তায় না। আর আমার চিন্তা করতে হবে না, আমার জন্য তোমার জীবনে কোনো আঁচ আসবে না।”

সেদিন রাতে কারোর-ই ঘুম হলো না। একদিকে তখনকার রাগান্বিত হয়ে দৃঢ়তার সহিত বলা কথাগুলো আমাকে ভেতরে ভেতরেই গুমরে মারছিল। আসলেই কি আমি কুশাল’কে ছাড়া একা থাকতে পারব? এক মন প্রবোধ দেয়, পারবে না, তাকে যে খুব ভালোবাসো। তোমার অস্তিত্বে মিশে আছে সে। আরেক মন প্রবোধ দেয়, পারতে হবে। সে তো তোমার মনের খবর নিলো না। সকল সিদ্ধান্ত শেষে তোমায় জানাল। দু-মন দশায় কান্না করতে করতে ঘুমালাম।
_______

চলে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত কুশালের সাথে কথা বলিনি। সে-ও রাগ ভাঙাতে এলো না। তাতে মনঃক্ষুণ্ন হলাম বেশ। সত্যিই কি কুশাল আমায় কখনো ভালোবাসেনি? ফের বেহায়া অশ্রু বিসর্জন শুরু হলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একা একাই কথা বলতে লাগলাম। খালামনি বা খালু এবিষয়ে জানেন না। কী দরকার তাঁদের অযথা মানসিক পীড়া দেওয়ার। যা কষ্ট সব আমার মাথা পেতেই নিয়েছি। ভুল না কি সঠিক বিয়ের সিদ্ধান্তটা এখন এসব ভাবতে বসলেও ভাবি অন্যটা কারণ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন তো করা যাবে না। অযথা সেসেব চিন্তা করে লাভই বা কী? মনে মনেই শুধু দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়া। পেছন থেকে কাঁধের কাছে কারো গরম নিশ্বাস আছড়ে পড়ার আভাসে জানান দেয় কুশালের অস্তিত্বের। তাও নিশ্চুপ, নিশ্চল আমি। আরো ঘনিষ্ঠতার সাথে এগিয়ে এসে দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে নাক ঘষতে থাকে সে। তার বিরোধিতাও করলাম না। আমার দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে তার দিকে আমাকে ঘুরিয়ে নেয়। দু-হাতে মাঝে আঁজলা ভরে নেয় আমার মুখ। কিছুক্ষণ দু’জোড়া চোখের মিলন হয়, শেষ হয়ে দু-জোড়া ঠোঁটের স্পর্শে। পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে অসহিষ্ণু গলায় কুশাল বলে,

“এভাবে চুপ থেকো না জান। তোমার নীরবতা আমায় পোড়াচ্ছে বেশ। এই কষ্টের চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।”

নির্বাক আমি এবার ডুকরে কেঁদে ওঠি। জড়িয়ে নেই আদুরে আলিঙ্গনে তাকে। মনে হয় ছেড়ে দিলে, আর পাব না ভালোবাসার এই মানুষটা’কে। শুধু একটাই কথা আওড়াই,

“তোমাকে ছাড়া আমার কেউ নেই। ভালোবাসি যে খুব।”

অতঃপর জ্যোৎস্না ভরা রাত্রিতে শান্ত নদে শুধু দু-জন নর-নারীর উদ্দীপিত শব্দের ঢেউয়ের দোলা জানান দিচ্ছিল।
______

সারারাত ভর ভালোবাসার মানুষটাকে শুধু আঁকড়ে ধরে ছিলাম। এই বুঝি ছেড়ে দিলে হারিয়ে যাবে। না ঘুমানোর ফল স্বরূপ চোখ ফোলে রক্তলাল বর্ণ ধারণ করে। যার দরুন কুশাল বেশ রাগারাগি করে। যাওয়ার সময় রাতের দিকে। তাই আমাকে দুপুরে একটু ঘুমাত বলে। আমি-ও জেদ করে কুশালের হাত ধরে বলি,

“পাশে থাকো, দেখবে আমার ঘুম এসে পড়বে।”

সত্যি সত্যিই সে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ঘুম থেকে ওঠে দেখি সময়টা সন্ধ্যের। আঁতকে ওঠে দ্রুতই কুশাল’কে খুঁজতে থাকি। মনটা বারবার কু গাইছে, কুশাল আমায় ফেলে চলে গেল না তো?

“যে যেতে চাই যাক না,
মন খারাপের বায়না,
তাকে আর ধরে রাখার দায় না;
যে যাবে, চলে যাক না।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here