প্রিয়ংবদা পর্ব ১৪:১৫:১৬

0
1112

#প্রিয়ংবদা
#চতুর্দশ,পঞ্চদশ ও ষোড়শ পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

রোববার বিকেল। শ্রাবণের শেষ সপ্তাহ চালাচ্ছে বর্ষাবিদায়ের তুমুল তোড়জোড়! বৃষ্টিমাখা আকাশ ধীরে ধীরে বিদায় জানাচ্ছে বৃষ্টিস্রষ্টা মেঘেদের!দীগন্তের যেদিকেই চোখ পড়ে সেদিকেই কেবল নীল,নীল আর নীল!
এই সুবিশাল নীলচে জগতটার এককোণেতেই নীল ব্যাথার সমীকরণ গুনে যাচ্ছে কেউ কেউ। তাদের একেকজনের সমীকরণে একেকরকম ব্যাথা। কারো মনে প্রিয়কারো ভুল বোঝার যন্ত্রণা, তো কারো মনে প্রিয় কারো বলা মিথ্যে স্বরুপ প্রতারণা, কেউ নিজের সবটা দিয়ে কামনা করছে প্রিয়তমাকে ফিরিয়ে আনার, তো কেউ নিজের শর্তেই আবদ্ধ প্রিয়র কাছে ফিরে যাবার!
চারটে জীবনের এমন অদ্ভুত সমীকরণেই যেন কেটে গেল সেই তপ্ত, মেঘহীন, তিক্ত বিকেলটা।
কাদম্বিনী দেবী ফিরে গেলেন বৃদ্ধাশ্রমে!আশুতোষবাবু চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েই ফিরলেন মেঘকুঞ্জে!হৃদিতা বিগত সময়ের মতো এড়িয়ে চললো আদৃতকে, আর আদৃত সেই দমবন্ধ করা অবহেলাটুকু কুড়িয়ে নিল খুব যত্নে,জমা করলো নিজের ঝুলিতে,হিসেব রাখলো ভালোবাসার বদলে পাওয়া নিষ্ঠুরতার!
.
আমাদের জীবনটা নেহাতই গৎবাঁধা। এই নির্দিষ্ট নিরিখে বাধা জীবনটা ঠিকই বয়ে চলে নিজ নিজ গতিতেই,থামেনা খনিকের জন্যও।আপন গন্তব্যে যেতে তার কোন বাঁধা নেই, নেই কোন তাড়া। সে স্থির, সাবলীল, সময়ের স্রোতে গা ভাসানো এক অক্লান্ত শ্রমিক!
এই জীবনের অধিকারীরাও কিন্তু এমনই। সময়ের সাথে এরা সব পরিস্থিতিতেই মানিয়ে নেয় নিজেকে, বুকের মাঝে হাজার টনেক যন্ত্রণা, আকাশসম উঁচু কষ্টের বোঝা বয়েও এরা ঠিক সামলে যায় সময়ের তাগিদেই। মনমরা হয়েই করে যায় নিজের সব করণীয়!ভাঙা মনের আড়ালের ঠুনকো হাসিটাই তখন মনে হয় বাস্তব, সত্যি! তবে হঠাৎ কখনো যখন আবার সেই মরা মনের কারণটা হুটকরেই এসে হাজির হয় সামনে, তখনই বুকের মধ্যে জমে থাকা ছাই চাপা কষ্টটা বেরিয়ে পড়ে। বুকের ভেতরে বেড়ে ওঠা দগদগে ঘাঁ টাকেই খুঁচিয়ে দেয় নিজ মহিমায়!

আদৃত আর হৃদিতার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটলো।
তখন, সবেমাত্র শ্রাবণ গিয়ে ভাদ্র পা রেখেছে ধরায়। নীলাভ আকাশের বুকে সুতো কাটা ঘুড়ির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে থোকা থোকা মেঘ। তুলতুলে সেই মেঘের আড়ালেই ক্ষণে ক্ষণে লুকিয়ে পড়ছে কুসুমবৎ রবি। মেঘের আড়ালেই ম্লান হচ্ছে তার দ্যুতি,প্রখর তেজ!আবার পলক পড়তেই বেরিয়ে পড়ছে আড়াল থেকে!তীব্র তাপোদাহে পুড়িয়ে ঝলসে দিচ্ছে নরলোক!
কলেজ থেকে ফেরার পথে আজও সেই বাদামমামার থেকে বাদাম নিচ্ছিল হৃদিতা। হঠাৎ পাশ কেটে শোঁ করে একটা গাড়ি ছুটে গিয়ে থামে কলেজ গেটের সামনে!হৃদিতা চমকে উঠে দু পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
“গাড়িতে চড়েন বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন, নাকি পাবলিক রোডটা কিনেছেন?রাস্তায় দেখেশুনে গাড়ি চালাতে পারেন না?দামী দামী গাড়ি থাকার মানেই কি পাবলিক রোডে পাবলিকেরই ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেবার অধিকার পেয়ে যাওয়া?”

হৃদিতার কথা শেষ হওয়ামাত্র গাড়ির দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসে আদৃত! হৃদিতা থমকে যায়। থমকায় আদৃতও। তবে প্রকাশ করেনা কেউই, কে জানে কেন! হয়তো চাপা অভিমানে!
আদৃত হৃদিতার দিকে এগিয়ে আসতে নিতেই হৃদিতার চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মনে ঘুরঘুর করে শখানেক অজানা অসম্ভব ভয়!
তবে সেসবে পাত্তা না দিয়ে মিথ্যে সাহসের ভান করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই,উদ্দেশ্য, আদৃত ঠিক কি করে তা দেখা!
হৃদিতা যখন আদৃতের ঠিক সামনে তখন তাকে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই আদৃত তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তারই পেছনে!দেখতে পায়, তারই বয়সী এক মেয়ের সাথে কথা বলতে।
জীবনে প্রথমবারের মতো হৃদিতা অনুভব করে তার আদৃতনামক এই মানুষটাকে নিয়ে হিংসে হচ্ছে! তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যে আদৃত অন্য একটা মেয়ের সাথে অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে এটা তার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না,বিন্দুমাত্র না।
তবে তার সহ্য হবার কথা, সহ্য করা উচিৎ, তবে মস্তিষ্ক এই উচিত কর্মটিই করতে চাইছে না।
হৃদিতা নিজের ওপরেই বিরক্ত হলো। একটু ভেবে মনে করলো, লোকটার সাথে দেখা হলো পুরো সতের দিন পরে!এই সতেরদিনে কমপক্ষে হাজার বার হলেও আদৃতের আনসেভড নাম্বারটায় ডায়াল করতে নিয়েও করেনি সে! পাছে আদৃত কিছু মনে করে, তার দেয়া অবহেলার আগুনে তাকেই পোড়ায়,এই ভয়ে! তবে লাভ কি হলো!সেই তো আদৃতের অবহেলার তীরে বিদ্ধ হলো হৃদিতার কোমল হিয়া, চোখের পলকেই সে ক্ষতে অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হলো,তবে সে ক্ষত সারাবার উপায় পাওয়া গেলনা।
হৃদিতা ম্লান হাসলো! মনে হলো, তার একদিনেই এত কষ্ট হয়!ছেলেটাকে তো প্রথম থেকেই অবহেলা করে যাচ্ছে সে! সে কি বোঝেনি ঐ বৃষ্টিভেজা মিষ্টি মুহূর্তে আদৃতের বলা প্রতিটা কথার অর্থ, প্রতিটা শব্দের পেছনে লুপ্ত অনুভুতি, আদৃতের প্রতিটা উচ্চারণের সময় তার চাহুনীর গভীরতা! নিশ্চই বুঝেছিল! তবে সে তাকে গ্রাহ্য করেনি!
এখন যখন তার সেই অগ্রাহ্যতা তারই কাছে ফিরে আসছে তখন তাকে কষ্ট পেলে হবে কেন?
হৃদিতা সয়ে নিল। দীর্ঘ এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গেল আদৃত ও সেই অপরিচিত মেয়েটির অশ্রাব্য কথোপকথন! তবে শোনা না গেলেও ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা হাসি দেখেই হৃদিতার মনমরা ভাবটা হু হু করে বেড়ে গেল!
হৃদিতা আর দাঁড়ালো না, হনহনে পায়ে সেখান থেকে চলে গেল, আদৃতের পাশ কাটিয়ে। আদৃত দেখেও দেখলো না!
হৃদিতা হয়তো একটিবারের জন্য আদৃতের কন্ঠে “হৃদ” দু অক্ষরের এই হৃদয়হরা সম্বোধনটা শুনতে চাইছিল!তবে তার ইচ্ছে পূরণই হলোনা!আদৃত ডাকলো না, একটিবার তাকালো না অবধি। হৃদিতার ভাঙা মনটা যেন কোন নিঠুর পাষাণ হাত আরো দুমরে দুচড়ে দিল। সেই ভেঙে টুকরো হওয়া মনটাকেই বহু কষ্টে বয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলো হৃদিতা। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুললেন টাপুর দেবী। মেয়ের চোখমুখের অমন শুকনো দশা দেখে কপালে হাত রেখে চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“হৃদ!মা!কি হয়েছে, চোখমুখের এমন অবস্থা কেন?শরীর খারাপ মা?”
হৃদিতা ক্লান্ত হেসে মাথা নাড়লো। তারপর আর কিচ্ছু না বলেই ধীর পায়ে চলে গেল নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে। দুহাতে মুখ ঢেকে কোন এক অজানা অচেনা নীলচে ব্যাথায় ফুঁপিয়ে উঠলো। চোখের ধারায় কোমল কপোল ভিজে নেয়ে একাকার হয়ে গেল। সেই জলটুকুই হয়তো হৃদিতার মনের গোপণ প্রণয় আভাসের সাক্ষী হয়ে রইলো যাকে কেউ দেখলো না, জানলো না। শুধু আড়ালে এক কিশোরীর মনের সুপ্ত প্রেমটুকু জেগে ওঠার প্রগাঢ় এক প্রত্যক্ষদর্শী রুপে নিজের ছাপ ফেলে উবে গেল বাষ্প হয়ে! মিলিয়ে গেল সিক্ত প্রণয়ের গভীর চিহ্নটুকু!
.
জোৎস্না রাত্রি! কাজল কালো আকাশের বুকে সমহিমায় বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সপ্তমীর একফালি বাঁকা চাঁদ।
সেই চাঁদকে ঘিরেই যেন ঐ গোটা আকাশের কোটি কোটি তারার সকল আকর্ষণ! আদৃত চোখ নামায় কালো আকাশের বুক থেকে!এই কৃষ্ণগগন যে তাকে তার কৃষ্ণমানবীটির কথা আরো বেশি করে মনে করায়! কি লাভ মনে করে। সে যে তার জন্য একবিন্দু অনুভুতিও রাখেনা নিজের মনে, একতরফা অনুভুতি, তাকে কি প্রেম বলা চলে?জানেনা সে! তপ্তশ্বাস ফেলে বাগানের দিকে তাকায়। সেখানের সাদা বাতিটাকে ঘিরে ছোট ছোট পোকার উড্ডয়ন এই দোতলা ঘরের বারান্দা থেকেও দেখা যায়। পাশেই একখানা শিউলি গাছ। ফুলও ফুটেছে অনেক! দুর থেকেই ভাদ্র বাতাসে ভেসে আসছে তাদের ঘ্রাণ।
আদৃতের চোখে আবারও ভেসে ওঠে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরিধেয় সেই নিষ্ঠুরতম নারীর কথা! সে চোখ বুজে নেয়! তবে লাভ কি?চোখের সামনে নিরন্তর যাতায়াত চলে হৃদিতার হাসি, হৃদিতার দুষ্টুমি, তার লজ্জা,তার রাগ সব,সবটা। আদৃতের দম আটকে আসতে চায়। ভালোবাসার এত তীক্ষ্ণ অনুভুতি গ্রাস করে নেয় সকল অভিমান। সব ভুলে নিজ মনেই বলে ওঠে,
“আপনি আমাকে কেন একটিবার জিজ্ঞেস করলেন না হৃদ!কেন?কেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে জোড় গলায় চাইলেন না আপনাকে মিথ্যে বলার উত্তর!চাইলে আমি আর লুকোতাম না। সব বলে দিতাম। বিশ্বাস করুন। আমার একটা ভুলের জন্য এত অসহ্য যন্ত্রণা, বুক জ্বালানো অবহেলা আমাকে না দিলেও পারতেন হৃদ।
কেন ভালোবাসলেন না হৃদ?কেন?ভালোবাসা কি খুব কঠিন ছিল?নাকি আমার যোগ্যতা ছিল না! এত এত প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলেন?এত ঘৃণা করতে পারলেন হৃদ?
আপনি আমার কল্পনার চাইতেও বেশি নির্দয় হৃদ।
তবে সবচেয়ে নির্দয় সত্যি কি জানেন, আমি এই নির্দয় আপনিটাকেই ভালোবাসি, ভীষণ বেশি ভালোবাসি!খুব!”

আদৃতের কন্ঠ কেঁপে উঠল। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে টলমলে চোখে পিছু ফিরতেই মিথ্যে হাসির মুখোশ পড়ে বলে উঠল,
“ছুটকি! তুই?কখন এলি?ডাকবিনা?বুঝতেই পারিনি!কিছু বলবি?”

অন্বেষা কাতর নয়নে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন অযথা হাসির অভিনয় করছিস দাভাই?তোকে চিনি আমি! বুঝি কোনটা তোর সত্যি হাসি আর কোনটা মিথ্যে। ”

আদৃত কথা বলেনা। চোখ নামিয়ে চুপ করে থাকে! অন্বেষা আবার প্রশ্ন করে,
“এতই যদি ভালোবাসিস তবে আজ দেখা হবার পরও কথা কেন বললি না?বল?এত ইগো তোর?”

আদৃত কাতর দৃষ্টি মেলে তাকায়। মলিন স্বরে উত্তর দেয়,
“এটা আমার ইগো নয়, ছুটকি!আমি ওকে ভালোবাসি! ও চাইলে হাজার বার ওর সামনে মাথা নোয়াতে পারি, হাজার বার ফেরার অনুরোধ করতে পারি। তবে সেটা শুধু তখনই যখন ও চায়!কিন্তু ও তো চায়ই না আমাকে।যে আমাকে চায়না তার জীবনে জোড় করে প্রবেশের ইচ্ছে আমার নেই।
আর কথা!ওর সাথে কথা বললে, ওর চোখের দিকে তাকালে আবার দুর্বল হয়ে পড়বো। না জানি তখন কি করে বসবো! তাই! এতে কোথাও ইগো নেই অনু!কোথাও না!”

অন্বেষা তপ্তশ্বাস ফেলে। তিক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“তোকে কে বললো, ও তোকে চায়না?ও বলেছে?”
আদৃত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে প্রত্ত্যুত্তর করে,
“না,ও বলেনি!তবে বুঝে গেছি! প্রথম দিন থেকেই ওর অবহেলা, পালিয়ে বেড়ানো, এসবই বুঝিয়ে দিয়েছে!”

অন্বেষা দুহাত কোমরে রেখে রাগী নয়নে তাকালো। তদাপেক্ষা রাগী স্বরে বলে উঠল,
“তোর মাথা আর আমার মুন্ডু বুঝেছিস!স্টুপিড!
মেয়েরা কার থেকে পালায় জানিস, কার সাথে লুকোচুরি করে বেড়ায় নিজের অনুভূতি নিয়ে?যাদের তারা বিশেষ অনুভব করে!আর সে বিশেষ অনুভূতি যাতে বিশেষ ব্যক্তির সামনে হুটহাট ধরা না পড়ে যায় সেই ভয়েই তাদের এমন পালাই পালাই!
আমি আজ ওর চোখে স্পষ্ট তোকে নিয়ে জেলাসি দেখেছি!টানা এক ঘন্টা বাজের চোখে দেখে গেছে আমাকে!আমার খুবই লজ্জা করছিল। ও তো আর জানেনা আমরা ভাইবোন, ঠিক উল্টো পাল্টা কিছু ভেবেছে।
আর তুই যখন ওর সাথে কথা না বলেই যচলে এলি পাশ দিয়ে, তখন ওর টলমলে চোখে উপচে পড়া কষ্ট দেখেছি আমি দাভাই!যেকষ্টে তুই পুড়ছিস,ঠিক সেই কষ্ট!
দেখ আমি তো একটা মেয়ে, তাই ফিমেইল ফিলিংস তোর চেয়ে একটু হলেও বেশি বুঝবো। আর আ’ম শিওর, আমি যা বুঝেছি তা একদম ঠিক!”

আদৃত অবাক দৃষ্টিতে অন্বেষাকে একপলক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“সত্যি বলছিস?শি ফিলস সামথিং ফর মি?”

অন্বেষা একগাল হেসে বলে,
“ইয়াহ্ ব্রো! ”

আদৃত হাসে!অনেকদিন পরে মন খুলে হাসে!অন্বেষা সে হাসিতে খুশি হয়। তারপরে আবারও ভীষণই গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“কিন্তু একটাই সমস্যা!”

আদৃতের হাসিতে উজ্জ্বল মুখখানি ফ্যাকাশে হয়ে যায় হঠাৎই!মলিন বদনে জিজ্ঞেস করে,
“কি সমস্যা? ”

অন্বেষা বহুকষ্টে হাসি চেপে রেখে বলে,
“এই যে আমি তোকে এত গ্রেট একটা ইনফরমেশন দিলাম,এর জন্য তোর কি উচিত না আমাকে কিছু দেয়া। এই ধর, আমি যদি এটা এখন না বলতাম, তো, দুজনেই সারাজীবন দেবদাস-দেবদাসী হয়ে থাকতি!সো ইউশ্যুড গিভ মি আ রিওয়ার্ড! ”

আদৃত হেসে ফেলে অন্বেষার মাথায় একটা গাট্টা মেরে শুধালো,
“ফাজিল!কি চাই বল!”

অন্বেষা আবারো বিস্তর একখানি হাসি আঁকে ঠোঁটের কোণে! পিটপিটে চোখে জবাব দেয়,
“একটা গান শোনা দাভাই!ফটাফট!আর গানটা অবশ্যই তোমার হৃদ মাঝারে যত্নে রাখা “হৃদকে ডেডিকেট করে!
গা গা,চটপট গেয়ে ফেল!”

আদৃত আবারো প্রসন্ন হাসে! ব্যালকনির এককোণে হেলান দিয়ে রাখা গিটারটা তুলে নেয় হাতে। দুহাতের আঙুলে তাতে সুর তুলেই গেয়ে ওঠে,

“দিন পাল্টায় রং বদলায়
অস্থির মন,
হাতের মুঠোয় ফেরারি সময়
শুধু শিহরণ,
ছায়া পথ ধরে হাতছানি কার
সেই পিছুটান,
তার কথা মনে পড়ে
তার কথা মনে পড়ে!

দিন পাল্টায় রং বদলায়
অস্থির মন,
হাতের মুঠোয় ফেরারি সময়
শুধু শিহরণ,
ছায়া পথ ধরে হাতছানি কার
সেই পিছুটান,
কার কথা মনে পড়ে
কার কথা মনে পড়ে।

রাত জাগা পাখি যায় ডেকে যায়
দীর্ঘ শ্বাস,
জোনাকিরা জ্বলে গাছের পাতায়
আলোর আভাস ।
পাশে পড়ে থাকা কবিতার খাতা
নীলচে আকাশ
কলমের রং গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে
স্তব্ধ বাতাস,
I Love You,I Love You!

ঝড় বয়ে গেছে পড়ে আছে শুধু
ছেঁড়া মাস্তুল,
ফিকে হয়ে যাওয়া কুয়াশার পিছে
উঁকি দেয় ভুল,
ছেঁড়া কবিতার পাতা গুলো সব
আজও অক্ষয়
হৃদয়ের কোণে ভালোবাসার শেষ
স্বাক্ষর ।
I Love You,Iove You!”

অন্বেষা এতক্ষণ পুরোটা শুনে যাচ্ছিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো!প্রতিটা লাইন, প্রতিটা শব্দই যেন চিৎকার করে জানান দিচ্ছিলো হৃদিতার প্রতি তার দাভাইয়ের প্রবল ভালোবাসার অস্তিত্ব!
আদৃত থামতেই অন্বেষা মুগ্ধতা ভরা আঁখিদুটি তাক করলো তার দিকে, নিদারুণ নিমগ্ন স্বরে শুধালো,
“খুব ভালোবাসিস তাই না?এত ভালো কিকরে বাসলি রে?এতটা ভালোবাসার সৃষ্টি হলো কি করে?”

আদৃত মুচকি হাসলো। গিটারটা নামিয়ে রাখলো পাশেই দেয়ালে হেলান দিয়ে! তারপর অসীম মুগ্ধতায় মোড়ানো নরম স্বরে প্রত্ত্যুত্তর করলো,
“সাধারণ চোখে দেখলে ওকে ভালো লাগার মতো হয়তো বা কিছু নেই,কিছু ছিলনা।
তবে ওকে খুব সাধারণভাবে দেখার সুযোগটাই আমি পাইনি।
আমাদের দেখাই হয়েছিল এক অসাধারণ পরিস্থিতিতে। সেইদিন, ওনার ভীতু চোখজোড়ার লেপ্টানো কাজল, ওনার মিষ্টি মিষ্টি দুষ্টুমি, ওনার সব অবাধ্যতা, সবটা তাদের সবটুকু দিয়ে মুগ্ধ করেছিল আমাাে, আকর্ষিত করেছিল নিজের প্রতি!
আমার মনে সবচেয়ে বেশি দাগকাটে, মাত্র ক’দিনের পরিচয়েই ঠাম্মির সাথে গড়ে ওঠা ওর বন্ডিংটা।
একটা মানুষের হৃদয় কতটা সরল হলে সে এমন অবাধে আপন করে নিতে পারে যে কাউকে?
সত্যি বলতে প্রথম ভালো লাগা সেটাই!
তবে বিষয়টাকে আমি নিছকই একটা মুগ্ধতা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম কেটে যাবে, তবে তা আর হলো কই!
অঘটন ঘটলো তার পরেরদিন, যখন ওনার বাড়িতেই ওনাকে আরো বিমুগ্ধ রুপে দেখলাম। সেই ভেজা চুলের ডগা থেকে গড়ানো বিন্দু বিন্দু জল, ভেজা কোমরে লেপ্টানো জামা, কালো টিপ পড়া কৃষ্ণ ললাট সবটাই যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে গেল আমায়! আমি প্রথমবারের মতো নির্লজ্জ চোখে কোন নারীর দেহের প্রতিটা বাঁকে বাঁকে চোখ বুলিয়ে গেলাম,আর ফলস্বরুপ মুগ্ধতার পরিমাণ বাড়লো, বৈ কমলো না!
লবণ চা খেয়েও সেই মুগ্ধতা বহরে বৃদ্ধি পেল!ভাবতে পারিস?
তারপরে আর কিছুতেই কমার নাম নিলনা, ওনার হাসি হাসি মুখ, চায়ে নুন মেশাবার পরে যে অপরাধী চোখে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে, সে ভয়ঙ্কর দৃষ্টি, আমার মুখে “হৃদ” শুনে লজ্জায় ওনার মুখ লুকোনো, সবটা বারবার ঘুরেফিরে এসে কেড়ে নিল রাতের ঘুম!আর সেই নির্ঘুম শান্তিহীন রাতের পরেই উনি বরাবরের মতো গেঁথে বসেলেন মনে। আমি সরাতে চেয়েও পারলাম না।
যেদিকে তাকাতে লাগলাম, শুধু আর শুধু ওনার মুখটাই ভেসে উঠলো ক্রমাগত!
অতঃপর আমি বুঝে গেলাম, আমি প্রেমে পড়ে গেছি,গভীর প্রেমে, প্রেমে পড়েছি বলেই তার সব কিছুতেই মুগ্ধতা এসে ছুঁয়ে যেত আমায়!ভালোবেসেছি বলেই নিজের সবটাতে তার অস্তিত্ব অনুভব করতাম অবিরত!”

অন্বেষা সবকথাই বিভোর হয়ে শুনলো। তারপরে আলতো হেসে বলে উঠল,
“পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনাই তবে রিপিট হলো,বল?দাদুর মতো তুইও নিজের কৃষ্ণকায়াকে আলটিমেটলি পেয়েই গেলি!”

আদৃত হালকা হেসে উত্তর দিল,
“উঁহু,দাদুর আর আমার কাহিনিটা একটু ভিন্ন। দাদু প্রেমে পড়েছিল বিয়ের পরেরদিন!মানে বিয়ের পর।তাই দাদুর প্রেমের রাস্তায় কোন বাঁধা ছিলনা।নিজেরই বউ ছিল ঠাম্মি!
কিন্তু আমি প্রেমে পড়েছি বিয়ের আগে। এবারে যার প্রেমে পড়লাম সে যে কি চায়, কেন চায় তা কিছুই বুঝিনা আমি। এমতাবস্থায় অন্যের মেয়েকে নিজের বউ করতে আমাকে প্রচুর খাটতে হবে বুঝলি!
মোট কথা দাদুর প্রেমটা রেডিমেট ছিল। আর আমারটাকে দরজি দিয়ে বানাতে হবে!”

অন্বেষা ফিক করে হেসে দিল!হাসলো আদৃতও!তারপরে কিছু মনে পড়েছে,এমন ভাবে বললো,
“আর আমার সে কৃষ্ণকায়া হবে না। তার থাকবে আমার দেয়া নিজস্ব সম্বোধন, একদম নতুন, একদম অনন্য!
কৃষ্ণকায়া যেমন কেবল আর কেবলই দাদুর। তেমনই আমার সেও শুধু আর শুধুই আমার হবে!”

অন্বেষা মাথা নাড়লো!তারপর ছোট একটা হাই তুলে বললো,
“অনেক রাত হলো দাভাই। যা ঘুমা!কাল তো সকালে কাজ আছে তোর!”

আদৃত ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাজ?কি কাজ?”
অন্বেষা আলসে ভঙ্গিতে জবাব দিল,
“হৃদের সাথে দেখা করতে যাবি!ওকে সব বুঝিয়ে বলবি!”

আদৃত হতাশ স্বরে বলে ওঠে,
“ও যা মেয়ে? শুনবে?আমি কিছু বলতে গেলে, না আমাকেই এটা সেটা বলে মেইন টপিক থেকে সরিয়ে দিয়ে যায়! খালি যত রাজ্যের উদ্ভট সব প্রশ্ন!”

অন্বেষা ঘাড় বাঁকিয়ে জবাব দেয়,
“উদ্ভট বলেই সে সরল দাভাই!মনে প্যাচ কষা মানুষেরা কখনো সরল,বোকা বোকা প্রশ্ন করতে পারেনা। তাদের সাজানো প্রশ্নের পসরা হয় জটিল থেকে জটিলতর।
তাই আমার মতে উদ্ভট-অদ্ভুত কাজকর্ম গুলো নিখাঁদ সারল্যের লক্ষণ! ”

আদৃত মাথা দুলিয়ে সায় জানায়। তারপরে বলে ওঠে,
“ওকে! ডান। চেষ্টা করব সবটা বোঝানোর। তবে কতটা কি বুঝবে, গড নোওস!”

অন্বেষা আস্বস্ত স্বরে বলে,
“ডোন্ট ওয়ারি,ঠিক বুঝবে!এবার চল আমি এলাম। গুড নাইট!”

আদৃত আবারো পিছু ডাকলো, অন্বেষা থামতেই বিমর্ষ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ছুটকি?এবারেও কি আবার ফিরে যাবি হোস্টেলে?এবার থেকে যা না। আর যাস না প্লিজ!”

অন্বেষা ফিকে হেসে জবাব দিল,
“এভাবে বলে আমাকে দুর্বল কেন করিস বলতো?তুই নিজেও জানিস, যে বাড়িতে আমার ঠাম্মি থাকে না, সে বাড়িতে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না।
তিন-চার মাস পরে আসি, দু-তিনদিন থাকি,তাও শুধু তোর আর দাদুর জন্য!এর বেশি কিছু সম্ভব নারে।
যদি কখনো ঠাম্মির শর্ত মেনে ওনাকে এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়!তবে সেদিনই ফিরবো বাড়িতে, একেবারেই!তার আগে না।
ঘুমিয়ে পড়।শুভ রাত্রী দাভাই!”

আদৃত কথা বাড়ায় না। কিছু খুঁজেও পায়না বলার মতো! শুধু রাগ হয় সেই পরিস্থিতির ওপরে, যার জন্য আজ গোটা পরিবারটা এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পরস্পরের থেকে!
.
শারদ প্রভাত!ঘুমন্ত পৃথিবী তখনো হালকা কুয়াশার চাদরেতে ঘেরা।সবুজ ঘাসের ওপরে সেই কুয়াশা চাদর ছিটিয়ে দিচ্ছে মুক্তর মতো শিশির কণা।
প্রথম ভোরের লালচে প্রভায় সেই মুক্তো শিশির চমকে উঠছে হীরক খন্ডের ন্যায়!
হৃদিতা জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে গেল সেই নব্য দিবসের সূচনা!
নির্ঘুমে ক্রন্দনরত চোখদুটো ফুলে টুলে বেহাল অবস্থা! উশকো-খুশকো চুলের কোন বিন্যাস নেই!সব এমন ছন্নছাড়া!
হৃদিতা আজ আর বিছানা থেকে নামলো না। অন্য সব দিনগুলোর মতো বিছানা ঠিক করে, ফ্রেশ হয়ে অগোছালো চুলগুলো বাঁধলো না।
কেমন পাথরের মতো বসে রইলো চুপচাপ! ঘড়ির কাটা গিয়ে যখন একে একে সাড়ে আটের ঘরে থামলো, তখন গিয়ে মনটা কেমন কু ডাকলো টাপুর দেবীর।
মেয়েটা এখনো, বেরোচ্ছে না কেন?কিছু হলো কি? দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল হলো মাতৃহৃদয়। ছুটে গেল মেয়ের ঘরের সামনে।
না! দরজা বন্ধ করেনি!চাপানো শুধুই। কালরাতে খেতে ডাকতে এসে যখন দেখেছিলেন চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে, তখন উনিই ভিড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন!
টাপুর দেবী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন!হৃদিতা তখনও জানালার কাছে বসা,তবে এখন কপালটা জানালার গ্রিলে ঠেকিয়ে রেখে চোখের পলক বুজে নিয়েছে! টাপুর দেবী মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ডাকেন,
“হৃদ!মা!ওঠ?কলেজে যাবিনা?সাড়ে আটটা বাজে!ওঠ!”
হৃদিতা সাড়া দেয়না। টাপুর দেবী এবারটা ভয় পান। কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়েটার কপালে হাত দিতেই আৎকে ওঠেন খুব! মেয়েটার ভীষণ জ্বর!তিনি একপ্রকার চেঁচিয়ে ওঠেন,
“হৃদের বাবা!শুনছো!একবার এদিকে এসো না!হৃদের যে খুব জ্বর!”
.
মেঘকুঞ্জ!সকালের আবছা কুয়াশা যেন মেঘের মতোই ঘিরে রেখেছে তাকে!সেই মেঘের পরত ভেদ করে ভেতরে ঢুকছে সোনালী রোদ!শিশির ভেজা শিউলি গুলো শানবাঁধানো গাছের গোড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খুব অনাড়ম্বড়ে!
আদৃত সেদিকেই এগিয়ে গেল। খুব ধৈর্য নিয়ে খুটে খুটে কুড়িয়ে নিল সবকটা ফুল!তারপর সেগুলোকে রাখলো মাঝারি আকৃতির ফুলের সাজিটায়!
সুঁইয়ের ছিদ্রে সুতো ভরে খুব মনোযোগ দিয়ে জীবনের প্রথম বারের মতো গাঁথলো শিউলি মালা। প্রিয়তমাকে দিতে চাওয়া সেই উপহারটুকুর বিনিময়ে পরপর টানা পাঁচবার সুঁই বিঁধলো হাতে। তবে তাতে প্রেমিকহৃদয় টললো না। অনাভ্যস্ত হাতেই গেঁথে নিল মালাটি!শিউলির জন্য শিউলি!

আদৃত সেদিন আর কোন কাজেই গেলনা। সেই সকাল বেলা গিয়ে দাঁড়ালো হৃদিতার বাড়ির সামনের পাঁকা রাস্তার মোড়টায়! সকাল গড়ালো, ঘড়ির কাটা আবর্তন করে গেল যথারীতি! সূর্য মাথার ওপরে উঠলো একটা সময়! প্রখর তাপে শরীর ঘেমে নেয়ে এক,তবুও আদৃত এক পাও নড়লো না। ওভাবেই অপেক্ষা করে যেতে লাগলো কাতরভাবে!! তবে সেই কাতর প্রেমিকমন জানলো না, যে রমণীর তরে তার এই কাতরতা,এমন ব্যাকুলতা!সে নিজেই এখন প্রবল জ্বরে কাতর!
প্রেমিকপুরুষের অপেক্ষার অবসান আর তার করা হয়ে উঠলো না!
ঘড়ির কাটা যখন দুপুর দেড়টার ঘরে যাবার প্রস্তুতি নিল, ঠিক তখন আদৃতের মনে হলো,হৃদিতার হয়তো কিছু একটা হয়েছে! এমন মিড টাইমে কলেজ অকারণে মিস করার মতো মেয়ে সে না!
আদৃত আর কিছু ভাবলো না। ছুটে চলে গেল হৃদিতার বাড়ির পথে!তার প্রিয়তমার সাথে সাক্ষাৎ না করে আজ সে যাবে না, একদম না!
.
ভাদ্রের উত্তপ্ত দুপুর!সেই দুপুরের উত্তাপের চেয়েও বেশি উত্তপ্ত রায়বাড়ির পরিবেশ! থমথমে মুখে মেয়ের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ঋতমবাবু ও টাপুর দেবী! চোখমুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে দুশ্চিন্তা! হঠাৎ জ্বর কেন হলো মেয়েটার?
ডক্টর বোস হৃদিতাকে ভালো মতো চেকআপ করে নিয়ে ঋতমবাবুর দিকে তাকালেন। কান থেকে স্টেথোস্কোপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন,
“তেমন কোন ভয় নেই ঋতম!সিজনাল জ্বর!তবে ও বেশ অনিয়ম করছে মনে হচ্ছে। ঠিকঠাক মতো ঘুম আর খাওয়াদাওয়া কিছুই হচ্ছে না। এজন্যই শরীরটা বেশি দুর্বল হয়ে গেছে। আর দুর্বলতার জন্যই ইমিউন সিস্টেম হঠাৎ ফিভার দ্বারা আক্রান্ত হলো!
ওর প্রতি একটু কেয়ার করবি!দেখেশুনে রাখবি,আর কটা মেডিসিন দিচ্ছি সেসব নিলেই দুদিনে ঠিক হয়ে যাবে।
টেনশন নিস না।
আজ তবে আমি আসি!”

ঋতমবাবু ঘাড় নাড়িয়ে এগিয়ে যান ডক্টর বোসের পিছু পিছু। ওনাকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে টাপুর দেবীকে ডাকেন,
“হৃদের মা?একটু দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে যাও না!আমি মোড়ের ফার্মেসীর দোকানটা থেকে প্রেসকিপশনের ওষুধ গুলো নিয়ে আসি।
মেয়েকে দেখে রেখ। পারলে কপালে একটু জলপট্টি দিয়ে দাও!”

টাপুর দেবী বেরিয়ে আসেন। মাথা নেড়ে সায় জানিয়েই উঠিয়ে দেন দরজার সিটকিনি!
ঋতমবাবু বেরিয়ে পড়েন!কাঁচা রাস্তাটা পেরিয়ে মোড়ের সামনে পৌঁছতেই আদৃতের সাথে দেখা হয় ওনার।
উনি অবাক নয়নে খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্নাত্মক চাহুনী নিক্ষেপ বলে ওঠেন,
“আরে আদৃত যে!কি ব্যাপার?এদিকে যে হঠাৎ!কোন দরকারে?”

আদৃত যেন পড়ে গেল অথৈ সমুদ্রে। হঠাৎ ঋতমবাবুর সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় চট করে কোন উত্তর পেলনা দেবার মতো! কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে উত্তর দিল,
“না মানে,আঙ্কেল! আসলে এমনিই একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম এদিকটায়। এদিকের পরিবেশটা তো খুব প্রিয় আমার।তাই আরকি!আবব আপনি আজ এখনো বাড়িতে আঙ্কেল, অফিসে যাননি?”

ঋতমবাবু বিমর্ষ চোখে চাইলেন, তদাপেক্ষা বিমর্ষ কন্ঠে বললেন,
“না বাবা!আসলে হৃদের আজ সকাল থেকেই হঠাৎ ভীষণ জ্বর এসেছে বুঝলে। ওর মা সকাল থেকে বডি স্পঞ্জ করে, জলপট্টি দিয়ে, মাথায় জল ঢেলেও সে জ্বর নামার নাম নেই!সেই যে শুরু থেকে ১০৩° তে গিয়ে থামলো, এখনো তাই!হঠাৎ এত জ্বর কেন এল সেটাই বুঝলাম না। পরে ডক্টরকে ডাকলাম। ও এসে দেখে গেল মাত্র।
সেসব ওষুধ আনতেই যাচ্ছি! ”

আদৃত চমকে তাকালো!”হৃদের জ্বর”দু শব্দের এই বাক্যটাই পৃথিবীর সবচেয়ে তিক্ত বাক্যের তকমা পেয়ে গেল মুহুর্তেই!খনিক ফ্যালফ্যালে শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঋতমবাবুর মুখপানে।তারপর খুবই করুন কন্ঠে শুধালো,
“আমি একটু দেখে আসি আঙ্কেল? ”
ঋতমবাবুর অভিজ্ঞ চোখ আদৃতের চোখে মুখে কেমন যেন বিষাদের ছাপ দেখতে পেলেন। ওনার হুট করেই মনে হলো, “হৃদের জ্বর” এই সত্যিটা তাদের মতো আদৃতের কাছেও তিক্ত,ভীষণ অপ্রিয়।
কিন্তু পরক্ষণেই কৌতুহলী মন প্রশ্ন সাজালো,
“হৃদ তো আমাদের আপন, তার কষ্ট সইতে না পারাটা আমাদের জন্য স্বাভাবিক। তবে আদৃত?তার সাথে তো হৃদের কোন সম্পর্ক নেই! তবে?তবে কিসের এত বিষাদ ছেলেটার চোখে!যেন জীবনের প্রিয়দের মাঝে অন্যতম প্রিয় কারো অসুখ করেছে!”

ঋতমবাবু কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে ভাবলেন, আর যখন ভাবনা তার ফল দিল তখন তিনি চমকিত চোখে আদৃতের দিকে তাকালেন, আদৃতের চোখেমুখে তখনও বিষাদের ছায়া,নিদারুণ অনুরোধ! ঋতমবাবু আগুপিছু না ভেবেই শুধালেন,
“তুমি কি হৃদকে পছন্দ করো আদৃত?
না মানে খারাপ ভাবে নিও না সরাসরি জিজ্ঞেস করার জন্য, তবে আমার সিক্সথ সেন্স বলছে ইউ বোথ লাইক এন্ড লাভ হৃদ!অ্যাম আই রাইট ইয়াং ম্যান?”

আদৃতের চোখেমুখে কোনরুপ লুকোচুরির ছাপ পাওয়া গেলনা। অত্যন্ত সপ্রতিভ স্বরে সে প্রত্ত্যুত্তর করলো,
“ইয়েস আঙ্কেল, ইউ আর রাইট!আই লাভ হৃদ!”

ঋতমবাবু হালকা হেসে বললেন,
“বাড়ি গিয়ে বসো আদৃত। আমি মেডিসিন নিয়ে ফিরে এ নিয়ে কথা বলবো!”

আদৃত মাথা নাড়লো। বাধ্য ছেলের মতোই চলে গেল ওনাদের বাড়ির পথে!
ঋতমবাবু নিজের মনেই হেসে বলে উঠলেন,
“হৃদ!অবশেষে তোর জীবনসাথীকে পেয়ে গেলিই তুই মা!সুখী হ!আদৃতের চোখে তোর জন্য যে ভালোবাসা দেখেছি তা মিথ্যে হতে পারেনা!কখনো না!”
.
আদৃত গিয়ে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুললেন টাপুর দেবী।দু হাত ভেজা! সম্ভবত জলপট্টি দিচ্ছিলেন!আদৃতকে দেখে সপ্রতিভ হাসলেন। কোমরে গুঁজে রাখা আচলটা ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে হাত মুছতে মুছতে বললেন,
“এসো বাবা,ভেতরে এসো!”

আদৃত ভেতরে ঢুকলো!টাপুর দেবী আবারো বলে উঠলেন,
“উনি ফোন করে জানালেন অবশ্য আমায়,বললেন তুমি আসবে!এসো বসো!আসলে হৃদটার হঠাৎ জ্বর আসাতেই একটু দুশ্চিন্তায় তো সবাই!তোমায় চা দিই বাবা?”

আদৃত হালকা হেসে উত্তর দিল,
“না না আন্টি!আমি ঠিক আছি। চা টা কিছু লাগবেনা। আমায় নিয়ে অত ব্যস্ত হবেননা।
আমি একটু হৃদকে দেখতে এসছি!আঙ্কেলের সাথে রাস্তায় দেখা,বললেন হুট করেই জ্বর বাঁধিয়েছে!সেজন্যই!”

টাপুর দেবী আবারও প্রশস্ত হাসলেন। হৃদিতার ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,
“এসো আমার সাথে! ”
আদৃত অনুসরণ করলো!হৃদিতার ঘরে গিয়ে বসতেই কলিংবেলটা বেজে উঠল আবারো।টাপুর দেবী ব্যস্ত হয়ে চেঁচালেন,
“যাই!”
তারপরে আবারো আদৃতের দিকে ফিরে সহাস্য কন্ঠে বললেন,
“তোমার আঙ্কেল এলো বুঝি। তুমি একটু বোসো বাবা!আমি আসছি!”
আদৃত সম্মতি জানালো চোখের পলক ফেলে! টাপুর দেবী চলে যেতেই হৃদিতার মাথার ওপরে হাত রেখে খুব আস্তে কাতর স্বরে ডাকলো,
“হৃদ!”
হৃদিতা চকিতে তাকালো!জ্বরের ঘোরে চোখ মেলে রাখা দায়!নিজের দেহের উত্তাপ জ্বালিয়ে দিচ্ছে নিজেরই চোখজোড়া, তবুও হৃদিতা চাইলো!তার বহুকাঙ্ক্ষিত সেই কন্ঠে আরো বেশি আকাঙ্ক্ষিত সম্বোধন তাকে চোখ মেলে তাকাতে বাধ্য করলো! হৃদিতা প্রথমটায় ভেবে নিল ঘোর!সে জ্বরের ঘোরে আদৃতকে হ্যালুসিনেট করছে। তাই ভেবে সে ফিচেল হেসে বলে উঠল,
“আজ কেন আবার আমার কল্পনা হয়ে এলেন আদৃতবাবু?কালতো কত নিষ্ঠুরভাবে এড়িয়ে গেলেন আমাকে!একটিবার ফিরেও তাকালেন না!কালো মেয়ের ওপর থেকে মোহ কেটে গেছে তাইনা?”

আদৃত মৃদু হাসলো, জ্বরের ঘোরেই যে উল্টোপাল্টা বকছে তা বুঝতে পেরে উত্তর দিল,
“আপনার থেকেই তো শিখেছি হৃদ!হুটহাট কাউকে এড়িয়ে যেতে হয়,কিকরে, সেসব তো আপনার কাছেই শেখা!”

হৃদিতাও হাসে!প্রায় বুজে আসা চোখে উত্তর দেয়,
“কল্পনার আপনিও দেখি ঝগড়া করেন আদৃতবাবু,সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপান!আপনি কেন মিথ্যে বললেন আমাকে?
প্রথম দিনগুলো,তখন তো এড়িয়ে যেতাম লজ্জায়,যদি আমার চোখ পড়ে বুঝে নিতেন আমার সুপ্ত অনুভুতি!
কিন্তু দিদার অসুস্থতার দিনের পর থেকে এড়িয়ে গেছি অভিমাণে!প্রথম প্রথম মিথ্যে বলার জন্য ঘৃণা জন্মেছিল আপনার ওপরে!তবে তা ক্ষণস্থায়ী হয়ে দীর্ঘস্থায়ী হলো সেই অযাচিত অভিমানটাই।
কতবার সেই অভিমান কাটিয়ে আপনার নাম্বারটাতে কল করতে চেয়েছি, কিন্তু শেষ অবধি পারিনি!
তবে, আপনিও তো অভিমাণ ভাঙানোর চেষ্টা করেননি!তাহলে?”

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনলেন ঋতমবাবু ও টাপুর দেবী!
টাপুর দেবী কিছু বলতে নেবেন তার আগেই ঋতমবাবু ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
“এখান থেকে চলো হৃদের মা!ওদের একা থাকতে দাও কিছুক্ষণ!তোমার মেয়ের জ্বর সারানোর আসল মেডিসিন এসে গেছে। এখন আর সত্যিই চিন্তা নেই!”
টাপুরদেবী মুচকি হেসে ঘাড় নাড়ান। খুব সন্তর্পণে সরে যান দরজার সামনে থেকে, পাছে আদৃত তাদের দেখে ফেলে অস্বস্তিতে ভোগে!

হৃদিতার কথা শুনে আদৃত খুব নরম স্বরে বলে ওঠে,
“আমি যে আমার হৃদের অভিমাণ বুঝিনি, তাকে আগলে রাখিনি,তার আদর আদর অভিমানটুকু ভাঙানোর চেষ্টা করিনি,তারজন্য হৃদের প্রেমিকপুরুষ সরি!খুব করে সরি!
হৃদ কি পারেনা তাকে ক্ষমা করে দিয়ে আরেকটিবার ভালোবাসার সুযোগ করে দিতে!”

হৃদিতা দুর্বল হেসে জবাব দেয়,
“কেন পারবেনা!খুব পারে!তবে আপনি যে হৃদের কল্পনার আদৃত,আদৃতবাবু!বাস্তবের আপনি তো কখনো এমন করে বলেন না!তাহলে সুযোগটা কিকরে পাবেন?কল্পনাকে কি সুযোগ দেয়া যায়! ”

আদৃত হাসে। হঠাৎই মাথা নুঁইয়ে করে বসে এক নিষিদ্ধ কর্ম!ঠোঁট ডাবিয়ে চুমু আঁকে হৃদিতার কপালে। জ্বরের তাপে কপাল তখন ভীষণ গরম। সেই গরম ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়েই কেঁপে ওঠে আদৃত। এত জ্বর উঠেছে বুঝতেই পারেনি!
কেঁপে ওঠে হৃদিতাও!চোখ মেলে পিটিপিট করে তাকায় আদৃতের মুখপানে!তারপরে ছলছলে চোখে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি বাস্তব আদৃতবাবু?”
আদৃত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।উপহার দেয় এক দুর্বোধ্য হাসি!সেই হাসিতেই হৃদিতার সবটুকু কষ্ট,সব জ্বালা,সব যন্ত্রণা যেন মিলিয়ে যায় দুর অজানায়!মনের মাঝে ভর করে প্রগাঢ় প্রশান্তি।
পরক্ষণেই আদৃতের আরো দুটি হৃদয়কাঁপানো অধর স্পর্শ নিজের উত্তপ্ত কপোল যুগলে আবিষ্কার করে লজ্জায় মিঁইয়ে যায় হৃদিতা!
আদৃত জলপট্টির বাটিটা থেকে ভেজা কাপড়ের টুকরোটা তুলে নিয়ে বসিয়ে দেয় হৃদিতার কপালে। অদ্ভুতভাবেই বেশ ক’বারেই উত্তাপ কমে আসে কিছুটা। হৃদিতার মনে হয়, মনের শান্তিই মুখ্য। মন যখন শান্ত হয়,তখন যে শরীরে কোন কষ্টই দীর্ঘক্ষণ বাসা বাধতে পারেনা, তা স্পষ্টত প্রমাণিত আজ!

হৃদিতার শরীরের তাপ খানিকটা কমে এলে আদৃত টেম্পারেচার চেক করে। কিছুটা কমেছে, তবুও অনেক!১০২°!
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“এবারে আমি আসি!আঙ্কেলকে বলি তোমার মেডিসিন গুলো দিয়ে দিতে। খেয়ে একটু ঘুমোও।
ভয় নেই, আর এড়াবো না। সে সাধ্যই নেই আর! ”

হৃদিতা লাজুক হাসে। আদৃত যেতে গিয়েও যায় না। ফিরে এসে আবারো দাঁড়ায় হৃদিতার সামনে। পকেট থেকে কাগজে মুড়িয়ে রাখা শিউলি মালাটা বের করে খুব ধীরে,অতি যত্নে!সারাদিনের পরে সব ফুলই কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। চাপ লেগে ছিড়ে পড়েছে পাপড়ি!আদৃত তাই এগিয়ে দেয় হৃদিতার দিকে। হৃদিতা তাকায় একবার।
তারপরে প্রসারিত হেসে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি গেঁথেছেন!”
আদৃত হালকা হেসে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলে!হাসে হৃদিতাও!দুর্বল হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেয় লুটিয়ে পড়া মালাটাই। খুব করে ঘ্রাণ নেয় নাকের কাছে এনে!ভীষণ মিষ্টি। ফুল নেতিয়ে গেলেও সুগন্ধটুকু মিঁইয়ে যায়নি ভেবেই হাসে!আদৃত সে হাসি দেখে শান্তি পায়!দু চোখ ভরে কেবল দেখে যায়, এক ম্লান শিউলিকে ঘিরে অপর এক ম্লান শিউলির আহ্লাদ!

#চলবে!

[আমি কথা রেখেছি!তিন পর্বই দিলাম একসাথে!
এবার আপনারা যদি এই দীর্ঘসময়ের পরিশ্রমটুকুর কথা মাথায় রেখে, এই পর্বসমূহ পড়ে আপনাদের অনুভূতিটুকু দু-এক লাইনে হলেও আমাকে জানান, তবে খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো।
আসলে আমার মনে হচ্ছে উপন্যাসটা শুরু করা ভুল হয়েছে আমার। তবুও শুরু করেছি যখন তো, শেষ তো করতেই হবে!তবে লেখার আগ্রহটা কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে!
এমতাবস্থায় আপনাদের থেকে একটু আধটু গঠনমূলক মন্তব্য কি আমি আশা করতে পারিনা?
জানিনা ঠিক,হয়তো খুবই অন্যায় আবদার করে ফেললাম!দুঃখিত!

এত বড় পর্ব, লিখতেই ছয় ঘন্টা লেগে গেছে!রি-চেইক করার আর সময় পাইনি তাই!ধন্যবাদ সবাইকে।ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করা হলো!]

[পেজের সবাইকে রিয়্যাক্ট করার জন্য অনুরোধ করা হলো!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here