#প্রিয়ংবদা
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়
২৩.
সময় বয়ে চলে তার আপন গতিতে!চোখের পলকেই তা ফুরিয়ে যায় কর্পুরের মতোন!কেটে যায় নিমেষেই!
কাদম্বিনী দেবী মেঘকুঞ্জে ফিরেছেন সপ্তাহের মতো হবে!মেঘকুঞ্জ আবারও মেতে উঠেছে আগের মতো!হাসি-আনন্দ খেলা করে বেরাচ্ছে তার প্রতিটা কোণে।বহুদিনের জমানো দূরত্বটুকু কেমন এক লহমায় মিটে গেছে প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের।
বাইরের মতো, মেঘকুঞ্জের ভেতরটাও এখন সমানতালে ঝলমলে,রঙিন,প্রাণবন্ত!
কাদম্বিনী দেবী বহুদিন পর নিজের হাতে সাজানো ছাদটায় পা রেখেছেন।অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন স্বামীর কাছে জেদ করে যে পদ্মফুলগুলো লাগিয়েছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।আজও সেই কৃত্রিম ছোট্ট পদ্মপুকুরটি ঠিক আগের মতোই পরিষ্কার, স্বচ্ছ! ইটের দেয়ালের গায়ে এক বিন্দু শ্যাওলা অবধি নেই! এতগুলো দিন যে তিনি এর কাছে এসে যত্ন করতে পারেননি তবুও।
কাদম্বিনী দেবী জানেন কাজটা আশুতোষবাবুরই!তার স্ত্রীর প্রিয় কোন কিছুকেই অবহেলা করেন না তিনি,পারেনইনা!
চিন্তার মাঝেই বিকেলের সূর্য অস্ত যায়! পশ্চিমাকাশের প্রতিটা কোণে ছড়িয়ে পড়ে লালচে আবীর!ঘরফিরতি পাখিরা উড়ে চলে সেই আবীররাঙা রক্তিম গগণের পথ ধরেই!প্রত্যেকের মাঝেই আপনঘরে পৌঁছবার তাড়া!যেন পৌঁছতে পারলেই শান্তি!আসলেই তো শান্তি!
কাদম্বিনী দেবীও বোঝেন সেই শান্তির অর্থ!গোটা তিনটে বছর,এতগুলো দিন বাদে তিনিও যখন প্রথম পা রাখলেন নিজের সাজানো বাড়িটায়,তখন ঠিক এমনি এক শান্তিময় আবহ খেলে গিয়েছিল তার অন্তরে!মনে হয়েছিল এর চেয়ে শান্তি হয়তো আর কিছুতেই নেই!কিছুতেই না!
নীরহারা বিহঙ্গের নীরে ফেরার আনন্দই যে আলাদা,সর্বাপেক্ষা অন্যরকম!
কাদম্বিনী দেবী এসবই ভেবে যায় একমনে,একধ্যানে!!
ভাবনার সুতো কাটে আশুতোষবাবুর কথায়!তিনি পেছনে থেকে ডেকে ওঠেন,
“কৃষ্ণকায়া!”
কাদম্বিনী দেবী পিছু ফেরেন। স্বামীর দিকে মুখ তুলে চেয়ে আলতো হেসে বললেন,
“বলুন!”
আশুতোষবাবু স্নিগ্ধ হাসলেন।মিষ্টি কন্ঠে বললেন,
“কি ভাবছো এত?এত ভাবনা চিন্তার কি দরকার?চলো তো নিচে চলো। বৌমা চা করেছে!তুমি সন্ধ্যাআরতি করলেনা আজ?”
কাদম্বিনী দেবী হালকা হাসলেন।প্রত্ত্যুত্তর করলেন,
“বৌমাই তো করলো এতদিন ধরে।ওই করুক!এ সংসারের ভবিষ্যৎ কত্রী তো সেই।বর্তমানও!তাকে তো নিজের অধিকারগুলো ছেড়ে দিতে হবে ধীরে ধীরে!তাইনা?”
আশুতোষবাবু ব্যথিত নয়নে তাকান!কাতর স্বরে শুধান,
“এখনও কি অভিমাণ করে আছো তুমি কৃষ্ণকায়া?”
কাদম্বিনী দেবী দুর্বোধ্য হেসে না-সূচক মাথা নাড়লেন।নরম স্বরে বললেন,
“অভিমান করিনি!তবে এ সংসারের নিয়মই হলো সময়ের ব্যবধানে আমাদের সকলকেই নিজ নিজ স্থানটুকু ছেড়ে দিতে হয়!আমার বয়স হয়েছে!আজ আছি কাল নেই!আমার পরে সব দায়িত্ব তো বৌমারই!তাই পরে যখন দায়িত্ব ওর কাঁধেই পড়বে, তখন এখন থেকেই আস্তে আস্তে দায়িত্ব গুলো সামলানোর অভ্যেস করে নিক!একটা বয়সের পর আমাদের সবারই বিশ্রামের প্রয়োজন হয়!তাছাড়া এ তিনবছর তো ওই সামলেছে সব!আমার বিশ্বাস, ও এখনো পারবে!যখন পেরে উঠবেনা নিতান্তই তখন নাহয় আমি করবো, নিজের করণীয়!তাছাড়া হৃদিতা দিদিভাই তো আসছেই ক’দিন পরে!ও আসলে তো ও নিজেই সাহায্য করে দিতে পারবে!বৌমার সমস্যা হবার কথা না!
আমি অভিমান করে নেই! শুধু ইচ্ছে করছিল একটু নিভৃতে থাকতে!এ বাড়ির প্রতিটা কোণে আপনার আর আমার কত কত স্মৃতি লুকিয়ে আছে বলুন!সবার সামনে তো সেসব স্মৃতিচারণ হয়না।কিছু কাজ একান্ত নিভৃতে করতে হয়!সবার চোখের আড়ালে। আপনার আমার স্মৃতিগুলোও তেমন!তাদের সবার মাঝে অনুভব করার চেয়ে গোপণে অনুভব করায় বেশি স্বস্তি,বেশি শান্তি।
বুঝলেন মশাই!”
আশুতোষবাবু হাসলেন,স্নিগ্ধতাভরা হাসি!কাদম্বিনী দেবীর হাতজোড়া এক পলকেই করে নিলেন আপন মুঠোবন্দি! জিজ্ঞেস করলেন,
“বুঝেছি!তো কি স্মৃতির ডায়েরীর কোন পাতায় হারিয়েছিলেন মহারাণী?শুনি!সেসব স্মৃতিতে কিন্তু আমারো মালিকানা আছে।আমাকেও জানাতে হবে!নাহলে তো আমি মানবো না!তখন অবরোধ চলবে।প্রণয়ের অবরোধ!”
কাদম্বিনী দেবী শিশুসুলভ হাসেন।তার হাসির খিলখিল ধ্বনিতে মুখরিত হয় পুরো রক্তিম আকাশ,সায়াহ্নবাতাস আর সামনে দন্ডায়মান তার প্রেমিকপুরুষের মন!
আশুতোষবাবু পুনরায় বলে ওঠেন,
“এভাবে হাসবে না!এভাবে হাসলে এত বছর বাদেও নিজের যৌবনের সব স্মৃতিগুলো চোখের সম্মুখে ভাসে আমার!বারবার মনে হয় এই অপরুপ কৃষ্ণরমণীটি আমার,একান্তই আমার!যার কালো চোখের মায়ায় আমি নিজেকে হারিয়েছি অজস্রবার,যার হৃদয়হরা চাহুনিতে আমি মরেছি অগুন্তিবার, যার খিলখিল হাসির শব্দে আমি প্রেমে পড়েছি প্রতিবার,প্রতিমুহূর্তে!
আর ভালোবেসেছি আমার কৃষ্ণকায়াকে, আমার হৃদয়রাজ্যের একমাত্র সম্রাজ্ঞীকে!”
কাদম্বিনী দেবী লজ্জা পান।বিবাহ,সংসারজীবনের এত বছর পরও স্বামীর মুখনিঃসৃত এমন প্রণয় বাক্যে বারংবার কম্পিত হন একদম নববধূর মতোই!প্রতিটা অনুভূতি,প্রতিটা শব্দ সবই পুরোনো,বহুবার শোনা,বহুবার অনুভূত তবুও কত নবীন,কত রঙিন!
ভালোবাসার যে ক্ষয় হয়না, তা চিরযৌবনা বলেই হয়তো এমন!
আশুতোষবাবু এবারে ফিচেল হেসে বলেন,
“আমার এক সন্তানের মা হয়েও তোমার এত লজ্জা, তা দেখেই তো আমি অবাক কৃষ্ণকায়া!
অথচ আমার ইচ্ছে ছিল আমাদের আরও দু-তিনটে ছেলে-মেয়ে হোক। বেশ সারাবাড়িময় তারা ছোটাছুটি করে বেড়াতো।বিষয়টা ভালো হত না।
সে তো নেহাতই ডাক্তারবাবু বললেন,তোমার আর সন্তান না নেয়াই ভালো, শরীর দূর্বল,ধকল না নিতেও পারো,তাই সেসব ইচ্ছেকে বাক্সবন্দি করে দিলাম।
আজ মনে হচ্ছে, যদি তেমন হতো, আরো ক’টা বাচ্চার পরিকল্পনা করতাম,তবে তো তোমাকে লজ্জায় খুঁজেই পাওয়া যেতনা। ”
কাদম্বিনী দেবী এবারে প্রতিবাদের সুর তুলে বলেন,
“মোটেও তেমন না। যান!আপনি খুব খারাপ!শুধু লজ্জা দেন!বুড়ো বয়সে ভিমরতি এই একেই বলে বুঝলেন।
আপনার দেখাদেখি রাজ্যের ফাজিল হয়েছে আপনার নাতিটাও!দিদিভাইকে প্রথম দিন সে তুলে নিয়ে গেছিলো,আমার সাথে কথা বলতে আসতো বলে! ভাবতে পারেন!
আর তাকে তুলতে গিয়ে নিজে পড়লো দিদিভাইয়ের প্রেমে! আপনার নাতিও যে মেয়েটাকে এমন করেই জ্বালায় তা কি আমি বুঝিনা!ঠিকই বুঝি। নেহাৎ মেয়েটা ভদ্র বলে বলেনা কিছু!
আপনারা দুটোই সাংঘাতিক!
দাদুভাইয়েরটা নাহয় তবু মানা যায়! কিন্তু আপনি?বলি বয়স কত হলো আপনার?এই বয়সে এসব কথা বলেন, লজ্জা টজ্জা কি নেই?”
আশুতোষবাবু হঠাৎ করেই করে ফেলেন ভাবনাতীত এক কাজ!কাদম্বিনী দেবীর হাত জোড়া মুক্ত করে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ান!আটপৌড়ে করে পড়া শাড়ির আচল দিয়ে মাথায় দেয়া ঘোমটাটা ফেলে দেন আচমকাই!সাদাপাকা চুলে বাধা খোপাটাও খুলে দেন একটানে!সারা পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে আধপাঁকা এলোকেশ!আশুতোষবাবু আকড়ে ধরের স্ত্রীর কোমড়, চিবুক ঠেকান কাঁধে!তারপর বিভোর স্বরে বলেন,
“কৃষ্ণকেশী কৃষ্ণকায়ার কৃষ্ণ আঁখির প্রেমে যে প্রেমিকমন একবার মজে, তার লজ্জা পেতে নেই!তার কেবল ভালোবাসতে জানতে হয়,শুধুই ভালোবাসতে!”
কাদম্বিনী দেবী লজ্জায় নুঁইয়ে পড়েন।তবে বাঁধা দেন না। এই মানুষটার বুকেই যে তার জন্য একপৃথিবী ভালোবাসা লুকোনো!সেই অসীম প্রণয় থেকে কি শুধুমাত্র লজ্জার জন্য দূরে সরে থাকা যায়? একদম যায় না!
আশুতোষবাবু আবার বলেন,
“তুমি আমার সারাজীবনের সাথী কৃষ্ণকায়া,আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা, প্রণয়ানুভূতির একমাত্র অধিকারিণী! আমার স্বপ্ন কি জানো?তুমি!আমার দিবা-রাত্রী সব তুমি!আর তোমার ছায়াসঙ্গি আমি কৃষ্ণকায়া!আজ এই যে এত এত বছর পরেও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আজও একইরকম,আগের মতোন!একটুও কমতি হয়নি তাতে!বিন্দুপরিমাণও না।
আমার জীবণের সবচেয়ে প্রিয় সত্যি কি জানো কৃষ্ণকায়া?জানোনা হয়তো!
আমিই বলি!
আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি, আর তুমি শুধু আমার!শুধুই আমার!
ভালোবাসি কৃষ্ণকায়া,ভীষণ ভালোবাসি!যতটা ভালোবাসলে তুমিহীনা নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হতে পারে ঠিক ততটাই ভালোবাসি!”
কাদম্বিনী দেবী উত্তর দেননা।কেবল দুচোখ বুজে অনুভব করে যায় তার প্রিয়তমর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের গভীরতা,আর তাতে লুকায়িত ভালোবাসার পরিমাণ!
স্ত্রীর মৌনতা দেখে আশুতোষবাবু হঠাৎই গুণগুণিয়ে ওঠেন,
“আমার স্বপ্ন তুমি,
ওগো চিরদিনের সাথী
তুমি সূর্য ওঠা ভোর আমার,
আর তারায় ভরা রাতি
আমার স্বপ্ন তুমি,
ওগো চিরদিনের সাথী।
আমি তোমার ছায়া,
তোমার আকাশ নীলে আমি,
স্নিগ্ধ মেঘের মায়া।
তোমায় কাছে পেয়ে,
পৃথিবী তে কে আর সুখী,
বলো আমার চেয়ে ?
তোমায় কাছে পেয়ে
হাতের আড়াল দিয়ে বাঁচাও,
ঝড়ের মুখে বাতি।
আমার স্বপ্ন তুমি,
ওগো চিরদিনের সাথী।
তুমি সূর্য ওঠা ভোর আমার,
আর তারায় ভরা রাতি।
আমার স্বপ্ন তুমি,
ওগো চিরদিনের সাথী।”
কাদম্বিনী দেবী এবার চোখ মেলেন।লালচে আকাশ ততক্ষণে ঢাকা পড়েছে কালো চাদরের আড়ালে!হয়তো তাদের প্রণয়কাব্য দেখে সেও লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে! কাদম্বিনী দেবী হাসেন!স্বামীর ছাড়া অন্তরা থেকেই সুর তোলেন,
“তুমি ছেড়োনা হাত পথে,
যদি আঁধার আসেই নেমে
গ্রহণ যত করো আমায়,
ততোই বাঁধো প্রেমে।
পাশেই আমার থাকো,
জীবন টাকে শান্তি দিয়ে,
সবুজ করে রাখো
পাশেই আমার থাকো
তোমার পূজার দুঃখ সুখের,
প্রেমের মালা গাঁথি।
আমার স্বপ্ন তুমি,
ওগো চিরদিনের সাথী।
তুমি সূর্য ওঠা ভোর আমার,
আর তারায় ভরা রাতি।”
আশুতোষবাবু হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় করেন স্ত্রীর কটিদেশে!ফিসফিসিয়ে বলেন,
“আমি জীবিত থাকতে তোমার হাত কখনোই ছাড়া সম্ভব না কৃষ্ণকায়া!সারাজীবন তোমাকে প্রেমের বাঁধনেই বেঁধে রাখবো!আমার প্রণয়বাঁধন থেকে তোমার মুক্তি নেই!একটুও না!”
কাদম্বিনী দেবী সলজ্জ হেসে জবাব দেন,
“আমার মুক্তি চাইও না।
ভালোবাসি আপনাকে!আপনার মতো নয়,নিজের মতো করে, সবটা দিয়ে!”
আশুতোষবাবু তৃপ্তির হাসি হাসেন।তৃপ্তনয়নে তাকিয়ে রয় ঐ আকাশের নিখাঁত অন্ধকারে!কাদম্বিনী দেবী প্রেমিক পুরুষের স্পর্শগুলো অনুভব করতে আবারো বুজে নেন আঁখিপল্লব!
আর দূর থেকে তাদের এই প্রণয়গাঁথার সাক্ষী হয়ে রয়, শর্বরীর কালচে আকাশ, শরতের শিশিরসিক্ত শীতল বাতাস, মেঘের আড়ালে হাসা গোটা চাঁদ আর লক্ষ লক্ষ নক্ষত্ররাজি!
.
চোখের পলকে কেটে গেছে আরো ক’টা দিন।ভাদ্র এসে ঠেকেছে একদম তার যাবার পথে!মাস ফুরোতে তখনও দিন পাঁচেক মতো বাকি!রৌদ্রজ্জ্বল আকাশের বুকে তখন কেবল পেঁজা তুলোর রাজত্ব!নিরিবিলি পথের ধারে তখন সার সার কাশের মেলা!আকাশের মেঘপুঞ্জের মতো তারাও শুভ্রতায় ভরে রেখেছে শ্যামল প্রকৃতি!
হৃদিতার সাথে আর এর মধ্যে দেখা হয়নি কাদম্বিনী দেবীর!সামনেই বিয়ে, দূর্গাপূজো!আর তারপরই টেস্ট!বিয়ে-পূজোর দিন কটায় পড়ালেখা ঠিকমতো হবে না বলে, আর বাড়ির বাইরে যাওয়া হয়নি তার।সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেছে নিজের স্টাডিতেই!
আদৃত অবশ্য মাঝে দু’দিন এসে একবার করে দেখা করে গিয়েছিল!তবে সে দেখায় দুজনের মাঝে তেমন কথা হয়নি কিছুই!কেবল একপলক দেখে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করেই বিদায় নিয়েছে সে!
কিন্তু সেদিন রাত্রেই আদৃত হঠাৎ কল করে বসে হৃদিতাকে!হৃদিতা তখন ভূ-গোলের পাতায় চোখ ডুবিয়ে আছে!হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠায় রিসিভারটা চাপতেই কানে এসে বারি খায় আদৃতের কাতর কন্ঠ,
“হৃদ!”
হৃদিতা চমকে ওঠে।পড়ার তালে খেয়ালই করেনি কার ফোন ছিল। সে বইটা বন্ধ করে রেখে নামানো কন্ঠে উত্তর দেয়,
“বলুন!”
আদৃত কোনরুপ ভণিতা ছাড়াই বলে ওঠে,
“আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে হৃদ!মনে হচ্ছে না দেখতে পেলে মরে যাব।দম আটকে যাবে!আমাকে বাঁচান হৃদ!”
হৃদিতার বুকের ভেতরটা কেমন একটা অজানা ব্যাথায় মুষরে যায়! অজানা কারণেই চোখে এসে ভীর জমায় অশ্রু!সে কাতর স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে?আপনার কন্ঠ এমন কেন শোনাচ্ছে আদৃতবাবু!আপনি কি অসুস্থ?”
আদৃত দমবন্ধ হয়ে আছে এমন ছটফটিয়ে বলে ওঠে,
“আপনার সাথে শেষ দেখা হয়েছে পাঁচদিন আগে হৃদ!পাঁচদিন! পুরো চার লক্ষ বত্রিশ হাজার সেকেন্ড হৃদ!
এই এত বিশাল অংকের অসাক্ষাৎ,এর জন্যই আমি অসুস্থ! আমার সুস্থতার জন্য আপনাকে প্রয়োজন।ভীষণ প্রয়োজন!আপনাকে একটু দেখতে চাই হৃদ। ”
হৃদিতা পড়ে অকুল পাথারে!দিশেহারা চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রয় পলকহীন।তারপর কিছু একটা ভেবে বলে,
“ভিডিও কল দিই?”
আদৃত অসম্মত কন্ঠে উত্তর দেয়,
“না। ভার্চুয়াল সাক্ষাৎ-এ আমার হবে না। আমার প্রত্যক্ষ দর্শন চাই!”
হৃদিতা আবারো দিশেহারা নয়ন মেলে তাকায়! অসহায় কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“এত রাতে?কি করে?”
আদৃত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।ফোনের অডিও স্পিকারের মাধ্যমে সেই তপ্তশ্বাসের আওয়াজ এসে বারি খায় হৃদিতার কানে।তারপর বেশ কিছুক্ষণ চলে উভয়পক্ষের নিরবতা।
নিরবতা ভেঙে আদৃতই ক্লান্ত স্বরে বলে ওঠে,
“নিচে আসুন হৃদ। আমি আপনার বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে!”
হৃদিতা এবারে হতবাক হয়ে যায়। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি আমার বাড়ির সামনে?”
ফোনটা চোখেন সামনে এনে স্ক্রিনে দেখে নেয় সময়টা!৯ঃ৫৪!প্রায় ১০টা।হৃদিতা বিস্মিত কন্ঠে আবারো বলে,
“রাত দশটা বাজে আদৃত বাবু!এতরাতে আপনি আমার বাড়ির সামনে?কেউ দেখলে কি ভাববে?বাবা-মা জানলে?আর আমি এখন সদর দরজা দিয়ে কি করে বেরোবো!মা-বাবা দেখে ফেললে?”
আদৃত এবারে কিছুটা রাগ নিয়ে বলে ওঠে,
“আপনি আসবেন কিনা হৃদ?এত অযুহাত ভালো লাগে না। আপনাকে না দেখে আমার দমবন্ধ হবার দশা,আর আপনি কে কি ভাববে, তা নিয়ে পড়ে আছেন। আই ডোন্ট কেয়ার কে কি ভাবলো!আপনি আসুন। আঙ্কেল-আন্টিকে আমি কল করে বলছি নাহয়!”
হৃদিতা চমকিত কন্ঠে প্রত্ত্যুত্তর করে,
“না না, মা-বাবাকে বলতে হবে না।আপনি দাঁড়ান!আমি আসছি আদৃতবাবু!পাঁচ মিনিট!”
আদৃত আর কথা বাড়ায়না। কেটে দেয় ফোনকল!হৃদিতা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়! দরজার বাইরে পা রাখতে রাখতে হালকা হেসে বিরবির করে বলে ওঠে,
“পাগল!”
২৪.
নিশুতি রাত্রী!ঘড়ির পেন্ডুলামটা একে একে বেজে উঠল দশবার!
হৃদিতা গায়ে একটা পাতলা শাল চাপিয়ে নিল!বাবা তখনও জেগে!স্টাডি টেবিলে চশমা চোখে বরাবরের মতো কোন একটা বইয়ের পাতায়দৃষ্টি নিমগ্ন করে বসে!হৃদিতা এক পলক উঁকি দিয়ে দেখে নিল!তারপরে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলো ড্রয়িংরুমে!রান্নাঘর থেকে তখনো বাসনের ঠুকঠাক শব্দ ভেসে আসছে।হৃদিতা খানিকটা ঝুকে দেখে নেয় মায়ের গতিবিধি!টাপুর দেবী তখন উল্টো দিকে মুখ করে সিঙ্কে বাসন ধুতে ব্যস্ত।
হৃদিতা তা দেখে বুকে হাত রেখে স্বস্তিতে শ্বাস নেয়!এক পা দু পা করে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
দরজা খোলার উদ্দেশ্যে ওপরের ছিটকিনিটা নিঃশব্দে খুলতে গিয়েই পেছন থেকে মায়ের ডাক কানে আসে!
“হৃদ!এত রাতে দরজা খুলছিস কেন?কোথায় যাস?”
হৃদিতা আৎকে উঠে পিছু ফেরে। টাপুর দেবী সন্দিহান নয়নে তার দিকেই তাকিয়ে!ভয়ে হৃদিতার গলা শুকিয়ে আসার উপক্রম।
মেয়েকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে টাপুর দেবী আবারও জিজ্ঞেস করেন,
“কিরে!চুপ কেন?বল?এত রাতে এমন চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে যাস কেন?বাইরে কি?”
হৃদিতা এবারে তোঁতলানো কন্ঠে জবাব দেয়,
“না,মমমানে মমমমা!আআআসসলে আমার না ঘঘঘররররে বসে থথথাকতে ববববোর লাগছিল!ততততাই এএএএকটু বাইরে যাচ্ছিলাম ঠঠঠান্ডা হাওয়ায় হহহেঁটে বেড়াতে!তততাহলে একটু ভভভালো লাগতো!”
টাপুর দেবী ভ্রু কুচকে বলেন,
“হ্যাঁ!তো এমন লুকিয়ে চুরিয়ে যাবার কি আছে?আর এমন তোঁতলাচ্ছিস কেন?যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিস!”
হৃদিতা ঘাবড়ানো কন্ঠে বলে,
“ককককই?তততোঁতলাচ্ছি না তোহ্!”
টাপুর দেবী এবারে রাগী কন্ঠে বলে ওঠেন,
“এই তো তোঁতলাচ্ছিস!”
হৃদিতা এবারে চোখ বুজে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে একটু সামলে নেয়। তারপর গড়গড় করে বলে যায়,
“আসলে মা, এত রাত, তারওপরে বাইরে তো হিম পড়ছে!এখন যদি বাইরে যাবার জন্য তুমি রাগ করো, তাই লুকিয়ে বেরোচ্ছিলাম।আর কিছু না তো!হিহি!”
হৃদিতার এমন মেইল ট্রেনের বেগে বলা কথা আর ক্যাবলাকান্ত মার্কা হাসি দেখে টাপুর দেবী নিজেও বোকা বনে গেলেন। হৃদিতা দুপাটি দাঁত বের করে হেসে আবারো মাকে জিজ্ঞেস করে উঠল,
“মা,আমি যাই?”
টাপুর দেবী বোকা বোকা চোখে অনুমতি দিয়ে বললেন,
“যা!”
হৃদিতাকে আর কে পায়!দরজা খুলে সে একছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে!
আর টাপুর দেবী পিটপিট করে চেয়ে থেকে নিজের মনেই বলে উঠলেন,
“মেয়েটার কি হলো আজ?এত রাতে বাইরে বেরিয়ে গেল হাওয়া খেতে!কি জানি বাবা!”
.
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।ধোঁয়াটে কুয়াশায় ছেয়ে আছে চারপাশ।মাঝে মাঝে গাছের তলে দু-একটা ঝিঁঝি পোকা উড়তে দেখা যাচ্ছে! একটু বাদে আবার লুকিয়ে পড়ছে পাতার আড়ালে!
গেটের কাছে জ্বলতে থাকা ল্যাম্পটার আলোও সেই কুয়াশার ভীড়ে আবদ্ধ হয়ে আছে ওটুকু স্থানেই!হৃদিতা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল গেটের দিকে।গেটটা ভেতর থেকে লাগানো। খুলে দিতেই চোখ পড়লো আদৃতের পানে।এমন কুয়াশাঘেরা শীতল রাতে সে গায়ে একটা হাফহাতা নেভিব্লু টি-শার্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে! হৃদিতা ভ্রু কুচকে তাকায়। বিরবির করে বলে,
“লোকটার কি ঠান্ডা টান্ডা লাগে না নাকি!”
আদৃত ততক্ষণে এগিয়ে এসছে বেশ কিছুটা!হৃদিতার একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বলে ওঠে,
“না লাগেনা। ভেতরে চলুন!”
আদৃত ভেতরে ঢুকে যায়। ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় বাগানের দিকে।বাগানে তখন হাসনা-হেনার তীব্র ঘ্রাণ।কুয়াশার সাথে মিশে গিয়ে সেই সুগন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে আরো মাদকতা!সেই মাতাল ঘ্রাণে বুঁদ হয়েই আদৃত ডাকে হৃদিতাকে,
“হৃদ!এদিকে আসুন!”
হৃদিতা গুটিগুটি পায়ে সেদিকেই এগিয়ে যায় আদৃতের কথা মতো। আদৃত হঠাৎই হৃদিতার বাহুজোড়া আকড়ে ধরে শক্ত করে। তাকে টেনে নেয় নিজের কাছে!বাড়ির ভেতর থেকে আসা একফালি আলোর রেখা এসে পড়ে হৃদিতার মুখের ওপর!সেই আলোক রেখাই যেন হৃদিতার কৃষ্ণরুপে সোনার কাঠি ছোঁয়ায়! আদৃতের ঘোর বেড়ে যায় আরো বেশি!
হৃদিতার বেনী ছেড়ে কপালে বেরিয়ে আসা চুলগুলো সে খুব যত্নে গুঁজে দেয় কানের পিঠে।তারপরে ঘোর লাগা কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“কালোটিপ পড়েছেন!এখন কি রোজ টিপ পড়েন হৃদ?সবসময়? ”
হৃদিতা কথা বলেনা। কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়! আদৃত প্রসন্ন হাসে!পকেট হাতরে বের করে আনে একথোঁকা মাধবীলতা।তার মিষ্টি ঘ্রাণ এসে বারি খায় হৃদিতার নাসারন্ধ্রে!সে প্রফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“মাধবীলতা? আমার জন্য? ”
আদৃত হাসে।চোখের ইশারায় সাড়া দেয়!হৃদিতার ঠোঁটের প্রসারণটা দীর্ঘ হয় আরও!আদৃত হাতের ফুলটা খুব যত্নে গুঁজে দেয় প্রিয়তমার বাঁধা চুলের ভাজে!তারপর তাকিয়ে রয় একধ্যানে!
হৃদিতা লাজুক হেসে শুধায়,
“কি দেখেন?”
আদৃত বিভোর স্বরে জবাব দেয়,
“আপনাকে!”
হৃদিতা চোখ নামিয়ে নেয়!আদৃত এবারটা হঠাৎই হাঁটুমুড়ে বসে পড়ে তার সামনে!চোখের পলকে হৃদিতার ডান পাটা তুলে নেয় নিজের হাঁটুর ওপরে!হৃদিতা ব্যস্ত হয়ে পা নামাতে চায়, আদৃত দেয় না।হৃদিতা অসহায় হরিণীর মতো ছটফট করে তার চঞ্চল আঁখিজোড়া মেলে বলে ওঠে,
“পায়ে হাত দেন কেন?পা ছাড়ুন!”
আদৃত কপাল কুচকে তাকায়! সেই কুঞ্চিত ললাটের প্রতিটা ভাজে দৃশ্যমান হয় প্রবল বিরক্তি। বিরক্ত কন্ঠে সে চাপা ধমকের স্বরে বলে ওঠে,
“এত নড়াচড়া করেন কেন?কি হয়েছে পা ধরলে?আপনার কি সোনার পা?”
হৃদিতা আর কথা বাড়ায়না। বেশ বুঝতে পারে, তার কথা তাকেই ফিরিয়ে দিল আদৃত। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে গাল ফুলিয়ে! আদৃত এবার পকেট থেকে বের করে দুটো নুপুর!রুপোর ওপরে সুন্দর করে পাথর বসানো নুপুর দুটো দেখে হৃদিতা বিস্মিত স্বরে বলে ওঠে,
“এগুলো?এগুলো তো খুব দামী আদৃতবাবু! এত দামী নুপুর দিয়ে কি করবো আমি? আপনি এভাবে অযথা টাকা নষ্ট করবেন না,আমার…!”
“শিশশশশশ্!”
আদৃত থামিয়ে দেয়!আর বলতে দেয়না!হৃদিতার ডানপায়ে নুপুর পড়িয়ে তা নামিয়ে রাখে মাটিতে।আবারো বাঁপাটা তুলে নেয়।তাতেও সমান যত্নে পড়িয়ে দেয় নুপুরটা!হৃদিতা এবারে নিজেই নামিয়ে নেয় পা। আদৃত উঠে দাঁড়ায়! হৃদিতার মুখ তখনো ভার,গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই!আদৃত সেদিকে তাকিয়ে হেসে চোখ ফেরায়!মিষ্টি করে বলে ওঠে,
“আপনিই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি দামী হৃদ।খুব দামী!তাই আপনাকে সাজাতে কোন মূল্য আমার কাছে অধিক নয়!ঈশ্বরের আশির্বাদে আমাদের অনেক আছে!আমার হৃদকে তার থেকে একটু সাজালে কম পড়বে না কিছু!”
হৃদিতা এবারটা আলতো হাসে,কপোলদ্বয় ধারণ করে রক্তিম আভা।আদৃত বুঝতে পারেনা লজ্জায় নাকি শীতে! সে হৃদিতাকে এবারে তাড়া দিয়ে বলে,
“আপনার শীত করছে হৃদ।ভেতরে যান!”
হৃদিতা আদৃতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“আরেকটু থাকি!”
আদৃত দুষ্টু হাসে।দুষ্টুমীর স্বরে বলে ওঠে,
“কেন?প্রেম পাচ্ছে?”
হৃদিতা লজ্জা পেয়ে যায়! তবে আদৃতের থেকে চোখ সরায় না। লাজুক হেসেই প্রত্ত্যুত্তর করে,
“হ্যাঁ!”
আদৃত হেসে ফেলে। বিদ্রুপ করে বলে,
“বাড়িতে জানে?”
হৃদিতা অবুঝ দৃষ্টিতে তাকায়! কিয়ৎক্ষণ পর যখন বুঝে যায়, তখন বড় বড় চোখে তাকিয়ে রাগত স্বরে আদৃতকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ,জানে!অসভ্য!”
আদৃত আবারো হাসে।তারপর কি মনে করে যেন, এসে দাঁড়ায় হৃদিতার খুব কাছে, তবে স্পর্শ করেনা আর।অনুনয়ের সুরে বলে ওঠে,
“একটা গান শুনেছেন হৃদ?”
হৃদিতা কৌতুহলী কন্ঠে শুধায়,
“কি গান?”
আদৃত ঘোরলাগা কন্ঠে জবাব দেয়,
“ও চাঁদ, সামলে রেখ জোছনাকে!”
হৃদিতা মাথা নাড়ে,চোখের ইশারায় বোঝায়,
“শুনেছি!কেন?”
আদৃত বিভোর হয়ে বলে,
“আমারও এই মুহুর্তে এই গান যিনি লিখেছেন, তার মতোই অনুভূতি হচ্ছে!আপনি আমার জীবনের চাঁদ হৃদ। সেই চন্দ্রিমা,যে আমার জীবনটা ভালোবাসার আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে নিজের জোছনা দিয়ে!
আপনার সেই প্রণয়ালোক সামলে রাখবেন হৃদ। আপনার প্রণয়পূর্ণিমায় কেবল আমার অধিকার!”
হৃদিতার ঠোঁটে ম্লান হাসি ফুটে ওঠে, সে বিষাদময় কন্ঠে উত্তর দেয়,
“আমি চাঁদ নই আদৃতবাবু!চাঁদ তো খুব সুন্দর! আমি তো কালো!আমার সাথে চাঁদের তুলনা করবেন না। চাঁদ যে রাগ করবে!চাঁদের মতো আমার জোছনা হয়না আদৃতবাবু!বরং চাঁদের ক্ষয়ে যে অমাবশ্যা হয়,সেই অমানিশা আমি!”
আদৃত শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে স্বগোতক্তি করে,
“আকাশের চাঁদের কলঙ্ক আছে হৃদ। সেই সৌন্দর্যের কি অর্থ যার সাথে কলঙ্কের নাম উঠে আসে।
আপনি আমার জীবন আলো করা চাঁদ। আমার চাঁদের কোন কলঙ্ক নেই হৃদ।একটুও না। সেজন্যই তো তার নিষ্কলঙ্ক পূর্ণিমায় আমার জীবনটা আলোয় ভরে গেছে, তার হৃদয়ের পুণ্যালোকে আমার ভাঙা পরিবারটা আবার জোড়া লেগেছে!
আমার আকাশের চাঁদের মতো সুন্দর চাঁদ চাইনা। আমার চাঁদের মনটা সবার চেয়ে সুন্দর! আমার সেটুকু হলেই চলবে!আমার আপনি হলেই চলবে হৃদ!”
হৃদিতার চোখ টলমল করে ওঠে, আনন্দাশ্রু এসে জড়ো হয় অক্ষিপটে!আদৃত তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে ওঠে,
“ভালোবাসি হৃদ। আপনাকে খুব ভালোবাসি।ঠিক কতটা তা তো জানিনা, তবে যতটা ভালোবাসা আমার ঝুলিতে জমানো আছে, তার সবটা দিয়ে ভালোবাসি!”
হৃদিতা উত্তর দেয়না আর। শুধু তার মনের ভেতরেই বারবার উচ্চারিত হতে থাকে একটি বাক্য,
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি আদৃতবাবু!ভালোবাসি!”
এভাবে ঠিক কতক্ষণ কেটে যায় হিসেব রাখা হয়না। রাত গভীর হয়ে আসে আরো কিছুটা!অন্ধকারের গাঢ়তা বেড়ে গিয়ে কুন্ডলী পাঁকায় ঘন কুয়াশা!আদৃতের তপ্তশ্বাস এসে বারবার আছড়ে পড়ে হৃদিতার মুখের ওপর, আর ঠিক সে সময়টাতে হৃদিতার বুকের ভেতর আছড়ে পড়ে ঢেউ,ভালোবাসার উথলে পড়া ঢেউ!আর সেই ঢেউয়েই তলিয়ে যায় চেতনা।কোন এক ঘোরে বিভোর হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে ওভাবেই!দুজন দুজনের খুব কাছে!
.
হৃদিতার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে টাপুর দেবী বেরিয়ে আসেন বাড়ির ভেতর থেকে! হৃদিতাকে ডাকতে বাগানের দিকে এসেই চোখ আটকে যায় ওনার!চোখ ফিরিয়ে উল্টো দিকে মুখ করে ডেকে ওঠে,
“হৃদ!”
হৃদিতা চমকে তাকায়,ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায় আদৃতের থেকে!
আদৃত নিজেও বিস্মিত।মেয়েটাকে দেখে এত ঘোর লেগে গিয়েছিল, বোঝাই যায়নি সময় কোনদিক দিয়ে কেটে গেল!সে অপরাধী কন্ঠে টাপুর দেবীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“আব…আসলে আন্টি আমি,ঐ না মানে আমি আসলে!”
টাপুর দেবী হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে ঠোঁট চেপে হেসে গম্ভীর মুখে বলে ওঠেন,
“হৃদের সাথে দেখা করতে এসেছিলে তাইতো!বললেই হতো। বাড়িতে যেতে। আমার মেয়েটা আমাকে গড়গড় করে মিথ্যে বলে বেরিয়ে এলো, যে সে হাওয়া খেতে আসছে, অথচ বাইরে যে সে প্রেম করছে তা তো আমি বুঝিনি বাবা!বুঝলে তোমাদের প্রাইভেট মোমেন্টে ঢুকে পড়তাম না।
ছি ছি!কাজটা কি ঠিক করলে?”
আদৃত একহাতে মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলে উঠল,
“আসলে আন্টি,এত রাত তো,তাই!সরি আন্টি!”
টাপুর দেবী এবারে হেসে দিয়ে বললেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে!ভেতরে এসো এখন।”
আদৃত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়া নিয়ে বলে,
“না আন্টি,আজ না। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে অলরেডি!অন্য কোনদিন নাহয়! আজ আমি আসি আন্টি!নমষ্কার!”
টাপুর দেবী বুঝতে পারেন আদৃত লজ্জা পাচ্ছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সম্মতি জানান।
ওনার সম্মতি পেতেই আদৃত গেট খুলে বেরিয়ে যায় খুব দ্রুত!
টাপুরদেবী গেটটা আবার লাগিয়ে দিয়ে ফিরে আসে মেয়ের সামনে।
হৃদিতা চোখ মুখ খিঁচে এখনো সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে,
টাপুর দেবী তা দেখে মুচকি হেসে বলেন,
“কি রে!এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?চল ভেতরে চল!আদৃত তো চলে গেছে!আর বাইরে কি?”
হৃদিতা নত মুখে বলে ওঠে,
“আসলে মা,উনি ফোন করে বললেন,ওনার নাকি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আমায়,আর আমাদের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।এমন করে বললেন, খুব মায়া হলো, তাই আর না করতে পারিনি।
উনি বলেছিলেন তোমাদের জানানোর কথা। আমিই না করেছি! তোমাদের বললে কি না কি ভকবো!তাই আর…!”
টাপুর দেবী দুষ্টুমি করে বলে ওঠেন,
“বুঝি বুঝি!সবই বুঝি!আমিও কখনও তোর বয়সী ছিলাম!বিয়ে ঠিকহবার পরে, তোর দাদুর চোখ ফাঁকি দিয়ে আমিও করেছি তোর বাবার সাথে দেখা!
বুঝেছি আমি। আমাকে আর বোঝাতে হবে না।
মেয়ে বড় হয়ে গেছে তো!লুকিয়ে লুকিয়ে হবু বরের সাথে দেখা করতে আসছে,মাকে মিথ্যে বলছে,প্রেম করতে শিখে গেছে!বুঝি তো,বুঝি!”
হৃদিতা এবারটা লজ্জা পেয়ে যায়! লজ্জায় আনত মৃখখানি লুকিয়ে ফেলে মায়ের বুকে!টাপুর দেবী মেয়ের মাথায় হাত রাখেন। স্নেহসিক্ত কন্ঠে বলে ওঠেন,
“তোদের ভালোবাসা চিরকাল অটুট থাক মা।সারাজীবন দুজন দুজনকে একইভাবে ভালোবেসে যা। সময়ের তালে তোদের ভালোবাসার রঙ যেন ফিঁকে না হয়ে যায়!
ছেলেটা তোকে খুব ভালোবাসে হৃদ!ওকে কখনও কষ্ট দিস না। সবসময় ভালো রাখার চেষ্টা করিস।নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসার চেষ্টা করিস।
আমি জানি তুই পারবি। মায়ের বিশ্বাস আছে তোর ওপরে!
তুই স্বামী সোহাগী হবি হৃদ।আমি আশির্বাদ করি!”
#চলবে!
[আজ দ্বিতীয়বারের মতো মনে হচ্ছে, উপন্যাসটা শুরু করা আমার অনেক বড় একটা ভুল!🙂
এখন থেকে রোজ ডাবল পার্ট পাবেন!আমি খুব দ্রুত শেষ করবো!কাহিনী এবার খুব দ্রুত এগোবে!]