মাস্টারমশাই পর্ব ৬

0
198

মাস্টারমশাই
পর্ব ৬
________________
‘আব্বু আমার গিফট দাও?’ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আবদার করে বসল ইয়াসমিন। চেয়ারে বসে সদ্য চায়ে চুমুক দিয়েছেন তানভীর স্যার। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা ব্রেকফাস্ট করতে ব্যস্ত। তারাও পাশে বসে আছে। প্রত্যেক দিনের সকালের তুলনায় আজকের সকাল একটু আলাদা। আজ ইয়াসমিন ষোলো বছরে পা দিল। আজ তার জন্মদিন। তানভীর স্যার জন্মদিন একদম পছন্দ করেন না। বছরে প্রত্যেক দিনের মতো জন্মদিনও একটি সাধারন দিন। তাকে উদযাপন করার কোনো মানে হয় না। তাদের পরিবারে বারবারই এমন হয়ে আসছে। কারোর জন্মদিন পালন করতে দেন না তানভীর স্যার। দৈনন্দিক দিনের রুটিনের মতো জন্মদিনেও একই রুটিন পালন করতে হয়। কোনো ছাড় নেই। পড়াশোনা থেকে শুরু করে বাড়ির কাজ সবই করতে হয়। বেলা বাড়লেই তানভীর স্যার স্কুলে যাবেন সঙ্গে ইয়াসমিনকেও যেতে হবে। জন্মদিনে কার বা ভালো লাগে পড়াশোনা করতে? আর পাঁচটি দিনের মতো জন্মদিনটিকে একই ভাবে কাটাতে চাইলো না ইয়াসমিন। সকাল সকাল বাবার কাছে আবদার করে বসলো। তানভীর স্যার আবার একবার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,’কিসের গিফট?’
‘মনে করো আজকে কি?’ তানভীর স্যার ভাবলেন কিন্তু মনে করতে পারলেন না। অযথা ইয়াসমিনকে সব কিছু বলতে হলো।
‘আব্বু আজ আমার জন্মদিন। মেয়ের জন্মদিন ভুলে গেছো?’ তানভীর স্যার টেবিলের ওপর চায়ের কাপ রাখলেন। তারপর একটা জোরে হাই তুলে বললেন,’জন্মদিন তো জন্মদিন। তাতে কি হয়েছে?’ ইয়াসমিন বিরক্ত প্রকাশ করল। তার আব্বু কিছুই বোঝেন না। সবকিছুতে নাটক না করলে হয় না। আবার আব্বুকে রাজি না করালেও চলবে না। তাকে স্কুলে যেতে হবে। সে আদুরে গলায় বলল,’আব্বু তুমি ঠিকমত কথাটি শোনো। আজ আমার জন্মদিন।’
‘হ্যাঁ রে মা। আমি ঠিক শুনেছি। তোর আজকে জন্মদিন। কিন্তু এতে আনন্দ করার কি আছে বরং দুঃখ প্রকাশ কর।’ তানভীর স্যারের কথা শুনে বাড়ির সকলে অবাক হলো না। কথার মধ্যে কোনোরকম নতুনত্ব নেই। সবাই উনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। জন্মদিনে দুঃখ প্রকাশ করবে! এ আবার কেমন কথা? তানভীর স্যার একটু উল্টাসিধা মানুষ। সব সময় উল্টো দিকে দিয়ে কথা বলেন।কিন্তু এতটা উল্টো দিক দিয়ে কথা বলবেন কেউ ভাবতে পারেনি। ইয়াসমিন আশ্চর্য হয়ে বলল,’মানে?’
স্যার মেয়েকে নিজের কোলে নিয়ে বসালেন। বাবার কোলে বসে শান্তির নিশ্বাস ছাড়লো। নিশ্চয়ই তিনি এতক্ষণ মজা করছিলেন। যদিও কখনো বাবাকে মজা করতে দেখেনি। সব সময় সিরিয়াস থাকেন। আব্বু ইয়াসমিনের মাথায় চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললেন,’আচ্ছা মা বলতো জন্মদিনের মানে কি?’ তার আব্বু কখনো শোধরাবে না। এখানেও প্রশ্ন করতে হলো। ভীষণ বিরক্ত হলেও প্রকাশ করল না। শান্ত মাথায় বলল,’জন্মদিন হচ্ছে একটা পরিবারের সুখের দিন। যার জন্মদিন তার জন্য পরিবারের সকলে আল্লাহর কাছে দোয়া করে যাতে ওই মানুষটি শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে সব সময় সুস্থ থাকে এবং আরও অনেক কিছু।’
‘মোটেও না। জন্মদিন হচ্ছে মানুষের জীবনে সবচাইতে একটি শিক্ষণীয় দিন। জন্মদিন মানে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। জন্মদিন মানে জীবন থেকে একটা বছর কমে যাওয়া। আর আমরা ওই দিনটিকে হাসি খুশিতে উদযাপন করব। এ কি করে সম্ভব? একটা বছর ধরে আমরা কি করলাম? কোথায় কোথায় সময় কাটিয়ে ফেললাম? তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করার মানে হচ্ছে জন্মদিন। আর আমরা তা না করে উদযাপন করছি।’
বাড়ির সকল সদস্য চুপচাপ হয়ে গেল। প্রত্যেকটা মুহূর্ত তিনি সিরিয়াস। জীবন থেকে আনন্দ যেন মুছে গেছে। নিজে কখনো আনন্দ করবেন না আর বাড়ির সদস্যদের আনন্দ করতেও দেবেন না। আমিনা স্বামীর উপর ভীষণ চটে গেলেন। উনার স্বামী জন্মদিনকে মৃত্যুর দিন বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি রাগান্বিত স্বরে বললেন,’হয়েছে তোমার জ্ঞান দেওয়া।তোমার কাছে জন্মদিন দুঃখের হতে পারে। কিন্তু ওদের কাছে নয়। ওরা একটু ঘুরতে চায়। স্বাধীন হয়ে থাকতে চায়।একটা ছোট্ট গিফট কিনে দিলে এমন কি হয়ে যেত?’
তানভীর স্যার কিছু বললেন না। চুপ করে বসে রইলেন। ইয়াসমিনের চোখ ছল ছল করে উঠেছে। বাবা কখনো ছেলেমেয়েদের আবদার বুঝলো না। তিনি বড়ই নিষ্ঠুর। সকালের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা সমাপ্তি ঘটে গেছে। তিনি কিছুতেই জন্মদিন পালন করতে দেবেন না। কারণ উনি মনে করেন উনার ভালোলাগাই উনার আইন। আলম পরিবারে থেকে পরিবারের আইন ভাঙার সাধ্য কারোর নেই। ভাঙতে হলে বাড়ির বাইরে যেতে হবে।যা কখনোই সম্ভব নয়। নিজের চোখের জল নিজেই মুছে ফেলল। নিজেকে সান্ত্বনা দিল। আর কখনোই আব্বুর কাছে কোনো কিছু আশা করবে না। আশা করাই বৃথা। আশা করে বারবার প্রত্যাখান হওয়ার চাইতে আশা না করাই ভালো।
এতক্ষণ চুপচাপ বসে সমস্ত কথা শুনছিল মাহবুব। একটা কথাও বলেনি সে। আব্বুর আদেশ বারবার মেনে নিয়েছে সে। এমনকি গ্রামের কলেজে ভর্তিও হয়ে গেছে। বন্ধুদের সঙ্গে আর তেমন মেলামেশা নেই। আঠারো বছর পেরিয়ে গেছে তবুও স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে দেয়নি তার বাবা। নিজের ধরাবাঁধা জীবন তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। ছেলেমেয়ের ভালোলাগা,খারাপ লাগা উপর একবিন্দুও গুরুত্ব দেননি। চেয়ার থেকে উঠে বাবার সামনে দাঁড়ালো। তারপর বাবার দিকে নিজের চোখ স্থির রেখে বলল,’আচ্ছা আব্বু ওই সব বাদ দাও। আমরা কোনো উপহার চাই না। আমাদের কিছু টাকা দাও বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখে আসি। তাতে তো কোনো অসুবিধা নেই?”
সিনেমার কথা শুনে ইয়াসমিনের বুকটা ফুরফুরে করে উঠলো। তার বান্ধবীদের কাছ থেকে শুনেছে, কোনো একটি বিহারী ছেলে বাংলাতে এসে মুভি করেছে।নাম সম্ভবত জিৎ।উনার প্রথম মুভি ‘সাথী’। বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। কাতার কাতার লোকে গিয়ে মুভি দেখছে। আর প্রশংসায় ভাসছে। মুভি দেখার বড্ড ইচ্ছে ছিল ইয়াসমিনের।বন্ধুরা দু-দুবার একই সিনেমা দেখে এসেছে। তাকে অনেকবার ডেকেছে কিন্তু যায়নি।বাবাকে কখনো বলতে পারেনি। জন্মদিনে যদি সেই ইচ্ছে পূরণ হয় তাহলে মন্দ হবে না। তার মুখ আবার হাসিতে ভরে উঠলো। বাবাকে রাজি করানোর চেষ্টা করল। তিনি তো রাজি হলেন না বরং উল্টো বললেন,’কারোর কোথাও যাওয়া হবে না। এখন সিনেমা দেখার বয়স নয়। পড়ার সময় পড়তে বস।’
‘তাহলে এই বয়সে আমরা কি করব? ঘরে বসে ডিম পাড়বো?’ মাহাবুব বাবাকে চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলল। সঙ্গে সঙ্গে তানভীর স্যার মেয়েকে কোল থেকে তুলে দিলেন। তড়িৎ বেগে ছুটে গেলেন মাহবুবের কাছে।পরপর গোটাকয়েক গালে চড় বসিয়ে দিলেন।তারস্বরে বললেন,’ফাজলামি পেয়েছিস?গুরুজনদের মুখের উপর কথা! এত সাহস হয় কি করে? কলেজে পড়ছিস, বড় হয়ে গেছিস বাবা কিছু বলবে না যদি ভাবিস তাহলে সম্পূর্ণ ভুল। ঠাটিয়ে লাল করে দেব। আমি যতদিন বেঁচে আছি এই বাড়িতে আমার নিয়ম চলবে।’
মুহুর্তের মধ্যে কি হলো কিছুই বুঝতে পারলো না কেউই। আমিনা ছেলের পাশে বসে রয়েছেন। ছেলের গালে হাত বোলিয়ে দিলেন। চোখের জল ছেলের গালে পড়লো। স্বামীর আচরনে তিনি হতবাক।ছোটবেলায় ছেলে মেয়েদের প্রচুর মারতেন, শাসন করতেন,অনেক বাধা দিয়েছিলেন কিন্তু কখনো শোনেননি। কিন্তু এই বয়সে এসেও ছেলের উপর হাত তুলবেন ভাবতে পারেননি। তিনি শুধুমাত্র ভয় দেখানোর জন্য হাত তুলেননি। যথেষ্ট শক্তি দিয়ে মেরেছেন। কাঠের মতো শক্ত হাতের চড় খেয়ে মাহবুব রীতিমতো গোঙ্গানো শুরু করে দিয়েছে। দুটো ফর্সা গাল টকটকে লাল হয়ে গেছে। তিনি একবার স্বামীর দিকে একবার ছেলের দিকে প্রখর দৃষ্টিতে তাকালেন।
‘মেরে ফেলো ছেলেমেয়েদের। এ বাড়িতে থাকার চাইতে না থাকাই ভালো। পারলে আমাকে মেরে ফেলো। সামান্য কথায় তোমার হাত উঠে যায়। ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েরা কি পেয়েছে বলতো? শাসন আর চোখ রাঙ্গানো ছাড়া কিছুই পায়নি। আজ মেয়ের জন্মদিনে অশান্তি না করলে হতো না?’
‘অশান্তি আমি করিনি, তোমরা শুরু করেছো। বাবার মুখের উপর কথা বলার স্পর্ধা হয় কি করে?বাবা মানে কি ওটা জানে ?’
রাগে ফুলে রয়েছেন তানভীর স্যার। কিছুতেই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছেন না। এত শাসন এত দেখভাল করার পরও তার ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে পারেননি। উনার মুখের উপর কথা বলছে। ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে না পারার মতো ব্যর্থতা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ব্যর্থতা আর নেই।নিজের উপর রাগ হয়,আবার অভিমানও হয়। নিজের ছেলেমেয়েদেরকে সবার শ্রেষ্ঠ দেখতে চান। তাইতো তিনি কঠোর হয়েছেন। সবার কাছে খারাপ হয়েছেন। তবুও হার মানেনি।
‘এই বয়সে ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করবে,সিনেমা দেখতে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক। যদি সব কিছুতে বাধা দাও তাহলে তারা কখনোই কিছু মানবে না। তুমিতো শাসনের নামে অত্যাচার করছো।’ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন আমিনা।
হরতাল পুনরায় চেয়ারে বসলেন। অনেকক্ষণ পিনপতন নীরবতা থাকলো। তারপর তিনি স্বাভাবিক ভাবে বললেন,’এখন পড়াশোনা আর খেলাধুলার সময়। এখন ক্যারিয়ার গড়তে হবে। এই বয়সে সিনেমা দেখে হাসি খুশিতে কাটিয়ে দেওয়ার সময় নয়।এই বয়সে তুমি ঠিক করবে তুমি ভবিষ্যতে কেমন থাকবে।সময় থাকতে ঘাম না ঝরালে পরে চোখের জল ঝরাতে হবে।গ্রামে অনেক সময় টিভিতে সিনেমা দেখানো হয়। তখন তারা দেখতে যায়। গ্রামে যখন বারোয়ারি মেলা বসে তখন তো বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুরতে থাকে। ওই সময় তো আমি কখনো বাধা দেইনি। প্রতিটি মানুষের জীবনে লক্ষ্য থাকা উচিত। আর এদের জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই। লক্ষ্যহীন মানুষ শুকনো গাছের পাতার মতো। বাতাস যেদিকে হবে তারাও সেই দিকে উড়ে যাবে।’ স্বামীর কথা বেশ মন দিয়ে শুনলেন আমিনা। তবে মানতে চাইলেন না। তিনি রাগান্বিত স্বরে বললেন,’তাহলে এত মানুষ সিনেমা দেখছে,এত ছাত্র-ছাত্রী ঘোরাঘুরি করছে,তারা সবাই ভুল? তুমি একা সঠিক?’
‘আমিনা, বোঝার চেষ্টা করো।ভীড় রাস্তা সব সময় সঠিক হয় না।’

রোজ দশটার সময় তানভীর স্যার স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হন। আজও একই কাজ করলেন। সকালের ঘটনা তিনি পুরোপুরি ভুলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, ছেলে মেয়েরা যেন কিছুতেই স্কুল-কলেজ কামাই না করে। যদি ভুলেও করে তার পরিণতি ভয়ানক হয়ে দাঁড়াবে। বাবার কথা অমান্য করার সাধ্য নেই মাহবুবের।বাবার উপর কথা বললেও বাবার প্রতি সব সময় আনুগত্য থাকে। বাবার আদেশ যথাসাধ্য পালন করার চেষ্টা করে। বাবা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা একদম পছন্দ করে না। তাইতো সে একের পর এক বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করেছে। বাবার মতো করে হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু উনার সমস্ত নিয়ম মানতে পারে না। তাইতো উনার উপর জমে রয়েছে একরাশ অভিমান। তবুও ভীষণ ভালবাসে নিজের আব্বুকে। সে তাড়াতাড়ি কলেজ যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে তখনই ইয়াসমিনের কথা মনে পড়লো। বেচারা জন্মদিনেও অনেক কষ্ট সহ্য করল। তাকে কিছুটা সময় দেওয়া উচিত। ইয়াসমিনের ঘরে দরজা খোলাই ছিল। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।ইয়াসমিন দুটো হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। কাছে গিয়ে বসলো মাহবুব। বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল,’ কাঁদিস না বোন। আমি তোকে গিফট এনে দেব।’ মাহবুবের কথা শুনে ইয়াসমিন আরও বেশি কাঁদতে শুরু করল। সে দাদাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’এই বাড়িতে আমাদের কোনো অধিকার নেই, তাই না! সবসময় একটা ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। একটা কাজ করার আগে দশবার ভাবতে হয়। কোনো কাজ শান্তি ভাবে করতে পারি না। আর ভালো লাগছে না এই বাড়িতে থাকতে। আমরা এত বড় হয়েছি। আব্বু কেন আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দিচ্ছে না?’
বোনকে কি করে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারছে না মাহবুব। শুধু বোনের পিঠে হাত বোলিয়ে মিথ্যে কতগুলো আশ্বাস দিল। ইয়াসমিন কিছুটা থেমে আবার বলল,’আসলে আব্বুর হৃদয় বলে কিছু নেই। পাষাণ হৃদয় ধারী এক মানুষ।’
মাহবুব বোনের চোখের জল মুছে দিল। তাকে আরও কাছে টেনে হাসানোর চেষ্টা করল।এবাড়িতে যতক্ষণ আছে ততক্ষণ আব্বুর কথা শুনে চলতে হবে। এছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই।সে বোনকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বলল। কিন্তু ইয়াসমিন কিছুতেই স্কুলে যাবে না। আজ থেকে আব্বুর একটা কথাও শুনবে না। উনাকে আর সহ্য করতে পারছে না। মাহবুব নরম গলায় বলল,’আমরা আব্বুর মতো করে কখনো হতে পারিনি। মনে হয় না হবো বলে। অন্তত আব্বুর আদেশ গুলো পালন করি।তাতে আব্বু অনেক খুশি থাকবেন। তাছাড়া বাবার কথা অমান্য করার সাধ্য কিন্তু আমাদের কারোরই নেই। তার পরিণতি ভয়ানক হয়ে যাবে।’
ইয়াসমিন অনেকক্ষণ বসে ভাবতে থাকলো,স্কুলে যাবে কি যাবে না!সেও বাবার আদেশ সব সময় মেনে চলার চেষ্টা করে। আজ যদি না মানে তাহলে বাবা ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে। অনেক কষ্ট পাবেন।তার উপর মার পড়বে। মন না চাইলেও পরিস্থিতি বাধ্য করলো স্কুলে যেতে। কিন্তু সময় অনেক হয়ে গেছে। প্রথম ক্লাস বাবার রয়েছে। তিনি কিছুতেই ক্লাসে ঢুকতে দেবেন না। সেই কথা ভেবে আবার মুখ শুকিয়ে যায় ইয়াসমিনের। মাহবুব পরিস্থিতির কথা বুঝতে পারে। ইয়াসমিনকে বলল,’চিন্তা করিস না। আমি তোর বই খাতা গুছিয়ে দিচ্ছি,তুই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে।’
এতক্ষণে মাহবুব সফল হতে পারল। তার বোন হাসলো। মুখে প্রফুল্ল হাসি ফুটে উঠেছে। দাদার কপালে চুম্বন করে বলল,’লাভ ইউ দাদা।’
‘লাভ ইউ টু বোনু।’

দিন গড়িয়ে যেতে থাকে দিনের মতো করে।যতই দিন গড়তে থাকে ততই কাবেরী আর শুভজিৎ এর মধ্যে সৌহার্দ্য সম্পর্ক বাড়তে থাকে।একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে।একে অপরকে ছাড়া তারা এখন এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। ভালবাসার গভীর বন্ধনে জড়িয়ে গেছে। এটা ভাই-বোন না বন্ধুত্ব তা জানে না। হয়তো এই সম্পর্কের কোনো নাম নেই। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও গভীর সম্পর্কে জড়ানো যায়,তারা তা প্রমাণ করে দিয়েছে। প্রতিদিন তারা একই রুটিন মেনে চলে। রোজ বিকেলে একসঙ্গে খেলাধুলা করে। আবার সন্ধ্যার সময় শুভজিৎ কাবেরীর সঙ্গে পড়াশোনা করতে বসে। প্রায় সবগুলো অক্ষর শিখে গেছে সে। নিজের নাম লিখতে পারে। প্রথম যেদিন নিজের নাম লিখতে পারলো। সেদিন গোটা দেওয়ালে নিজের নাম লিখে ফেলল। হাতে কলম পেলেই নিজের নাম লিখতে শুরু করে। গাছে, গাছের পাতা, মাটি কোথাও বাদ যায়নি। সব জায়গায় নিজের নাম খোদাই করেছে। কাবেরী এ-দিক-ও-দিক খেলতে যাওয়া কিংবা ঘুরতে যাওয়া একদম পছন্দ করে না। কিন্তু শুভজিৎ সম্পূর্ণ বিপরীত। আবার কাবেরী তাকে বাইরে যেতে দেয় না। একসঙ্গে দুজন খেলতে চায়। শুভজিৎ দুজন মিলে খেলতে পছন্দ করে না। অনেক জন ছাড়া খেলার মজা পায় না। তাই দুজনের মধ্যে অনেক সময় মন কাটাকাটি হয়। কাবেরীর গোমড়া মুখ একদম পছন্দ করে না শুভজিৎ। তাকে সব সময় হাসি খুশিতে দেখতে চায়। তাই নিজেও এক সময় বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সব সময় কাবেরী সঙ্গে থাকার চেষ্টা করে। তার সঙ্গেই খেলাধুলো করে। এই প্রথম তারা ক্রিকেট খেলছিল।যতক্ষণ না কাবেরী শুভজিৎ কে আউট করতে পারবে ততক্ষণ সে ব্যাট ধরে থাকবে। আউট হলে আবার ঠিক উল্টোটি হবে।শুভজিৎ কে কিছুতেই আউট করতে পারে না কাবেরী। মিনিটির পর মিনিট ব্যাট ধরে থাকে সে। কিন্তু কাবেরী প্রথম বলেই আউট হয়ে যায়। কিন্তু সে কিছুতেই ব্যাট ছাড়বে না। সে আউট মানবে না। নানা ধরনের যুক্তি দাঁড় করাবে। সে না তার চাইতে বড়। সে মেয়ে খেলতে পারে না। তাকে একটু বেশি সুযোগ দেওয়া উচিত। কোনো উপায় পায় না শুভজিৎ। বাধ্য হয়ে বারবার বল করতে থাকে। দিনের বেশিরভাগ সময় সে বল করে আর কাবেরী ব্যাট। কিন্তু একটাও ব্যাটে-বলে সংযোগ করতে পারে না। তবুও তারা খেলে। বিরক্ত হলেও প্রকাশ করতে পারে না শুভজিৎ। সদ্য এনে দেওয়া কাবেরী নতুন সাদা ফ্রক ময়লা করে বাড়িতে নিয়ে যায়। ব্যস, শুরু হয় মায়ের বকবকানি। পিঠে পরে মার। মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করে পরের দিন কিছুতেই খেলতে যাবে না। কিন্তু পরের দিন কে শোনে কার কথা। একইভাবে মাঠে গিয়ে গড়াগড়ি করে। আবার জামা ময়লা করে বাড়িতে ফিরে আসে।

পর্ব ৭ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here