মেঘভেলায় প্রেমচিঠি” পর্ব ৬

0
449

“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি”

৬.

বাসার বুয়া এসে দরজা খুলে দিয়েছে৷ রোদসী চমকে গেলো, যখন দেখে তাঁর সামনে বরাবর দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখে শয়তানী হাসি খেলাধুলা করছে। রোদসী শুকনা ঢোক গিলে। কারণ ওই হাসির মানে জানে সে, মুখের হাসিটি তাঁকে যেন উপহাস করে বলছে,

‘এবার কোথায় পালাবে, রোদচশমা? ‘

রোদসীর মনে হলো, কেউ একজন কথাটা মিথ্যা বলেনি ‘যেখানে বাঘের ভয়,সেখানে সন্ধ্যা হয় ‘। কী সুন্দর ভাবে তাঁর সঙ্গে মিলে গেলো। রোদসী মিনমিন করে এগিয়ে এসে ড্রইং রুমের সামনে আসতেই দিলারা এসে বললেন,

‘আরে রোদি মা যে! এসো এসো, শিশির ওই রুমটায় থাকে। ‘

বলে রোদসীকে নিয়ে যেতে লাগলেন। হঠাৎ নজর পড়লো শহর এই সময় ঘরে আছে। কিন্তু ছেলেটা এই বিকেলের সময়টায় কখনো ঘরে থাকেনা। মাঠে ধুলোবালিতে নেচে-কুঁদে বেড়ায়। আর ঘরে থাকলেও পুরো ঘরটা চিড়িয়াখানার মতো নোংরা করে নাকে তেল দিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমায়। পড়াশোনার নাম গন্ধেও নেই। তবে আজ কী হলো! তিনি সন্দিগ্ধ মনে তাকিয়ে শহরকে বললেন,

‘এই হতচ্ছাড়া,তুই ঘরে কী করছিস? ‘

শহর নিষ্পাপ একখানা মুখ করে টেবিলে বসে বলল,

‘এমন করে বলছো আম্মা, আমি মনে হয় কখনো বাড়িতে আসিইনা! ‘

‘আমি কী বলেছি তা? তোর তো ঘরের কিছুতে মন বসে না। তাহলে আজ কেনো? শোন তুই ঘরে থাকলেই কীসব হ্যানত্যান ক্রাফট করিস! কয়েক দিন আগেও আমার শখের কাঁচের কাপ-পিরিচ, প্লেট ভাঙলি। খবরদার, যদি এবার এমন কিছু করিস। ‘

‘ তোমার শোকেসের প্লেট শুধু সারাজীবন দেখেই গেলাম। এমন জিনিসের বেঁচে থেকে লাভ কী? ‘

‘এক থাপ্পড় দিয়ে কানপট্টি গরম করে দিবো! আমার শোকেসে একদম নজর দিবি না। যাহ, তুই দূর হ আমার বাসা থেকে। ‘

‘যাচ্ছি যাচ্ছি, তোমার বাসায় থাকতে আমার বয়েই গেলো। ‘

‘দেখা যাবে৷ আবার ফিরে আসিস। দুগালে জুতা না দিয়েছি! ‘

‘আসলেও আমি আমার বাপের বাড়িতে আসবো। মেয়েরা যেমন নাইয়রে যায়। তেমন আরকি! কিন্তু সমস্যা একটাই, আমার তো বউ নেই। ‘

‘বেহায়ার জাত! মায়ের সঙ্গে ইয়ার্কি করিস।’

শহর ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেনা এমন মুখে হাসি দিয়ে বাহিরে চলে গেলো। রোদসী বড় একটা হা করে মা ছেলের ঝগড়া দেখছিলো। এরকম ঝগড়া সে কখনো দেখেনি। মা যেমন কথায় কথায় খোঁচা দিয়ে দেয়, ছেলেও তেমন করে একদফা এগিয়ে যায়। দিলারা শহরকে বকতে বকতে রোদসীকে শিশিরের রুমে নিয়ে গেলেন৷ রোদসী রুমে ঢুকে অবাক না হয়ে পারলো না। এখানে আসার সময় দিলারা তাঁকে শহরের রুমটাও দেখিয়েছে। নাক কুঁচকে এসেছিলো বটে। কিন্তু, ছোট ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলেটার রুম এতো গোছানো। দেখে মনে হয় এটা কোনো মেয়ের রুমে এসে পড়েছে সে। রোদসী আসতেই বাথরুম থেকে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে একটা ছেলে বেরিয়ে আসলো। রোদসী দেখলো, কিছুটা গুলুমুলু, ফোলা ফোলা গালের গোছানো পরিপাটি একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো। রোদসীর মনে হলো, ছেলেটা তাঁরই কার্বন কপি। এই যে, এইমাত্র যখন টেবিল থেকে গোল চশমাটা চোখে নিয়ে লাগিয়ে মিষ্টি করে শান্ত হাসলো, তখন মনে হলো রোদসীই এমন করছে। কী অদ্ভুত! একই মায়ের পেটের দুই ভাই৷ একজন কী শান্তশিষ্ট! আরেক জন হাড় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খায়। শহর আর রোদসীর ভাই আর্শ এক ক্যাটাগরীর মানুষ। যারা কথা ছাড়া বাঁচে না। বকবক না করলে পেটের ভাত হজম হয়না। আর শিশির ছেলেটা ভদ্রর মতো সালাম দিয়ে পাশে বসলো। দিলারা গর্বিত মুখে বললেন,

‘জানো মা, আমার শিশির পড়াশোনায় খুব ভালো। একবার পড়লেই মুখস্থ হয়ে যায়। তোমার মতোই বইপ্রেমী। ‘

রোদসী মৃদু হেসে বলল,

‘জ্বী আন্টি, দেখেই বুঝতে পারছি৷ ‘

‘আচ্ছা তাহলে, তুমি আজকে শুধু কথাবার্তা বলে নাও। আমি একটু আসছি। ‘

‘জ্বী। ‘

রোদসী টেবিলের অপরপাশে গিয়ে বসতেই শিশিরও অন্য পাশে চেয়ার টেনে বসলো। রোদসী জিজ্ঞেস করলো,

‘ক্লাসে রোল কত তোমার? ‘

‘জ্বী, এক। ‘

রোদসী বুঝতে পারলো শিশির সত্যিই ভালো ছাত্র।
টুকটাক কথাবার্তায় যথেষ্ট শান্ত মনে হলো তাঁর। সে মনে মনে একটু ভয়ই পেয়েছিলো। ভেবেছিলো শিশিরও যদি শহরের মতো হয়! একজনই তাঁর জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে দিলো। দুইজন হলে মরেই যাবে। কিন্তু এখন চিন্তা মুক্ত লাগছে। হালকা পাতলা কিছু পড়া বিষয়ক আলোচনা করে বের হলো রোদসী।
কাল বিকেল থেকে রোজ পড়াবে সে। যেহেতু খুব কাছেই বাসা, তাই কোনো ঝামেলা নেই। ঘরে এসে বিছানাটা ঝেড়ে দিলো। টেবিলটা মুছে বারান্দায় গেলো। তিতুসের বাটিটায় ওর কিছু খাবার দিয়ে চুপ করে পাশেই বসে রইলো বই নিয়ে। আর্শ সবেমাত্র মাঠ থেকে খেলে বাড়ি এসে পড়েছে। সে এসেই রোদসীকে ঝাকিয়ে বলল,

‘জানো আপু, আজকে উপরের তলার শহর ভাইয়া আমাকে চকলেট কিনে দিয়েছে। ভাইয়াটা অনেক ভালো। আমাকে ক্রিকেট খেলায়ও নিয়েছে। ‘

রোদসী বিরক্ত মুখে বলল,

‘এমন নোংরা হয়েছিস! ফ্রেশ না হয়ে এখানে এলি কেনো? আর বলেছিলাম না, ওই শহর ছেলেটার থেকে দূরে থাকবি। ‘

আর্শ মুখ অসম্মতিসূচক নেড়ে বলল,

‘কিন্তু আপু, শহর ভাইয়া খুব আদর করে আমাকে। ‘

‘এই যা তো এখান থেকে! ছেলেটার নাম নিবি না আমার সামনে৷ ‘

আর্শ মুখ মলিন করে বের হলো। কেয়া ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলেন৷ আর্শকে বললেন,

‘কী হয়েছে? এমন মুখ করে আছিস কেনো? ‘

‘মা, আপু আগে তো আমার সঙ্গে কত খেলা করতো,বিকেল হলেই ঘুরতে নিয়ে যেতো। কিন্তু এখন কথাও বলেনা। ‘

‘কথা তো কারও সঙ্গেই বলেনা। তোর সাথে কোনো শত্রুতা নেই। মন খারাপ করিস না। যা ঘরে টিভি দেখ।’

‘কিন্তু এমন কেনো করে আপু?’

‘তুই ছোট এখনো, অত বুঝতে হবে না। ‘

আর্শ চলে যেতেই তিনি চোখের কোণের জলটুকু মুছে নিলেন। অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে চলবেনা। সময় সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে থাকবে। মনে মনে ঠিক করলেন, যতদ্রুত সম্ভব তিনি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবেন। নাহলে, এভাবে একা থাকতে থাকতে মেয়েটা মানসিক রোগীতে পরিনত হবে। মেয়েকে বাঁচাতে হলে, তাই করতে হবে। কেউ কিছু জানার আগেই কাজ সারতে পারলেই স্বস্তি।

চলবে-
লেখিকা- নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here