মেঘভেলায় প্রেমচিঠি” পর্ব ২০

0
446

“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”

২০.

মোটা দেয়াল আর ব্যারা দিয়ে ঢেকে দেয়া তাঁর ভিতরে
জিরাফ গুলোকে দেখতে বেশ লাগছে। কী সুন্দর করে ছোট জিরাফটা মায়ের দিকে তাকিয়ে খাবার খাচ্ছে! মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে রোদসী আর শহর। শহরের হাত ধরে রোদসী সবগুলো পশু পাখি নিপুণ দৃষ্টিতে পরীক্ষণ করছে। রোদসীর সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ময়ূর। আশ্চর্যজনক ভাবে, রোদসী ময়ূরের খাঁচার সামনে যেতেই সেটা একটু কাছে এসে ডানা মেলে ঘুরে ঘুরে দেখালো। খুশিতে হেঁসে ফেললো সে। শহর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
মেয়েটাকে সুন্দর লাগে হাসলে, অথচ মেয়েটা হাসতেই চায়না। যেনো ঘোর আপত্তি হাসিখুশি থাকায়। শহর ঠিক করে, কাজের থেকে বিরতি নিয়ে মাঝে মাঝে মেয়েটাকে ঘুরিয়ে আনবে এদিকে ওদিকে। অল্প খানিকটা দিলেই কেমন চোখ মুখ চকচক করে ওঠে। যদিও মুখ ফুটে অতোটা আনন্দ প্রকাশ করে না। কেনো এতো দ্বিধা? শহর আনমনে ভাবে। ধ্যান ভাঙে রোদসীর হাত টানায়। রোদসী উৎফুল্লতা নিয়ে বলছে,

‘চলুন না, ঐ পার্কটায় যাই। ‘

শহর তাকিয়ে দেখে চিড়িয়াখানার ভিতরের ছোট একটা জায়গা নিয়ে পার্ক করা। এটা বোধ হয় নতুন হয়েছে, কিংবা ওরই চোখে পড়েনি। শহর হাসিমুখে বলে,

‘চলো। ‘

রোদসীকে নিয়ে পার্কটায় ঢোকে শহর। দুইটা দোলনা, একটা স্লিপার আর আরওকিছু বাচ্চাদের খেলার জিনিস রাখা। শহর এসবই দেখছিলো। হঠাৎ খেয়াল করে রোদসী এক ধ্যানে দোলনার দিকে তাকিয়ে আছে। শহর মুখ কাছে এনে বলে,

‘চড়বে? ‘

রোদসী চকিতে তাকায়। চোখের মাঝে কোন স্মৃতি হয়তো ভেসে বেড়াচ্ছিলো। রোদসী তড়িৎ গতিতে মাথা
নাড়িয়ে বলে,

‘না। এখন কী আর বাচ্চা আছি নাকি? ‘

শহর খোঁচা দিয়ে বলে,

‘এখনও বা কী বড় হয়েছো! আমার কাঁধ সমানও তো না তুমি। ‘

রোদসী ভ্রু কুচকে তাকালো। বাই এনি চান্স, ছেলেটা কী তাঁকে অপমান করলো! তাও আবার উচ্চতা নিয়ে?
হ্যা, রোদসী জানে যে শহর একটু বেশিই লম্বা। চিকন শরীরে যেনো আরও বেশি লম্বা লাগে। তাই বলে, রোদসী যে খাটো তা নয়। পাঁচ ফুট ছয়ের মতো হবে।
কিন্তু শহরের পাশে দাঁড়ালে একটা পুতুলের মতো লাগে। নাক ফুলিয়ে রোদসী বলল,

‘অতিরিক্ত লম্বা হওয়া কোনো ভালো কথা নয়। এটাও এক ধরনের রোগ। তাই অতো গর্ব করার কিছুই নেই। ‘

শহর মুখ বাঁকিয়ে বলল,

‘হুহ্! লম্বা হওয়া রোগ তোমাকে কে বলেছে? ‘

‘রোগই তো, এটাকে বলা হয় লম্বুটে রোগ। কথায় আছে না, লম্বা মানুষের বুদ্ধি হাঁটুতে থাকে! ‘

শহর রেগে গিয়ে বলল,

‘কীহ! কী বললে তুমি? ‘

‘এক কথা আমি দু’বার বলিনা, বয়রাদের সঙ্গে তো জীবনেও চলিনা।’

শহর ঠোঁট চেপে রাখলো। কীভাবে কথায় কথায় তাঁকে অপমান করলো এই ছোট মেয়েটা! একি মানা যায়!
শহর মুখ ফুলিয়ে পাশের বেঞ্চিতে বসে বলল,

‘আচ্ছা তাহলে, আমি যেহেতু বয়রা আর তুমি বয়রাদের সঙ্গে চলোও না। তবে, একা একাই ঘুরে যাও। ‘

রোদসী শহরকে চেতিয়ে দিয়ে খিলখিল করে হাসছে। শহরের কথা শুনে বলল,

‘ঠিক আছে। ‘

বলে রোদসী পার্ক থেকে বেরিয়ে গেলো। এক মিনিট দুই মিনিট করে আধা ঘণ্টা পার হতেই শহরের টনক নড়লো। এতক্ষণ ভাবছিলো, রোদসী হয়তোবা এখানেই কোথাও ঘুরছে। কিন্তু, যখন শহর দেখলো পার্কের আশেপাশে রোদসী কোথাও নেই তখন কপাল বেয়ে সুক্ষ্ম ঘামের লাইন ফোঁটায় ফোঁটায় গলদেশে পড়ছে। বুকটা ধুকধুক করতে শুরু করলো। রোদসীর কাছে তো ফোনও নেই। নাহলে, কল করা যেতো। একা মেয়ে মানুষ, কোনো বিপদ হলে! আর ভাবতে পারেনা শহর। নিজের উপর ভীষণ রাগ হয়। কেনো বলেছিলো, একা যেতে। পূর্ণ এক ঘন্টা খোঁজা খুঁজির পরও যখন শহর কোথাও পেলো না তখন চোখের কোণে জল জমলো। চোখে হাহাকার ঠেলে বেরিয়ে আসলো। শুঁকনো মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে বুকে।
শহর এখানের এক ডিউটিরত কর্মকর্তাকে বিষয়টা জানালে তিনি বললেন, মাইকিং করলে পাওয়া যেতে পারে। শহরও দ্রুত গেলো মাইকিং এর ব্যবস্থা করতে।
সেখানে কর্মরত এক লোক ঘোষণা করলো। শহর পাশের বেঞ্চে বসে আছে মুখ দুই হাতে ঢেকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। দরদর করে ঘেমে উঠেছে শরীর। নানান রকম চিন্তা ভাবনা করতে করতে হঠাৎ মনে হলো কে যেন কাঁধে হাত রেখেছে। মুখ তুলে তাকাতেই দেখলো রোদসী মিটিমিটি হেঁসে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। শহর কোনো কিছু না ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। উত্তেজিত হয়ে বলল,

‘কোথায় চলে গেছিলে তুমি! আরেকটু হলেই আমার শ্বাস আঁটকে যেতো। তুমি আর কখনো ছেড়ে যেওনা রোদচশমা। ‘

রোদসী অবাক হয়ে গেলো। হাত পা শিরশির করে কাঁপছে। শহরকে ভয় দেখানোর জন্য রোদসী একটু দূরে সাপ পরিদর্শন করার জায়গাটায় গিয়েছিলো।
ভেবেছিলো কিছুক্ষণ পরই এসে পড়বে। কিন্তু শহর যে এতো তাড়াতাড়ি হয়রান হয়ে খুঁজে বেরাবে, তা বোধ হয় কল্পনাতেও আসেনি তাঁর। অজান্তেই আবছা ভালো লাগা রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেয়ে যেতে লাগলো। কেউ তাঁর জন্য এতোটা চিন্তা করে ভেবে সুখপাখিরা তিরতির করে উড়তে লাগে মনে। আশেপাশে কয়েক জন লোক মুখ চেপে হাসছে। তা দেখে লজ্জা পেলো রোদসী। ইতস্তত করে শহরকে ছাড়ালো। শহরের চোখে মুখে এখনো উৎকন্ঠা। যেনো আশেপাশের কেউই এখন গুরুত্বপূর্ণ নয় রোদসী ছাড়া। শহরকে শান্ত করতে রোদসী মিনমিন করে অপরাধীর মতো বলল,

‘আসলে, আমি পাশেই ছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি আপনি এতো তাড়াতাড়ি খুঁজে এনাউন্সমেন্ট করবেন। সরি। ‘

শহর হাফ ছাড়লো। শান্ত হলো কিছুটা। রোদসীর হাতটা আঁকড়ে ধরে পাশের লোকজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হলো চিড়িয়াখানা থেকে। রোদসী একবার নিজেদের একসাথে থাকা জোরালো হাতটার
দিকে একবার তাকাচ্ছে আরেক বার শহরের মুখের দিকে। একটু পর বলল,

‘আমি ছোট বাচ্চা না। একা হাঁটতে পারি। ‘

শহর আড়চোখে একবার তাকিয়ে বলল,

‘তুমি একটা বড় বাচ্চা। আবারও হারিয়ে যাবে। ‘

‘আমি তখন হারাইনি। এর আগেও এখানে অনেক বার এসেছি। রাস্তা চিনি তো। ‘

‘ঐ সময় হারাওনি। কিন্তু এবার হারালে! ‘

‘আমি হারালেই বা আপনার কী! আমি তো ঝগড়া করি শুধু, রাগ দেখাই। ‘

রোদসীর খোঁচা দেয়ায় শহর তেমন কিছু মুখে না বললেও মনে মনে বলল,

‘তুমি আরেকবার হারালে আর আমি ধুঁকে ধুঁকে মরবো রৌদ্রানী। ‘

_

গাড়ি থেকে নেমে মাঝরাস্তায় শহর ফুচকা আনতে গেলো। রোদসী বিরক্ত মুখে গাড়ির পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। এই ছেলেটার কিছু ঠিক নেই। মন যখন যা চায় তাই করে। এই দুপুর বেলা কেউ ফুচকা খায়! শহরকে বলেছিলো, বিকেলে খেতে। কিন্তু নাহ, জনাবের না কী ক্রেভিং হয়েছে। রোদসী তখন মনে মনে বেশ কয়েকটা গালি দিয়েছিলো ওকে। আরে বাবা! ছেলে মানুষ, তুই কী প্রেগন্যান্ট! যে আবার ক্রেভিং হবে! জাস্ট অসহ্য, বিরক্তিকর ব্যাপার স্যাপার। ফুঁসতে থাকলো রোদসী। সেই যে গিয়েছে, আসার নাম নেই। রোদসী ভাবলো, একটু এগিয়ে দেখা যাক। গিয়ে দেখে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে শহর। তাই রোদসী আর এগোলো না৷ চুপচাপ সাইডে দাঁড়াতেই, মনে হলো কেউ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। পেছনে তাকিয়ে দেখলো, ঠিকই দুটো মহিলা ওর দিকে আসছে। হালকা চেনা লাগলেও বুঝতে পারলো না এরা কে। তবে মহিলা দুটো ওর কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। চোখে মুখে দারুণ কৌতূহল। যেনো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখে ফেলেছে। একজন মহিলা উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

‘আরে! তুমি আমাদের পুরনো পাড়ার রোদ না? ঐ যে, একটা ছেলে যে তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে ধর্ষণ করেছিলো! ‘

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here