”মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”
২৬.
অনিশ্চিত জীবনের আভাসে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো রোদসী। অসহ্য দহনে অন্তর আত্মাও কেঁদে উঠলো। যেখানে ভেবেছিলো আর কেউ পাশে না থাকলেও মা বাবার ভরসা অবশ্যই পাবে। অথচ, অন্য লোকের কথায় কান দিয়ে তারাও আরেকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলো। না না, রোদসীর মতে অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত। কেয়া হোসেন কঠোর ভাবে বলেছেন, ‘যার জন্য এই মেয়ে আমাদের ছেড়ে গেছে, ওকে তার কাছেই পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করো। ‘ এটি অবশ্য কেয়ার নিজস্ব মত নয়। আশেপাশের অসংখ্য মানুষরা কানাঘুঁষা করে তার মগজে ঢুকিয়েছে। রাগের মাথায় তিনি তাই সিদ্ধান্ত নিলেন। মেডিকেল টেস্টে বোঝা গেছে, রোদসী ইজ নট রেপড। অতএব, সবার মতে সূর্য মোটেও ধর্ষণের জন্য ওকে নিয়ে যায়নি। তবুও একবার কেউ ভাবলো না, যদি সূর্য তেমন কিছু না-ই করে থাকে তাহলে রোদসী সেরকম অবস্থায় কী করে পৌঁছালো। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করছেনা এ কথা। অনেকের মতে, রোদসীর পরিবার ধর্ষণের ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতেই মিথ্যা রিপোর্ট বানিয়েছে। রোদসী খুব ভালো করে বুঝতে পারছে,ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। হাসপাতাল থেকে ওকে বাসায় শিফট হয়েছে খুবই সীমিত সময়ের জন্য। বাসায় আসার পর কেয়া বা মনিরুল কেউই দুই বাক্য উচ্চারণ করেনি ওর সাথে। বিয়ের জন্য মোটামুটি একটা শাড়ি এনে এক প্রকার জোরজবরি করেই পরানো হলো। শাড়ির আঁচল খামচে তখন রোদসী গুণগুণীয়ে কাঁদছে। আপন মানুষ গুলোই যখন অবিশ্বাস করলো, তখন কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। বলতে নিয়েও অপমানিত হলো। কেয়াকে যখন রোদসী বলছিলো, ওর কোনো দোষ নেই। তিনি পরিষ্কার করে বলে দিলেন, এইসব নাটক না করতে।
কাজী এসেছে বিয়ের জন্য। রোদসীকে টেনেহিঁচড়ে সেদিকে নিয়ে যাওয়া হলো। রোদসী বসার পর দেখলো তার পাশেই সূর্য বসে আছে। রোদসীকে দেখে আড়ালে বিদঘুটে এক হাসি দিয়ে ওর হাতটা চেপে বললো,
‘পালিয়ে কী লাভ হলো? সেই আমার কাছেই তো এলে সোনা। ‘
রোদসী রেগে ঘৃণ্য দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘তোর মতো চরিত্রহীনের সঙ্গে আমি জীবনেও থাকবো না! ‘
সূর্য ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
‘এই চরিত্রহীনকেই গ্রহণ করতে হবে, নাহলে আমি সব ধ্বংস করবো রোদ ‘
মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে রোদসী। এমন নোংরা একজন মানুষের সাথে কীভাবে থাকবে ভেবেই মরে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। কাজী সাহেব ‘কবুল’ বলতে বললেও ঠোট চেপে বসে আছে রোদসী। সূর্য অনেক বার চোখ রাঙিয়ে দিলেও মুখ খুলছে না। অনেক ক্ষণ কেটে যাওয়ার পর যখন আর কোনো উপায় পেলো না তখন হার মেনে কবুল বলতে নিচ্ছিলো। কিন্তু পেছনে থেকে এক নারীকন্ঠে তাতে বাঁধা পড়লো। রোদসী সহ বাকী সবাই তাকিয়ে দেখলো একটা অল্প বয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদসী চমকে উঠলো, এটা নদী। উষ্কখুষ্ক চুল, মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে নদী। রোদসীর আত্মা যেনো এবার পানি পেলো। উঠে দাঁড়িয়ে গেলো ও। সূর্য আমতা আমতা করতে থাকলো। নদী এসেই সূর্যকে থাপ্পড় মেরে দিলো। কলার টেনে বললো,
‘শয়তানের বাচ্চা! আমাকে বিয়ে করে কারো সামনে স্বীকৃতি দিতে চাস না এই কারণে! আমাকে এতিম পেয়ে ফাসিয়ে বিয়ে করলি, এখন আবার আরেক জনের সঙ্গে এমন করছিস! লজ্জা নেই তোর! ‘
সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। রোদসী এগিয়ে এসে নদীকে জিজ্ঞেস করলো ওকে কে এনেছে। নদী বললো, রোদসীর মামাতো ভাই আশরাফ গিয়ে নিয়ে এসেছে। সূর্য কলার ছাড়িয়ে বলে,
‘দেখো নদী, আমি তোমাকে ভালোবাসি না। একজন পুরুষ দুই বিয়ে করতে পারে। তোমার সমস্যা হলে, আমি তোমাকে তালাক দিয়ে দেবো। ‘
নদী আগে থেকেই কাঁদছিলো। এখন অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো। ঠিক এই মানুষটাকেই একসময় নিজের পৃথিবী ভাবতো নদী। এতিম হওয়ায় মা বাবার সঙ্গ পায়নি। একা একা হোস্টেলে বড় হয়েছে। একটা মামা ছিলো, সে শুধু মাসে মাসে হোস্টেলের টাকা টা দিতো। এভাবেই এক কোচিং থেকে সূর্যের থেকে পরিচয়। নদীর সত্যিকারেই পানির মতো শান্ত। এ কূল কিনারায় কেউ ছিলো না। সব মেয়ের মতো ওরও একটা স্বপ্ন ছিলো স্বামী সংসারের। সূর্যকে ঘিরেই সব স্বপ্ন সাজিয়ে ছিলো। সূর্যের ভালোমানুষির মুখোশটাই দেখেছিলো। আড়ালের কুৎসিত চেহারাটা নজরে পড়েনি। সরল মনটা প্রথম সূর্যকেই দিয়েছিলো। অথচ, এখন এ মানুষটাই এখন বলছে তালাক দিবে। এতক্ষণ নদী সব সয়ে নিয়ে ভেবেছিলো, সূর্যকে আর যাই হোক ছেড়ে দিবেনা। এখন আর কিছু বলার শব্দ পেলো না। চলে যেতে যেতে সূর্যকে শুধু বলল,
‘একদিন তুমি বুঝবে আমি কী ছিলাম। তোমার মতো মানুষের ধ্বংস হবেই, হয় আজ নাহয় কাল। ‘
নদী চলে যাওয়ার পর রোদসীর মা বাবাকে আশরাফ সব কথা বললো। পুলিশও এসেছে। আশরাফই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে। রোদসী আশরাফকে সব খুলে বলেছিলো হাসপাতালেই। বোনের কথায় অবিশ্বাস করেনি ও। আশরাফ পুলিশকে সবকিছু বের করতে অনুরোধ করলো। ধীরে ধীরে আরও অনেক সত্য সামনে এলো। সূর্য এর আগে ড্রাগসের ব্যবসা করতো। নারী পাচারের ব্যবসাতেও হাত ছিলো। পুলিশ ফোর্স এসে সূর্যকে এরেস্ট করে নিয়ে গেলো। রোদসীকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সবার সামনে আসতেই কেয়া, মনিরুল অপরাধী চোখে তাকালেন। তারা দু’জনই রোদসীর কাছে আসতে নিলে রোদসী বললো, এ বাড়িতে আর থাকবে না সে। দু’জন অনেক আকুতি করলেও রোদসী মনে যে আঘাতটা পেয়েছিলো তা মুছে যায়নি। তারপর অনেক দিন মামাবাড়িতেই ছিলো রোদসী। একা একা একটা আলাদা জগৎ বানিয়ে ফেলেছিলো। আশরাফ ও মামা বাড়ির সবাই অনেক চেষ্টা করে ওকে আবারও টেনে ভর্তি করালো। এসএসসি দিতে পারেনি সেসময়। একরকম ঘরেই সারাক্ষণ বসে থাকতো রোদসী। পড়াশোনা শুরু করলেও কোনো বন্ধু বান্ধব বানায়নি। আর না কোনো ছেলে মানুষের কথায় বিশ্বাস করেছে। নদীকে দেখে ওর ভালোবাসার সাধ মিটেছিলো। আর রিম্মি, সোহাকে দেখে বন্ধুত্বের। সেখানে এসএসসি দিয়ে তারপর বাড়ি ফিরে রোদসী। রোজ রোজ মা বাবার আহাজারি আর সহ্য হচ্ছিল না। তবুও ক্ষত পুরোপুরি মিটেনি। তারউপর কিছু মানুষ তো আছেই এখনো রাস্তায় দেখলে দুই একটা তিক্ত বাণী শোনাতে ভোলেনা।
রোদসী শহরের বুক থেকে মাথা তুললো। শহরের চোখ লাল হয়ে আছে। যেনো একটা ঘোরে আছে সে। রোদসীর গায়ে এখনো জ্বর আছে। আলতো হেঁসে রোদসী শহরকে ঝাকাতেই শহর নড়েচড়ে উঠলো। এসব কিছু শুনে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। রোদসীর গালে হাত রেখে বললো,
‘অনেক হয়েছে ঘুমাও। ‘
রোদসী চোখ বন্ধ করে হেলে ছিলো। চোখ খুলে বলল,
‘আপনাকে আমার আগে এসব বলা উচিত ছিলো। আপনার নিশ্চয়ই এখন আফসোস হচ্ছে, আপনাকে ঠকিয়েছি আমি। ‘
শহর গম্ভীর গলায় বলল,
‘রোদসী, তুমি ধর্ষণ হওনি। কিন্তু যদি হতে, তবুও আমার কোনো সমস্যা ছিলো না। দোষ মোটেও তোমার হতো না, দোষ যা সবটা ওই লোকটার। আমাদের সমাজে ধর্ষকের চেয়েও ধর্ষিতারা বেশি ভোগে। সামনে আট দশটা জ্ঞানের বাণী শোনাতে পারে কিন্তু ওই ধর্ষিতাকে নিজের বাড়ির বউ করতে পারে না। যে মেয়ে হোটেলে গিয়ে বয়ফ্রেন্ডের কাছে একশোবার নিজেকে বিলিয়ে দেয় লুকিয়ে, তাকে ঠিকই বউ করতে পারে কিন্তু যে মেয়ে সারাজীবন পর্দার আড়ালে থেকেছে তাকে জোর করে ধর্ষণের পর গ্রহণ করতে আপত্তি করে। এদের কথায় কান দিলে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। এরা একবেলা তোমাকে খাওয়াবে পড়াবে না। অতএব, এদেরকে দেখলে উচিত জবাবটা মুখের উপরই দিয়ে দিবে। এখন ঘুমাও, তুমি অসুস্থ। ‘
মুগ্ধ দৃষ্টিতে রোদসী ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবারও চোখ বুঁজে নিলো। রোদসীর মাথাটা নিজের বুকের উপর টেনে শহর পাশেই শুয়ে পড়লো। রোদসীর মুখের উপর তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক। নিজের চোখ বুঁজে রোদসীর কানের কাছে বিরবির করে বলল,
‘রৌদ্রময়ী, তুমি আমার দিকে একটুকরো প্রেম ছু্ড়ে দিতে পারো না! ‘
চলবে-
(উফফ! কতদিন পর। সবাইকে সরি। গ্রামের বাড়িতে নেটের যে এতো করুণ অবস্থা হবে ভাবতেও পারিনি। এই পর্বটা ছয়দিন আগে লেখা, অথচ পোস্ট করতে না পেরে অশান্তিতে ভুগেছি। যাক, এবার ফিরে এলাম। শুভ দুপুর।)