নিভৃতে_যতনে পর্ব ২০

0
2617

#নিভৃতে_যতনে
#Part_20
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— আপনাকে দেখলে আমার কি মনে হয় যানেন? ছ্যাঁকা খাওয়া বিরহ প্রেমিক। মানে দেবদাসকেও হার মানাবেন আপনি। আচ্ছা আসলেই ছ্যাঁকা ট্যাকা খেয়েছেন নাকি?

শেষের কথাটা কৌতুকের সুরেই বললাম। কথাটা শুনে উনি ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দেন,

— হ্যাঁ খেয়েছি।

তাঁর এই এহেন স্বীকারোক্তি আমার কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছানো মাএ তা বজ্রপাতের ন্যায় প্রতিধ্বনিত হলো। পা যুগল স্থির হয়ে আসলো, চোখে মুখে ফুটে উঠলো অপার বিস্ময়। অধর দুইটির মাঝে সৃষ্টি হলো কিঞ্চিৎ দূরত্ব। বুকের বা পাশটা হুড়হুড় করে মুচড়ে উঠলো। বিষয়টা যে মোটেও আমার বোধগম্য ছিল না তা আমার চেহেরা দেখে সাফ বুঝা যাচ্ছে। আমি কথাটা নিচক ফাজলামো করে বলেছিলাম। এইটা যে বাস্তব হয়ে দাঁড়াবে তা মোটেও আশা করিনি। আমি স্তম্ভিত চাহনিতে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছু দূর যেতেই রোয়েন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকালো৷ আমাকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চার-পাঁচ কদম আমার দিকে এগিয়ে আসলো। শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

— কোন সমস্যা?

আমি কিছু না বলে আড়ষ্ট নয়নে তাঁর পানে তাকিয়ে থাকলাম। জোৎস্নার স্নিগ্ধ আলো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তাঁর উপর। সেই আলোয় তার মুখশ্রীর মুখভঙ্গি আমার নিকট স্পষ্ট। অতি ভাবলেশহীন তাঁর আকার ভঙ্গি। যেন কিছুই হয়নি। অথচ এইদিকে আমার মনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে ঝড়। আমাকে এইভাবে চুপ থাকতে দেখে রোয়েন আবার বলে উঠলেন,

— কি হলো?

এইবার আমি নিজেকে একটু স্বাভাবিক করলাম। বিষয়টার সত্যতা যাচাই করার জন্য রোয়েনকে জিজ্ঞেস করলাম,

— আসলেই কি তা সত্যি?

আমার প্রশ্ন শোনার পর রোয়েনের ভ্রুকুটি আরও কুঞ্চিত হয়ে আসলো। তাঁর অদ্ভুত দুইটি নয়নে ফুটে উঠলো একটুখানি বিভ্রান্তি। যা আমার নিকট স্পষ্ট। উনি সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

— কোনটা সত্যি?

আমি অতি শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— ছ্যাঁকা খাওয়ার বিষয়টা?

কথাটা শোনার পর তার নয়নে বিদ্যমান বিভ্রান্তি দূর হলো। এক হয়ে আসা ভ্রুকুটি নিজ স্থানে ফিরে এলো৷ উনি শীতল চাহনি আমার উপর নিক্ষেপ করে পুনরায় স্বীকারোক্তি করলেন,

— হ্যাঁ।

তার স্বীকারোক্তিটি যেন আমার মধ্যে বিষন্নতা বয়ে আনে। বুকের কোন এক পাশে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো। রোয়েন ছ্যাঁকা খেয়েছে, তাঁর আগে একটা রিলেশন ছিল, উনিও একদা কাউকে ভালোবাসতো কথাগুলো ভাবনার মাঝে আসতেই আমার মন বারংবার বিষিয়ে যাচ্ছে। আমার এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ আমি জানি না। না আমি রোয়েনের প্রতি দূর্বল, না আমি তাঁকে ভালোবাসি। তাও আমার এমন অনুভূতি কেন হচ্ছে জানি না। শুধু জানি কোন এক চাপা কষ্ট আমায় তীব্রভাবে ঝাঁকড়ে ধরেছে। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করলাম। নিজেই নিজেকে বুঝ দিতে থাকলাম যে, ” সবারই একটা পার্সোনাল লাইফ আছে, প্রাইভেসি আছে। সেই সাথে একটা অতীতও আছে। অতীতটা হতে পারে তিক্ত অথবা সিক্ত। কিন্তু এর উপরে একটা সত্য হলো সেটা অতীত। যার এখন কোন অস্তিত্ব নেই। যেটা এখন একমাত্র সত্য তা হচ্ছে বর্তমান। আর এইভাবেও এখনকার দিনে রিলেশন করাটা কমন বিষয়। তাই এইটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।”

কথাগুলো আমার মস্তিষ্ক বিচরণ করতেই আমি শান্ত হয়ে যাই। মুখে ঝুলিয়ে নেই সরু হাসির রেখা। হঠাৎ মনের মাঝে একটা প্রশ্ন আসতেই আমি রোয়েনের দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— যদি কিছু না মনে করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করতে চাই। চিন্তা নেই আপনার ব্রেকাপের কারণ জিজ্ঞেস করবো না। আমি শুধু জানতে চাই, আপনি কি ব্রেকাপের পরই এমন হয়ে গিয়েছিলেন?

রোয়েন আমার কথা শুনে স্থির চোখে তাকায়। স্বাভাবিক গলায় বলেন,

— আরেহ না! আমি ছোট থেকেই এমন। বলতে পারো ছোট থেকেই ইন্ট্রোভার্ট বা অন্তর্মুখী। আর এর পিছে স্পেসিফিক কোন কারণ নেই৷ আর রইলো আমার ব্রেকাপের কথা। সেটা এমন কোন বিষয় নেই যে প্রশ্ন করা যাবে না বা নিষেধাজ্ঞা আছে।

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— তো বলুন।

রোয়েন দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— ভার্সিটিতে পড়াকালীন বছর খানিক প্রেম ছিল। পরে একটা সময় এসে সে তিক্ত হয়ে উঠে এবং আমাকে জানিয়ে দে সে আর রিলেশন রাখতে চায় না৷

আমি কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— কারণ?

— কারণ এইটাই আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আর আমার বাবা গ্রামের স্কুলের সাধারণ একজন হেডমাস্টার। আমার সাথে তার লাইফ সিকিউর না। এই সম্পর্কের কোন নিশ্চিয়তা নেই। সব শুনে আমিও আর সম্পর্কটা ধরে রাখিনি। ব্যাস! হয়ে গেলো ব্রেকাপ।

— আর খোঁজ করেন নি?

— দরকার বোধ করি নি। কিন্তু পরবর্তীতে এক কমন ফ্রেন্ডের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম যে,তার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে বিয়েও। বর প্রবাসী। অবস্থা ভালো। বিয়ের পর তাকেও বিদেশ নিয়ে যাবে। লাইফ একদম সেট। এইতো!

আমি বেশ কৌতহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— বিয়েটা কি আদৌ হয়েছিল?

উনি ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,

— শুনেছিলাম তো হয়েছিল। বাকি আর জানি না।

— অহ আচ্ছা।

এরপর নিরবতা। কথা নেই কারো মুখে। কেটে যায় কিছু প্রহর। জোৎস্নার আলো গলিয়ে পড়তে থাকে ভূপৃষ্ঠের বুকে। স্নিগ্ধ পরশে ভরিয়ে দিতে থাকে আমাদের৷ আমি তাকিয়ে আছি রোয়েনের দিকে আর উনি তাকিয়ে আছে আকাশের পানে। পরিবেশটা যেন স্বাভাবিক হয়েও অস্বাভাবিক। আমার খুব করে ইচ্ছে হলো তাকে জিজ্ঞেস করতে,

— সে কি আপনার আবেগ ছিল নাকি ভালোবাসা?

কিন্তু মনের সংশয় আর আড়ষ্টতার জন্য প্রশ্নটা আর করা হলো না। প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে। রাতের অন্ধকার প্রগাঢ় হওয়ার সাথে সাথে হিম বায়ুর আনাগোনা বেড়ে যায়। যা ক্ষণেই গায়ের পশম দাঁড় করিয়ে দেয়। মৃদু কাঁপন ধরে যায় শরীরে। আমি গায়ের ওড়নাটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিতেই রোয়েন বলে উঠেন,

— রাত হয়েছে অনেক। এখন ফিরা উচিৎ।

আমিও তার কথায় সাই জানালাম। পাশাপাশি দুইজনই রওনা দিলাম রিজোর্টের উদ্দেশ্যে। আমার শরীরের কাঁপনটা স্পষ্ট হয়ে আসতেই রোয়েন একটা টু শব্দও না করে তার গায়ের জ্যাকেটটা খুলে পিছন থেকে আমার গায়ে জড়িয়ে দেয়। এরপর নির্বোধ ভাবে হাটতে থাকে। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতেই আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে স্নিগ্ধ হাসি। আমি গায়ে জ্যাকেটটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে আনমনে ভাবি,

— হোক না মানুষটি নিভৃতে গড়া, নির্মল প্রেমিক তো সে আমারই।

_______________________

চারদিকটা এখনো অন্ধকারে আছন্ন। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। হয়তো মিনিট পাঁচেকের মাঝেই রক্তিম এক গোলপিন্ডের দেখা মিলবে। হিম হিম ভাব চারদিকে। গোটা শহর এখনো কুয়াশায় ঘেরা। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ পর এক পুরুষালী কন্ঠ এসে বারি খায়। কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। নিজের নাম শ্রবণ হতেই মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। সজাগ হই আমি। নিভু নিভু চোখে সামনে তাকাতেই বুঝতে পারি কেউ আমাকে মৃদু পরিমাণে ধাক্কাচ্ছে। সাথে সাথে আমার ঘুম উবে যায়। আমি উঠে বসি। সামনে তাকাতেই দেখি রোয়েন দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে তার গম্ভীরতা। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই তিনি স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠেন,

— তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো। বাইরে যাব আমরা।

আমি একবার কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঢুলুঢুলু পায়ে এগিয়ে গেলাম ওয়াশরুমের। ফ্রেশ হয়ে আসতে না আসতেই রোয়েন বলে উঠেন,

— গায়ে মোটা কিছু জড়িয়ে নাও। বেশ ঠান্ডা বাইরে।

আমি তার কথা মত গায়ে একটা শাল জড়িয়ে নেই। অতঃপর উনার সামনে আসতেই আমার হাতের কব্জি ধরে বাইরে নিয়ে আসে। বাইরে আসতেই দেখতে পাই চারদিক ঘন কুয়াশায় ঘেরা। কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। এমনকি রোয়েনের পিছন দিকটাও আমার কাছে আবছা লাগছে। মাত্র আঁধার কাটছে। পুবাকাশে দেখা যাচ্ছে সরু আলোর রেখা। বুঝাই যাচ্ছে সূর্য উঠার সময় হয়ে গিয়েছে। হয়তো কয়েক প্রহর পেরুতেই গোল আকৃতির সূর্যটির দেখা মিলবে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর রোয়েন আমায় নিয়ে এক উঁচু জায়গায় এসে স্থির হয়। আমি তার দিকে কৌতহলী চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— আমরা এইখানে কেন এসেছি?

সে একটু নরম গলায় বলে,

— এখনই দেখতে পাবে। তুমি শুধু চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকো।

আমি তার কথা মত তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। খানিক বাদেই দেখা গেল, দূর পাহাড়ের ঘেষে বেরিয়ে আসছে সূর্যের রক্তিম লালচে আভা। যা মুহূর্তেই প্রগাঢ় নীল আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া। পাহাড় আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য্যিমামা। সবুজের মাঝে লালাভ রক্তিম এক চাহনি। আমি মনোমুগ্ধ হয়ে দৃশ্যটা যখন দেখছি ঠিক তখনই রোয়েন আমার পিছে এসে দাঁড়ান। কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি আমার সাথে ঘেষে দাঁড়ান এবং আমার ডান হাতটা চেপে ধরে উর্ধ্বে তা উপরে তুলে ধরেন। ঘটনাক্রমে আমি ভড়কে গেলেও হঠাৎ অনুভব করি শৈত্য কণার মত কিছু একটা আমার হাতের তর্জনী ছুঁয়ে যাচ্ছে। যা মুহূর্তেই গলে গিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার হাতের তর্জনী আর তালু। সাথে সাথে আমি শিউরি উঠি। হাত সরিয়ে আনতে নিলে রোয়েন আমার কানের সামনে ফিসফিসিয়ে বলে,

— ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এইগুলো মেঘ।

কথাটা কর্ণপাত হতেই আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি শুধু সামনে। মুখের ভাষাই যেন হারিয়ে ফেলেছি। নিজের জ্ঞান শক্তি পর্যন্ত যেন লোপ পেয়ে বসে আছি। ঘোরের মধ্যে চলে যেতে থাকি আমি। মেঘদলের উপরে হাসছে সূর্য। রোদ ঠিকরে পড়ছে মেঘের গায়ে। এ যেন অপরুপ দৃশ্য। দ্বিতীয় বারের মত মেঘ আমার হাতের তর্জনী স্পর্শ করতেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসি আমি। খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। একের পর এক মেঘের গায়ে আঁচড় কেটে লিখতে থাকি আমার নাম। মোহনীয় দৃষ্টিতে দেখতে থাকি শুভ্র মেঘে রাঙ্গা পরিবেশ।

#চলবে
এতক্ষণ কারেন্ট ছিল না বিধায় পর্বটা দিতে দেরি হয়ে গেলো। অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here