#নিভৃতে_যতনে
#Part_24
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
রোয়েনকে রান্না করতে দেখে আমার চোখ চড়কগাছ। বিস্ময়ে অভিভূত আমি। অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে থাকি সামনে। স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলে উঠি,
— আপনি রান্না জানেন?
আমার কন্ঠ শুনে রোয়েন মাথা তুলে আমার দিকে তাকান। ভ্রুকুটি কুঁচকে বলেন,
— রান্না না জানলে কি রান্নাঘরে আসতাম?
কথাটা শোনা মাত্র আমি থমথম খেয়ে যাই। অস্ফুটস্বরে বলি,
— না মানে ছেলেদের কখনো রান্না করতে দেখিনি তো তাই একটু…
আমার কথার মাঝে রোয়েন ফোঁড়ন দিয়ে বলে,
— রেস্টুরেন্টে তো দেখছ নাকি?
আমি কিছুক্ষণ ভেবে মাথা দুলিয়ে বলি,
— হ্যাঁ।
— রেস্টুরেন্টে কিন্তু রান্না থেকে শুরু করে থালাবাসন ধোঁয়া, খাবার সার্ভ করা, টেবিল ও ফ্লোর পরিষ্কার করা সবই ছেলেরা করে। তখন কিন্তু তাদের দেখে কারো অবাক লাগে বরং স্বাভাবিকই লাগে। অথচ এই একই কাজই যদি ছেলেরা বাসায় করে তাহলে সকলে যেন অবাকের শেষ চূড়ায় চলে যায়। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
আমি এতক্ষণ রোয়েনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। রোয়েনের কথা শেষে কথাগুলো যেন আমার মস্তিষ্কেও টনক নাড়ে। আসলেই তাই তো! আমি রোয়েনের দিকে থমথম দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলে,
— এর মূল কারণ কি জানো? আমাদের সমাজ। তারা আমাদের সকলের মধ্যে একটা চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, মেয়েরা ঘরের কাজের জন্য আর ছেলেরা বাহিরের কাজের জন্য তৈরি। আর এই চিন্তা পোষণ করেই তো সকলের চিন্তা ধারা এমন হয়েছে যে, যে কাজ বাহিরে ছেলেদের জন্য সম্মান সেটাই ঘরের চারদেয়ালে অসম্মান।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,
— কথাটা ভুল বলেন নি। কিন্তু কতজনেই বা ভাবে এইভাবে?
— যে কয়জন ভাবেই তাতেই হবে।
— সে যাই হোক! আপনি রান্না কিভাবে শিখলেন?
রোয়েন চপিং বোর্ডে শসা কাটতে কাটতে বলে,
— জব পাওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যাচেলর বাসায় থেকেছি আমি। তো সেই সুবাদে রান্না-বান্নাটা রপ্ত করতে হয়েছিল।
— আপনি ব্যাচেলর বাসায় থাকতেন?
— হুম।
— আচ্ছা আপনি যান বাকিটা আমি করে নিচ্ছি৷
— আরেহ হয়েই গিয়েছে সব।
— তাও আপনাকে রান্নাঘরে দেখতে অস্বস্তি লাগছে আমার।
রোয়েন আমার মুখ পানে তাকিয়ে বলে,
— সংসার যেহেতু দুইজনের সেহেতু দায়িত্বও দুইজনেরই। তুমি করো আর আমি করি একই কথা।
আমি ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলি,
— তাহলে এরপরের শিফট আমার।
— আচ্ছা।
____________________________
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় চারদিক আজ বেশ নীরব। তেমন কোন সোরগোল নেই।দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে আমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই নিয়ে বসি আর আমার পাশেই বসে রোয়েন ল্যাপটপ চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি বেশ ক্ষানিকটা সময় এইভাবেই বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে রেখে দেই। কেন জানি না বইয়ের পাতায় মন ঠেকছে না আজ। ঘরের মাঝে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বার বার বাহির থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি একবার রোয়েনের দিকে তাকাই। উনি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি গলা ঝেড়ে বলি,
— এই যে শুনছেন?
উনি ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,
— হুম বলো।
— বাসায় ভালো লাগছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে।
রোয়েন আমার দিকে শীতল চাহনিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
— বাহিরে যেতে চাও?
আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেই। তা দেখে রোয়েন ল্যাপটপে কিছু একটা করে অফ করে দেন। বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন,
— যাও! তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।
_________________
দেখতে দেখতে আরও বেশ কিছু সময় চলে গেল। শীত এসে পড়লো সপ্তপর্ণে। কুয়াশার চাদর লেপ্টে গেল শহরের আনাচেকানাচে। সেই সাথে ভারী হলো ঘুমের পাল্লা। শীত সকালের মিষ্টি ঘুম ছেঁড়ে উঠতে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেলো আমার। যার ফলে শেষের দিকে তাড়াহুড়ো লেগে গেল আমার। আজ রোয়েনের এক কাজিনের বিয়ে। সম্ভবত শুভ ভাইয়ার।দুপুর একটার মধ্যে থাকতে তাঁদের বাসায়। সেখান থেকে বরযাত্রী বের হবে এক সাথে। আত্মীয়তা বেশ ভালো বলে গ্রাম থেকে বাবা-মাও চলে এসেছে এই বিয়ে খাওয়ার জন্য। আপাতত তাঁরা শুভ ভাইয়ার বাসাতেই আছে। গতকাল বিকেলে এক কাজে তাদের শুভ ভাইয়াদের বাসায় যেতে হয়েছিল। এরপর কাজ শেষ হতে বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় শুভ ভাইয়ার বাসায়ই থেকে যান তাঁরা। তাই রোয়েন সকালেই তাঁদের কাপড় পাঠিয়ে দিয়েছেন যাতে তাঁদের অসুবিধা না হয়।
আমি বেশ তাড়াহুড়ো করছি কিন্তু তাও দেরি হয়েই যাচ্ছে৷ এর মূল কারণ শাড়ি৷ শুভ ভাইয়ার বাসা থেকে আমাকে একটা শাড়ি দেওয়া হয়েছে এবং বলে দেওয়া হয়েছে বিয়েতে আমি যেন এইটাই পড়ি৷ যার জন্য না চাওয়া সত্ত্বেও বাধ্য শাড়ি পড়তে হচ্ছে আমার। এক তো হাতে সময় কম তাঁর উপর এই শাড়ি। ঝামেলা আর ঝামেলা। কথায় আছে না, তারাহুরো করলে কোন কাজ ঠিকভাবে হয় না। আমার সাথেও আজ ঠিক তাই হচ্ছে। আমি বারংবার শাড়ির কুঁচি ঠিক করার চেষ্টা করছি কিন্তু বার বারই তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছুটেই ঠিক হচ্ছে না। আমি যখন এই শাড়ির কুঁচি নিয়ে একদফা যুদ্ধ করছি ঠিক তখনই রোয়েন রুমে এসে বলে,
— কি হয়নি তোমার।
সাথে সাথে আমি পিছনে ঘুরে চেঁচিয়ে বলি,
— এই আপনি! নক করে আসতে পারেন না। আমি শাড়ি পড়ছি তো।
রোয়েন নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলে,
— সেটা তো বিগত এক ঘন্টা ধরেই পড়ছো।
আমি কোনোমতে ভাঁজ করা শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে অর্ধেক কুঁচি করা শাড়ির ভাঁজগুলো হাতে নিয়ে রোয়েনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলি,
— কুঁচিগুলোই তো হচ্ছে না। কি করবো আমি?
রোয়েন অন্যদিকে তাকিয়ে বলেন,
— আমি কি জানি?
আমি নতজানু হয়ে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলি,
— একটু সাহায্য করেন।
রোয়েন একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে৷ অতঃপর আমার সামনে হাটু গেঁড়ে বসে বলে,
— তুমি উপর দিয়ে কুঁচি ঠিক করো আমি নিচ দিয়ে ঠিক করে দিচ্ছি৷
আমি মাথা দুলিয়ে কুঁচি করতে মন দিলাম। অবশেষে গিয়ে কুঁচিগুলো ঠিক হলো। উনি নিজ দিয়ে কুঁচি ঠিক করে দাঁড়িয়ে পড়েন। আমি তাঁর দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,
— থেংক ইউ!
উনি আমার সামনে এসে কানের কাছে ঝুঁকে শীতল কন্ঠে বলেন,
— সে শুধু আমার হাতটি সামলে নিক বাকি আজীবন আমি তার কুঁচি সামলে নিব।
কথাটা বলেই তিনি দুই-তিন কদম পিছিয়ে গেলেন। আমার দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলেন,
— তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। আর হ্যাঁ, শাড়িতে পিনআপ ভালো মত করবে। বিয়ে-শাদির মহল সবসময় তোমার দিকে নজর রাখা সম্ভব না।
কথাটা বলেই তিনি দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যান আর আমি হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তাঁর যাওয়ার দিকে। মুখে নেই রা। ঠোঁট যুগল আমার কিঞ্চিৎ ফাঁক। আমি দরজার পানে তাকিয়ে থেকে আনমনেই বলে উঠি, ‘লোকটা এমন অদ্ভুত কেন? একে বুঝা বড় দায়।’
#চলবে