নিভৃতে_যতনে পর্ব ৩১

0
2517

#নিভৃতে_যতনে
#Part_31
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

জৈষ্ঠ্যমাসের তপ্ত গরমে তিক্ত হয়ে উঠেছে পরিবেশ। ভ্যাপসা গরম আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠা রৌদ আড়াআড়ি ভাবে বিরাজমান। রৌদ্রতপ্ত দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে রোয়েন ছুটেছে আমায় নিয়ে। গন্তব্য আমার জানা নেই। তাজ্জবের বিষয় হলো, যে নাকি অসুস্থ শরীর নিয়ে অফিসে ছুটতে প্রস্তুত সেই আজ বিনা কারণেই অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন। সেই সাথে আমাকেও ক্লাস বাঙ্ক দিতে বলেছেন। আদৌ ভাবা যায়? এ তো ভূতের মুখে রাম রাম। আমি সন্দিহান কন্ঠে তাঁকে এই নিয়ে প্রশ্ন করেছি বহুবার। কিন্তু প্রতিবারই তাঁর দিক থেকে স্পষ্ট কোন উত্তর মিলে নেই। ব্যাট যে আস্ত ঘাড়ত্যাড়া তা যেম প্রতি পদে পদে প্রমাণ করা চাই তাঁর। হুহ!
বাইক ফ্লাইওভারে উঠতেই আমি শেষবারের মত উদ্যোগ নেই জানার আসলে আমরা যাচ্ছিটা কোথায়। আমি রোয়েনের কাধ থেকে হাত সরিয়ে সপ্তপর্ণে রোয়েনের কোমড় জড়িয়ে ধরে মিষ্টি সুরে জিজ্ঞেস করি,

— কোথায় যাচ্ছি আমরা?

রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

— তোমার সতীনের কাছে।

আমি রোয়েনের কথায় ফুঁসে উঠি। মনে মনে কয়েকটা সুশীল বকা দিয়ে বলি, “এত সুন্দর করে জিজ্ঞেস করলাম তাও পাত্তা দিল না। এমন হার্টলেস মানুষের সাথে কেন সংসার করছি আমি? হুয়াই?” রাগে দুঃখে উনার কোমর ছেড়ে দিয়ে বাইকের পিছন দিকটা ভালো ধরে তাঁর থেকে দূরত্ব নিয়ে বসি৷ মুখ ঘুরিয়ে রাখি আকাশের পানে। হঠাৎ আমার ষষ্ঠইন্দ্রীয় জানান দেয় কারো শীতল দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার মুখ পানে। ক্ষণেই লুকিং গ্লাসে নজর যেতেই দেখি রোয়েনের নির্মল চাহনি। দর্পণের মধ্য দিয়ে দুইজনের দৃষ্টি এক প্রান্তের মিলিত হতেই রোয়েন বাঁকা হাসে। তাঁর হাসির অর্থ বুঝার আগেই বাইকের স্পীড বেড়ে যায় শতভাগ। মুহূর্তেই আমি ভড়কে যাই আর নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে আমি আঁকড়ে ধরি রোয়েনের কোমড়। আমি কিছু বলতে যাব তাঁর আগেই রোয়েন বলে উঠেন,

— নীড়হারা যেমন পাখি হয় না, আমার তীর ব্যতীত তার কোন নীড় হয় না।

_______________________

দুইপাশে সারি সারি গাছের মেলা। নীলাভ আকাশে ছড়িয়ে আছে সোনালী রৌদ্দুরের আলতো ছোঁয়া। হাইওয়ের মত সরু বিস্তৃত রাস্তায় চলছে বাইক। চারপাশে চোখ বুলাতেই নজরে পড়ে এক সাইনবোর্ড। তাতে গোটা অক্ষরে লিখা ‘পূর্বাচল’। আমার আর বুঝতে নেই আসলে আমরা কোথায়। কিন্তু রোয়েন আজ হঠাৎ আমায় এইখানে নেওয়ার আসার কারণটা বুঝে উঠতে পারলাম না৷ বেশ কিছুক্ষণ পর নীলা বাজারের রাস্তায় বাইক উঠে পড়ে। কিছু দূর যেতেই রোয়েন বাইক থামায়৷ আমায় নামতে বলে নিজেও নেমে পড়ে। আমায় এক ছাউনিতে দাঁড় করিয়ে দুইটা ডাব কিনে আনেন তিনি। একটা আমার দিকে এগিয়ে দেন। আমিও বিনাবাক্যে সেটা গ্রহণ করলাম।

ডাবক খাওয়া শেষে আবার বাইক চলতে শুরু করে। শহীদ মায়েজ উদ্দিন চত্তরের থেকে পুব দিকে মোড় নিতেই নজরে পড়ে বাবুইপাখি ও কুড়েঘরের মত খুটিগুলো। ভালো করে খেয়াল করতে বুঝা গেল এইগুলো রেস্টুরেন্ট। মূলত রেস্টুরেন্টের ভিতরটা আকর্ষণীয় করতেই এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে৷ রোদের তীক্ষ্ণতা কমে এসেছে। শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের। আরও বেশ কিছুক্ষণ পথ অতিক্রম করার পর ‘পূর্বাচল ইকো পার্কের’ সামনে এসে বাইকটা স্থির হয়৷ আমি নেমে পড়তেই রোয়েন বাইক পার্ক করে আসতেই ভিতরে চলে যাই আমরা। ভিতরের পরিবেশ সুন্দর। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি রঙিন লাইন,আশেপাশে কিছু ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট,সামনে মস্ত বড় লেক,চারদিকে সুবজ রাঙ্গা গাছগাছালির মেলা। বেশ মনোরম আর নির্মল পরিবেশ। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় চারদিকে মানুষ তেমন নাই বললেই চলে। আমি রোয়েনের দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি আমার হাতের মাঝে নিজের হাত গলিয়ে দিয়ে অগ্রসর হন সামনে। লেকের তীরেই আসতেই দেখতে পাই তীরেই বাঁধা আছে কিছু নৌকা। রোয়েন কোন দরদাম না করেই একটা নৌকায় উঠে পড়েন। অতঃপর আমার হাত শক্ত করে ধরে বলেন,

— উঠে পড়ো।

আমি কিছুক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে থাকিয়ে উঠে পড়ি নৌকায়। নৌকার মাঝে এসে বসতেই নৌকা চলতে শুরু করে। পানির থৈ থৈ আওয়াজ কানে আসতেই মন জুড়ে যায় আমার। রোদ্দুরে তীক্ষ্ণতা এখন আদুরে হয়ে উঠেছে। বেশ ভালো লাগছে পরিবেশটা। নৌকা লেকের মধ্যভাগে আসতে আমি রোয়েনের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। বুঝার চেষ্টা করি রোয়েন আসলে আমরা এইখানে কেন এসেছি। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলি,

— হঠাৎ আজ আমরা এইখানে কেন এসেছি?

রোয়েন কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। নৌকা চালকের কাছে চলে যান। কি নিয়ে যেন কথা বলতে থাকেন। আমি কিছুটা সময় তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে স্বচ্ছ পানির দিকে নিবদ্ধ করি। বেশ কিছুক্ষণ পর উনি ফিরে এসে আমার পাশে বসেন। আমি তাঁর দিকে তাকাতেই উনি হালকা হেসে আমার দিকে একটা ছোট রক্তিম লাল গোলাপের তোড়া এগিয়ে দিয়ে কানের কাছে এসে নমনীয় কন্ঠে বলেন,

— শুভ বিবাহবার্ষিকী!

কর্ণধারে কথাটা বারি খেতেই আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি রোয়েনের মুখপানে। মুহূর্তেই আমার নিকট সব পরিস্কার হয়ে আসে রোয়েনের আজকের কর্মকাণ্ডের অর্থ। হঠাৎ টনক নাড়ে, আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী অথচ আমারই মনে নেই? বিয়ের প্রথম বার্ষিকীটা সকল মেয়েরই জন্য অন্যরকম অনুভূতি বয়ে আনে। এইদিনটা নিয়ে সকলের কত প্ল্যান থাকে, কত আশা থাকে। অথচ আমি বেমালুম ভুলে বসে আছি। এতটা বেখেয়ালি কবে হলাম আমি? হঠাৎ বুকের বাপাশে তীব্র ব্যথা অনুভব করি। গলা ধরে আসছে বার বার। দৃষ্টি নরম হয়ে আসতেই আমি মাথা নিচু করে ফেলি৷ ক্ষণেই নয়ন দুইটির কার্নিশ বেয়ে নীরবে গড়িয়ে পড়ে দুইফোটা নোনাজল। নীরবে কেঁদতে থাকি আমি। আমার কান্না দেখে হয়তো রোয়েন কিছুটা ভড়কে যায়। কেমন বিচলিত দেখাল তাকে। পরমুহূর্তে নিজেকে স্থির করে আমায় পিছন দিয়ে এক বাহু জড়িয়ে ধরে সিক্ত কন্ঠে বলেন,

— কি হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি?

আমি কিছু না বলে নীরবে কান্না কর‍তে থাকি। তা দেখে রোয়েন আর কয়েকবার একই কথা জিজ্ঞেস করেন। অবশেষে আমি ধরা গলায় বলি,

— কিভাবে পারলাম আমি ভুলতে আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী?

রোয়েন আমায় আগলে নিয়ে বলেন,

— এইটা ব্যাপার না।

আমি করুন কন্ঠে বলি,

— আমার জন্য যে অনেক কিছু।

রোয়েন মিষ্টি হেসে বলেন,

— প্রকৃতির নিয়মই হচ্ছে, দুইজনের মধ্যে একজনের বিশেষ দিনের কথা মনে থাকবে আরেকজনের থাকবে না। এইবার না-হয় তুমি ভুলে গিয়েছ পরেরবার না-হয় আমি ভুলে যাব।

শেষের কথাটা শুনে আমার ঠোঁটের কোনে শ্লেষের হাসি ফুটে উঠে। আমি বিষাদময় কন্ঠে বলি,

— কিছু তো করতেও পারলাম না আপনার জন্য অথচ আপনি কত কি প্ল্যান করে বসে আছেন।

রোয়েন নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,

— কোথায় কত কি প্ল্যান করেছি?

আমি কিছুনা বলে রোয়েনের বুকে মাথা চেপে বসে থাকি। রোয়েন স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,

— ফুলগুলো কি পছন্দ হয়নি? নদীতে ফেলে দিব?

আমি কিছু না বলে আলতো হাতে ফুলগুলো নিয়ে নিলাম। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকলাম ফুলগুলোর দিকে। কিভাবে যে মানুষটির সাথে একটি বছর পার করে ফেললাম বুঝতেই পারলাম না। যে মানুষটাকে প্রথমে দুই চোখে দেখতে পারতাম না আজ তাঁর জন্য মাতোয়ারা আমি। যাকে ঘিরে আমার চরম বিরক্তি, তাঁকেই ঘিরে এখন আমার সকল অনুভূতি। জৈষ্ঠ্যমাসের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিনে আমাদের সাক্ষাৎ যে চিরকালের জন্য আমাদের একই বন্ধনে বেঁধে দিবে তা কে জানতো? হঠাৎই রোয়েন আমার বা হাত টেনে ধরতে আমি আমার ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি। রোয়েন আমার অনামিকা আঙ্গুলে ছোট একটা সাদা আর নীল পাথরে কারুকাজ করা আংটি পড়িয়ে দিতেই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। আংটিটা পড়ানো শেষে রোয়েন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলে উঠেন,

— আমার জীবনের সকল জৈষ্ঠ্যমাস যেন তাকে নিয়েই শেষ হয়।

___________________

সময় যে কত দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে তা পিছনের দিনগুলো গুনলে বুঝা যায়। এই যে সময় কাটা যে কখন বৈশাখ,জৈষ্ঠ্য পেরিয়ে শ্রাবণে গিয়ে ঠেকলো বুঝাই গেল না। রমজান মাসও যে এসে এখন শেষ হতো চললো৷ এইতো মাত্র আর একদিন বাকি। ইদের ছুটি কাটাতে মা-বাবা ঢাকাই চলে এসেছেন। কালকে ইদ বলে আজ বাসায় ঢেড় আয়োজন। পলি আন্টি সন্ধ্যা পর্যন্ত মায়ের কাজে সাহায্য করলেও তার যাওয়ার পর আমিই মাকে সাহায্য করতে থাকি। রাত যখন প্রায় এগারোটা ছুঁই ছুঁই তখন মা আর আমার কাজ শেষ হয়। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে রুমে আসতেই রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

— এইদিকে আসো!

কথাটা শুনে আমি তাঁর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাই। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— কেন?

— প্রশ্ন করতে বলিনি। এইদিকে আসে বলেছি।

আমি আর কিছু না বলে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তাঁর মুখ বরাবর গিয়ে বসতেই উনি আমার এক হাত টেনে বলেন,

— মেহেদী পড়োনি কেন?

আমি স্মিত হেসে বলি,

— আমার মেহেদী দেওয়ার তেমন অভ্যাস নেই। তার উপর দিতেও জানি না।

রোয়েন আর কিছু না বলে পিছন থেকে একটা কাভেরি মেহেদী বের করেন। মেহেদীটা দেখা মাত্র বিষ্ময়ে আমার ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আসে। রোয়েন পাশে মোবাইলের ডিসপ্লেতে মেহেদীর একটা ডিজাইন রেখে আমারটা তাঁর উরুর উপর নিয়ে চুপচাপ ডিজাইনটা দেখে মেহেদী দিতে শুরু করেন। আমি কিছু বলতে যাব তাঁর আগেই তিনি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

— হুসসস!! ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।

কথাটা শুনে আমার হাসি পেলেও হাসলাম না আমি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইলাম আর রোয়েন একধ্যানে মেহেদী দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঘন্টাখানিক পর মেহেদী দেওয়া শেষ হতেই তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলেন,

— ডান!

আমি কথাটা শুনে নিজের হাতের দিকে তাকাতেই মিষ্টি হাসি দেই। রোয়েন বেশ সুন্দর করেই মেহেদীটা পড়িয়ে দিয়েছেন। মেহেদীর এক কোনে লুকিয়ে থাকা ‘আর’ শব্দটি নজর বুলাচ্ছি বার বার। রোয়েন কৌশলে নিজের নামের প্রথম শব্দটি লিখলেও আমার নজরে তা ঠিকই ধরা পড়ে যায়। মাঝেমধ্যে মানুষটি এমন অপ্রকাশিত পাগলামো,অনুভূতি দেখলে সত্যি অভিভূত হই আমি। কিছু না বলেও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ খুব ভালো করতে জানেন তিনি। আমি মিষ্টি হেসে বলি,

— আপনি তো দেখছি ভালোই মেহেদী দিতে জানেন।

রোয়েন নিজের চুলে হাত গলিয়ে বলেন,

— কষ্টের ফল মিষ্টি হলেই হয়।

কথাটা শুনে আমি মিটমিটিয়ে হাসি। রোয়েন যে মিষ্টি ফল বলতে মেহেদীর রঙ গাঢ় হওয়ার কথা বলছে তা ঢেড় বুঝতে পারছি। আমি আর কিছু না বলে উঠতে যাব তখনই আমার ফোন বেজে উঠে। আমি বা হাতে ফোনটা তুলে নিতেই দেখি হৃদিপু কল করেছেন। আমি ঘড়ি একবার দেখে নিলাম। রাত বারোটার বেশি বাজে। এইসময় হৃদিপু কেন ফোন করলো? কোন বিপদ হলো না তো? আমি চটজলদি ফোনটা রিসিভ করে হৃদিপুর কান্নামিশ্রিত কন্ঠ শুনতে পেলাম। ক্ষণেই বিচলিত হয়ে পড়ি আমি। অস্থির কন্ঠে কয়েকবার কি হয়েছে জানার চেষ্টা করি৷ অতঃপর হৃদিপুর উত্তর শুনে আমি একদম স্তব্ধ হয়ে যাই। মাথা ভনভন করে ঘুরতে শুরু করে। নিস্তেজ হতে বসে পড়ি বিছানায়।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here