নিভৃতে_যতনে পর্ব ৩৮

0
2186

#নিভৃতে_যতনে
#Part_38
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি হলুদ রাঙ্গা আকাশের পানে। বিষিয়ে আছে মনটি। নয়ন দুইটিতে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। না চাইতেও রোয়েনের ব্যবহারগুলো বার বার ভাবাচ্ছে আমায়। ভার্সিটি থেকে আসার পর ঘরের কোথাও রোয়েনের দেখা মিলে নি। পলি আন্টিকে তাঁর কথা জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, তিনি নাকি অফিসে গিয়েছেন। কথাটা শোনামাত্র খানিকটা সময়ের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। কোন ভাবেই হিসাব মিলাতে পারছিলাম না। কেন না, সকালে আমি যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, অফিস যাবেন কি-না তখন তিনি অকপটে নাকচ করে দিয়েছিলেন। তার মানে কি উনি আমায় মিথ্যে বলেছিলেন? কিন্তু কেন? প্রশ্নটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই হতাশামূলক নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। অভিমানে সিক্ত হয়ে আসে নয়ন দুইটি। হঠাৎ করেই রোয়েনের মধ্যে আসা পরিবর্তনগুলো মেনে নিতে পারছিনা। তাঁর ব্যবহারগুলো বেশ পোড়াচ্ছে আমায়। সেই সাথে ভাবাচ্ছেও। দুইদিন আগেও তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। আমাকে নিয়ে ঘুরেও এসেছিলেন। আমার প্রতি তাঁর ব্যবহারগুলো ছিল অতি স্নিগ্ধ। কিন্তু হুট করে তাঁর কি হয়ে গেলো কে জানে? এত জলদি এতটা পরিবর্তন, আদৌ কি সম্ভব?
কিছুটা প্রহর অতিবাহিত হতেই চারদিকে ভেসে উঠে এক মধুর ধ্বনি। মাগরিবের আযান দিচ্ছে। আযানের কলধ্বনি কর্ণধারে এসে বারি খেতেই নিজের স্তম্ভিত ফিরে পাই আমি। ক্ষণেই মাথায় কাপড় টেনে রুমে চলে যাই। ওযু করে নামাজ আদায় করে নেই। অতঃপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিজের এসাইনমেন্টগুলো নিয়ে বসে পড়ি।

রাত নয়টা প্রায় ছুঁই ছুঁই। এখনো রোয়েনের আসার নাম গন্ধ নেই। আমি মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে বার বার পায়চারী করছি। মনে মাঝে কু ডাকছে। উনি তো সহজে এত দেরি করেন না। তাহলে আজ কেন? বেশ কয়েকবার ফোন মিলিয়েছি রোয়েনের নাম্বারে। রিং হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কেউ ফোনটা তুলছে না। এতক্ষণ চিন্তা হলেও এখন ভয় হচ্ছে প্রচুর। কাউকে যে বলবো সে উপায়ও নেই। কেন না এতে অন্যরাও চিন্তায় পড়ে যাবে। তার উপর এখন পাশেও কেউ নাই। রোয়েনের দেরি হচ্ছে বলে পলি আন্টি চলে গিয়েছেন ঘন্টাখানিক আগেই। যার দরুন সব এখন নিজেকেই বইতে হইছে। সময় যত গড়াচ্ছে ততই চিন্তা আর ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে রোয়েনের এক্সিডেন্ট করা সেই রাতের কথা। যার ফলে কোনভাবেই ক্ষান্ত হতে পারছি না। ক্ষণেই ঠান্ডা হয়ে আসছে হাত-পা। নিজেকে বড্ড অগোছালো লাগছে৷
অবশেষে আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাত দশটায় রোয়েন এসে হাজির হোন। দরজা খুলে তাকে দেখামাত্র সকল অভিমান ভুলে জড়িয়ে ধরে তাকে। কম্পিত কন্ঠে বলে উঠি,

— আপনি ঠিক আছেন তো? কিছু হয়নি তো আপনার? এত দেরি কেন করলেন আপনি? ফোন কেন ধরেন নি আমার? আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানেন?

রোয়েন ম্লান হেসে এক হাত আমার পিঠে গলিয়ে দিয়ে বলেন,

— আমি ঠিক আছি। এত হাইপার হওয়ার কিছু নেই।

কথাটা শোনা যেন আমার জানে জান আসে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নয়ন দুইটির পাতা বুজে ফেলি। হাত-পা কাঁপছে মৃদু পরিমাণ। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত হতেই আমি তাঁর থেকে সরে এসে দাঁড়াই। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাই তাঁর মুখপানে। ক্লান্তি ভরা মুখখানিতে ম্লান হাসি। আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— এত দেরি কেন করলেন আপনি? ফোনও তুললেন না যে?

রোয়েন ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে গলার টাই কিছুটা ঢিলে করে নেন। নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,

— কাজ ছিল।

— একটা বার ফোন করে তো জানাতে পারতেন। ভয়ে ছিলাম আমি।

— মনে ছিল না।

কথাটা বলে তিনি রুমে চলে যান ফ্রেশ হতে আর আমি সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করি। রোয়েন ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে আমি খাবার গরম করে ফেলি৷ খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে চলে যাই রোয়েনকে ডাকতে। দরজা কাছে আসতেই দেখতে পাই রোয়েন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছছে। আমি কোনরকম ভনিতা না করে বলি,

— খাবার গরম করেছি, খেতে আসুন।

— খাব না।

— কেন?

— খিদে নেই।

আমি কিছুটা রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— খিদে নেই বলতে? আপনি কি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন?

রোয়েন এইবার তিক্ত কন্ঠে বলে উঠেন,

— এখন কি সব কিছুর কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে?

কথাটা শ্রবণ হওয়া মাত্র আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি রোয়েনের পানে। এক রাশ অভিমান এসে ভর করে মনের মাঝে। ভারী হয়ে এর পাল্লা। রোয়েনকে কিছুটা সময় পর্যবেক্ষণ করে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসি রুম থেকে। ডাইনিং এ এসে একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে ফেলি। খাবারটা মূলত রোয়েনের জন্য। মানুষটা রাতে না খেয়ে একদমই ঘুমাতে পারেনা। আমি তাঁর শুকনো মুখটা দেখেই বুঝেছি তিনি কিছু খায়নি। কিন্তু তাও সিউর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে। কথাটা ভাবামাত্র বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
তাঁর সাথে যতই অভিমান করি না কেন, তাঁকে তো হেলায় ফেলে দিতে পারিনা। দিন শেষে তাঁকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমারই।
খাবার নিয়ে আমি এগিয়ে যাই রুমে। রুমে আসতেই দেখি রোয়েন মাথায় এক হাত রেখে শুয়ে আছেন। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে যাই তাঁর দিকে। বেড সাইড টেবিলে প্লেটটা রেখে তাঁর বাহুতে হালকা টান দেই। তিনি সচকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি আমি কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠি,

— খেয়ে নিন।

তিনি গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

— বললাম তো খাব না।

— খেতে বলেছি খাবেন। এত কথা কেন বলেন? উঠুন বলছি।

এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক বিতর্কের পর রোয়েন বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে উঠে বসে। আমি আর কিছু না বলে প্লেট হাতে তুলে নেই। খুব সপ্তপর্ণে তাঁর মুখে তুলে খাবারটুকু। রোয়েন কিছুক্ষণ আমার মুখপানে তাকিয়ে থেকে বিনাবাক্যে খাবারটুকু খেয়ে নেন।

রোয়েনকে খায়িয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নেই কিছুটা। অতঃপর সব গুছিয়ে রুমে আসতেই তৃতীয় বারের মত সেই দগ্ধ পোড়া গন্ধটি নাকে এসে বারি খায়। ক্ষণেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় আমার। আমি উনার সামনে গিয়ে তিক্ত কন্ঠে বলে উঠি,

— আবার এইসব ছাইপাঁশ খাচ্ছেন? এখনই ফেলুন ওইটা বলছি।

তিনি কঠোর সুরে বলেন,

— রুমে যাও।

— আগে ফেলুন ওইটা বলছি।

— আমার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বলি নি তোমায়।

আমি তেঁতে উঠে বলি,

— আপনি বললেই হলো?

রোয়েন এইবার তেজী গলায় বলে উঠেন,

— বলছি না এইসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে? একবারে বুঝো না কথাটা? রুমে যাও বলছি।

মুহূর্তেই নয়ন দুইটি সিক্ত হয়ে আসলো। আমি চোখের পানি লুকাতে দ্রুত সেই জায়গা থেকে সরে আসি৷ রুমের লাইট অফ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেই। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোটা নোনাজল। জলন্ত সিগারেট হয়তো রোয়েনের হাতে কিন্তু তার দহনে পুড়ছি আমি। কেন করছে এমন উনি? আমি তো আর তাঁর খারাপ চাইছি না, তাহলে? এতটা কঠোরতা কেন? পরের মত আচরণ কেন করছেন তিনি? শুনেছি, সম্পর্কের বয়স যত বাড়ে ততোই অনিহা আর অনুগ্রহ স্থান পায়। একটা গ্যাপ চলে আসে৷ আমাদের বেলাও কি তাই হচ্ছে? নাকি অন্য কিছু? আপাতত প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে ফেলে অভিমান জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরি আমি। অভিমানের বসেই সিদ্ধান্ত নেই, তিনি যেহেতু চাইছেন আমায় দূরে সরিয়ে রাখতে তাহলে তাই হোক। বলবো না আমি আর কোন কথা। হঠাৎ রোয়েনের পায়ের আওয়াজ পেতেই আমি নিজের চোখের জলটুকু মুছে নেই৷ চুপটি মেরে শুয়ে থাকি৷ ক্ষণেই রোয়েন আমার পাশে এসে শুয়ে পড়েন। দুইজনের মাঝে তখন পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ রোয়েন আমার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেন। মুহূর্তেই আমি ভড়কে যাই। ঘটনাক্রমে বুঝতে একটু সময় লাগে আমার। আমি এতে অভ্যস্ত হলেও আজ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। তাই প্রথমে একটু হাঁসফাঁস করলেও পরবর্তীতে স্থির হয়ে যাই। সিগারেটের মৃদু গন্ধ আসছে। এতে গা গুলিয়ে আসলেও আমি চুপটি মেরে শুয়ে থাকি। হঠাৎ রোয়েন বলে উঠেন,

— সিয়াশা!

নিজের নামটা তাঁর মুখে উচ্চারিত হওয়া মাত্র বুকটা মুচড়ে উঠে আমার। মনে হলো, কন্ঠটা যেন কেমন শোনালো। তাঁর এই ডাক শুনে বুকের মাঝে বয়ে যেতে শুরু করে এক ঝড়। এই ডাক যে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেননি। না চাইতেও আমি ছোট করে বলে উঠি,

— হু!

— একটা কঠিন প্রশ্নের উত্তর চাই তোমার থেকে। দিবে কি?

আমি নিচু স্বরে বলি,

— করুন।

রোয়েন তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলেন,

— আমার সাথে থাকতে গিয়ে যদি কোনদিন চরম বাস্তবতার স্বীকার হও তখন তুমি কি করবে? এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে নাকি থেকে যাবে?

আমি চকিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। হঠাৎ এমন প্রশ্ন করার মানে কি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কেমন বাস্তবতা? আর তাঁর কেন মনে হচ্ছে আমি সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হলে সংসার ছেড়ে চলেও যেতে পারি? এত এত প্রশ্নের ভিড়ে সবকিছুই যেন এখন গোলক ধাঁধা লাগছে। যার আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না আমি। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি নিরপেক্ষভাবে উত্তর দেই,

— সেটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। সকল পরিস্থিতি যেমন এক না, তেমনই এর প্রতিকারও এক না। পরিস্থিতি বুঝেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

আমার কথার পৃষ্ঠে কোন কথা বললেন না। শুধু কয়েকটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে তার বুক চিরে। যার কলধ্বনি ছিল আমার নিকট অতি স্পষ্ট।

#চলবে
অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘নিভৃতে যতনে’ মানেটা কি। তখন বলি নি কিন্তু আজ বলছি।

নিভৃত মানে অপ্রকাশিত/নীরব আর যতনে মানে যত্ন/ ভালবাসা। ‘নিভৃতে যতনে’ মানে নীরবে যত্নের প্রকাশ বা অপ্রকাশিতভাবে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আশা করি এখন কনসেপ্টটা সকলের কাছে পরিষ্কার।😊

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here