#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৬
সেলিমের কাছে যেহেতু আমি এতটা অপাংক্তেয় তাই আর নিজে থেকে তার কাছে ছোট হতে চাইলাম না। আমি যে তার সবকিছু জানি সেটাও জানাতে ইচ্ছে হলো না। কারণ তাতে ফায়দা তো কিছু হবেই না বরং আমার নারী সত্ত্বারই অপমান হবে। সে থাকুক না তার মতো। আমিও আর স্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে তার কাছে অধিকার ফলাতে যেতে চাই না। অবাক হচ্ছি সেলিমের এমন আচরণের কথা ভেবে। আমি যদি সেলিমের মুখখানা মনে করে ভুল পথে পা দিতে যেয়েও নিজেকে আটকাতে পারি তাহলে সে কেন পারছে না? শুধুমাত্র আমি নারী বলেই কি এমনটা পেরেছি ? সে পুরুষ হয়েছে তাতে কী হয়েছে? তার দেয়া প্রতিশ্রুতির কী কোনো দাম নেই? একই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। অথচ চিন্তা-চেতনায় কত তফাৎ!
যুগে যুগে নারীরাই কেন এত এত স্যাক্রিফাইস করবে? সেলিমের ভেতরে কি নিজেকে এই পথ থেকে ফেরানোর কোনোরকম তাগাদা অনুভূত হয়নি? একবারও আমার কথা ভাবেনি?
প্রশ্নগুলির উত্তর খুব পেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কী করে পাব, কার কাছে পাব?
কর্ণারের দিকে একটা রুম খালি ছিল মাস দুয়েক ধরে। মমতাজ আপার রুম চাচ্ছেন শুনেই কুলসুম খালা রুমটা খুলে দিলেন। ভাড়া মাসে ৩০০০ টাকা। আমি একমাসের এডভান্স করেই উঠে গেলাম।
আমি হাতে করে ছোট একটা ব্যাগে সামান্য কিছু কাপড়চোপড় এনেছি। খুবই সাধারণ মানের কিছু কাপড়চোপড়। এখানে আমি কোন আড়ম্বরতা চাই না। ড্রাইভারকে দিয়ে খুব প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে নিলাম। ড্রাইভার খুব অবাক আমার এহেন কাজকর্ম দেখে।
ঘরে মালপত্র খুব বেশি না। চৌদ্দশ টাকা দামের একটা চৌকি। আটশ টাকা দামের কাঠের একটা আলনা। আর অতি প্রয়োজনীয় কিছু থালা বাসন যা একেবারে না হলেই না।
ড্রাইভারকে গাড়ির চাবি দিয়ে বিদায় করে দিলাম। আমি ফোন না দিলে তাকে আসতে নিষেধ করেছি। এবং আমি কোথায় আছি এগুলো কাউকে একদমই জানাতে নিষেধ করেছি। গাড়ি গ্যারেজে রেখে তাকে বাড়ি চলে যেতে বলেছি। বেচারা বাবা-মার সাথে দেখা করতে যায় না বহুদিন। ভাবলাম এই সুযোগে একটু মা বাবাকে দেখে আসুক। ছুটি পেয়ে বেচারা দারুণ খুশি।
ব্যাংককে যখন গেলাম তখনও সে ছুটি পায়নি। সেলিমের ড্রাইভার অসুস্থ থাকায় সেলিমের ডিউটি পড়েছে তার উপর। ছুটির কথা শুনে ওর মুখে যে হাসি দেখেছি সেটা আমার নিজের কাছেই খুব তৃপ্তিকর মনে হয়েছে।
খুবই আটপৌরে সাধারণ মানের কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছি। আমি এখানে মানুষগুলোর সাথে মিশে যেতে চাই। সেই সাথে মমতাজ আপার যদি কিছু উপকার করা যায়। এদের সাথে থাকলে হয়তো নিজের কষ্টগুলোকে কিছুদিনের জন্য হলেও ভুলে থাকা যাবে। সমাজের উচু তলার মানুষগুলোর সাথে তো থেকেই ছিলাম এতদিন। এখানে শুধু লোক দেখানো চাকচিক্য আর আভিজাত্যের ছড়াছড়ি। ভেতরটা সবারই ফাঁপা কিন্তু কেউ সেটা প্রকাশ করতে চায় না। তাই এবার এই সমাজে থেকে দেখতে চাই আসলেই কি ওদের থেকে দূরে থাকা যায়? যদি সম্ভব তাহলে আমি ওই সমাজে ফিরে যেতে চাই না আর। সেখানে শুধু হিংসাত্মক প্রতিযোগিতার ছড়াছড়ি চারদিকে।
মমতাজ আপা এসেছেন ঘন্টা খানেক হলো। আমার পাগলামি দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।
– তোর এ পাগলামির কোন মানে হয় না। বুঝলাম তোর একাকীত্ব কাটানোর সঙ্গী প্রয়োজন। এর জন্য তোকে এখানে এসে কেন থাকতে হবে? তুই আমার কাছে চলে আয়। সারারাত দু’বোন মিলে আমরা এনজিওর বিভিন্ন কাজ এগিয়ে নেব। আমার বাসায় তো জানিস আমার বৃদ্ধা আম্মা ছাড়া আর কেউই থাকে না। ভাই দুটো বউ নিয়ে বিদেশে পড়ে আছে। একাকীত্বের যন্ত্রণা আমিও ভোগ করতাম যদি আমার পাশে আম্মা না থাকত। শুধু ভয় হয়। আজকাল আম্মার অসুখ বিসুখ যে পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন। কখন না আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। তখন আমার দিনগুলো কি করে কাটবে, আমি কিভাবে থাকব ভেবেই হাত পা অবশ হয়ে আসে। তবে সবচেয়ে মজার কথা কি জানিস! আম্মা এখনো আমার বিয়ের স্বপ্ন দেখে। তার একটাই কথা মরার আগে সে আমাকে বিয়ে দিতে চায়। এই বুড়িকে বিয়ে করবে কে তুই আমাকে বলতো! সেদিন বাসায় যেয়ে দেখি এক ঘটক মহিলার সাথে আম্মা ফুসুরফাসুর করছে। আমি বাসাতে ঢুকতেই একদম সব কিছু চুপচাপ। আম্মা বলে তার নাকি কোন কালের কোন বান্ধবীর মেয়ে। আমাকে বোকা ভেবেছে আম্মা। আমি তো উনাকে দেখার সাথেই বুঝতে পেরেছি। আমাকে দেখে হুড়মুড় করে সবকিছু ব্যাগে ঢুকিয়েছে ওটা দেখেই বুঝতে পেরেছি উনি নিশ্চয়ই কোন ম্যারেজ মিডিয়ার লোক। আমি মনে মনে খানিকক্ষণ হেসে রুমে চলে গিয়েছি। আম্মা তার মতন কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকুক এটা ভেবে তাকে আর কিছু বলি না।
আচ্ছা, এই দেখ তোর কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আমি দুনিয়ার নিজের গল্প নিয়ে বসে গেছি এটাই আমার দোষ। এবার বল, সেলিম সিলেট থেকে ফিরতে দেরী হবে এজন্য তুই কিছুদিন এখানে থাকতে চাস তাই তো। তুই সারাদিন এখানে থাক আমার সমস্যা নেই। এনজিওর কিছু কাজ বাজ করে সন্ধ্যার সময় আমার সাথে আমার বাসায় যাবি। সারারাত দু’জনে একসাথে গল্প করব অনেক ভালো সময় কাটবে আমাদের। তাছাড়া আম্মাও বোর হয়ে যায় একা একা থাকতে থাকতে। তোকে পেলে ভীষণ খুশি হবে।
– আপা! আমি যাব একদিন খালাম্মার সাথে দেখা করতে। কিন্তু আমাকে কিছুদিন এখানে থাকতে দাও, আপা। আমি দিনরাত চব্বিশঘণ্টা এদের সাথে থাকতে চাই। আমি আমার জীবনে একটু ভিন্নতা চাই।
– তুই তোর জীবনে ভিন্নতা আনতে চাস বুঝতে পারছি তাই বলে এভাবে এখানে থেকে? তুই তো এদের এখানে বসতেই চাচ্ছিলি না আর এখন থাকতে চাচ্ছিস? তুই বুঝতে পারছিস কত ধরনের অসুবিধা ফেস করতে হবে এখানে?
– আমি জানি আপা। সব জেনে বুঝেই এখানে থাকতে চাচ্ছি,প্লিজ। যদি বেশি অসুবিধা হয়, এডজাস্ট করতে না পারি তাহলে আগামীকালকেই আমি আমি চলে যাব। আমাকে তো আর কেউ এখানে বেঁধে রাখেনি তাই না!
– আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। তোকে হাজার বুঝালেও কাজ হবে না। যা খুশি কর। কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিস। আমি সাথে সাথে চলে আসব। তুই যে পরিমাণ জিদ ধরেছিস তাতে এখানে যে তুই থাকবি সেটা আমি বুঝতে পারছি। তোর সাথে আমিও থাকতাম কিন্তু বাসাতে আম্মা একা একা থাকবে কী করে সেটা ভেবে আমি চাইলেও তোর সাথে থাকতে পারছি না।
– না,না, আপা! তুমি কেন থাকবে? তুমি যে আমার জন্য এতটা ভেবেছ এটা আমার জন্য পরম পাওয়া। আমার জন্য ভাবার মানুষগুলো ধীরে ধীরে আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমার জীবনের এই সংকটময় মুহূর্তে তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়েছ এটা সত্যিই আমার জন্য বিশাল পাওয়া।
দুপুরের দিকে সেলিমের ফোন এল। এই দায়সারা কিছু হাই-হ্যালো কথাবার্তা সেরে রেখে দিলো। অন্য দিন যেমন সে কবে ফিরবে, ওখানকার কাজ কতদূর সেরেছে এসব জিজ্ঞেস করি আজ আমি সেলিমকে কিছুই জিজ্ঞেস করতে গেলাম না। ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না আর।
বিপাকে করলাম সন্ধ্যাবেলা। দুপুরে মমতাজ আপার সাথে বাইরে খাবার খেয়েছি। আসার সময় কিছু করে বাজার সদাই নিয়ে এসেছি। রাতের খাবারের জন্য একটা পাতিলে কিছু চাল, ডাল, আলু এবং অন্যান্য কিছু সবজি মিলিয়ে খিচুড়ি রান্না করার জন্য নিয়ে বের হলাম। রান্না ঘরে যেয়ে দেখি আগেই বিশাল লাইন লেগেছে। আমার সিরিয়াল পেতে পেতে রাত দশটা বেজে যাবে। রান্নাঘরের যে চেহারা এখানে কোন কিছু রান্না করলে যে ভক্তি করে খেতে পারব কিনা সেটাই এখন ভাবনার বিষয়। কিন্তু ওসব কিছু ভাবনা বাদ দিয়ে নিজেকে নিজে বোঝালাম যে আমি সবকিছু জেনে শুনেই এখানে এসেছি। এরা যদি পারে আমি কেন পারব না? এরাও মানুষ আমিও মানুষ। এখন এখান থেকে পেছনে ফেরার কোনো মানে নেই। ভেবেছিলাম রান্না সেরে গোসল করব। এখন যেহেতু রান্না করতে দেরি হবে তাই ভাবলাম গোসলটা তবে সেরে নেই। এখানের বাথরুমের যে অবস্থা দেখে এসেছি তাতে গোসল করতে পারব কিনা সেটাও একটা চিন্তার বিষয়। কল পাড়ে ছেলে, বুড়ো, মহিলা, পুরুষ অনেকেই একসাথে গোসল করে। মেয়েদের জন্য টিনের বেড়া দিয়ে আলাদা গোসলখানার ব্যবস্থা থাকলেও তার ভেতরের অবস্থা বড়ই নাজুক।
সাহস করে গোসল খানার দিকে গিয়ে দেখলাম এখন কিছুটা ফাঁকা আছে সেখানটা। দুটো বাচ্চা ছেলে আমাকে দেখে এগিয়ে এল। ওরাই কল চেপে আমার বালতিটা ভরে দিলো। আমি কোন রকম করে নাক চোখ বুজে ওই টিন ঘেরা বাথরুমের ভিতরে গোসলটা সেরে ফেলি।
বস্তিতে আমি নতুন এসেছি তাছাড়া মমতাজ আপার সাথে এসেছি এটা জানার পর থেকে সবাই আমাকে বেশ সম্মান করছে। উনারা আমার আসল পরিচয় জানে না। সবাই ভেবেছে হয়তো মমতাজ আপার এনজিওতে চাকরি করি। আমিই মমতাজ আপাকে কুলসুম খালার কাছে এটা বলার জন্য বলেছি।
আশে পাশের রুমের কয়েকজনের সাথে মমতাজ আপা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন। আমার পাশেই থাকেন বিলকিস বানু। মহিলার তিনটা বাচ্চা। খুবই রোগা আর হ্যাংলা পাতলা হলেও বেশ মিশুক স্বভাবের। বারো বছরের মেয়েটার কাছে দু’বছরের দুধের ছেলেটাকে রেখে সারাদিনে বাসায় বাসায় কাজ করে। আরেকটা ছেলে আছে আট বছরের। এরা নামমাত্র স্কুলে যায়। দেখা যায় মাসের ত্রিশ দিনের মধ্যে পনেরো দিনেই অনুপস্থিত থাকে।
রান্না করতে যেহেতু দেরি হবে তাই আমি আমার উনার সাথে গল্প করার জন্য তার রুমে যাওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক এমন সময় বাইরে এমন জোরে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হল যে আমার কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। একটু উঁকি মেরেই তাকিয়ে দেখলাম বিলকিস বানুর সাথে আরেক মহিলার তুমুল ঝগড়া শুরু হয়েছে। ঝগড়ার কারণ হচ্ছে বিলকিস বানু আট বছরের ছেলেটাকে মেরে কপাল ফাটিয়েছে তার পাশের রুমের বাচ্চাটা। সেও বিলকিস বানুর ছেলের বয়সী বা কিছুটা বড় হবে হয়ত।
আঘাত খুব বেশি না এক কর্নার থেকে একটু থেতলে গেছে। হয়তো ধাক্কা দিয়ে রাস্তার উপর ফেলে দিয়েছিল এজন্য এই দশা। বাচ্চারা বাচ্চারা এমন করেই থাকে।
কিন্তু দুজনের বাকবিতণ্ডা আর গালিগালাজ শুনলে মনে হবে হয়তো একজন আরেকজনকে খুনই করে ফেলেছে। বাচ্চাদের মারামারি নিয়ে ঝগড়া লেগে সেখান থেকে দু’জন দু’জনকে কবে কে কী খাইয়েছিল, কাকে কবে কে কী দিয়েছিল, কার কাছে কত টাকা পায়, কার স্বামী কয় টাকা আয় করে, কার স্বামী কয়টা প্রেম করে, কয়টা বিয়ে করছে, কার বাড়ি কী আছে এসব নিয়েও শুরু হয়েছে খোটা দেওয়ার প্রতিযোগিতা। মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছিল বিলকিস বানু আর ওই মহিলার সাথে হাতাহাতি শুরু হয়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। আশেপাশের কয়েকজন তাদের ঝগড়া থামাতে এগিয়ে গেলেও আমি ব্যাপারটা খুব এনজয় করছিলাম। এখানে প্রথম যখন এসেছিলাম তখন এসব ঝগড়া-ফ্যাসাদ শুনলে খুব বিরক্ত লাগত কিন্তু এখন তার উল্টো।
ঝগড়াঝাঁটির একপর্যায়ে মনে হলো বিলকিস বানুকে দেখতে রোগা-পাতলা লাগলেও ঝগড়ায় সে ভীষণ পটু। প্রতিপক্ষ বাকবিতণ্ডায় হেরে যেয়ে নিজের স্বামীর কাছে যেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে বলছে আগামীকালের মধ্যেই সে এই বস্তি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবে। এসব মানুষের সাথে সে আর থাকবে না। মহিলার কান্নাকাটি দেখে আমিও ধরে নিয়েছি হয়তো উনি সত্যিই চলে যাবেন।
এর মধ্যে একজন এসে আমাকে জানাল একটা চুলা ফাঁকা হয়েছে আমি তাড়াতাড়ি আমার চাল ডাল নিয়ে চুলার দিকে রওনা হলাম। কোনরকম নাক চোখ বন্ধ করে খিচুড়ি আর একটা ডিম ভাজি করে নিয়ে রুমে এলাম। খাওয়ার পরে কিছু অংশ বেঁচে গিয়েছে যেহেতু ফ্রিজ নেই তাই এটা রাখা সম্ভব না। তাই রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কল পারের সেই ছেলে দুটোকে দেখে ডাক দিলাম। ওরাও সাথে সাথেই চেটেপুটে খেয়ে সাবার করে ফেলল। আমার রেখে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবারটুকু পেয়ে ওদের মুখে যে পরিতৃপ্তির হাসি দেখলাম সেটা তে আমার কী যে ভালো লাগল! এরা অল্পতেই ভীষণ খুশি। ওদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। বুঝলাম আমার মত ওদেরও আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। পরে আবার আসবে কথা দিয়ে ওদের রুমে চলে গেল।
পরেরদিন কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে করতে বিকেল পেরিয়ে গেল। আগেরদিন মমতাজ আপা আমাকে কাজ দিয়ে গিয়েছিলেন। ওনারও আসার কথা থাকলেও আসতে পারেনি। খালাম্মার শরীরটা একটু খারাপ। ফোনে জানিয়েছে আপা। আমি একাই কাজ করেছি। দুপুরে বাইরের গলির মাথার হোটেল থেকে খাবার এনে খেয়েছি।
বিকেলে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য শুয়েছি তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। আমি উঠে যেয়ে দরজা খুলে দেখি কালকের রাতের হুলস্থুল কাণ্ড ঘটানো বিলকিস বানু দাঁড়িয়ে।
– আফা, ডিস্টাব দেলাম মনে হয়?
– না, না, আপা। বলেন! ভেতর আসেন। বসে কথা বলি।
– না আফা, আরাকদিন। আমনে আমার ঘরে আইয়েন। একসাথে এক কাপ চা খামুয়ানে। কাইল আমনের সাতে তেমন আলাপ করতে পারিনাই। আইজ আসেন এট্টু গল্প করি।
– না, মানে!
আমার কথা শেষ করার আগেই সে আমার হাত ধরে টানা শুরু করল। আমি আর না করতে পারলাম না।
উনার রুমে যেয়ে দেখি মুড়ি চানাচুর মাখা, তেল পিঠা, আর লাল চায়ের ব্যবস্থা করে রেখেছে। আমার ভীষণ লজ্জা হচ্ছিল। আবার এদের আন্তরিকতা দেখে খুব ভালোও লাগছে। আমাকে উনি হাত ধরে খাটে বসালেন। আমি মানা করা স্বত্তেও মুড়ি চানাচুরের বাটি এগিয়ে দিলেন।
– আফা, এট্টু বসেন। মুই আইতে আছি। এক মিনিট।
– আচ্ছা, আচ্ছা।
উনি চলে যাবার পর আমি তাকিয়ে উনার ঘরের চারপাশে দেখছিলাম। মহিলা বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। চারপাশে সবকিছু গোছানো।
– আরে রাগ করতে অয়না, সোনা। তুই না আমার ছোড বুইন। বড় বুইন রাগের মাতায় কত কি কইছি। এইল লাই এত রাগ অবি? তোরে ছাড়া আমি সইন্ধার নাস্তা খাই কোনোদিন? আমার গলা দিয়া নামবে কিচ্ছু?
আয় সোনা! পোলাপান নিয়া আমরা ঝামেলা করছি দেখ, ওরা ঠিকই মিল দিয়া আইজ আবার খেলতে গেছে। একজাগা থাকলে এমন ছাওয়াল পাওয়াল লাগে। আমরা এ নিয়া এমনে ঝগড়াঝাটি করব এইটা কি ঠিক? কাইল যা হইছে মাফ কইরা দে, বুইন!
হাত ধরে টানতে টানতে কাল রাতে ঝগড়া হওয়া মহিলাকে রুমে নিয়ে আসল বিলকিস বানু।। বিলকিস বানুর মুখে উনার নাম শুনে বুঝলাম ওই মহিলার নাম আদরি।
আদরি খানিকটা কপট রাগ দেখিয়ে চলে যেতে চাইলে বিলকিস বানু তার পথ আটকাল। আমাকে বলল, আফা, এট্টু বুঝান দেহি। পাগলী এত রাগ করে দেখছেন!
আমি অবাক হয়ে ভাবছি গতকাল এদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল সারাজীবনের জন্য এদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। অথচ চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই দু’জনে আবার এক হয়ে গেল। বাহ!
– আদরি আপা, আসেন না। এক সাথে চা খাই। বিলকিস আপা কত মজার মজার খাবারের ব্যবস্থা করেছে। বসুন না। খুব খুশি হবো। বিলকিস আপা তো তার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছেই। আপনিও ক্ষমা করে দিন না।
আদরি আঁচলে চোখ মুছে বলল, আমারেও মাফ কইরেন বিলকিস ভাবি। না বুইঝা কত্ত কী আমিও তো কইছি আমনারে।
আমার দু’জনের ব্যবহার দেখে এত ভালো লাগল। বুঝলাম এরা কোনো রাগ খুব বেশি সময় মনে রাখে না। খুবই ক্ষমাশীল মন এদের। কাল এতকিছুর পরেও কত সুন্দর করে একে অপরের দোষ স্বীকার করে নিলো। একজন ছোট হয়েছে তাতে কী!
সম্পর্ক তো ঠিক থাকল। অথচ আমি? ছোট বোন কি একটু বলেছে সেটা মাথায় আটকে রেখেছি সুপার গ্লু আঠা দিয়ে। এই তিন বছর ছোট বোনটার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। ও না হয় ছোট হতে চাচ্ছে না। আমি তো পারতাম এতদিনে ওর রাগ ভাঙ্গাতে। আমিও আমার ইগোর কারণে ওর কাছে ছোট হতে চাইনি। আমি যদি ওকে এভাবে টেনে বুকে নিতাম ওকি পারত আমাকে ফিরিয়ে দিতে? কোনোদিনই পারত না।
এই মিথ্যে রাগ, অহংকার দেখিয়ে আপন বোনের সাথে মুখ দেখাদেখি বন্ধ! ক্ষমা করার কী অপূর্ব মানসিকতা বিলকিস বানু আর আদরির। নিজেকে ওদের কাছে খুব ছোট মনে হচ্ছে। এত এত লেখাপড়া শিখে কী লাভ যেখানে জীবনবোধের জ্ঞানই নেই।
বিলকিস বানুদের মত অশিক্ষিত থাকাই বুঝি ভালো ছিল।
বেশ ভালো সময় কাটল উনাদের সাথে। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমাতে যাব তখন ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিয়ে অবাক হলাম ভীষণভাবে। আমার ছোট জা মালিহার ফোন। ও কখনোই আমাকে ফোন দিয়েছে আমার মনে পড়ছে না।
কিছুটা ইতস্ততভাবে ফোন রিসিভ করলাম। রিসিভ করতেই কোনো রকম হাই হ্যালো ছাড়াই মালিহা বলে উঠে,
– ভাবি, কই ছিলেন আজ সারাদিন? সন্ধ্যায় আপনার বাসায় যেয়ে এক ঘন্টা বসে ছিলাম। ফোনেও পাইনি। মেইডরা বলল, আপনি নাকি গতকালও ছিলেন না বাসায়।
মালিহা আমার বাসায় গিয়েছিল শুনে খানিকটা ভড়কে গেলাম। ও তো আমার বাসায় বিনা কারণে যাবার মতো মেয়ে না। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে।
আমি আমার গাম্ভীর্যভাব বজায় রেখে স্বাভাবিকভাবেই বললাম, এক ফ্রেন্ডের বাসায় এসেছি। থাকব কিছুদিন। আমাকে কি দরকার বলোতো! আম্মা আব্বার শরীর ভালো তো?
– উনারা ভালো আছেন। আপনার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিল।
– ফোনে বলা যাবে নাকি সরাসরি কথা বলতে হবে?
– সমস্যা নেই। ফোনে বলা যাবে। আপনি ফ্রি আছেন তো!
– হ্যাঁ, হ্যাঁ! সমস্যা নেই। তুমি বলো।
– ভাবি, পেচাপেচি না করলে সরাসরি বলি। ভাইয়ার অফিসে তার পিএস হিসেবে হেলেন নামে একটা মেয়ে নতুন ঢুকেছে জানেন নিশ্চয়ই।
হেলেনের নাম শুনে আমার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। আমি সেটাকে লুকিয়ে রেখে আস্তে করে বললাম, হুম জানি। কী হয়েছে?
– হেলেন আমার বড় আপার ক্লোজ ফ্রেন্ড। বড় আপা আমাকে বলেছিল বলেই আমি আব্বাকে সুপারিশ করে ওকে ভাইয়ার পিএসের পদে আমাদের এখানে জবে ঢুকিয়েছি। মেয়েটা বড় বেয়াদব আগে বুঝিনি। আপা ফোন করে জানাল ও নাকি ভাইয়ার সাথে লিভ ইন করছে এই দু’মাস ধরে। জানি আপনার শুনতে খুব খারাপ লাগছে! কিন্তু আমার খবরটা জানার সাথে সাথে মনে হলো আপনাকে জানানো জরুরি। তাই জানালাম।
– তুমি শিওর তো?
– হুম। আমি ওভার শিওর। হেলেন নিজে আপাকে বলেছে।
– ও আচ্ছা!
– কি ব্যাপার! আপনি এত নিরুত্তাপ?
– কী করব বলো? জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করার কী সামর্থ্য আমার? আমার অবস্থান তো জানোই। তুমি আমার জন্য একটা ফেভার করবে বোন? এতটা যখন আমার জন্য ভেবেছ তবে আম্মার কাছে একটু ব্যাপারটা জানাও। উনি তবে আব্বাকে বলে হেলেনকে চাকরি থেকে বাদ দেয়াতে পারবেন।
– আপনি ভেবেছেন আমি এখনো জানাইনি? জানিয়েছি।
– তাই! কী বললেন উনি?
– সে আপনার জানতে হবে না। কষ্ট পাবেন।
– দূর বোকা! আমি কষ্ট পাই না। এতদিনেও বোঝনি। বল তুমি।
– উনি বলেছেন, ভাইয়া নাকি যা করছে ঠিকই করছে। উনি আপনাকে নিয়ে কোনোদিনই সুখী না। বেকায়দায় পড়ে নাকি আপনাকে বিয়ে করে সেই ভুলের মাশুল সারাজীবন ধরে দিয়ে যাচ্ছে। আপনাদের ছেলে প্রিয়র জন্য না পারছে গিলতে না পারছে ফেলতে। তাই তার ছেলের দুর্বিষহ জীবনে হেলেন যদি একটু সুখ এনে দিতে পারে তাতে ক্ষতি কী?
মালিহার মুখে শাশুড়ির বয়ান শুনে আমার দম আটকে আসছে কান্নার দমকে। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, ঠিকই তো বলেছে সে। আমাকে নিয়ে তোমার ভাইয়া হয়ত আসলেই সুখী না। তা তুমি তারপরও আমাকে জানালে কেন?
– কারণ, আমার কাছে ব্যাপার টা মোটেই ভালো লাগেনি। এই বয়সে এসব ভাইয়ার মানায় না। প্রিয় জানলে কী হবে বুঝতে পারছেন? তাছাড়া আম্মা কী করে এটাতে সাপোর্ট দিচ্ছে বুঝলাম না। এত নামাজ রোজা করেন, দুই দুইবার হজ করে আসছেন। অথচ ছেলে ভুল পথে হাঁটছে সেটাতে বাহবা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমি উচিত কথা বলি, ভাবি। আজ উনি বড় ছেলেকে বাহবা দিচ্ছেন কাল ছোট ছেলেকেও দিবেন। আর আপনার দেবর কেমন তা তো জানেনই। ভাইয়ার মতো মানুষ যদি এসব করে বেড়াতে পারে তবে আর সজলের কী ভরসা? বড় ভাইয়ের দেখাদেখি সেও হেলেনের মতো একটার জায়গা দশটা রক্ষিতা নিয়ে ঘুরবে। তবে আমি আপনার মতো এত ভালো মানুষ না। একদম সাইজ করে দিব। আপনিও চুপ থাকবেন না, প্লিজ। নিজের অধিকার নিজেরই আদায় করতে হবে। আপনি ভ্যান্দার মতো চুপচাপ থাকলে সবাই এভাবেই আপনাকে ঠকাতে থাকবে। আপনার সাথে আমার যোগাযোগ না থাকলেও মাঝেমাঝে আপনার কথা নিয়ে আমার বোনের সাথে আলোচনা করি। খুব খারাপ লাগে। আপনি শক্ত হোন, ভাবি।
আচ্ছা, সজল আসছে। ফোন রাখছি, ভাবি। ভালো থাকবেন।
আমি কোনোরকম করে কান্না লুকিয়ে বললাম, তুমিও।
চলবে…….
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/337738498008826/