#Journey
#১৮
জেসমিন আনমনে লেপটপের সামনে বসে আছে।লেপটপ ওর কাজের অপেক্ষা করতে করতে স্ক্রিন সেভার চলে এসেছিল,সেই স্ক্রিন সেভারও চলে গেছে,এখন স্ক্রিন অন্ধকার।তবুও জেসমিন নির্বাক,আনমনে চেয়ার হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে তাকিয়ে তাকিয়ে আকাশ দেখছে।আকাশে কয়েক টুকরো মেঘ ছেড়া তুলোর ন্যায় ছন্নছাড়া ভাবে ভাসছে,ভাসছে জেসমিনের স্মৃতিগুলোও মনের আকাশে,ঠিক এই মেঘ গুলোর মত। মনে পড়ে যাচ্ছে গত এক মাসের কথা…
রাইফের প্রতি গোপন একটা অনুভূতি ভার্সিটি জীবন থেকেই মনের গহীনে পুষে রেখেছিল একটি অস্ফুটিত ফুলের কলির মত,যা গত এক মাসে পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হয়ে ডালপালা মেলে এক বিরাট গাছ হয়ে গিয়েছে,শেকড়ের মত আত্মার একেবারে গহীনে তার ছোট ছোট শিরা উপশিরা ছড়িয়ে দিয়েছে,আস্বাদন করছে ওর সব খারাপ অনুভূতিগুলোকে,আর তা দিয়ে গাছ ভরে ফুল ফুটছে।কিছু ডাল ফুলের ভারে নুইয়ে পড়ছে, তবুও ফুটছে,আর পুরো গাছটাই ওর আত্মার সম্পূর্ণটা দখল করে ফেলেছে।
কিন্তু রাইফটা এসব কিছুই জানে না,টেরও পায়নি নিশ্চিত।জেসমিনের ভেতরের অনুভূতিগুলো যে প্রতিরাতের প্রতিটা শব্দের আঘাতে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে,তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না,হতে হয় না প্রযুক্তি গবেষেক,কিংবা কোন কোম্পানীর এডমিন,অথবা মনসতত্ববিদ।এটুকু বুঝতে হলে দরকার গভীর চোখ যাতে ধরা পড়বে প্রতিটা কর্ম,চোখেমুখে ভালোবাসার প্রতিফলন।দরকার অতি প্রখর শ্রবণশক্তি সম্পন্ন কান যাতে ধরা পড়বে প্রতিটা উচ্চারিত শব্দের ভাঁজ।দরকার একটা স্নায়ুতন্ত্রে ভরপুর হাত যা এক স্পর্শেই বুঝে যাবে শরীরের প্রতিটি ভাঁজ,তার বেড়ে ওঠা কিংবা বুঁজে যাওয়া,নতুন করে জেগে ওঠা প্রতিটি শিহরণ, আর সে শিহরণে শিহরিত হবে সেই হাতের মালিক।দরকার ধারণার চাইতেও তীক্ষ্ণ একটা মন যা বুঝতে পারবে প্রিয় মানুষের সবটুকু!
সেরকম ইন্দ্রিয় রাইফের আছে কিনা জেসমিনের জানা নেই,আর গত তিনদিন ধরে তো এ নিয়ে রীতিমতো সন্দেহ হচ্ছে।কারণ ওর ভেতরে গজিয়ে ওঠে অনুভূতির গাছে ডাল ধরে রাইফ রীতিমতো ঝাঁকা ঝাঁকি শুরু করে দিয়েছে যাতে সব ফুল ঝরে যাবার মত অবস্থা।জেসমিন চাচ্ছিল না এই গাছে কোন কলংক লাগুক,কিংবা কোন ক্ষতি হোক,কিন্তু রাইফ তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না।কয়েকদিন ধরে হুটহাট করে সেই প্রসঙ্গ টেনে আনছে যা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা জেসমিন প্রতিদিন করছে। এক প্রকার বাধ্য হয়েই রাগ করে যোগাযোগ বন্ধ করেছে।
কিন্তু তাতে লাভ হবে কি? যে মুহুর্ত থেকে ফোন বন্ধ করেছে,সে মুহূর্ত থেকেই চোখের পানি বাঁধ মানছে না।রাইফের কন্ঠ না শুনে আজকাল ঘুম আসে না।ঘুমুতে যেয়েও মনে হয় আজ কি যেন ওকে অপূর্ণ করে রেখেছে।বারবার রাইফের কথা মনে পড়ে,কিছুতেই ওকে মাথা থেকে বের করা জেসমিনের এখনও মনে আছে রুবায়েতের কথা।এই ছেলেকেও ভালোবেসেছিল,কিন্তু রাইফের আত্মার মত রুবায়েতের ভেতর ডুবে যেতে পারি নি,কারণ তত গভীরতা ওর আত্মায় নেই।রাইফের ভেতর জেসমিন যতটা ডুবে গিয়েছে,এরকম আর কখনও হয়নি।এটাই কি অসীম ভালোবাসা? এটাকে কি বলে,সীমাহীন মুগ্ধতা? নাকি আত্মার সংযোগ? জেসমিন জানে না।
সত্যি বলতে খুব ভয় পাচ্ছে রাইফের সাথে আবার কথা বলতে।যদিও রাইফ সরি বলেছে,আর বলবে না বলেছে,কিন্তু তবুও এই কথা আসবেই।আজ হোক,কাল হোক,এ নিয়ে দুজনের মাঝে কথা হবেই,রাইফ অভিমান করবেই।হয়ত বলবে, তুমি আমাকে কাছের মানুষ ভাবো না,ভাবলে লুকাতে না।কিন্তু ওকে কিভাবে বলবে নিজের পেছনে ফেলে আসা নোংরা অতীত? কিভাবে বলবে আজকের জেসমিনের নব জন্মের গল্প যাতে মিশে আছে হাজারো মুহূর্তের অশ্রাব্য বেদনা,যন্ত্রণা। সেই বেদনা দায়ক সময়টা রাইফ সামনে আনবেই,শুধু সময়ের ব্যাপার।কিন্তু রাইফ কি ভাববে? নিশ্চিত ঘৃণা করবে,অপছন্দ করবে,তার প্রতি বিরূপ ভাব তৈরি হবে মনে।সেই বিরূপ ভাব নিয়ে নতুন কোন জীবন শুরু হবে?? অসম্ভব!!
শুধু মাত্র একারণে জেসমিন ওকে এড়িয়ে চলছে।হাত পা নিশপিশ করছে,তবু কল রিসিভ করছে না,টেক্সটের রিপ্লাই দিচ্ছে না,মেসেজ সীন করছে না।
রাইফ যেহেতু অধ্যাবসায়ী,তাই এত এড়িয়ে চলার পরও সে কল করা,মেসেজ দেয়া,কোন কিছু বাদ দেয়নি।জেসমিনের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়,এর শেষ কোথায়? আজকাল কাজগুলোও ঠিকঠাক ভাবে হচ্ছে না।স্যার তিনটা এসাইনমেন্ট ধরিয়ে দিয়েছে যার মাঝে মাত্র একটা শেষ হয়েছে,তাও স্যার সন্তুষ্ট হতে পারেন নি।জেসমিন লেপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকায়,কাজে মনোযোগ দেয়ার বৃথা চেষ্টা করে।
কয়েক ঘন্টা পর বাইরে বেশ হৈচৈ শোনা যায়।কিছু একটা হচ্ছে বাইরে।জেসমিনের রুম থেকে বাহিরের মাঠটা দেখা যায়।জানালা দিয়ে সেখানে উঁকি দেয়।কি নিয়ে যেন সবাই মাতামাতি করছে।কি নিয়ে করছে?জানালা থেকে উঁকি দিয়ে জেসমিন দেখার চেষ্টা করে।কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ঘড়িতে এখন দুটো বাজে।এই ভর দুপুরে এখানে আবার কি হল?
বিরক্ত হয়ে উঠে আসে চেয়ার থেকে।এক কাপ কফি খাওয়া দরকার,মাথাটা হ্যাং হয়ে আছে।ক্যাফেটেরিয়াতে হেঁটে যাবার সময় দেখছে অনেকেই ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।কেউ আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে,আবার কেউ অন্যকে ডেকে ওকে দেখাচ্ছে।জেসমিনের ভীষণ আজিব লাগে,দ্রুত নিজের কাপড়ের দিকে তাকায়,কোথাও ছিড়ে ফেটে গেল নাকি?!দ্রুত খুঁজে দেখে,কই!কিচ্ছু নেই তো! পেছনে কিছু লেগে আছে? কোথায়! কিছুই নেই! আয়না বের করে মুখ দেখে,মুখেও তো কিছু লেগে নেই,সব স্বাভাবিক। তাহলে??!!
জেসমিন সাবধানে চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়াতে বসে।আশেপাশের মানুষ কি স্টক করছে?করছে তো! ঘটনা কি?কেউ ওকে এখানে চেনেই না,আর আজ এমন ঘুরে ঘুরে দেখছে কেন! সামনে কাউন্টারে গিয়ে খাবার কালেক্ট করে।ছেলেটা যদিও অন্যদের মত ওর দিকে তাকাচ্ছে না,হাসছে না,তবুও ওর মনে হচ্ছে ছেলেটাও মুচকি হাসছে! খাবার নিয়ে মাথা নিচু করে কোনোমতে খাওয়া শেষ করে এক দৌড়ে পালায়।পালাতে পালাতে ভাবে,আজ ছুটি নিতেই হবে!
প্রফেসরের রুমে যায় জেসমিন,সেখানে গিয়ে ছুটির আবদার করে।
“এই অসময়ে কেন যেতে চাচ্ছো?”
“স্যার একটু সমস্যা হয়েছে”
“তা তো বুঝতেই পারছি,কারণ তুমি একজন সিন্সিয়ার মানুষ।আচ্ছা,তুমি কি কোন কারণে ডিস্টার্বড?”
“কেন স্যার?এই প্রশ্ন কেন করলেন?”
“কারণ কিছু দিন ধরে তোমার কাছ থেকে আমি আশানুরূপ রেসপন্স পাচ্ছি না।সবসময় উদাসীন থাক।তিনটে এসাইনমেন্ট দিয়েছি,তার মাঝে মাত্র একটা শেষ করেছ,তাও আবার ভুলে ভরা।আমাকে তো স্টুডেন্টদের এসব সাপ্লাই দিতে হবে,এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে!প্রতিটা মিনিট আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ,সময় একেবারেই নষ্ট করা যাবে না! তুমি তো কখনও এমন করনি,তাই জিজ্ঞাসা করছি…কিছু নিয়ে ডিস্টার্বড তুমি?”
জেসমিন মাথা নিচু করে পা দিয়ে মাটিতে সার্কেল আঁকছে।প্রফেসরের শব্দগুলো কান দিয়ে ঢুকেছে,কিন্তু মগজে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।কি উত্তর দিবে উনাকে?কোনোমতে ছুটি ম্যানেজ করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে।রিফ্রেশমেন্ট দরকার খুব!
বাইরে এসে বিল্ডিং থেকে বেরুতে খেয়াল করে ভার্সিটির মাঠের সেই ভীড়টা।এগুবে নাকি এগুবে না,সেটা ভাবে কয়েকবার,শেষ পর্যন্ত এগিয়েই যায়।ভীড় ঠেলে যখন সেখানে ভীড়ের কারণ দেখে,
তখন জেসমিনের চক্ষু চড়ক গাছ!!!
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria