#Journey
#২
জাফারের চেহারায় কেমন একটা মলিন ভাব চলে এসেছে,সে ছেলে সেলিমের হাত ধরে হাতে চুমু খাচ্ছে,ওর কপালে চুমু খাচ্ছে।জেসমিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,কি সুন্দর দৃশ্য! বাবা আর ছেলের বন্ধনটা বুঝি এমনই হয়!খারাপ লাগছে ওর স্ত্রীর কথা মনে করিয়ে মন খারাপ করে দিয়েছে বলে।প্রসঙ্গ পাল্টাতে জাফারকে জিজ্ঞাসা করে,
“আচ্ছা,কত বছর ধরে এখানে আছেন আপনি?”
“এইত,১৭ বছর হবে”
“তাহলে আপনার বয়স…?”
“Can you guess?”
“Opps,I’m a bad guesser!”
“হা হা হা,আমার ৩৫ বছর বয়স”
“বাহ,such a young age”
“Umm,not that much,nowadays, people don’t live so long!”
“So true!আচ্ছা,আপনার শৈশব কোথায় কাটল?বাংলাদেশে?নাকি পাকিস্তানে?”
“আমার জন্ম পাকিস্তানে,বড় হয়েছিও সেখানেই।বাংলাদেশের কথা শুধু মায়ের মুখে শুনতাম।খুব ইচ্ছে ছিল মায়ের দেশ দেখার,তবে আজও সুযোগ হয়নি”
“তাহলে আপনার মা বাবার কিভাবে বিয়ে হল? আপনার মা কি পাকিস্তানে থাকতেন?”
“হুম,যুদ্ধের আগেই আমার নানা পাকিস্তানে থাকতেন,ওখানে তিনি চাকরি করতেন।যুদ্ধের পর দেশে ফেরাটা খুব কঠিন হয়ে যায়,তাই পাকিস্তানেই তারা থেকে যান”
“হুম,এরপর উনাদের পরিচয় হয়, নাকি?”
“হুম,মাকে বাবা একটা পার্কে বসে থাকতে দেখেছিলেন।বলে না, love at first sight”? বাবার ঠিক তাই হল। মাকে প্রস্তাব দিলেন,মা কিছুতেই রাজী হন নি।পরে বাবা দাদা দাদীকে নিয়ে একেবারে আমার নানার কাছে হাজীর।নানা বাবাকে পছন্দ করেলেন,আর বিয়ে দিয়ে দিলেন!”
“বাহ,ইন্টারেস্টিং ঘটনা!”
“হুম,বাবা আর মায়ের মাঝে অনেক ভালোবাসা ছিল,বুঝ হবার পর থেকেই দেখেছি।এখনও তারা একজন আরেকজনকে ছাড়া খেতে বসেন না!”
“ওয়াও!আচ্ছা,পাকিস্তানিরা কেমন হয়?অনেক ফ্রেন্ডলি,নাকি খারাপ?আমরা তো ঐ দেশের মানুষকে শুধু অত্যাচারী হিসেবেই জানি,পছন্দও করি না।সরি,মাইন্ড করবেন না প্লিজ আমার কথায়!অবশ্য এই দেশে এসে আমার এই ধারণা বদলে গেছে।আমার বন্ধু আছে দু তিনজন পাকিস্তানি ”
“নাহ,মাইন্ড করার কি আছে?যুদ্ধের কারণে আমরা তো এত খারাপ জিনিস দেখিনি যা আপনারা দেখেছেন।আমাদের সরকার,আমাদের মিলিটারী আপনাদের উপর অত্যাচার করেছে,ভাল লাগারও কথা না।তবে আমরা সবাই কিন্তু এক না! আমাদের মাঝেও ভাল আছে খারাপ আছে,খুনী আছে,উদার মনের মানুষ আছে।বাঙালীদের সাথে আমাদের খুব পার্থক্য নেই,এশিয়ানদের মাঝে বাঙালী,ইন্ডিয়ান আর পাকিস্তানিদের মাঝে অনেক মিল”
“হুম,আমারো তাই মনে হয়। যুদ্ধ যারা করে,তারা সবাই তো খারাপ হয় না।যাক বাদ দিন,আমার কিন্তু আপনাকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই,নো অফেন্স,ওকে?”
“হা হা হা,হুম,আমি কিন্তু বাঙালীও!আমার শরীরের বাঙালী মায়ের রক্ত,আমাকে নিয়ে কি ইস্যু থাকবে বলেন!”
“তাও কথা!বাদ দিন এত ভারী ভারী বিষয়।… আচ্ছা,আমি কি সেলিমকে একটু আদর করতে পারি?”
“আহ!সেটা জিজ্ঞাসা করার কি আছে?…সেলিম?আন্টির কাছে যাও তো”
জেসমিন হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে কাছে টেনে নেয়,ইশ,কি মায়াবী! কাছে আসার পর ওর চোখ গুলো দেখতে আরো সুন্দর লাগছে,বড় বড় পিঙ্গল রঙের চোখ জোড়া,কি মায়া ওখানে মেশানো!জেসমিন ওর গাল গুলো আলতো করে ধরে, যেন জোরে চাপ দিলেই গাল খুলে পড়ে যাবে।হেসে ওর গালে চুমু খায়।সেলিম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গাল মুছে ফেলে।তাই দেখে জেসমিন আর জাফার দুজনেই হেসে ফেলে।জাফার বলে,
“ও সবার কাছেই যায়,কিন্তু কারো চুমু খাওয়াটা একদম পছন্দ করে না,এমনকি এই কাজটা আমার সাথেও করে!”
“আহা,আমি জানতাম না,সরি বাবা”
সেলিম ঠোঁট দুটোকে এক করে চোখা করে রাখে।জেসমিন জাফারকে জিজ্ঞাসা করে,
“ও ওর মায়ের চোখ পেয়েছে,তাই না?”
“হুম,একেবারে।আমার তেমন কিছু পায়নি চুল ছাড়া”
“উহু,আপনার নাকটা পেয়েছে,একদম এক!”
জাফার হাসেন।জেসমিন আবার প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা,আপনার স্ত্রীর নাম কি?”
“লিলিয়ানা সারজিও”
“ওয়াও,লিলিয়ানা!নামটা সুন্দর তো। এর মানে কি?”
“লিলি,শাপলা,শাপলার দাশ”
“Wow,cute name I must say. উনি তো মুসলিম ছিলেন না,ছিলেন কি?”
“ও কনভার্টেড মুসলিম ছিল,আমার সাথে পরিচয়ের পর ইসলামের দিকে এগিয়ে আসে।খুবই ভাল একটা মানুষ ছিল!”
“আপনাদের পরিচয় কিভাবে হয়?”
“ও একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করত,ওয়েইটার ছিল।আমার কলেজের পাশে হওয়ায় সেখানে প্রায়ই দেখতাম ওকে।ভাল লাগত।একদিন ওকে এক লোক খুব বাজে ভাবে বকছিল,রাস্তার কুকুর জাতীয় মানুষ এরা।আমি উঠে গিয়ে প্রতিবাদ করি।যদিও বিনিময়ে আমাকে ঘুসি খেতে হয়,তবে আমার আর লিলিয়ানার খুব ভাল একটা সম্পর্ক হয়ে যায়।সেখান থেকেই ধীরে ধীরে প্রেম হয়।অবশ্য ওকে পারতাম খ্রিস্টান অবস্থাতেই বিয়ে করতে,কিন্তু আমি জানি, এটা ঠিক না।আমি আমার স্রষ্টার অনেক অমান্য করি,কিন্তু এত বড় ব্যাপারে অমান্য কি করে করি?তাছাড়া হোক ধর্ম আলাদা,কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যে একজনই,এ ব্যাপারে তো কারো দ্বিমত নেই!আমি আর যাই হোক,স্রষ্টার বিরুদ্ধে যেয়ে ওকে স্ত্রী হিসেবে নিতে পারব না!
ওকে একথা জানাতেই খুব ভেঙে পড়েছিল।আমি ধীরে ধীরে বুঝালাম ওকে। একটু একটু করে ইসলামকে জানতে জানতে ও বুঝতে পারল আমাকে,আমার কাজ কর্ম।আমি যদিও এই দেশে আছি,তবু আমি নামায রোযা ছাড়িনি।লিলিয়ানা আমার এসব খুব পছন্দ করত।আমি যখন জুম্মার মসজিদে যেতাম,ও বাইরে দাঁড়িয়ে দেখত,আমার মত নামায পড়ার চেষ্টা করত,রুকু,সিজদা করত।আমি খুব মজা পেতাম,তবে বুঝাতাম,ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেন এসব না করে।ওর পরিবার আছে,আমার জন্যে ধর্ম বদলে যেন বিপদে না পড়ে।ও বলত,ওর বড় বোন নাকি মুসলমান হয়ে গেছে,লিলিয়ানাও হবে। আস্তে আস্তে যখন দেখলাম মন থেকেই বদলাতে চায়,আমিও ওকে সাহায্য করলাম।কিছুদিন পর আমরা বিয়ে করলাম।আমার বন্ধুরা,ওর বন্ধুরা,ওর বড় বোন আর তার ইরানী স্বামী,অনেকেই ছিল।সেই দিনটার কথা আজও মনে আছে,প্রতিটা মুহূর্ত মনে আছে!ওকে আমি আদর করে লিলি ডাকতাম,আমার লিলি! ধর্ম বদলানোর সাথে সাথেই আমরা বিয়ে করি।তখন ওর নাম রাখি লিলি আমান,জাফার আমানের সাথে মিলিয়ে। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না,আমার কাছে মনে হয়, ও একটা হুরপরি! আল্লাহ আমার কাছে ওর মত একটা হুরপরিকে পাঠিয়েছে! বিয়ের পর থেকে আমি আরও বদলে গেছি,ও আমাকে কখনো নামায কাযাও করতে দিত না।বলত, “কতকাল নামায পড়িনি,এখন যফি তুমিও না পড়,আল্লাহকে কি বলবে? এমনিতেই সাওয়াবের দিক দিয়ে অনেকের পিছে পড়ে আছি!!” ওর কথা গুলো আমাকে ভীষণভাবে টানত,কি সুন্দর কথা!
ওর সাথে কাটানো প্রতিটা দিন,প্রতিটা রাত আমার জন্যে একটা স্বপ্ন! এত ভালো মনে হয় পৃথিবীর কেউ কাউকে বাসে নি যতটা আমরা একে অপরকে বেসেছিলাম! হয়ত এজন্যেই…এজন্যেই আল্লাহ ওকে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন,আর যাওয়ার আগে লিলি আমাকে দিয়ে গেছে ওর আর আমার রক্তে মিশ্রিত একটা কলিজার টুকরো,আমার সেলিম!”
বাবার আবেগঘন শব্দ চয়ন শুনে সেলিম উঠে বাবার কাছে চলে যায়,বাবাকে দুহাতে চেপে ধরে।সেলিমের চুলে মুখ গুঁজে জাফার চোখ বুঁজে।
একটু আগেই জাফারের মন খারাপ দেখে জেসমিন ঠিক করেছিল তার স্ত্রীর কথা আর বলবে না,সেটা মনে পড়তেই নিজেকে গালি দেয়।বিপত্নীক মানুষের পত্নীর কথা তুলবে না ভেবেও আবার তুলে ফেলেছে।ইশ,বেচারা।কি ভালোটাই না বাসত তার স্ত্রীকে,কি পবিত্র সে ভালোবাসা।অথচ সেটা ঠিক মত পাবার আগেই মানুষটা চলে গেল।একসাথে থাকে সন্তানদের মানুষ করা,ছোট ছোট খুনশুটি,কিছুই হল নাহ!ওর ভাবনার মাঝেই জাফার কিছুটা ধাতস্থ হয়।স্বাভাবিক হয়ে বলে,
“কিছু মনে করবেন না।আসলে ওর মাকে খুব ভালোবাসি তো, তাই মনে পড়লেই এমন আবেগী হয়ে যাই।আমার আবার এদিক থেকে আবেগ বেশি।আমার কথা বাদ দিন,আপনারটা বলুন।আপনি এখানে কেন এসেছেন?স্বামীর সাথে নাকি?”
“নাহ,আমি এখনও বিয়ে করিনি”
“তাহলে কি?চাকরি?”
“তাও না।পিএইচডি করতে এসেছি,সাথে ইতালি দেশটা ঘুরে দেখতে”
“বাহ,সুন্দর সিদ্ধান্ত।তা এখনও বিয়ে করেন নি কেন?বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি?…কিছু মনে করবেন না,এমনিই বলে ফেলেছি!”
” না না,ইটস ওকে!যদিও টিপিকাল এশিয়ান মানুষের মত প্রশ্ন হয়ে গেল,তবে আমি কিছু মনে করিনি।সত্যি বলতে বিয়ের জন্য ইচ্ছেই হয়নি কখনও”
“সে কি!এত বিদ্বেষ বিয়ের প্রতি!বিয়ে মানে কিন্তু অন্য একটা নতুন পৃথিবীর উন্মোচন! যে বিয়ে করল না,সে কিন্তু এই পৃথিবীর সন্ধান কখনও পাবেন না!”
জেসমিন মাথা নিচু করে নখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে।জাফারকে খুব বলতে ইচ্ছা করে অনেক কিছু,কিন্তু সবটাই গিলে ফেলে।জাফারের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,
“এখনও তেমন কাউকে পাইনি যাকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে!”
“ওহো!তাহলে তো একে ব্যাডলাক বলতেই হচ্ছে!”
“হুম”
“আচ্ছা,কেউ কি আপনাকে পছন্দও করেনি কখনও?বা আপনি কাউকে পছন্দ করেননি?”
“আপনার এই প্রশ্নের উত্তরটা জানি না আমি নিজেও।এই উত্তরের খোঁজেই আজ আমার এই যাত্রা!”
“মানে??”
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria